Showing posts with label সন্মাত্রানন্দ. Show all posts
Showing posts with label সন্মাত্রানন্দ. Show all posts

Monday, June 17, 2019

ঘর কোথায়!

সারাদিন এ পথে ও পথে এ পাড়ায় ও পাড়ায় ঘুরে ঘুরে দানাপানির জোগাড় করতে করতে রাত হয়। পথের পাশে কুপি জ্বেলে বসে থাকে সবজিওয়ালারা, ফুল আর মালার পসরা সাজিয়ে রাতের পসারিনী, হাইওয়ে দিয়ে সারি সারি মালভর্তি ট্রাক কোথায় যেন যায় সারারাত ধরে। মনে হয়, রাত হল, ঘরে যাই।
ভাবি, কোথায় আমার সেই ঘর? কোথাও তো নেই। আকৈশোর ঘরছাড়া, ভবঘুরেগিরি করেই জীবন কাটল। কতো জায়গায় যে থেকেছি, কতো জায়গায় যে ঘুমিয়েছি মঠে, মন্দিরে, আশ্রমে, পথে, গৃহস্থের ঘরে, খোলা ছাদে কোথায় নয়। তার পরেও যেখানে যখন রাতে ফিরি তখন সেই জায়গাকেই ঘর মনে হয়। কিন্তু তাকে ঘর কি আর বলা চলে?
রাস্তা দিয়ে ফিরতে ফিরতে দেখি কোনো এক বাড়ির আলো ঝলমলে জানালা, খাওয়ার টেবিলে এসে বসেছে সে বাড়ির মানুষজন। স্বামী, স্ত্রী, ছেলে, মেয়ে, ছেলের বৌ। হৈ হৈ ব্যাপার। তারা রাতের খাবার খেতে খেতে গল্প করছে, হাসছে, মজা করছে। দূর থেকে দেখতে বেশ লাগে তাদের এই সুখের পৃথিবীর খণ্ড মুহূর্ত। ভাবি, যদি এই সুখ চিরস্থায়ী হত!
ওই পুরুষটি তার স্ত্রীকে ঘিরে যে স্বপ্ন দেখেছিল, তা কি মিলে গেছে পুরোপুরি? সবটা নয়। স্ত্রী যে স্বপ্ন দেখেছিল তার স্বামীকে নিয়ে, কিংবা মা-বাবা যে স্বপ্ন দেখেছে তাদের ছেলেমেয়েদের নিয়ে, তার ছিটেফোঁটাও কি মিলবে বাস্তবের সঙ্গে? অল্প একটু মিলবে, বাকি অনেকটাই অধরা থেকে যাবে। মানুষের স্বপ্ন বড় ব্যক্তিগত, বাস্তবের সঙ্গে সেই স্বপ্নের সচরাচর দেখা হয় না। সারা জীবন পাশাপাশি থেকেও দুজন মানুষ একে অপরের কাছে অচেনা থেকে যায়। যে এই কথার বিরোধিতা করে, সে হয় মিথ্যাবাদী, নয় মোহগ্রস্ত। সকলেই সকলের কাছে শেষাবধি অচেনা।
অচেনা, অপরিচিত মানুষ সব...কেউ স্বামী-স্ত্রী, কেউ সন্তানসন্ততি সেজে ডাইনিং টেবিলে কয়েক মুহূর্তের জন্য খেতে বসেছে, আনন্দ করছে, হাসছে। কেউ কারুর নয়, তবুও। এখানে আচমকাই সব দেখা, কিছুদিন একসাথে থাকা, তারপর চলে যাওয়া যে যার পথে। এই একসঙ্গে থাকাটার নামই ঘর? 'ঘর' শব্দটির মধ্যে এই অভিপ্রায় তো ছিল না। নিশ্চিন্ত, পরম, অচ্ছেদ্য ভালবাসার নীড়কেই তো আশা করেছে মানুষ 'ঘর' শব্দটি উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে। কিন্তু এ কেমন ঘর? একদল অপরিচিত মানুষের সঙ্গে একজীবন থাকাথাকি, এই-ই ঘর? আর তা ছাড়া সত্যিকারের ঘর কোথায় এই পৃথিবীতে, যেখানে ব্যক্তিমানুষের স্বপ্ন সাকার হয়ে বিরাজ করে? দেয় চিরস্থায়িত্বের নিশ্চিন্ত আশ্বাস?
ভাল লাগছে না তো? ভাল লাগবেই বা কেন? অপ্রিয় সত্য কার ভাল লাগে, বলুন? থাক ওসব কথা। চলুন, দেড়শো বছর আগের একটা গল্প বলি।
