Thursday, June 20, 2019

প্রাতিষ্ঠানিক বিবাহ ও নারীর শরীরের অধিকার

বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠানটি নারীর শরীরের ওপর কেবল একটি পু্রুষের মালিকানা নয় , পারিবারিক মালিকানা এনে দেয় । আমাদের মহাকাব্যগুলোর দিকে তাকালে এমনটাই দেখা যায় । প্রাচীনকালে কন্যারা স্বয়ংবরা হতেন , এই নিয়ে অনেককেই বেশ শ্লাঘা করতে দেখেছি , কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এইসব স্বয়ংবরের পেছনে থাকতো পৌরুষ দেখিয়ে নারীকে ""জয়"" করে নেবার কোনো না কোনো প্রতিযোগিতা !! তাকিয়ে দেখুন সীতার , তাকিয়ে দেখুন দ্রৌপদীর স্বয়ংবরের দিকে !! একটি নারীশরীরের মালিকানা পাবার জন্য শৌর্যবান সব পুরুষদের দ্বৈরথ !! প্রতিযোগিতা দ্বারা নারীকে জয় করে নেবার প্রদর্শনী , যা শুনলেই মেলার মাঠে লটারি বা জুয়া খেলার কথা মনে পড়ে । পণ্য সাজানো থাকবে, বিভিন্ন কসরত করে যিনি খেলায় জিতবেন , পণ্যটি তাঁর । আর্য ভারতের ইতিহাসে নারীর পণ্যায়ণের পত্তন এই প্রথাগুলোর হাত ধরেই । গুহাজীবন বা গোষ্ঠীজীবনে নারীর অধিকার ছিলো স্বাধীনভাবে সঙ্গী চয়ন করবার , কিন্তু আর্যসংস্কৃতির এই স্বয়ম্বর ইত্যাদি প্রথা মূলত নারীর আপাত চয়নের অধিকারের আড়ালে নারীর শরীরের অধিকার নিয়ে জুয়া খেলা । সেখানে লক্ষ্যভেদ বা শর্তপূরণ যিনি করবেন, নারীটি তাঁর ভোগ্যা হবেন , তাঁর নিজের সেই বীরপুরুষটিকে পছন্দ হোক বা না হোক । আর শর্তগুলোও ঠিক করে দিতেন কন্যার পিতারা , কন্যা নিজে নন ।

দ্রৌপদীকে "জয়" করে আনলেন অর্জুন , শাশুড়ির সিদ্ধান্তে তিনি হয়ে গেলেন পঞ্চভর্তারিকা , নিজের কোনো অধিকার ছিলোনা না বলার । মুহূর্তে তাঁর শরীরকে পাঁচ পুরুষের ভোগ্য করে দেয়া হলো , তাঁর অনুমতির বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা কেউ করলেন না , এমনকী অর্জুন‌ও নন !! কারণ বিজিত নারীর শরীর কেবল প্রভু পুরুষটির নয় , পরিবারের সম্পত্তি । জ্যেষ্ঠ স্বামী যুধিষ্ঠিরের সিদ্ধান্তে তিনি মুহূর্তের মধ্যে রাজেন্দ্রাণী থেকে পরিণত হলেন দাসীতে , পাশাখেলায় পণ বা বাজি রাখা হলো তাঁকে । একজন মানুষ আরেকজন মানুষকে বাজি রেখে জুয়া খেলতে পারে কারণ নারীটি তার বা তার পরিবারের সম্পত্তি !! কোনোমতেই একজন স্বাধীন মানুষ নন !! নারীর এর চেয়ে চরম অগৌরবের আর কী হতে পারে ?? অন্তঃপুর থেকে প্রকাশ্য রাজসভায় চূড়ান্ত অপমানের মুখোমুখি হতে হলো তাঁকে । নিজের কোনো মতামত ছিলোনা সেখানেও !!

