প্রথম পর্ব
বাংলা একাডেমীর বর্ধমান হাউসের পেছনের ভবনের সিঁড়িতে একজন কৃষক দর্শনের অপরিচিত মানুষকে দেখে একদিন থমকে দাঁড়ালাম। লম্বা, কৃশকায়, একহারা গড়ন তাঁর। পাঞ্জাবি-পাজামা পরনে। পায়ে রাবারের জুতো। একেবারে সাদামাটা। তামাটে গায়ের রং, পোড় খাওয়া মানুষ, দেখে আঁচ করা যায়। আপাদমস্তক সাধারণ, সাদাসিধে। তবে অসাধারণ তাঁর চোখ দুটো। তীক্ষ্ম, ধারালো, ভয়ানক বুদ্ধিদীপ্ত।
"বিদ্যাশিক্ষার ডিগ্রী আছে,
জ্ঞানের কোনো ডিগ্রী নেই.
জ্ঞান ডিগ্রীবিহীন ও সীমাহীন"
জ্ঞানের কোনো ডিগ্রী নেই.
জ্ঞান ডিগ্রীবিহীন ও সীমাহীন"
-আরজ আলী মাতুব্বর
মনোযোগ দিয়ে চাইলে যে কেউ চোখ জোড়া দেখে আকর্ষণ বোধ করবেন। হঠাৎ করে আমি মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পড়লে তিনিও অনেকটা অপ্রস্তুত হয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন। জিজ্ঞাসু চোখে চাইলেন আমার দিকে। চোখের ভাষায় তাঁর পথ আটকাবার কারণ জানতে চাইলেন। আমি কিছুটা জড়তা নিয়ে শুধোলাম আপনাকে তো চিনলাম না! সেই মুহূর্তে মনে হয়েছিল, তিনি বুঝি কোনো গ্রামের চারণ কবি। পথ চলেন, আর স্বভাবসুলভ কবিতা বানান। উৎসুক শ্রোতা পেলে ধরে প্রবল উৎসাহে শুনিয়ে দেন। সেই কথাটি পেশ করে তিনি হয়তো পকেট হাতড়ে দুচারখান কবিতা বের করে পড়তে দেবেন। অথবা পাঠ করে শোনাবেন।
আরজ আলী মাতুব্বরের বসতবাড়ী (আরজ মঞ্জিল) লামচরি
না, কোনোটাই করলেন না তিনি। আমার অনুমানের মতো করে বললেনও না কিছু। একটু রয়ে সয়ে বললেন তিনি, আমি একজন সামান্য কৃষক, থাকি গাঁও-গেরামে। আমাকে চিনবেন কেমন করে! তবে জগৎ ও জীবনের নানা বিষয় নিয়ে একটু আধটু ভাবনা ভাবি। মনের খেয়ালে সেই ভাবনাগুলো নিয়ে গুছিয়ে একটু লেখার চেষ্টা করি। অল্প কয়েকখানা বই বের করেছি নিজের কষ্টের পয়সায়। আমাদের এলাকায় কেউ কেউ হয়তো বইগুলো পড়েছেন। তাও সংখ্যায় খুব বেশি হবে না। বই এতদূর এই ঢাকা শহরে আসেনি। কখনো আসলেও কেউ তা পড়বে না।
দ্বিতীয় পর্ব
আরজ আলী মাতুব্বর। নাগরিক পরিসর থেকে অনেক দূরে জন্ম তাঁর। জীবনভর একটানা সংগ্রাম-সংঘাতের মধ্য একই স্থানে সারাটি জীবন বসবাস করেছেন। ভীষণ একাকীত্বে, নিরিবিলিতে নিজ গ্রামে থেকে আপন যেটুকু জমি-জিরেত তাতে ফসল ফলিয়েছেন। আর তার ফাঁকে ফাঁকে জীবন ও জগতের সত্যানুসন্ধান করে ফিরেছেন।
ইংরেজিতে ‘সেল্ফ টট’ বলে প্রচলিত যে কথাটি তা খাঁটি অর্থেই প্রযোজ্য আরজ আলী মাতুব্বরের ক্ষেত্রে। সাধারণ অর্থে কোনো বিদ্যাপীঠে তার শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ হয়নি। বছর দেড়েক একটি মক্তবে ভর্তি হয়ে, অক্ষর জ্ঞানটুকু নেয়া হয়েছিল। ব্যস, অইটুকুই। এই সামান্য অক্ষরজ্ঞান পুঁজি করে জ্ঞানরাজ্যের বিশাল অঙ্গনে বিস্ময়কর পদাচারণা ঘটেছিল তাঁর। সুপুরী, নারকোল আর নদনদীর জন্য অধিক পরিচিত বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের বর্তমান বিভাগীয় শহর বরিশাল। বরিশাল শহরের কোল ঘেঁষে কীর্তনখোলা নদী। কীর্তনখোলার এক পাড়ে বরিশাল শহর। নদীর বিপরীত দিকে চরমোনাই গ্রাম। এই দুয়ের মাঝ বরাবর বয়ে গেছে কীর্তনখোলা।
