আমার শেষ ইচ্ছা, আমার মৃত্যুর পর কেউ যেন না কাঁদে, আমি চাই আমার শবদেহের পাশে সবাই যেন আমাকে গান শোনায়।একুশে পদকপ্রাপ্ত বরেণ্য সংগীতশিল্পী সুবীর নন্দী টেলিভিশন চ্যানেলে ফাহমিদা নবীর সাথে এক আলাপচারিতায় তার এই ইচ্ছার কথা জানিয়েছিলেন। কিন্তু গত ৭ই মে ভোরের আলো ফোটার সময় যখন তার মৃত্যু সংবাদ গায়কের পরিবার-শুভাকাঙ্ক্ষী-সহকর্মী-ভক্তদের কানে এসেছিল, তখন নিশ্চয়ই তাদের মন কেঁদে উঠেছিল। হয়তোবা কেউ কেউ শুনতে বসে গিয়েছিলেন সুবীর নন্দীর কণ্ঠের প্রিয় কোনো গান।
সুবীর নন্দী আধুনিক বাংলা গানের এক কিংবদন্তী শিল্পী, সুরের রাজকুমার। দীর্ঘ চার দশকের ক্যারিয়ারে তিনি গেয়েছেন প্রায় আড়াই হাজারেরও বেশি গান। আধুনিক বাংলা গানের জাগরণ পর্ব বলা হয় গত শতকের ষাটের দশককে। স্বাভাবিকভাবেই তখন আমাদের দেশে ছিল ভারতীয় বাংলা আধুনিক গানের শিল্পীদের বিস্তর প্রভাব। ঠিক সেই সময়ে আবির্ভাব ঘটে সুবীর নন্দীর মতো কয়েকজন গুণী শিল্পীর যারা যাবতীয় প্রভাব থেকে মুক্ত থেকে নিজেদের সংগীত প্রতিভা ও সাধনাকে কাজে লাগিয়ে সূচনা করেছিলেন বাংলাদেশের আধুনিক বাংলা গানের নতুন এক অধ্যায়ের।
সুবীর নন্দী জন্মেছিলেন ১৯৫৩ সালের ১৯ নভেম্বর হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচং থানার নন্দীপাড়ায়। তার বাবা ডাক্তার সুধাংশু নন্দী ছিলেন সংগীতপ্রেমী আর মা পুতুল রানীও বাড়িতে ঘরোয়াভাবে গান গাইতেন। তাই ছোটবেলা থেকেই সুবীর নন্দী পারিবারিকভাবেই গানবাজনার মধ্য দিয়ে বড় হয়েছেন। বাবার চাকরি সূত্রে নন্দীর শৈশব কেটেছে চা বাগান এলাকাতে। পড়েছেন সেই চা-বাগান এলাকারই খ্রিষ্টান মিশনারীর একটা স্কুলে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গণ্ডি পার করার পর পড়াশোনার জন্য চলে যান হবিগঞ্জ শহরে। সেখানে ভর্তি হন হবিগঞ্জ সরকারি হাইস্কুলে, তারপর পড়েছেন হবিগঞ্জের বৃন্দাবন সরকারি কলেজে।
সুরের ভুবনে তার পথচলা শুরু হয়েছিল ১৯৬৩ সালে। তখন তিনি মাত্র তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র। মায়ের কাছে প্রথম গান শেখা শুরু হলেও শাস্ত্রীয় সংগীতে তার গুরু ওস্তাদ বাবর আলী খান। তবে তিনি লোকগানে তালিম নিয়েছেন বিদিত লাল দাসের কাছে। কিশোর বয়সেই তিনি সিলেট বেতারের তালিকাভুক্ত শিল্পী হয়ে যান, সেখানে প্রথম গান গেয়েছিলেন ১৯৬৭ সালে। প্রথমে শুধুমাত্র সিলেটের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও ১৯৭২ সাল থেকে তার ঢাকায় আসা-যাওয়া শুরু হয়। প্রথমদিকে নজরুলগীতি নিয়ে মনোযোগী হলেও অল্প কিছুদিনের মধ্যেই ঝুঁকে পড়েন বাংলা আধুনিক গানের দিকে।
