আমরা এমন একটা দেশে বাস করি, যে দেশটা ইতর আর শুওরে ভর্তি।
হাঁটতে চলতে এদের দেখা পাবেন, গায়ের সঙ্গে ধাক্কা খাবেন। প্রতিক্রিয়াশীলরা
বলে নব্বই পার্সেন্ট মুসলমানের দেশ, সরকার বলে শতভাগ দারিদ্র্যমুক্ত দেশ,
আমিও সেরকম বলি, নিরানব্বই পার্সেন্ট অমানুষ আর জানোয়ারে ভর্তি একটা দেশ
এটা। শুনতে চান কেন?
বাইরের দেশে ব্ল্যাক ফ্রাইডে নামে কেনাকাটার একটা স্পেশাল
অকেশন আছে, এই দিনে প্রচুর ছাড় দেয়া হয় অনেক পণ্যে। আর আমাদের দেশে প্রতিটা
শুক্রবারই ব্ল্যাক ফ্রাইডে, তবে অন্য অর্থে। শুক্রবারে বাজারে গেলে দামের
ঠেলায় আপনি চোখেমুখে অন্ধকার দেখবেন, সেটাই আমাদের ব্ল্যাক ফ্রাইডে।
রোজার মাসে বিশ্বের সব মুসমিলপ্রধান দেশে দেখবেন ব্যবসায়ীরা
চেষ্টা করে, যতটা পারা যায় সৎ থাকার। সারাবছর ব্যবসা করলেও, এই একটা মাসে
তারা কমবেশি ক্রেতাদের সেবা করার চিন্তাভাবনা করে; ভাবে, মানুষের উপকার
করতে পারলে টাকা কামানো না যাক, অন্তত কয়টা নেকি বেশি কামানো যাবে, সেটা
হয়তো পরকালে কাজে লাগবে। একই জিনিসটা খ্রিস্টানরা করে বছরের শেষে, বড়দিনের
সময়, ভারতেও দুর্গাপূজা আর দিওয়ালির সময় বিশাল বিশাল ছাড়ের অফার দেখি
অ্যামাজন/ফ্লিপকার্টে।
আর আমাদের দেশের ইতর বাটপার ব্যবসায়ীরা এই একটা মাসের
অপেক্ষায় থাকে। সারাবছর কাস্টোমারের হাত-পা কেটে রাখা এই জানোয়ারের দল
রোজার মাসে আল্লাহর নাম মুখে নিয়ে মানুষের গলা কাটার মিশনে নামে। ইফতার
আইটেম থেকে কাঁচাবাজার, যেখানেই যান, গলা আপনার কাটা যাবেই। ছোলাবুট থেকে
গরুর মাংস, চিনি থেকে তেল- রোজার সময় এমন একটা জিনিস পাবেন না যেটার দাম
আগের মাসের তুলনায় বাড়েনি।
বাজারে মুরগী কিনতে যাবেন, চোখের পলকে বাটপারের দল ঝুড়ির
ওজনসহ ঢুকিয়ে দেবে। দেড় কেজির মুরগীর সঙ্গে তিনশো গ্রামের ঝুড়ির ওজনটাও
দিয়ে আসতে হবে ফাও। রোজার শুরুতে গরুর মাংসের দর বাড়িয়ে চড়িয়ে বেঁধে দেয়া
হয় অনেক নাটক করে, সেটাও ব্যবসায়ীরা মানতে চায় না, দুই সপ্তাহের মাথায় তারা
ঘোষণা দেয়, সিটি করপোরেশনের নির্ধারিত দামে তারা মাংস বিক্রি করতে পারবে
না!
