Saturday, June 22, 2019

নীলিমা ইব্রাহিম: অন্তরে-বাহিরে সৎ একজন মানুষ।

অষ্টম শ্রেণীর ক্লাস চলছে।মাষ্টার মশাই অংক করাচ্ছেন। ইন্সপেক্টর এসেছেন স্কুল পরিদর্শনে, ইন্সপেক্টর প্রশ্ন করলেন- 'Bisect a straight line into five equal Parts.’
শিক্ষার্থীরা হতভম্ভ। কেউ দাঁড়ানোর সাহস পাচ্ছে না। অংকের শিক্ষক মাথা নিচু করে এক কোণে দাঁড়িয়ে আছেন। কিন্তু শিক্ষার্থীদের মধ্যে থেকে একজন উঠে দাঁড়ালো। সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। সে উত্তর দিল, ম্যাডাম Bisect অর্থ তো সমান দুভাগ করা।
একটা সরল রেখাকে Bisect করে সমান পাঁচ ভাগে ভাগ করা কিভাবে সম্ভব? রাগে গরগর করতে করতে বেরিয়ে গেলেন ইন্সপেক্টর। শিক্ষকের মুখে গর্ব মিশ্রিত হাসি দেখা দিল।
সেদিনের সেই শিক্ষার্থীর নাম নীলিমা রায় চৌধুরী, আমরা যাঁকে চিনি নীলিমা ইব্রাহিম নামে। সাদাকে সাদা এবং কালোকে কালো বলার সত্‍সাহস যিনি রাখতেন। কখনোই আপোস করেননি অন্যায় কাজের সাথে। আর তাই অবলীলায় ফিরিয়ে দিতে পেরেছেন মন্ত্রীত্বের প্রস্তাব। তিনি জানতেন তিনি একজন শিক্ষক। সেটাই ছিল তাঁর অহংকার। ১৯৭৪ সালের শেষার্ধে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু তাঁকে সরাসরি প্রশ্ন করেছিলেন, ‘রাজনীতি করবেন?’ তিনি স্পষ্ট জবাব দিয়েছিলেন, ‘না।’ ‘কেন?’ ‘বুঝি না, আমি মাস্টার, হ্যাঁ বললে হ্যাঁ আর না বললে না বুঝি। আমার পক্ষে রাজনীতি করা সম্ভব নয়।’ বঙ্গবন্ধু গম্ভীর হয়ে উঠে দাঁড়িয়েছিলেন, অনুরোধ করেছিলেন শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব নিতে। বঙ্গবন্ধু জানিয়েছিলেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে তিনি অনেক টাকা বরাদ্দ করেছেন, কারও ওপর নির্ভর করতে পারছেন না, তাই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব তিনি (ড. নীলিমা ইব্রাহিম) নিলে বঙ্গবন্ধু অনেকটা আশ্বস্ত হতে পারতেন। তিনি সবিনয়ে সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, বলেছিলেন, ‘বঙ্গবন্ধু, প্রথমত আমি শিক্ষক হিসেবে মরতে চাই। শেষ যাত্রার সম্মানটুকুর প্রতি আমার লোভ...।’
অথচ শিক্ষক হওয়ারই কথা ছিল না তাঁর। ১৯৬৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছিলেন পিএইচডি করতে। ভেবেছিলেন বছর খানেক বিশ্ববিদ্যালয়ে যাতায়াত করে থিসিস জমা দিয়ে ফিরে যাবেন ঘর গেরস্থালীতে, খুলনায় যেখানে রয়েছে তাঁর স্বামী ডা: মুহম্মদ ইব্রাহিম ও পাঁচ কন্যা। কিন্তু সব সময় মানুষের ভাবনার সাথে বিধাতার ভাবনা মেলেনা। তাই পিএইচডি করতে আসার দুসপ্তাহের মধ্যে বাংলা বিভাগের প্রফেসর আব্দুল হাইয়ের কথায় একরকম বাধ্য হয়েই যোগ দিলেন বাংলা বিভাগে। ১৯৫৬ সালে শুরু হওয়া সেই দায়িত্ব তিন দশককাল পরম নিষ্ঠার সাথে পালন করেছেন নীলিমা ইব্রাহিম। দায়িত্ব পালনের পথে ফুল বিছানো ছিল না, ছিল কন্টকপূর্ণ। কাঁটাগুলো সরাতে গিয়ে ক্ষত বিক্ষত হয়েছেন। তারপরও কাজ করে গেছেন অবিচলতার সাথে। বাংলাদেশের মুষ্টিমেয় যে কজন ব্যক্তি নিজ কর্মগুণে জগৎবিখ্যাত হয়েছেন নীলিমা ইব্রাহিম ছিলেন তাঁদের অন্যতম।
নীলিমা ইব্রাহিম জন্মেছিলেন ১৯২১ সালের ১১ জানুয়ারী খুলনা জেলার বাগেরহাট মহকুমার মূলঘর গ্রামে। জন্ম হয়েছিলো জমিদার পরিবারে। পিতা প্রফুল্ল রায়চৌধুরী, মাতা- কুসুমকুমারী দেবী। শৈশব কাটিয়েছেন খুলনায়। শৈশবে তিনি খুব দুরন্ত প্রকৃতির ছিলেন। তাঁর নিজের ভাষায় 'গেছো' প্রকৃতির। বাড়ীর আশে পাশে পুকুরে ঝাপাঝাপি, কুল, জামরুল আর কাঁচা আমের বংশ লোপ ইত্যাদিতে ছিল তাঁর জন্মগত অধিকার। রীতিমতো ফুটবল খেলতেন ভাইদের সাথে। মেয়ের প্রকৃতির সাথে সাথে গায়ের রং নিয়েও চিন্তিত ছিলেন মা কুসুমকুমারী। সকল ভাইবোনের মধ্যে একমাত্র নীলিমাই ছিলেন কৃষ্ণবর্ণা। সম্ভবত এজন্যই মার কাছ থেকে কিছুটা অবহেলা তিনি পেয়েছিলেন। আর সেটা পুষিয়ে দিতেন তাঁর বাবা। বলতেন, "আমার এই মেয়ের আমি বিয়ে দিব না। শ্বশুরবাড়ীতে লোকেরা মুখের কাপড় তুলে বলবে 'এমা এ বউ কালো' সে আমি সইতে পারব না।" তাঁর জীবনে তাঁর বাবার প্রভাব ছিল খুব বেশি। বাবা প্রফুল্ল কুমার বিদ্ধান, সাহিত্য রসিক ও সঙ্গীত প্রিয় ছিলেন। আর বাবার এই গুণগুলিই দেখা যায় মেয়ে নীলিমার মাঝে।

