অতীশ দীপঙ্কর
শ্রীজ্ঞানের জন্ম ৯৮০, মতান্তরে ৯৮২ খ্রিস্টাব্দে, মুন্সীগঞ্জ জেলার
বিক্রমপুরের বজ্রযোগিনী গ্রামে। তাঁর জন্মস্থানের বাস্তুভিটাকে এখনো
স্থানীয় জনগণ ‘পণ্ডিতের ভিটা’ বলে অভিহিত করে। তাঁর পিতা কল্যাণশ্রী ছিলেন
পাল রাজাদের অধীনস্ত সামন্ত রাজা। কেউ কেউ অবশ্য কল্যাণশ্রীকে চন্দ্রবংশীয়
রাজা বলে অনুমান করেন। অতীশের মাতার নাম প্রভাবতী, তিনি অতীশের জন্মনাম
রেখেছিলেন চন্দ্রগর্ভ। দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান ছিল তাঁর উপাধি, যা তিনি
পেয়েছিলেন ওদন্তপুরী বিহারে, আচার্য শীলরক্ষিতের কাছ থেকে।
অতীশ তাঁর
তিব্বতীয় আত্মকথায় বলেন, তাঁর পিতা তন্ত্রোপাসনা করতেন এবং ছিলেন একজন
বোধিসত্ত। পিতার কাছ থেকেই তিনি তন্ত্রোপাসনায় দীক্ষা নিয়েছিলেন। এর পর
তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু নালন্দায়। বিখ্যাত নৈয়ায়িক পণ্ডিত জেতারির নিকট তিনি
গৌণ-বিজ্ঞান শিক্ষা শুরু করেন, যা পরবর্তীতে তাঁর জন্য ধর্ম ও দর্শন
অধ্যয়নের পথ তৈরি করে দেয়। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নানা বিষয়ে তাঁর অধ্যয়ন
শুরু হয়। পাঠ করেন হীনযানীদের ত্রিপিটক, বৈশেষিক দর্শন, মহাযানীদের
ত্রিপিটক, মাধ্যমিক ও যোগাচারীদের অধিবিদ্যা ও ৪ ধরনের তন্ত্র। একুশ বছর
বয়সেই তিনি দর্শন, সাহিত্য, ব্যাকরণ ও শিল্পকলায় ব্যুত্পত্তি অর্জন করেন।
তির্থিকদের শাস্ত্রেও তিনি ব্যুত্পত্তি লাভ করেন এবং এক শিক্ষিত ব্রাহ্মণকে
তর্কযুদ্ধে পরাজিত করেন। অতীশের জীবনের প্রথম পর্যায়ের শিক্ষাগুরুদের
মধ্যে ছিলেন রাহুল গুপ্ত, শীলরক্ষিত প্রমুখ। অতীশ আকৃষ্ট হয়েছিলেন বৌদ্ধ
ধর্মের অনুধ্যানিক বিজ্ঞানের প্রতি, যার ভিত্তি ছিল ত্রিশিক্ষা, নৈতিকতা ও
দিব্য শিক্ষণ। রাহুল গুপ্তের অধীনে বৌদ্ধ ধর্মের গুঢ়তত্ত্ব শিক্ষার
উদ্দেশ্যে তিনি যান কৃষ্ণগিরি বিহারে। সেখানে কৃতিত্বের জন্য লাভ করেন
গুহ্যজ্ঞানবজ খেতাব। ১৯ বছর বয়সে তিনি পবিত্র ব্রত গ্রহণ করেন মহাসংঘিক
আচার্য শীলরক্ষিতের কাছে।
অতীশ দীপঙ্করের
জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ পর্যায় শুরু হয় সুবর্ণদ্বীপে, যার বর্তমান নাম
সুমাত্রা। একসময় এই দেশটি ছিল প্রাচ্যে বৌদ্ধ ধর্মের প্রধান একটি কেন্দ্র।