৩০০-৩৫০ টাকা যে গরুর মাংসের দাম থাকার কথা ছিল, ঈদের দুইদিন
আগে সেটা ৬০০/৭০০ টাকার নিচে পাওয়াই যায় না, এরমধ্যে আবার ২০০-২৫০ গ্রাম
হাড়-চর্বির যন্ত্রণা তো ফ্রি আছেই। একটু নির্ঝঞ্ঝাটে বাজার করতে সুপারশপে
যাবেন? তারাও ছুরিতে শাণ দিয়ে বসে আছে আপনাকে জবাই করার জন্যে।
মেয়াদোত্তীর্ণ মাছ মাংসে ফ্রিজ ভরিয়ে রেখেছে সবাই।
টাকা দিয়েও যদি জিনিসটা ভালো পাওয়া যেতো, তাহলেও হয়তো মেনে
নেয়া সম্ভব হতো। একটার পর একটা রেস্টুরেন্টে অভিযান চালানো হয়, আর আমরা
দেখি, রংচঙে যে খাবারগুলো আমাদের সামনে পরিবেশন করা হয়, সেগুলোর
প্রস্তুতপ্রণালী। হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী বাসী মাংস, ফাঙ্গাস পড়া ব্রেড
কিংবা নষ্ট হয়ে যাওয়া মেয়াদোত্তীর্ন জিনিসপত্র দিয়ে বানানো খাবারে কি
চমৎকারভাবেই না আমাদের আপ্যায়ন করা হয় রেস্টুরেন্টগুলোতে! মাঝারি মানের
রেস্টুরেন্টের কথা বাদই দিলাম, কেএফসি বা ডোমিনোসের মতো বিখ্যাত চেইন
শপগুলোও যখন এই ভেজালের মিছিলে নাম লেখায়, তখন আমাদের গা শিউরে ওঠে, বড্ড
অসহায় লাগে।
এক লাখ দুই লাখ জরিমানার বাহারী খবর শুনি, লাভ কি? দু’দিন
পরেই সব ভুলে আমরা উজবুকের দল ছুটে যাই সেই রেস্টুরেন্টগুলোতেই। এসব লাখ
টাকার জরিমানা পুষিয়ে নিতে দুইদিনও লাগে না এই হারামীদের, সেটা আমাদের
কারণেই। আমরা হাভাতের দল, এদের হাতে হররোজ বাঁশ না খেলে পেটের ভাত তো হজম
হয় না আমাদের।
ফলমূলে ফরমালিন দেয়া বন্ধ হয়েছে, কিন্ত আগুন দাম তো রোধ করা
যায়নি। এক কেজি মাল্টার দাম কি করে ২০০ টাকা হয়, সেটা আমার মাথায় কোনভাবেই
ঢোকে না। মাল্টা কবে থেকে বড়লোকের ফল হয়ে গেল? এই মাল্টা কি উগান্ডা থেকে
আমদানী করা? একশো লিচুর নাম করে ষাট-সত্তরটা গছিয়ে দেয়া হবে, অথচ দাম
তিনশোর কম রাখবে না কেউ। সারাবছর যে আপেল ১৩০-১৩৫ টাকায় ওঠানামা করে, রোজার
মাসে সেটাতে ১৬০-১৮০ টাকার কমে হাতই দেয়া যায় না।
বাসার মহিলারা নিজেদের একটু সুন্দর করে সাজানোর জন্যে ছোটে
পারসোনা, ফারজানা শাকিলস- এ। আমরা অবাক হয়ে দেখি, ভ্রাম্যমাণ আদালতের
অভিযানে বেরিয়ে আসে সেখানকার মেয়াদোত্তীর্ণ কসমেটিকসের সমাহার! তবুও আমাদের
বোনেরা, মেয়েরা চাঁদরাতে ছুটবে সেসব জায়গায়, ব্র্যান্ড বলে কথা! এসব
প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তারাই আবার যখন বিশেষ দিবসগুলোতে নারীশক্তি, নারীর
স্বাধীনতা, নারীর অর্থনৈতিক মুক্তির কথা বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলেন,
পত্রিকার বিশেষ সংখ্যার ফ্রন্ট পেজে হাসিমুখে সাক্ষাৎকার দেন, তখন আমার মুখ
থেকে অটোমেটিক গালাগাল বেরিয়ে আসে।
কয়েকদিন আগের কথা, ফার্মগেটের ইন্দিরা রোডে হঠাৎ অভিযান
চালালো ভ্রাম্যমান আদালত। হোটেলগুলোর রান্নাঘরের দুরবস্থা দেখে জরিমানা করা
হলো বেশ কয়েকটা হোটেলকে। শুওরের পাল তো দলে ভারী, তারা ইফতার বিক্রি বন্ধ
করে দিলো! মানে, আমার খুশি আমি ভেজাল দেবো, নোংরা খাবার খাওয়াবো, এটা আমার
মৌলিক অধিকার, কেউ সেখানে বাধা দিতে পারবে না!
সিলেটের কোথায় যেন দেখলাম, ভেজালবিরোধী অভিযান চালাতে আসা এক
ম্যাজিস্ট্রেটকে অবরুদ্ধ করে ফেলেছে বাজারের ব্যবসায়ীরা! পরে পুলিশ গিয়ে
উদ্ধার করেছে তাকে! এদের ক্ষমতা আন্দাজ করতে পারেন? বাংলাদেশে আসলে
ডাক্তারদের শুধুশুধু কসাই বলা হয়, আসল কসাই হচ্ছে ব্যবসায়ীরা।
এই দেশে ভেজাল খাবার রাখার দায়ে হোটেলকে জরিমানা করলে এরা
সবাই মিলে খাবার বিক্রি বন্ধ করে দেবে। মেয়াদোত্তীর্ণ ঔষধ রাখার দায়ে
ফার্মেসীকে জরিমানা করলে সবগুলো ফার্মেসী মিলে ঔষধ বিক্রি বন্ধ করে দেবে।
চালকের অসাবধানতায় দুর্ঘটনা ঘটে যাত্রী বা পথচারীর প্রাণ গেছে? ড্রাইভারকে
গ্রেফতার করেই দেখুন, পরিবহণ ধর্মঘট শুরু হয়ে যাবে এক ঘন্টার মধ্যে!