এছাড়াও স্বয়ংবরে নারীকে হরণ করবার প্রথাও ছিলো । কাশীরাজকন্যা অম্বা , অম্বিকা, অম্বালিকা তিন বোনকে স্বয়ংবর থেকেই হরণ করে এনেছিলেন ভীষ্ম , বৈমাত্রেয় ভাই বিচিত্রবীর্যের বিবাহের জন্য । এই হরণ প্রথা বা রাক্ষসবিবাহ প্রথাও অগৌরবের ছিলোনা পুরুষের পক্ষে বরং গৌরবের ছিলো । বাহুবল দ্বারা নারীকে জয় করা , তা সে নারীর তাকে পছন্দ হোক বা না হোক, সমাজের চোখেও অপার গৌরবের‌ই ছিলো । কাশীরাজকন্যা অম্বা মহারাজ শাল্বের বাগদত্তা ছিলেন , ভীষ্ম দ্বারা অপহৃত হবার পর তিনি আগুন জ্বেলে আত্মহত্যা করেন ।

নারীর নিজের সিদ্ধান্তে অপর পুরুষের সন্তানের মা হ‌ওয়া সমাজসিদ্ধ না হলেও , স্বামী বা পরিবারের অনুমতিতে সেসব ঢালাওভাবে সমাজসিদ্ধ ছিলো । কুন্তী বিবাহের পূর্বে নিজের সিদ্ধান্তে কর্ণের জন্ম দিয়েও তাঁকে ভাসিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন , অথচ বিবাহের পর স্বামীর অনুমতিসাপেক্ষে যখন তিনজন ভিন্ন পুরুষের তিন সন্তানের মা হলেন , সেই পুত্রেরা পেলেন "বৈধ" রাজবংশগৌরব !! কাশীকন্যা অম্বিকা ও অম্বালিকাও ইচ্ছার সম্পূর্ণ বিরুদ্ধে বাধ্য হয়েছিলেন শাশুড়ি সত্যবতীর আদেশে ভাসুর ব্যাসদেবের অঙ্কশায়িনী হতে , বংশরক্ষার তাগিদে !! অথচ স্বামী বিচিত্রবীর্য তখন মৃত , অর্থাৎ পৃথিবী জানবে যে সন্তান স্বামীর নয় , তাতে দোষ‌ও নেই !! বংশের সন্তান তো !! বংশধারা , পরিবার, এসবের কাছে নারীর নিজের শরীর , নিজের ইচ্ছে নির্মম এবং অবিসংবাদিতভাবে বলিপ্রদত্ত !!

অধুনা সুপ্রিমকোর্ট যে ৪৯৭ ধারাটি বাতিল করেছেন , সেখানেও এই কথাটিই ছিলো । নারী নিজের সিদ্ধান্তে কারোর সাথে শরীর ভাগ করতে পারবেনা , স্বামীর অনুমতিসাপেক্ষে পারবে । একেবারে মহাকাব্যিক নিদান । অনুমতি নিয়ে যা খুশি করুন কোনো অসুবিধে নেই । ও হ্যাঁ , স্বামীটির কিন্তু স্ত্রীর অনুমতির দরকার পড়বেনা অপর নারীর শয্যা ভাগ করতে অথবা স্ত্রী তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাও নিতে পারবেন না সেক্ষেত্রে !! তবুও কতো না গেলো গেলো হায় হায় রব চারদিকে !!