এ শহরেরই উত্তর প্রান্তে গঙ্গাঘেঁষা কোনো এক অঞ্চলে জন্মেছিলেন এক অন্যরকম মানুষ। নাম তাঁর হরিনাথ। যুবাবয়সে অত্যন্ত বলিষ্ঠ ছিলেন তিনি। এক হাজার বুকডন দিতে পারতেন। সাঁতরে গঙ্গা এপার ওপার করা তাঁর কাছে ছেলেখেলা ছিল। শৈশবেই পিতৃমাতৃহীন। দাদা-বৌদির কাছে মানুষ। ব্রাহ্মণ যুবক। গম্ভীর প্রকৃতির। একবেলা স্বপাক হবিষ্যান্ন আহার করতেন। সংস্কৃত ভাষায় অসামান্য অধিকার। বেদান্তশাস্ত্রের পঠনপাঠনে অতিশয় মনোযোগ ছিল হরিনাথের।
তারপর বহুদিন কেটে গেছে। দক্ষিণেশ্বরের এক সাধুর কাছে যাতায়াত ছিল। তাঁর কাছ থেকেই ধর্মজীবনের দিশা পেয়েছিলেন। পেয়েছিলেন ত্যাগ ও প্রেমের অনুপম আদর্শ, শাস্ত্রে যার আভাসটুকু মাত্র আছে।
গুরুদেবের মহাসমাধির পর ত্যাগব্রতী গুরুভ্রাতারা একসঙ্গে থাকতে শুরু করেছিলেন বরানগরের একটা জীর্ণ বাড়িতে। সকলেই প্রায় যুবক। নরেন, রাখাল, তারক, শশী, হরিনাথ, নিরঞ্জন...। সেই তাঁদের প্রথম মঠ। যথাসময়ে সন্ন্যাস নিলেন তাঁরা। হরিনাথ হলেন তুরীয়ানন্দ।
কয়েক মাস থাকবার পর হরিনাথের এই মঠে আটকে থাকা ভাল লাগল না। একদিন কাউকে কিছু না বলে বেরিয়ে পড়লেন পথে। মাঝে মাঝে বরানগরে খবর আসত তাঁর। তারপর আর কোনো খবর নেই। বরানগরের সাধুভাইয়েরা-- তাঁরাও একে একে বেরিয়ে পড়লেন অনিকেত যাত্রায়। কেউ কারুর খবর পেতেন না আর। কখনও এর ওর সঙ্গে দেখা হয়ে যেত পথের বাঁকে। কিন্তু হরিনাথের খবর খুব কমজনই পেতেন। অনেকে ধরে নিলেন, হরিনাথ মারা গেছেন।
হরিনাথ কিন্তু তখন গঙ্গোত্রীতে। একা। দুটি বহির্বাস, কম্বল একটা, একটি কমণ্ডলু, কটা বই। আর কিছু নেই। ঘুরতে ঘুরতে এ বিজন স্থানে এসে পড়েছেন। একটি পরিত্যক্ত গুহা পাওয়া গেল। এখানেই থাকতে শুরু করলেন। অনেক নীচে একটা ছত্র আছে। সপ্তাহে দুদিন সেখান থেকে ভিক্ষা করে নিয়ে আসেন। তাতেই চলে যায়। দিনের বেশিরভাগ সময় ধ্যানধারণা ও শাস্ত্রাধ্যয়নে ডুবে থাকেন। এইভাবে জীবনের কতো কতো নিমগ্ন বছর চলে গেল।
একটু রাত হলে গঙ্গার ধারে এসে বসেন। কনকনে হাড়হিম ঠান্ডা। ঘোর অন্ধকার রাত্রি, নিঃশব্দ চরাচর, শুধু গঙ্গার নিরবধি স্রোতোধ্বনি। সেই নীরব নিশীথের প্রহর জুড়ে হরিনাথ অন্তর্বহিঃশূন্য অনুভবে মগ্ন হয়ে থাকেন। কখনও কখনও ধ্যান ছেড়ে নিশ্চুপে অন্ধকারে উদাস হয়ে বসে থাকেন। প্রহরের পর প্রহর কেটে যায়।
রাত গাঢ়তর হলে ধীরে ধীরে গুহায় ফিরে আসেন হরিনাথ।
এক রাত্রে এরকম গঙ্গাতীরে বসে থাকতে থাকতে মনে হল, বড্ড শীত লাগছে। গুহায় ফিরে যাবেন। অন্যমনস্কভাবে নিজেকেই বলে উঠলেন, রাত হল। ঘরে চলো।
অমনই সম্বিত ফিরে এল। এ আমি কী বললাম? ঘরে চলো? ঘর? আমার আবার ঘর কোথায়? কোন সুদূর কৈশোরে ঘর ছেড়েছি...এখন আবার ঘর? এখনও ঘর? হায় হায়! এখনও আমার গৃহসংস্কার রয়ে গেছে?
ভয়ানক আত্মক্ষোভ হল তাঁর। দ্রুতপদে গুহাতে ফিরে ধ্যানে বসলেন। অবিরত বিচার, ধ্যান, তপশ্চর্যায় নিরত থেকে ছয় মাসের চেষ্টায় মনের অবচেতনা থেকে ঘর, ঘরের স্বপ্ন, ঘরের ধারণা, ঘরের স্মৃতিকে ঘষে ঘষে মুছে তুলে দিলেন। ছয়মাস পর একদিন সানন্দে বলে উঠলেন, নাহ, আমার মনে আর ঘর নেই। আমি যথার্থই অনিকেত হয়েছি!
এই জীবন আসলে একটা সেতু। সেতুর উপরে কেউ ঘর বানায়? সেতু বেয়ে পার হয়ে চলে যেতে হয় শুধু। আর কিছু নয়।