শহর থেকে কীর্তনখোলা নদী বেয়ে ১০/১২ কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রম করলে পড়বে এক শান্তসমাহিত গ্রাম। গ্রামটির নাম লামচরি। নদীর ঘাট থেকে প্রায় এক কিলোমিটার পথের দূরত্বে লামচরি গ্রামের কেন্দ্রস্থ লে একটি দরিদ্র কৃষিজীবী পরিবারের বাস। ‘মাতুব্বর বাড়ি’ বলে পরিচিত। লামচরি গ্রামের এ বাড়িতেই বাংলা ১৩০৭ সালের ৩ পৌষ আরজ আলী মাতুব্বরের জন্ম। পূর্বপুরুষের বাড়ি ছিল একই জেলার কালিকাপুর ও ঝর্ণাভাঙা গ্রামে। লামচরি গ্রাম একসময় জলাভূমি ছিল। পরে চর জেগে উঠলে আরজ আলীর পিতামহ আমান উল্লা মাতুব্বর শেষ জীবনে লামচরি গ্রামে ঘরবাড়ি বানিয়ে বসত গড়ে তোলেন।
পূর্বপুরুষের সকলেই ছিলেন কৃষিজীবী। চরে তখনো মানুষের বসবাস শুরু হয়নি। ক্ষেত-খামারও হয়নি। কম মানুষজন, ঘরবাড়ি, হালচাষ হতে থাকে। বাড়ির আশেপাশের চরের জমিতে ফসল ফলানো শুরু করলেন আরজের বাবা এন্তাজ আলী মাতুব্বর। লামচরি চর পরিণত হয় লামচরি গ্রামে। ধনধান্যে ভরে ওঠে লামচরির মানুষের ঘর-গোলা। ধীরে ধীরে একসময় সম্পন্ন গ্রাম হয়ে ওঠে লামচরি। আরজ আলী মাতুব্বরের জন্মের চার বছর পর ১৩১১ সালে মারা যান তার বাবা। মৃত্যুর সময় তার উত্তরাধিকারীদের জন্য রেখে যান সামান্য আবাদি জমি এবং বসত বাড়িটি। জমির পরিমাণ ৫ বিঘা। আর টিনে ছাওয়া বসতের দুটো ঘর। এসময় উপর্যপুরি কয়েক বছর প্রাকৃতিক প্রতিকূলতার জন্য ফসল মারা যায়। আরজ আলীরা ৫ ভাইবোন। ৩ ভাই ২ বোন। জন্মের কিছুদিন পর এক ভাই কাছেম আলী মারা যায় ১৩০১ সালে। একই বছরে আরেক ভাই ছোমেদ আলী ৩ বছর বয়সে মারা যায়। এন্তাজ আলী মাতুব্বর তার বড় মেয়ে জিগীর জান বিবিকে বিয়ে দিয়ে যান। তার মৃত্যুর সময় থাকে দুই ভাই বোন, কুলসুম বিবি ও আরজ আলী। আরজ আলীর মা লালমন্নেছা বিবি স্বামী এবং ক্ষেতের ফসল হারিয়ে ছেলেমেয়েকে নিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েন। অনাহারে অর্ধাহারে দিন কাটে তাদের।
তৃতীয় পর্ব
বরিশাল এলাকার দাপুটে জমিদার তখন লাকুটিয়ার রায় বাবুরা। জমিদারের খাজনা
বাকি পড়ে। দু মুঠো খাবারের সংস্থানই যখন হয়না তখন খাজনা পরিশোধের প্রশ্নই
আসে না। অত্যাচারী জমিদার তা বুঝবেন কেন! জমিদারি প্রথাই এমন-প্রজার
সুখ-সুবিধার বিষয়টা সেখানে গৌণ। পাইক-বরকন্দাজ দিয়ে, অত্যাচার-নির্যাতন করে
নিজেদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ নিশ্চিত করার জন্য প্রজাদের খাজনা আদায় করাটাই
