Saturday, June 8, 2019

হৃদয়বিনিময়

এই যে আমার হৃদয়, এ তোমার হোক । 
এই যে তোমার হৃদয়, এ আমার হোক ।

না । কোনও সাম্প্রতিক প্রণয়কবিতার পঙক্তি নয় এটি । শত শত বছর ধরে, কতো শত বছর আমি জানি না, হিন্দুবিবাহে উচ্চারিত মন্ত্রের বঙ্গানুবাদ । যদিদং হৃদয়ং মম, তদস্তু হৃদয়ং তব; যদিদং হৃদয়ং তব, তদস্তু হৃদয়ং মম । এই হৃদয়বিনিময়ের মন্ত্রটি বিবাহ অনুষ্ঠানের কলরোল, নারীপুরুষের সম্মিলিত হাসির আওয়াজ, স্টিরিওফোনিক শব্দের অত্যাচারের ভিতর ডুবে যায় । না পাত্র, না পাত্রী, না পুরুতঠাকুর, কেউই সংস্কৃত জানেন না, জানলেও এর তাৎপর্য বুঝবার মত পরিশীলন নেই প্রায়শই তাঁদের মনে । কত বড় একটা কথা কত সহজে, কত অক্লেশে মানুষ উচ্চারণ করে, এ মন্ত্র তার উদাহরণ । মনন নেই, পরিশীলন নেই, প্রয়োগ নেই জীবনে । এ এমন এক মন্ত্র, যা অতীন্দ্রিয় কোনও তত্ত্ববিষয়ক নয়, একেবারেই মানবিক কথাগুলি, মানুষের গভীরতম অন্তর্লীন প্রার্থনা এই মন্ত্রে ভাষা পেয়েছে । 

যাকে আমি ভালোবাসি, তার সঙ্গে আমি এক হতে চাই । একত্বের প্রতি আকর্ষণ জীবকুলের সহজাত । বিচ্ছেদ সর্বদাই অনাকাঙ্খিত, আকস্মিক । বিচ্ছেদ স্বাভাবিক নয়, আরোপিত এবং স্বরচিত । সনাতন শাশ্বতধর্মে মিলনকে, ঐক্যকে স্বাভাবিক বলা হয়েছে । অপরপক্ষে বৌদ্ধধর্মে বিচ্ছেদকেই স্বাভাবিক, চতুরার্য সত্যের প্রথম সত্য বলা হয়েছে । হিন্দু ধর্মের সাথে বৌদ্ধ ধর্মের এইখানে সূক্ষ্ম প্রভেদ । হিন্দু বলবেন, না । মিলনই স্বাভাবিক, বিচ্ছেদ নয় । আর সেই মিলন মানুষের দেহে দেহে নয়, মনের সঙ্গে মনেও নয়; সে মিলন আত্মায় । আত্মা এক ও অখণ্ড । তাতে দ্বিধা নেই, দ্বৈত নেই । একত্ব তাই আত্মার স্বরূপ । আর যা স্বরূপ, তাই তো স্বাভাবিক ।

বেশ কথা । কিন্তু তা হলে মনের সঙ্গে মনের মিলনের কথা বলা হল কেন এখানে? মিলন তো আত্মায় । আর আত্মা তো মন নয়, মনের অতীত । মনের পেছনে মনের থেকে স্বতন্ত্রভাবে আত্মার অধিষ্ঠান । এখানে মনের সঙ্গে মনের মিলের কথা বলা হল --অথচ মনের সঙ্গে মনের কি মিল হতে পারে? এক মনের সঙ্গে অন্য মনের পার্থক্য আছে । দুটো মন এক হবে কী করে? আমার মন তো আমারই মন, সে মন অন্যের মনের সঙ্গে এক হতে পারে কখনও?

এই প্রশ্নটি নিয়ে নাড়াচাড়া করলেই দেখব, 'আমার মন' কথাটার মধ্যে কী পরিমাণ অহংকার লুকিয়ে আছে । এটা আমার মন, আমারই মন । এ মন আমার সম্পত্তি ! কী ভয়ঙ্কর অহংকার ! একটু নিজের মনের দিকে তাকালেই আমি বুঝব, যাকে আমি বলছি 'আমার মন', তা গড়ে উঠেছে কত মানুষের দানে, পিতামাতা বন্ধুমিত্র শিক্ষকগ্রন্থ পরিজন -- কত মানুষের চিন্তার আকলন করে কত জন্ম ধরে গড়ে উঠেছে এই মন, যাকে আমি আজ ভুল করে 'আমার' বলছি । আর যতক্ষণ এই 'আমি' আর 'আমার'-এর স্বৈরতন্ত্র চলবে, ততক্ষণ বিচ্ছেদের বিষে নীল হয়ে থাকবে না আমার স্নায়ুকোষ, আমার হৃদয়?