মহাকাব্যে এমন নিদান দিয়েও দেখানো হয়েছে, পুরুষের কেটে দেয়া গণ্ডীর মধ্যে থাকলে নারী নিরাপদ , গণ্ডীর বাইরে গেলেই বিপদ !! লক্ষ্মণের গণ্ডী তো আসলে পুরুষতন্ত্রের দ্বারা নারীর জন্য মেপে দেয়া , নির্ধারণ করে দেয়া সীমারেখা । হে নারী তুমি পুরুষ বিনে একা , অসুরক্ষিত , অসহায় , খাদ্যবৎ !! অত‌এব গৃহের পরিধির মধ্যে থাকো , গণ্ডীর বাইরে বেরিওনা । গণ্ডীর মধ্যে থাকার অমোঘ নিদান তো মেয়েদের প্রতি পদে পদে !! অপর কেউ তোমায় ছুঁয়েছে কি ছোঁয়নি সেটা বিচার্য নয় , ছোঁয়ার সম্ভাবনামাত্রেই তুমি অসতী !! তোমায় ছুঁড়ে ফেলা যাবে আগুনে , ছুঁড়ে ফেলা যাবে নির্বাসনে , গর্ভাবস্থার মতো অবস্থাতেও ,নির্বিচারে !! আর তারপরেও ভাবীকালের নারী এহেন কর্মের কর্তাপুরুষের নামে জয়ধ্বনি তুলবে , ভক্তিগদগদ চিত্তে নত হবে । নিজের অপমান অসম্মান নির্যাতন পরিত্যাগ সবকিছু ভুলে গিয়ে প্রভুত্বস্বীকার আর ভৃত্যবৎ আনুগত্য নারীর মতোন আর কেউ দিতে পারবেনা পৃথিবীতে । এতোখানি পরিহাস নিজেদের নিয়ে আর কেউ করতে পারবেনা ।

অধিকৃত নারীশরীরটি বা তার গর্ভের মালিকানা বংশের বাইরে যেতে দেয়া যাবেনা , এ প্রথা কেবল আর্য নয় , অনার্য সমাজেও ছিলো । কিস্কিন্ধ্যাপতি বানররাজ বালীর রামের দ্বারা হত্যার পর তাঁর মহারাণী তারা বালীর অনুজ সুগ্রীবের দ্বারা এবং লঙ্কাপতি রাক্ষসরাজ রাবণের মৃত্যুর পর তাঁর রাণী মন্দোদরীকে রাবনানুজ বিভীষণের দ্বারা গৃহীতা হতে দেখা গেছে । অনার্য নারী সঙ্গীচয়নের ক্ষেত্রে আর্যনারী অপেক্ষা স্বাধীনতর হলেও বিবাহের পর তাদের শরীরের অধিকার স্বামী এবং তার কুল বা পরিবারের কুক্ষিগত‌ই ছিলো । স্বাধীনভাবে নিজ শরীরের চূড়ান্ত পর্যায়ের মালিকানা বা অধিকার তাদের‌ও ছিলোনা ।

নারীর শরীর , গর্ভ , যোনি , সমস্ত‌ই পুরুষতন্ত্রের , পরিবারতন্ত্রের অধিকারে , কবজায় !! মহাকাব্যের সময়ের কিছু নিয়মের খোলস হয়তো পাল্টেছে, নিয়োগ প্রথা হয়তো আজ আর সেভাবে প্রকাশ্যে আইনত প্রচলিত নেই , কিন্তু ভেতরে ভেতরে আদৌ কতোটা পাল্টেছে ?? আইন খানিকটাও এগোতে চাইলে প্রগতির মুখোশ ছিঁড়ে এতো চিলচীৎকার জুড়ছে চারদিকে সবাই ...... আবার না এসব ফিরে আসে !! সময়টাওতো ভালো নয় , বরং দুঃসময় বড় ।


লেখক: শিলা চক্রবর্তী

No comments:

Post a Comment

জয়দেব মুখোপাধ্যায় : চৈতন্য মৃত্যুরহস্যের কিনারা করতে গিয়ে প্রাণ দিয়েছিলেন যে গবেষক

জয়দেব মুখোপাধ্যায়ের যেন এক কিংবদন্তির নাম যার কথা অনেকেই শুনেছে , বহু মানুষই তাকে খুঁজে ফেরে কিন্ত তার ব্যাপারে বিশদে কেউ কিছু বলতে পারেনা...