মুখ্য ব্যাপার। দরিদ্র প্রজা খাজনা প্রদানে অসমর্থ হলে তারা প্রথমে পীড়ন
এবং শেষে ক্রোক বা নিলামের আয়োজন করতো।১৩১৭ সালে আরজের মা জমির খাজনা দিতে না পারলে যে সামান্য জমিটুকু ছিল তা জমিদাররা নিলামে চড়িয়ে নিজেরা দখল করে। বেঁচে থাকার জন্য, টিকে থাকার জন্য লালমন্নেছাকে অন্যের নিকট হাত পাততে হলো। করতে হলো ধারকর্জ। বরিশাল শহরের সে সময়ের কুখ্যাত কুসীদজীবী জনার্দন সেনের নিকট থেকে চড়া সুদে টাকা কর্জ করলেন। এই দেনার দায়ে পরের বছরই অর্থাৎ ১৩১৮ সালে জনার্দন সেন আরজ আলীদের টিনের বসত বাড়িখানা নিলাম করে নেয়ার এক বছরের মধ্যে আরজের মা পুত্র-কন্যা নিয়ে বিত্ত-বেসাত ও গৃহহীন হয়ে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের নিñিদ্র অন্ধকারের অতলে নিমজ্জিত হন।
রক্ষা এই, নিষ্ঠুর জমিদার বা কুসীদজীবী জমিছাড়া, ঘরহারা করলেও ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করে নি। একান্ত অনুগ্রহবশত ভিটেটুকুর মালিকানা বিধবার নিকট থেকে ছিনিয়ে নিতে পারেনি। পুরানো ভিটিতে তিনি কয়েকদিন কাঁদাকাটা করে অবশেষে সহানুভূতিশীল প্রতিবেশীদের সহায়তায় নতুন একখানা ঘর ওঠালেন। এক চিলতে একটি ঘর। ঘরখানি দৈর্ঘ্যে ছিল পাঁচ হাত। আর প্রস্থে চার হাত। ঘরের চাল ধৈঞ্চর, ছাউনি গুয়াপাতায়, মাদারের গাছের থাম আর ঢেকি লতা দিয়ে বাধা খেজুর পাতার বেড়া। ঘরের চারিদিকে রান্নার হাঁড়িপাতিল, পানির কলসি, চুলা, কাঁথা, বালিশ ইত্যাদি। এর মাঝে কোনোভাবে গুটিশুটি মেরে দু ভাইবোন ও মা বসবাস করতে শুরু করে নতুনভাবে। আর তাতে শুয়ে শুয়ে বালক আরজ আলী স্বপ্ন দেখতে থাকে। নানা এলোমেলো স্বপ্ন। এলোমেলো ভাবনা। তাদের দুর্দশার কথা। অত্যাচারী জমিদারের কথা। অফুরন্ত জিজ্ঞাসা তার মনে আকুলি-বিকুলি করে। বালক আরজ খেই হারিয়ে ফেলে। উত্তর মেলে না।
রাতে ঘুমের ঘোরে পা লেগে ঘরের একপাশে রাখা পানি ভরা কলসি ভেঙে পানি ঘরময় ছড়িয়ে কাঁথা বালিশ বিছানা ভিজে জবজবে একাকার কোনোদিন। আবার কোনোদিন পাতিলের পান্তাভাত ঘরময় ছিঁটিয়ে গেছে। এসময় তাদের দু’বেলার খাবার ছিল এঁটে কলার সাথে পান্তা ভাত। আরজের মা মানুষের বাড়ি বাড়ি কাজ করে, ঢেঁকিতে ধান কুটে কষ্টে সৃষ্টে কোনোভাবে দিনযাপন করেছেন। চোখের জল ফেলে মুখ বুঁজে কষ্ট সয়ে গেছেন তিনি। ভবিষ্যতের আশায় বুক বেঁধে উদয়াস্ত পরিশ্রম করেছেন। ছেলেমেয়ে দুটোকে আগলে রেখে সান্ত্বনা খুঁজেছেন। মানুষ করে গড়ে তুলতে সযত্ন চেষ্টা করেছেন। কিন্তু মানুষ করতে তো ছেলেকে লেখাপড়া করাতে হবে। তার সে সামর্থ্য কই? বেঁচেবর্তে থাকার জন্য খাবার চাই আগে। তারপর না লেখাপড়া। তাদের মুখের দু মুঠো খাবার জোটাতেই প্রাণান্ত। তায় আবার লেখাপড়া!