এ বিষ নাশ করার একমাত্র বিশল্যকরণী -- প্রেম । আর এই প্রেম এমনই এক আশ্চর্য আলোক, যা অহংকারকে গলা টিপে হত্যা করে না, তাকে বড় করে দেয় । এত বড় যে, সে মৎস্যগন্ধা থেকে পদ্মগন্ধা হয়ে যায় । ক্ষুদ্রত্বের অভিমান থেকে বিরাটত্বের আয়তিতে পৌঁছে দেয় । কিন্তু কোন্‌ কৌশলে?

প্রেম বলে, দুটো মন আলাদা, বেশ তো । কিন্তু তুমি তোমার মনটিতে, তোমার হৃদয়টিতে অন্যের অধিকার স্বীকার করে নাও । আর অন্যের হৃদয়টিকে দখল করে নাও । অন্যের হৃদয় হোক তোমারই হৃদয় । তোমার হৃদয় হোক অন্যের । দুজনার মাঝে বেড়া ভেঙে দাও । তোমার প্রিয় যেন তোমার মনের ভিতর আসতে পারে, তোমার হৃদয় হোক তারও সাম্রাজ্য । আর তুমি যেন যেতে পারো তোমার প্রিয়ের হৃদয়পুরে,  প্রিয়ের বা প্রিয়ার হৃদয় হোক তোমারও রাজ্যপাট । দুটি হৃদয় এক হোক, আর সেই একাকার হয়ে যাওয়া, কাঁটাতারহীন, বিভাজকরেখাহীন হৃদয়সাম্রাজ্যের হৃদয়েশ্বর, হৃদয়েশ্বরী হয়ে থাকো তোমরা দুজন ।

এক ভাবে দেখলে, এ শুধু বিবাহের মন্ত্র নয় । জীবনের মন্ত্র । পরিবারজীবনে, সাহিত্যজীবনে, সমাজজীবনে, রাষ্ট্রনৈতিক জীবনে সর্বত্রই এই প্রেমের মন্ত্র সমানভাবে প্রযোজ্য ।

“সংগচ্ছধ্বং সংবদধ্বং সং বো মনাংসি জানতাম্‌।
দেবাভাগং যথা পূর্বে সঞ্জানানা উপাসতে।।( ঋগ্বেদ-সংহিতা ১০।।১৯১।।২ )

-- একসঙ্গে চল,  একভাবে বলো, তোমাদের সকলের মনকে নিয়ে এক বিরাট মন সৃষ্টি ক’র।
পূর্বকালে দেবতারা যেরূপ মিলিতভাবে যজ্ঞের হবিঃ গ্রহণ করতেন, তোমরাও তদ্রূপ মিলিতভাবে জগতের যাবতীয় সম্পদ ব্যবহার ক’র।

"সমানো মন্ত্রঃ সমিতিঃ সমানী সমানাং মনঃ সহ চিত্তমেষাম্। ( ঋগ্বেদ-সংহিতা ১০।।১৯১।।৩ )
-- তোমাদের মন্ত্র এক হোক, সঙ্কল্প এক হোক । এক হোক তোমাদের মন ।

আর এই একত্বের প্রার্থনাই তো প্রেমের সারনিষ্কর্ষ ।

লেখক: সন্মাত্রানন্দ
লেখক (পশ্চিমবঙ্গ)

No comments:

Post a Comment

জয়দেব মুখোপাধ্যায় : চৈতন্য মৃত্যুরহস্যের কিনারা করতে গিয়ে প্রাণ দিয়েছিলেন যে গবেষক

জয়দেব মুখোপাধ্যায়ের যেন এক কিংবদন্তির নাম যার কথা অনেকেই শুনেছে , বহু মানুষই তাকে খুঁজে ফেরে কিন্ত তার ব্যাপারে বিশদে কেউ কিছু বলতে পারেনা...