এই দেশের প্রত্যেকটা মানুষ সুবিধাবাদী, আই রিপিট প্রত্যেকটা
মানুষ। রাস্তায় বৃষ্টির একটা ফোঁটা পড়ে সারতে পারে না, দুইশো টাকার সিএনজি
ভাড়া এক লাফে পাঁচশো টাকা হয়ে যায়। পঞ্চাশ টাকার রিক্সাভাড়ার দূরত্বে কেউ
একশো টাকার নিচে যেতে চায় না। যে ধান কৃষক ১২/১৩ টাকা কেজি দরে বিক্রি করে
সিণ্ডিকেটের কাছে, সেটাই আমরা চাল হিসেবে ৫৫/৬০ টাকায় কিনে খাই। বগুড়ার
কৃষক আলুর ন্যায্য দাম না পেয়ে রাস্তায় আলু ফেলে প্রতিবাদ জানায়, অথচ আমরা
বছরের কোন ঋতুতেই ১৮-২০-২৫ টাকার কমে আলু পাই না।
আড়ঙ-কে জরিমানা করায় গতকাল ভোক্তা অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তাকে
কয়েক ঘন্টার মধ্যে খুলনায় বদলি করা হয়েছে! মৌমাছির চাকে ঢিল ছুঁড়ে বসেছেন
মঞ্জুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার নামের সেই ভদ্রলোক, রেহাই কি আর আছে? এক সপ্তাহ
আগে যে পাঞ্জাবী ৭০০ টাকায় বিক্রি করা হয়েছে, সেটাই আজ ১৩০০ টাকার
প্রাইসট্যাগ লাগিয়ে বিক্রি করা হচ্ছিল আড়ঙে। অভিযোগ পেয়ে সেখানে অভিযান
চালিয়েছে ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তর, জরিমানা করেছে।
আর তার ঘন্টাকয়েক বাদেই চলে এসেছে বদলির ফরমান! অথচ আড়ং কিন্ত
স্বীকার করেই নিয়েছে যে, প্রাইস ট্যাগ সংক্রান্ত ভুলটা তাদের তরফ থেকে
হয়েছে। অথচ মাশুল গুণতে হচ্ছে সেই সরকারী কর্মকর্তাকে। কারণ তার ওপরওয়ালারা
অসন্তুষ্ট হয়েছেন তার ওপর! বাক্সপেটরা গুছিয়ে এখন চলে যাও খুলনা, ঢাকায়
তোমার আর থাকা হচ্ছে না বাপু! বিলাসপণ্যের দাম নির্ধারণের আইনটা কিরকম সেটা
জানি না, ভোক্তা অধিকারে এই মামলা খাটে কিনা সেটা বিশেষজ্ঞরা বলতে পারবেন।
কিন্ত এই আচমকা বদলির আদেশটা যে ন্যায়সঙ্গত কিছু নয়, সেটা তো পাগলেরও
বোঝার কথা।
যেটা বলছিলাম আগে, রোজার মাসে এসব ভণ্ডামি করা মানুষগুলো
কিন্ত প্রায় সবাই মুসলমান। এদের বেশিরভাগই রোজা রাখে, নামাজ পড়ে, কয়েক বছর
পরপর হজ আর ওমরাহও করে। এরা জাকাত দেয়, মসজিদে হাজার হাজার টাকা দান করে,
এতিমখানায় টাকা দেয়। এগুলো তারা কেন করে জানেন? পাপ মোচনের আশায়। দুনিয়ায়
এরা যেভাবে টাকা ঢেলে সবকিছু ম্যানেজ করে রেখেছে, সেভাবেই এরা খোদাকে ঘুষ
দেয়, ভাবে, খোদা বুঝি এসব পেয়ে খুশি হবেন, পুলসিরাতের রাস্তাটা কয়েক ফুট
চওড়া করে দেবেন এদের জন্যে! এরা স্রষ্টা আর ঘুষখোর আমলা বা রাজনীতিবিদদের
এক পাল্লায় মাপে!
এজন্যেই আমার সামনে যখন বাংলাদেশকে কেউ নব্বই পার্সেন্ট
মুসলমানের দেশ বলে, আমি একদলা থুথু মাটিতে ফেলে মনে মনে বলি, নিরানব্বই
পার্সেন্ট ইতর বাটপার অমানুষ জানোয়ারের দেশ এটা। এরা মানুষ হতে পারছে না,
মুসলমান হয়ে লাভ কি?
শুধুশুধু মুসলমানিত্বের নাম ভাঙিয়ে ইসলাম ধর্মটাকে
অপমান করার দরকার আছে কি?
লিখেছেন:
No comments:
Post a Comment