এসব প্রশ্নের তাড়নায় দীর্ঘদিন বিমোহিত মনে আচ্ছন্ন থেকেছি। হৃষ্টচিত্তে তাঁর বইগুলো সার্বক্ষণিকভাবে বহন করেছি। আর যখন যাকে পেয়েছি পড়ে পড়ে শুনিয়েছি। প্রথমত এটুকুই কর্তব্য বলে মনে হয়েছে। পরে মনে হয়েছে এটুকুতে সন্তুষ্ট হলে চলবে কেন? আমার আজীবন লালিত ধ্যানধারণা ও দর্শনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ এই রচনাগুলো আরো বৃহত্তর পরিসরে নিয়ে যাওয়ার আয়োজন করতে হবে। বহু পাঠককে আলোকিত করার, চিন্তার দাসত্ব থেকে মুক্ত করার অপরিমেয় গুণের অধিকারী কৃষক দার্শনিক আরজ আলী মাতুব্বরের রচনাগুলোকে একত্রিত করে পরিবেশন তো করা যায়। তবে আরো আগে এই লেখককে তো প্রকাশ করা দরকার। তার জীবনী প্রকাশের মাধ্যমে ব্যাপক মানুষের গোচরে নেয়া দরকার এই মহজ্জনকে। অনেকটা অন্ধ আবেগের আতিশয্যে নেমে গেলাম। পরে অবশ্য জেনেছিলাম দেশের প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বেশ আগে দৈনিক ইত্তেফাক-এর এক ঈদ সংখ্যায় তাঁকে নিয়ে লিখেছেন। মফিদুল হক সচিত্র সন্ধানীতে লিখেছেন। লিখেছেন এদেশের বিশিষ্ট স্পষ্টবাদী প্রবাদ পুরুষ অধ্যাপক আহমদ শরীফ, অগ্রসর লেখক-রাজনীতিক বদরুদ্দীন উমরও বুঝি লিখেছিলেন। বরিশালের দু’জন সংবাদকর্মী ও লেখক অরূপ তালুকদার এবং মিন্টু বসু লিখেছিলেন অথবা আরজ আলীর সাক্ষাৎকার প্রকাশ করেছিলেন। এগুলো সবকটি লেখাই পরে হাতে পেয়েছি। নাট্যকর্মী খায়রুল আলম সবুজের তৎপরতার কবি আসাদ চৌধুরী বাংলাদেশ টেলিভিশনে তার এক অনুষ্ঠানে আরজ আলীকে উপস্থাপন করেছিলেন। এগুলো জেনেছি পরে এবং ক্রমান্বয়ে। যাহোক এর পর টানা প্রায় ছয় বছর বরিশাল যাতায়াত। বরিশাল শহর থেকে লামচরি, নদীপথে। অনেকের সঙ্গে কথা, আলাপ, পরিচয়। পরিচয় হলো বরিশাল বিএম কলেজের দর্শনের অধ্যাপক কাজী আব্দুল কাদিরের সঙ্গে। একজন শুভ্র, øিগ্ধ, সাদাসিধে মানুষ। অতিশয় অমায়িক ও পাণ্ডিত্যের ভারে উন্নত এই মানুষটি আরজ আলী মাতুব্বরকে উদার ও অকৃপণ ভাবে সর্বতো সহায়তা করেছেন। হয়তো আরজ আলীর নিজেকে নির্মাণ করতে পারার পেছনে এই ভদ্রলোকের অবদান গরিষ্ঠভাগ।
“ জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে শুধু আপন বিশ্বাসই নয়, সকল মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া উচিত। সকল ধ্যান-ধারণা সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান লাভ করা দরকার প্রতিটি জ্ঞান পিপাসু মানুষের। শুধু সীমাবদ্ধ পরিমন্ডলে আবদ্ধ হলে চলেনা। সীমানাকে অতিক্রম করে যেতে হবে ক্রমান্বয়ে। এর মধ্যেই ক্রমশ অতিক্রম করা যাবে নিজেকে। ”