পাল সাম্রাজ্যের সঙ্গে এর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। সুবর্ণ দ্বীপে যাবার আগে
নানা বিষয়ে অধ্যয়ন অতীশকে অনেকটা অস্থির করে তুলেছিল। নানা বিষয়ের দিকে
ধাবিত হচ্ছিল তাঁর মন। এই বিচলন থেকে মনকে সুস্থির করতে তিনি খুঁজছিলেন
নিভৃত সাধনার একটি স্থান। সে সময় তাঁর বয়স ৩১ বছর। ব্যবসায়ীদের জাহাজে উঠে
ঝড়-ঝঞ্ঝাময় দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে তিনি পৌঁছান সুবর্ণ দ্বীপে। এখানে তিনি
কাটিয়েছিলেন ১২ বছর; চন্দ্রকীর্তি ছিলেন তাঁর শিক্ষক। তাঁর আরেক শিক্ষাগুরু
ছিলেন ধর্মকীর্তি বা ধর্মরক্ষিত, যার তিব্বতীয় নাম সেরলিংপা। এই
ধর্মরক্ষিতের সঙ্গে যে সুবর্ণ দ্বীপেই অতীশের সাক্ষাত্ হয়, সে বিষয়ে
নিশ্চিত হওয়া যায় না। ধর্মকীর্তির সঙ্গে তার মগধেও সাক্ষাত্ ঘটে থাকতে
পারে। সুবর্ণ দ্বীপে আরো যে পণ্ডিতদের সঙ্গে অতীশের দেখা হয়, তাঁদের মধ্যে
ছিলেন সুখগতি, ধর্মমিত্র, কসলসম্ভব, সুরবজ , দেবমতী, রবিগুপ্ত, ভূমিসার,
জ্ঞানসার, ভেগাইন্দ্র, দানশ্রীমিত্র, প্রজাভদ্র, সুচন্দ্রা, সামন্তভদ্র,
গুপ্তসার, অনন্তমাটি, রাজসেমেরু, সুরললিতা প্রমুখ। ধর্মকীর্তি ছিলেন
বোধিচিত্তের শিক্ষক। তাঁর কাছে অতীশ এমন এক ধরনের ধ্যান শিক্ষা করেন, যার
নাম তংলেং ধ্যান। এই ধ্যানের শিক্ষা যে তান্ত্রিক বিভিন্ন নীতির সঙ্গে
সঙ্গতিপূর্ণ তা বলা যায়, কেননা এ ধরনের ধ্যান-যোগের মাধ্যমে দেহের মধ্যে
থাকা নেতিবাচক শক্তিকে রূপান্তরিত করা যায় প্রীতিময় ও নিরাময়ের শক্তিতে।
অতীশের জীবনের
তৃতীয় পর্যায় শুরু হয় সুবর্ণ দ্বীপ থেকে ভারতবর্ষে ফিরে আসার পর। তিনি মগধে
ফিরে আসেন তাম্র দ্বীপ অর্থাত্ শিলং হয়ে। এ সময়ে অনেক পণ্ডিত ব্যক্তির
সঙ্গে সাক্ষাত্ হয় তাঁর। এদের কারো কারো সঙ্গে তিনি ধর্ম বিষয়ে তর্কযুদ্ধে
অংশ নেন। বজ্রাসনের মহাবোধিতে থাকাকালীন ধর্মবিষয়ক বিতর্কে তিনি তিনবার
তীর্থিক পাষণ্ডদের পরাজিত করেছিলেন। এর মাধ্যমে তিনি বৌদ্ধ ধর্মের
মহত্ত্বকে তুলে ধরেন। ক্রমে ধর্ম বিষয়ে অতীশের পাণ্ডিত্যের কথা চারদিকে
ছড়িয়ে পড়তে থাকে। বিক্রমশীলা মহাবিহার ছিল পাল রাজাদের প্রতিষ্ঠিত একটি
শিক্ষায়তন। মহীপালের আমন্ত্রণে অতীশ এই বিক্রমশীলা মহাবিহারের ‘স্থবির’ পদে