Image may contain: one or more people, closeup and text

নীলিমা মেধাবী ছিলেন ছোট বেলা থেকেই। ভর্তি হয়েছিলেন খুলনা করনেশন গার্লস স্কুলে। এই স্কুল থেকে মাধ্যমিক পাশের পর বাবা তাঁকে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিলেন কলকাতার বিখ্যাত ভিক্টোরিয়া ইনস্টিটিউশনে। সেখান থেকেই উচ্চমাধ্যমিক ও অনার্স (অর্থনীতি) সম্পন্ন পাশ করেন। তারপর এম.এ. পড়া শুরু করলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে। তবে অর্থনীতিতে এম.এ. আর করা হয়ে উঠেনি। শেষ পর্যন্ত স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে বি.টি. সম্পন্ন করেন। কিন্তু এম.এ. পাশের অদম্য ইচ্ছা থেকেই গিয়েছিল তাঁর। এরপর ভর্তি হলেন বাংলায়, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে, এবার অবশ্য এম.এ. সম্পন্ন করতে পেরেছিলেন তিনি।
মাধ্যমিক পরীক্ষার পর বসে থেকে তাঁর কোনো পরীক্ষা দেওয়া হয়নি। কারণ গুরুতর অসুখ নিয়ে বার্লি খেয়ে, আক্কেল দাঁতের অপারেশন নিয়ে দিয়েছেন উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা। কোরামিন ইনজেকশন নিয়ে বি.এ. পরীক্ষা, আর মুখে একটা গোটা ইরিসিপ্লাস নিয়ে দিয়েছেন বি.টি. পরীক্ষা। এম.এ. তেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। সে সময় হয় ডেঙ্গু জ্বর। প্রতিবারই অদম্য ইচ্ছাশক্তির জোরে কাটিয়ে উঠেছেন সব প্রতিকূলতা। পরীক্ষার আট মাস আগে স্ট্রোক হওয়াতে অর্থনীতিতে অনার্স পরীক্ষায় দ্বিতীয় শ্রেণী লাভ করেন। এছাড়া সব গুলোতেই ছিল প্রথম বিভাগ। অসুস্থার কারণে সব পরীক্ষা তাঁকে 'সিক বেড' এ শুয়ে দিতে হয়েছে। নানা রকম বিপদ আর ঝড়-ঝঞ্ঝা এসেছে তাঁর সমগ্র পাঠ্য জীবনে।
শিক্ষা জীবনে নীলিমা যে সকল শিক্ষকের সান্নিধ্যে এসেছেন তাঁদের কাছ থেকে সব সময় শেখার চেষ্টা করেছেন।

লেখক: আকবর দীপু

No comments:

Post a Comment

জয়দেব মুখোপাধ্যায় : চৈতন্য মৃত্যুরহস্যের কিনারা করতে গিয়ে প্রাণ দিয়েছিলেন যে গবেষক

জয়দেব মুখোপাধ্যায়ের যেন এক কিংবদন্তির নাম যার কথা অনেকেই শুনেছে , বহু মানুষই তাকে খুঁজে ফেরে কিন্ত তার ব্যাপারে বিশদে কেউ কিছু বলতে পারেনা...