-আরজ আলী মাতুব্বর
চতুর্থ পর্ব
সাহিত্য, সংস্কৃতি ও প্রশাসনের অনেক ব্যক্তির নিকট তাঁর সম্পর্কে
খোঁজ-খবর। অতঃপর সিদ্ধান্ত নেয়া হলো আরজ আলীর জীবনী লেখার। কথা হলো বাংলা
একাডেমীর তৎকালীন মহাপরিচালক ড, মাহমুদ শাহ কোরেশীর সঙ্গে। তিনি খুব
স্বল্পকালের জন্য নিয়োগ পেয়েছিলেন বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক হিসেবে। এক
ফেব্র“য়ারি থেকে আরেক ফেব্র“য়ারি এই এক বছর মাত্র তিনি এই দায়িত্বে নিয়োজিত
হয়েছিলেন। নিযুক্তি পাবার পর তিনি দুটো বিষয় সামনে রেখে কাজ করে
যাচ্ছিলেন। গতিশীলতা এবং বয়সে অপেক্ষাকৃত তরুণ লেখকদের বই প্রকাশ।
ঘনিষ্ঠতার সুবাদে দ্বিতীয়োক্ত বিষয়টি আমার নিকট ব্যক্ত করে তিনি দ্রুত
পাণ্ডুলিপি দিতে বললেন। আমি আরজ আলীর ব্যাপারটি বিবৃত করে মহাপরিচালক
বরাবরে একখানি চিঠিও দিলাম। সম্মতি মিললো, তারা প্রকাশ করবেন জীবনী পুস্তক।
এক সময় জীবনী পুস্তকের পাণ্ডুলিপি লেখা সমাপ্ত হলো। প্রকাশও হলো
স্বল্পকালের মধ্যে। মহাপরিচালক জনাব মাহমুদ শাহ কোরেশীর ব্যক্তিগত উৎসাহে
বইটি দ্রুত অনুমোদন ও সম্পাদনা লাভ করে ছাপাখানা থেকে বেরিয়ে এলো। ঠিক সে
সময়ই বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক হাসনাত আবদুল হাই আরজ আলী মাতুব্বরের জীবনী
লেখার উপকরণ সংগ্রহের জন্য আমাকে খোঁজাখুঁজি করছিলেন। তিনি আরজ আলী
সম্পর্কে জেনেছিলেন সাহিত্য ও সঙ্গীত অন্তপ্রাণ অ্যাডভোকেট আলী নূর সাহেবের
নিকট। প্রায় সমবয়সী এই বন্ধুযুগল পরস্পরকে মামা বলে সম্বোধন করেন।
নিকটাত্মীয় কেউ না হলেও দূরাত্মীয় হলেও হতে পারে। আবার নাও হতে পারে। তবে
দু’জনার বাড়ী একই জেলায়। দু’জনের মধ্যে সখ্য ভাব বেশ গভীর। একদিন দু’জনে
ধানমন্ডির দু’নম্বরে গে্যঁটে ইনস্টিটিউটে মঞ্চায়িত সক্রেটিস নাটক দেখে
ফেরার পথে নূর ভাই সক্রেটিস-তুল্য আরজ আলী মাতুব্বরের কথা হাসনাত ভাইয়ের
নিকট উত্থাপন করেন। হাসনাত ভাই হতবাক!বাংলাদেশে এমন একজন ব্যক্তি আমাদের অগোচরে থাকতে পারে, এতো ভাবনারও অতীত। নূর ভাইয়ের বয়ানের সঙ্গে হাসনাত ভাইয়ের বিস্ময় একাকার হবার এক পর্যায়ে হাসনাত ভাইয়ের উত্তেজিত ঘোষণাÑ এবার ঈদ সংখ্যায় তাঁর উপন্যাসের প্রধান চরিত্র আরজ আলী মাতুব্বর। এরপরই আমাকে খোঁজাখুঁজি।