অধিষ্ঠিত হন এবং পরে আচার্য হন। এ সময় চেদীরাজ কর্ণ (কণৌজ) মগধ আক্রমণ
করেন। এ আক্রমণে নয়পালের সৈন্যরা পরাজিত হয় এবং শত্রু সৈন্যরা রাজধানী
পর্যন্ত পৌঁছে যায়। কিন্তু মগধ অধিকার করতে তারা ব্যর্থ হয় এবং অনেক
বৌদ্ধমন্দির ও বিহার ধ্বংস করতে থাকে। নয়পালের সৈন্যরা এরপর কর্ণরাজের
সৈন্যদের হত্যা করতে শুরু করলে অতীশ তাদের আশ্রয় দেন এবং উভয় পক্ষের মধ্যে
সন্ধি স্থাপনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
অতীশের জীবনের
আরেকটি পর্যায় শুরু হয় তাঁর তিব্বতে যাবার ভেতর দিয়ে। তিব্বতে বৌদ্ধ
ধর্মবিরোধী রাজা লাং ডারমার বৌদ্ধ ধর্ম ধ্বংসের নীতির ফলে এ ধর্ম যে চরম
বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছিল, তা থেকে উত্তরণের জন্য বৌদ্ধ রাজা এশেওড বিশেষভাবে
তত্পর হয়েছিলেন পরবর্তীকালে। তিনিই প্রথম অতীশকে তিব্বতে আমন্ত্রণ জানান।
বৌদ্ধ ধর্মের পুনর্গঠনে রাজা এশেওড পুরংয়ের থোলিনে একটি বৌদ্ধ মঠ নির্মাণ
করেন। সেখানে কিছু তরুণকে বিশেষ গুরুত্বসহকারে বৌদ্ধ ধর্মের শিক্ষা দেয়া
হতে থাকে। কিন্তু তিব্বতীয় বৌদ্ধ গুরুদেরকে তিনি পর্যাপ্ত মনে করেননি।
কেননা তিব্বতীয় বৌদ্ধ সম্প্রদায়গুলোর বৌদ্ধমত অনেক বিচ্যুত হয়ে পড়েছিল
তান্ত্রিক ও পোন মরমীবাদের সঙ্গে মিশ্রণের কারণে। পরে এই তরুণ ভিক্ষুদেরকে
কাশ্মীর, মগধ ও ভারতবর্ষের নানা জায়গায় পাঠিয়ে দেয়া হয়, যাতে তারা শুদ্ধ
বৌদ্ধমত সম্পর্কে জানতে পারে।
এশেওড বৌদ্ধ
ধর্ম পুনর্গঠনের জন্য কাশ্মিরী পণ্ডিত রত্নবজ্রকে তিব্বতে আনার চেষ্টা
করেন। তিব্বতের তরুণ শিক্ষার্থী, যারা মগধে খ্যাতনামা বৌদ্ধ পণ্ডিতদের
দেখতে পাবেন তাদেরকে আমন্ত্রণ জানাবার নির্দেশ দেন। এ উদ্দেশ্যে মগধে
পাঠানো হয় ২১ জন ভিক্ষুকে। উচ্চ তাপমাত্রা, জ্বর, সাপের কামড় ও আরো নানা
কারণে এ দলটির ১৯ জনই পথে মারা পড়েন। রিনছেন যান-পো, মহাত্মা লোচভ ও লেগস
পাহি শেরাব প্রাণে বেঁচে যান এবং ভারতবর্ষ থেকে তিব্বতে ফিরতে সমর্থ হন। এ
তিব্বতীয় ভিক্ষুরা ভারতে গিয়ে খ্যাতনামা পণ্ডিতদের কাছে সংস্কৃত শেখেন,
বৌদ্ধ গ্রন্থাদি পড়েন এবং বিক্রমশীলার আচার্য অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান
সম্পর্কে জানতে পারেন। সে সময় লোচভ অতীশ দীপঙ্করকে তিব্বতে যাবার আমন্ত্রণ
জানাননি, তা নিছক অপরিণত প্রস্তাব হয়ে পড়তে পারে ভেবেই। তাঁরা তিব্বতে ফিরে
রাজা এশেওডকে তাদের বিচিত্র অভিজ্ঞতা, মগধের বিহার, সেখানকার শিক্ষণ ও
অতীশ সম্পর্কে জানান।
অতীশ সম্পর্কে
জানার পর রাজা এশেওড তিব্বতে বৌদ্ধ ধর্মের পুনর্গঠনের জন্য তাঁকেই উপযুক্ত
পণ্ডিত বলে ধরে নেন। তিনি একজন দূত, একশ পরিচারক ও যথেষ্ট পরিমাণ স্বর্ণ
উপঢৌকন হিসেবে পাঠান বিক্রমশীলায়। সেই দূত বিক্রমশীলায় গিয়ে অতীশের সঙ্গে
সাক্ষাত্ করে রাজার চিঠি ও স্বর্ণ উপহার দেন এবং তাঁকে তিব্বতে যাবার সহূদয়
আমন্ত্রণ জানান। তখন অতীশ উত্তর করেন, ‘তাহলে মনে হচ্ছে, আমার তিব্বতে
যাওয়ার পেছনে দুটো কারণ; এক. একরাশ স্বর্ণ আর দুই. অন্যদের ভক্তিতে পূজনীয়
হওয়ার বাসনা। আমার কথা হচ্ছে, এই দুটোর কোনোটার জন্যই বর্তমানে আমার কোনো
উদ্বেগ নাই।’ এ কথা শুনে রাজার দূত গেয়াত্সন মর্মাহত হন। দেশে ফিরে রাজা
এশেওডকে এই ব্যর্থ অভিযানের কথা জানালে তিনিও দুঃখিত হন। রাজা তখন মগধ থেকে
দ্বিতীয় কোনো পণ্ডিতকে তিব্বতে নিয়ে যাবার ইচ্ছা প্রকাশ করেন।
পরের ঘটনাপ্রবাহ
এমন নাটকীয়ভাবে ঘটতে থাকে যে, সেসব ঘটনা অতীশকে তিব্বতে যাবার সিদ্ধান্ত
নিতে বিশেষভাবে ভূমিকা রাখে। রাজা এশেওড বৌদ্ধ পণ্ডিতকে আনার জন্য স্বর্ণ
সংগ্রহে নেপাল সীমান্তে গিয়ে বিপদের মুখে পড়েন। রাজাসহ পুরো দলটি গারওয়ালের
রাজা গারলংয়ের সৈন্যদের নজরে পড়ে। রাজা গারওয়াল ছিলেন বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি
শত্রুভাবাপন্ন। তিনি জানতে পারেন, তিব্বতে বৌদ্ধ ধর্মের সংস্কারের জন্যই
পণ্ডিত আনতে স্বর্ণ সংগ্রহে এসেছেন তিব্বতের রাজা। অচিরেই গারওয়ালের রাজা
তাঁকে বন্দি করেন। তিনি এশেওডকে বৌদ্ধ ধর্ম ত্যাগ করে তাদের ধর্ম গ্রহণ
করতে অনুরোধ করেন এবং সেই শর্তে তাকে মুক্তি দেবার প্রস্তাব করেন। কিন্তু
রাজা এশেওড তাতে রাজি হন না। অন্যদিকে রাজার বন্দিত্বের কথা শুনে তাঁর
পুত্র ও ভ্রাতুষ্পুত্র ছং-চূব-ওড গারওয়ালে উপস্থিত হন একশ ঘোড়সওয়ার
সৈন্যসহ। তারা গারওয়াল আক্রমণের কথা ভাবেন। কিন্তু তাতে বন্দি রাজা এশেওডের
নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবার আশঙ্কা থাকায় তারা এই ভাবনা ছেড়ে দিয়ে সমঝোতার
প্রস্তাব দেন। গারওয়ালের রাজা দুটো শর্ত দেন, রাজা এশেওডের ধর্মান্তর, নয়তো
রাজার প্রতিকৃতির সমান স্বর্ণ। প্রথম প্রস্তাব রাজা এশেওড বাতিল করেন।
দ্বিতীয় প্রস্তাব অনুযায়ী স্বর্ণ সংগ্রহে লেগে যান ছং-চূব-ওড। কিন্তু এত
বেশি পরিমাণ স্বর্ণ সংগ্রহ করা দুষ্কর হয়ে পড়ে তার পক্ষে। রাজা এশেওড তখন
ভ্রাতুষ্পুত্র ছং-চূব-ওডকে অনুরোধ করেন যে, এই স্বর্ণের বিনিময়ে তাঁর
মুক্তির চেষ্টা না করে বরং বৌদ্ধ ধর্মের সংস্কারে পণ্ডিতদের নিয়ে আসার জন্য
এ অর্থ ব্যয় করা হোক। বৌদ্ধ ধর্মের কারণে কারাগারে তাঁর মৃত্যু বরং
মহিমান্বিত হবে। ধর্মের জন্য তাঁর এই প্রাণ উত্সর্গ করাকেই তিনি আনন্দের
সাথে মেনে নেন। ছং-চূব-ওড যখন পুনর্বার অতীশকে তিব্বতে আমন্ত্রণ জানান, তখন
এ ঘটনার কথা শুনে তিনি আর অস্বীকৃতি জানাননি। তিনি যখন তিব্বতে যেতে রাজি
হন, তখন বিক্রমশীলার অধিনায়ক ছিলেন আচার্য রত্নাকর। তিনি অতীশকে তিব্বতে
যেতে দিতে রাজি ছিলেন না। কারণ অতীশের অনুপস্থিতিতে বিক্রমশীলা এবং তার
অধীন নানা বিহার-সংঘগুলো দুর্দশাগ্রস্ত হয়ে পড়বে বলে তিনি মনে করেছিলেন।
অতীশকে আমন্ত্রণ জানাতে আসা তিব্বতী আচার্য বিনয়ধরকে তিনি বলেছিলেন: ‘অতীশ
না থাকিলে ভারতবর্ষ অন্ধকার। বহু বৌদ্ধ-প্রতিষ্ঠানের কুঞ্চিকা তাঁহারই
হাতে; তাঁহার অনুপস্থিতিতে এই সব প্রতিষ্ঠান শূন্য হইয়া যাইবে। চারিদিকের
অবস্থা দেখিয়া মনে হয়, ভারতবর্ষের দুর্দিন ঘনাইয়া আসিতেছে। অসংখ্য তুরুস্ক
সৈন্য ভারতবর্ষ আক্রমণ করিতেছে; আমি অত্যন্ত চিন্তিত বোধ করিতেছি। তবু,
আশীর্বাদ করিতেছি, তুমি অতীশ ও তোমাদের সঙ্গী লইয়া তোমাদের দেশে ফিরিয়া
যাও, সকল প্রাণীর কল্যাণের জন্য অতীশের সেবা ও কর্ম নিয়োজিত হউক।’
অতীশ তিব্বতে
পৌঁছান কয়েক বছরের দীর্ঘ ভ্রমণ শেষে। সেখানে তাঁকে রাজকীয় সংবর্ধনা দেয়া
হয়। তিনি যখন তিব্বতের থলিংয়ে পৌঁছান, তখন তার বয়স ষাট বছর। এর পর ১৩ বছর
তিনি বেঁচে ছিলেন। ঘুরে বেড়িয়েছেন তিব্বতের নানা জায়গায়। শুরু করেছিলেন
থলিংয়ে, এর পর যান পূর্বের সময়ে বিহারে এবং লাসায়। নানা মঠে ও বিহারে
ধর্মকথা প্রচার করেন তিনি, রচনা করেন অনেকগুলো গ্রন্থ। নানা শাস্ত্রগ্রন্থ