বাংলাদেশ বেতারে (তৎকালীন রেডিও বাংলাদেশ) তার গাওয়া প্রথম গান ছিল ‘যদি কেউ ধূপ জ্বেলে দেয়’। গানটির সুরকার মীর কাশেম তাকে বেতারে গান গাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। বিশেষকরে যখন ১৯৭৬ সালে রাজা হোসেন-সুজয় শ্যামের সুরে আব্দুস সামাদের ‘সূর্যগ্রহণ’ চলচ্চিত্রে প্লে-ব্যাক করার সুযোগ পেলেন। সেই সিনেমায় গাওয়া লোকগান ‘দোষী হইলাম আমি দয়াল রে’ গানটি তুমুল জনপ্রিয় হয়েছিল।
একক কিংবা দ্বৈত, সব ধরনের গানেই নন্দী বাবু ছিলেন সাবলীল। সাবিনা ইয়াসমীনের সাথে তার জুটি ছিল এক কথায় অনবদ্য। সাবিনা ইয়াসমীনের সাথে প্রথম প্লেব্যাক ছিল ‘অশিক্ষিত’ সিনেমায়, একেবারে ক্যারিয়ারের শুরুতে। সেই সিনেমায় সত্য সাহার সুরে ও গাজী মাজহারুল আনোয়ারের লেখা ‘মাস্টার সাব, আমি নাম-দস্তখত শিখতে চাই’ গানটি সিনেমপ্রেমী সবার মুখেমুখে প্রচলিত ছিল। রুনা লায়লার সাথেও তিনি অনেকগুলো গান করেছেন। বিশেষ করে তখনকার সময়ের প্রতিটি সাহিত্য নির্ভর সিনেমাতে সুবীর নন্দীর গান থাকবেই। ‘দেবদাস’, ‘শুভদা’, ‘চন্দ্রনাথ’, ‘বিরাজ বৌ’ সিনেমাতে তার দরদমাখা কণ্ঠের জাদুতে সবাই মুদ্ধ হয়েছে।
সংগীত যে একটা গভীর সাধনার ব্যাপার সেটা সুবীর নন্দীর মতো শিল্পীদের দেখলে বোঝা যায়। গানের পাশাপাশি তিনি ব্যাংকেও চাকরী করতেন, কিন্তু গানের সাধনায় তিনি কখনো কমতি রাখননি। প্রথমদিকে গান করার সময় জর্দা দিয়ে অনবরত পান খাওয়ার অভ্যাসের কারণে কিছু শব্দের উচ্চারণ নিয়ে সমস্যায় পড়তেন। একদিন প্রখ্যাত সুরকার সত্য সাহার সামনে বসে তিনি গান গাইছিলেন। কিন্তু একটা শব্দের উচ্চারণ ঠিকঠাক কোনোভাবেই হচ্ছিল না। সত্য সাহা তাকে বললেন, "হবে কীভাবে? সারা দিন মুখে পান দিয়ে রাখলে উচ্চারণ বের হবে?" তারপর থেকে নাকি আর কখনো তার মুখে পান দেখা যায়নি।
তার শৈশব-কৈশোর কেটেছে আধুনিক বাংলা গানের জোয়ারের মধ্যে। তাই স্বাভাবিকভাবেই উপমহাদেশের প্রখ্যাত কণ্ঠশিল্পী পঙ্কজ মল্লিক, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, মান্না দে, জগজিৎ সিং-দের ভক্ত ছিলেন তিনি। এদের গান শিল্পী হওয়ার ক্ষেত্রে সুবীর নন্দীকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে, প্রভাবিত করেছে।