আরজ আলীর জীবনী লিখেছি আমি, এটা নূর ভাই জানতেন। তিনিই হাসনাত ভাইকে আমার কথা বলেন এবং একদিন আমাদের দু’জনকে মুখোমুখিও করে দিলেন তার বাসায়। তারপর অসংখ্য দিন নূর ভাইয়ের লালমাটিয়ার বাসার বৈঠকখানায় আমরা বসেছি। এর অদূরে লালমাটিয়াস্থ আমার অপরিসর ডেরায়ও কয়েকদিন বসেছি। আবার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় অবধি অধ্যাপক মুহম্মদ শামসুল হকের নিকটও আমরা সদলবলে গিয়েছি। যথার্থ একজন গ্রন্থকীট এবং অতিশয় সজ্জন ও প্রগতি চিন্তার এই মানুষটি আরজ আলীকে উদার সহায়তায় সর্বতোভাবে ঋদ্ধ করেছেন। নিয়ামানুগভাবে বিষয়ওয়ারি পুস্তক নির্বাচন, সংগ্রহ ও আলোচনা এগুলো করেছেন তিনি পরম ঐকান্তিকতায়। আরজ আলীর উচ্চতা ও অসামান্যতা উপলব্ধি করে তিনি সহায়তায় মুক্তহাত প্রসারিত করেছিলেন। বস্তুত আরজের জ্ঞানচর্চার শৃঙ্খলা স্থাপনে শামসুল হকের অবদান অসামান্য। সৎ, জ্ঞানভুক ও নির্মল এই মানুষটি দীর্ঘদিন রোগে ভুগে প্রায় এক দশক আগে প্রয়াত হয়েছেন। ক্রমাগত আড্ডায় ও তথ্যাধারে তাঁর জুড়ি সত্যিই বিরল। আশঙ্কাজনকভাবে আমাদের সমাজে এমন মানুষের সংখ্যা ইদানীং কমে যাচ্ছে।
পঞ্চম ও শেষ পর্ব
উপন্যাসখানি লেখা হলো। আরজের জীবনচর্যা ও দার্শনিক অবস্থান পর্যবেক্ষণ করে
বিমুগ্ধ লেখক হাসনাত আবদুল হাই সীমাহীন দ্রুততায় জীবনীভিত্তিক উপন্যাস লিখে
ফেললেন। এই ধারার উপন্যাসের তিনি সূচনা করেছেন শিল্পী এস এম সুলতানের
জীবনচরিত অবলম্বনে রচিত উপন্যাস ‘সুলতান’-এর মাধ্যমে। ‘একজন আরজ আলী’ নামের
একখনি উপন্যাস অতি দ্রুততায় নামিয়ে ফেললেন হাসনাত ভাই এবং শাহাদত চৌধুরী
সম্পাদিত তৎকালীন সাপ্তাহিক বিচিত্রার ঈদ সংখ্যায় তা ছাপাও হয়ে গেল।
অত্যন্ত সুলিখিত এবং আরজ-জীবনের খুব প্রাসঙ্গিক অংশগুলো উপন্যাসের মেজাজে
অতিশয় মুনশিয়ানায় উপস্থাপন করে উপন্যাসটি রচিত।প্রায় কাছাকাছি সময়ে বাংলা একাডেমী প্রকাশিত আমার রচিত জীবনী ও একজন আরজ আলী উপন্যাস প্রকাশিত হলো। দুটো পুস্তক খুব দ্রুত পাঠকনন্দিতও হলো এবং আরজ আলী মাতুব্বরের প্রতি মানুষের গভীর মনোযোগ আকর্ষণ করলো। নূর ভাই সবিশেষ আগ্রহ নিয়ে বইখানির প্রকাশনা অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রস্তাব করলে আমরা তাৎক্ষণিক উৎসাহী হয়ে উঠি। জাতীয় জাদুঘরের শিশু মিলনায়তনে কেবল প্রকাশনা অনুষ্ঠানের আয়োজন নয়, আরজ আলী মাতুব্বরের পরিবারের সদস্য ও আরজ আলী সান্নিধ্যধন্য বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সম্মিলনী হয়ে গেল। এতে শিল্পী আবুল কাসেম, সরদার ফজলুল করিম, অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, অধ্যাপক মুহম্মদ শামসুল হক প্রমুখসহ বেশ কয়েকজন স্মৃতিচারণের পাশাপাশি দার্শনিক তত্ত্বের আলোচনা করেছিলেন। হলভর্তি উপচে পড়া নিবিষ্ট শ্রোতা। সকলে তন্ময় হয়ে শুনেছেন, আরজ আলীকে শ্রদ্ধার সঙ্গে উপলব্ধিতে মনোযোগি হয়েছেন।
অনুষ্ঠানটির সংবাদ প্রকাশে দৈনিক জনকণ্ঠ সে সময় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। এখানে বিশেষত জনকণ্ঠ সম্পাদক বর্ষীয়ান সাংবাদিক তোয়াব খানের কথা উল্লেখ করতেই হয়। তাঁর ব্যক্তিগত আগ্রহে খুব গুরুত্বের সঙ্গে খবর এবং উপর্যুপরি কয়েকটি ফিচার ও পুস্তক আলোচনা প্রকাশিত হয়। তিনি শিল্পী শামসুদ্দীনকে দিয়ে আরজ আলীর একটি মনোজ্ঞ স্কেচ করান। তিনি পরে আমাকে মূল ডিজাইনটি দিয়েছেন ব্যবহারের জন্য এবং স্কেচটি রচনাবলী ও বিভিন্ন স্থানে বহুল ব্যবহৃত ও পরিচিত। এমনকি স্কেচটি অনুসরণে পোস্টারও ছাপা হয়েছে।
এ সকল উদ্যোগে ও তৎপরতায় এতো দ্রুতলয়ে আরজ আলীর নাম, তাঁর দর্শন তত্ত্ব তরুণ বয়সী লেখক ও পাঠকের মধ্যে তাঁর প্রভাব ছড়িয়ে গেল যে তা একরকম অবিশ্বাস্য। দুদশক আগের কথার বয়ান এটুকুই থাক।
আরজ আলী মাতুব্বরের সঙ্গে কিয়ৎকালীন ব্যক্তিগত পরিচয় ও তাঁর সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে ওঠার বিবরণ পাঠক সমীপে তুলে ধরার তাগিদ থেকে এই বিবরণের অবতারণা করা হলো। বর্তমান প্রজন্ম আরজ আলীকে জানার প্রাথমিক তৃষ্ণা মিটবে এ পুস্তকখানির মাধ্যমে। বর্তমান জীবনী গ্রন্থের সংক্ষিপ্ত সংস্করণ প্রথম বাংলা একাডেমী প্রকাশ করেছিল ১৯৯৩ সালে। দ্রুত নিঃশেষিত হওয়ায় ২০০১ সালে দ্বিতীয় সংস্করণ হয়েছে। তাও অনেক আগে ফুরিয়ে গেছে। অথচ নতুন প্রজন্মের পাঠকদের মধ্যে আরজ আলী সম্পর্কে রয়েছে অপার কৌতূহল। তাঁর জীবন এবং দর্শনের সঙ্গে পরিচিত হবার তাগিদ অনুভব করেন তারা। প্রজন্মের তাগিদ ও চাহিদা বিবেচনা করে বর্তমান সংস্করণ বর্ধিত কলেবরে প্রকাশ করা হলো। এই সম্প্রসারণকৃত সংস্করণ পাঠককে আরজ আলী অনুধাবনে আরো সহায়ক হবে বলে আমরা ধারণা করি। আরজ আলীর প্রতি যতোটা মনোযোগ ফেরানো যাবে ততটাই আমাদের সমাজ যুক্তিসিদ্ধ ও বিজ্ঞানমুখী হয়ে উঠতে পারবে। সেটাই তো আমাদের কাম্য।
লেখক: আইয়ুব হোসেন, গবেষক ও সাংবাদিক
No comments:
Post a Comment