অনুবাদ করেন তিব্বতীয় ভাষায়। শেষ দিনগুলোতে তিনি ছিলেন লাসার দক্ষিণে
অবস্থিত ন্যাথাংয়ে। সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন ৭২ বছর বয়সে।
অতীশ দীপঙ্কর
তিব্বতে গিয়েছিলেন বৌদ্ধ ধর্ম সংস্কারের কাজে। তিব্বতে বৌদ্ধ ধর্মের পতনের
পর সেখানে বৌদ্ধ ধর্মের যে বিশৃঙ্খল ও বিপর্যস্ত দশা সৃষ্টি হয় এবং
তত্ত্বচর্চা ও সাধন ধারা নিয়ে যে বিতর্ক ও অস্পষ্টতার সৃষ্টি হয়, অতীশ
দীপঙ্কর তা নিরসন করে তিব্বতে বৌদ্ধ চিন্তার নতুন ধারা সৃষ্টি করেন। তাঁর
প্রবর্তিত কদম-পা ধারায় তিনি সন্ন্যাসী জীবন ও শৃঙ্খলার ওপর গুরুত্ব দেন
এবং সূত্রের শিক্ষা ও তন্ত্রের মধ্যকার পার্থক্য ঘুঁচিয়ে উভয়ের মধ্যে
সামঞ্জস্য প্রতিষ্ঠা করেন। অতীশ তিব্বতীয় বৌদ্ধ ধর্মকে প্রাচীন পোন ধর্মের
প্রভাব থেকে মুক্ত করেন। তবে তিব্বতীয় সংস্কৃতির অনিবার্য উপাদানগুলোকে
তিনি এই সমন্বিত ধারায় অঙ্গীকৃত করেন। রাজা এশেওড অতীশ দীপঙ্করকে তিব্বতে
নেবার উদ্যোগ নিয়েছিলেন তিব্বতীয় বৌদ্ধমত সংস্কারের প্রয়োজনে, বিশেষত বৌদ্ধ
ধারাকে পোন ধর্মীয় মরমীবাদ ও তন্ত্রের প্রভাবমুক্ত করতে। তবে অতীশ তাঁর
কদম-পা ধারায় তন্ত্রকে গুরুত্ব দিয়ে গ্রহণ করেন, বিশেষত সেই তন্ত্র যার
চর্চা তিনি করতেন সুমাত্রায় অবস্থানের সময়, যার নাম তংলেং ধ্যান।
তিব্বতীয়
বৌদ্ধমত সংস্কারে প্রধান ভূমিকা পালন করে অতীশ‘ দীপঙ্করের একটি রচনা
বোধি-পথ-প্রদীপ। এতে তিনি মাধ্যমিক মহাযান মতের সঙ্গে হীনযান ও বজ্র যানী
মতকে সঙ্গতিপূর্ণ করে তোলেন। বোধি-পথ-প্রদীপে অতীশের একটি গুরুত্বপূর্ণ
অবদান সাধকের জন্য একটি ক্রম-অগ্রসরমাণ পথ সৃষ্টি করে দেয়া। এতে বোধিচিত্ত
অর্জন থেকে শুরু করে পারমিতা ধ্যান অর্জন পর্যন্ত সাধকের জন্য ক্রমোন্নতির
একটি পথ তিনি প্রদর্শন করেন এবং এর সঙ্গে যুক্ত করেন বিভিন্ন কুশলধর্মকে।
বোধি-পথ-প্রদীপ-এ অতীশ তত্ত্বের সঙ্গে ব্যবহারিক চর্চার সমন্বয় সাধন করেন
এবং এমন একটি শিক্ষা-পদ্ধতির প্রবর্তন করেন, যার ভেতর দিয়ে ব্যক্তির মানসিক
ও নৈতিক পরিবর্তন ঘটানো যেতে পারে।
লেখক: রায়হান রাইন, অধ্যাপক, দর্শন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
No comments:
Post a Comment