অগ্রজ সংগীতজ্ঞদের অনেকে নতুন দিনের কালচার ব্যান্ড সংগীতকে অপসংস্কৃতির অংশ হিসেবে আখ্যা দিয়ে এসেছিলেন। তাদের কারোর মতে পপ কিংবা ব্যান্ড সংগীত নাকি বাংলা গানের জন্য হুমকিস্বরূপ। এক সাক্ষাৎকারে সুবীর নন্দীকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি উত্তর দেন,
আমি বিশ্বাস করি, সংগীত সবটাই সংগীত। সংগীতে ‘অপ’ বলতে কিছু নেই। আমাদের দেশে অনেক পণ্ডিতশ্রেণির সমালোচক পপ সংগীত কিংবা ব্যান্ড সংগীতকে নাক সিটকান। এটা আমাকে খুব ব্যথিত করে। একটা জিনিসকে আমি জানলাম না ভালো করে, বলে ফেললাম জাত গেল, জাত গেল। এটা ঠিক নয়। কারণ, আমাদের পপ ও ব্যান্ডের আন্দোলন অনেক এগিয়ে গেছে।তার জনপ্রিয় কিছু গানের মাঝে আছে- আমার এ দুটি চোখ, হাজার মনের কাছে প্রশ্ন করে, বন্ধু হতে চেয়ে তোমার, বৃষ্টির কাছ থেকে, একটা ছিল সোনার কন্যা, চাঁদের কলঙ্ক আছে, ও আমার উড়াল পঙ্খী রে, দিন যায় কথা থাকে, হাজার মনের কাছে, কত যে তোমাকে বেসেছি ভালো, সেই দুটি চোখে, কেন ভালোবাসা হারিয়ে যায়, তোমারই পরশে জীবন, বন্ধু তোর বরাত নিয়া, মাস্টার সাব, আমি নাম-দস্তখত শিখতে চাই ইত্যাদি।
উল্লেখযোগ্য পুরস্কার ও সম্মাননার মাঝে আছে- একুশে পদক (২০১৯); জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (৫বার); সেরা পুরুষ কন্ঠশিল্পীঃ মহানায়ক (১৯৮৪), শুভদা ( ১৯৮৬), শ্রাবণ মেঘের দিন (১৯৯৯), মেঘের পরে মেঘ (২০০৪), মহুয়া সুন্দরী (২০১৫); বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি (বাচসাস) পুরস্কার; সেরা পুরুষ কন্ঠশিল্পীঃ ১৯৭৭, ১৯৮২, ১৯৮৫, ১৯৮৬; ১৩তম চ্যানেল আই সংগীত পুরস্কার (আজীবন সম্মাননা)।
গত ১৪ এপ্রিল পরিবারের সাথে শ্রীমঙ্গল থেকে ঢাকায় ফেরার পথে ট্রেনে অসুস্থ হয়ে পড়লে রাত ১১ টার দিকে তাকে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) ভর্তি করা হয়। দীর্ঘদিন ধরে তিনি ডায়াবেটিসে ভুগছিলেন। তাছাড়াও তার হার্টে বাইপাস অপারেশন করা হয়েছিল। আবার কিডনিতেও সমস্যা ছিল। টানা ১৬ দিন সেখানে চিকিৎসাধীন থাকার পর গত ৩০ এপ্রিল উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে সিঙ্গাপুরে নেওয়া হয়।
সিঙ্গাপুর নেওয়ার কয়েকদিন পর সুবীর নন্দীর শারীরিক অবস্থার কিছুটা উন্নতি হলেও তারপর থেকে ক্রমেই অবস্থার অবনতি হতে থাকে। সেখানে চিকিৎসা চলাকালেও তিনি পরপর তিনবার হৃদ্রোগে আক্রান্ত হন। শেষমেষ গত মঙ্গলবার (৭ মে) ভোর সাড়ে চারটার দিকে তিনি দৈহিকভাবে মৃত্যুবরণ করেন। দৈহিকভাবে তার মৃত্যু হলেও আত্মিকভাবে তিনি চিরকাল বেঁচে থাকবেন সঙ্গীতপ্রেমীদের মাঝে।
লেখক:গৌতম কে শুভ
No comments:
Post a Comment