লেখক: সন্মাত্রানন্দ

Saturday, June 8, 2019

হৃদয়বিনিময়

এই যে আমার হৃদয়, এ তোমার হোক । 
এই যে তোমার হৃদয়, এ আমার হোক ।

না । কোনও সাম্প্রতিক প্রণয়কবিতার পঙক্তি নয় এটি । শত শত বছর ধরে, কতো শত বছর আমি জানি না, হিন্দুবিবাহে উচ্চারিত মন্ত্রের বঙ্গানুবাদ । যদিদং হৃদয়ং মম, তদস্তু হৃদয়ং তব; যদিদং হৃদয়ং তব, তদস্তু হৃদয়ং মম । এই হৃদয়বিনিময়ের মন্ত্রটি বিবাহ অনুষ্ঠানের কলরোল, নারীপুরুষের সম্মিলিত হাসির আওয়াজ, স্টিরিওফোনিক শব্দের অত্যাচারের ভিতর ডুবে যায় । না পাত্র, না পাত্রী, না পুরুতঠাকুর, কেউই সংস্কৃত জানেন না, জানলেও এর তাৎপর্য বুঝবার মত পরিশীলন নেই প্রায়শই তাঁদের মনে । কত বড় একটা কথা কত সহজে, কত অক্লেশে মানুষ উচ্চারণ করে, এ মন্ত্র তার উদাহরণ । মনন নেই, পরিশীলন নেই, প্রয়োগ নেই জীবনে । এ এমন এক মন্ত্র, যা অতীন্দ্রিয় কোনও তত্ত্ববিষয়ক নয়, একেবারেই মানবিক কথাগুলি, মানুষের গভীরতম অন্তর্লীন প্রার্থনা এই মন্ত্রে ভাষা পেয়েছে । 

যাকে আমি ভালোবাসি, তার সঙ্গে আমি এক হতে চাই । একত্বের প্রতি আকর্ষণ জীবকুলের সহজাত । বিচ্ছেদ সর্বদাই অনাকাঙ্খিত, আকস্মিক । বিচ্ছেদ স্বাভাবিক নয়, আরোপিত এবং স্বরচিত । সনাতন শাশ্বতধর্মে মিলনকে, ঐক্যকে স্বাভাবিক বলা হয়েছে । অপরপক্ষে বৌদ্ধধর্মে বিচ্ছেদকেই স্বাভাবিক, চতুরার্য সত্যের প্রথম সত্য বলা হয়েছে । হিন্দু ধর্মের সাথে বৌদ্ধ ধর্মের এইখানে সূক্ষ্ম প্রভেদ । হিন্দু বলবেন, না । মিলনই স্বাভাবিক, বিচ্ছেদ নয় । আর সেই মিলন মানুষের দেহে দেহে নয়, মনের সঙ্গে মনেও নয়; সে মিলন আত্মায় । আত্মা এক ও অখণ্ড । তাতে দ্বিধা নেই, দ্বৈত নেই । একত্ব তাই আত্মার স্বরূপ । আর যা স্বরূপ, তাই তো স্বাভাবিক ।

বেশ কথা । কিন্তু তা হলে মনের সঙ্গে মনের মিলনের কথা বলা হল কেন এখানে? মিলন তো আত্মায় । আর আত্মা তো মন নয়, মনের অতীত । মনের পেছনে মনের থেকে স্বতন্ত্রভাবে আত্মার অধিষ্ঠান । এখানে মনের সঙ্গে মনের মিলের কথা বলা হল --অথচ মনের সঙ্গে মনের কি মিল হতে পারে? এক মনের সঙ্গে অন্য মনের পার্থক্য আছে । দুটো মন এক হবে কী করে? আমার মন তো আমারই মন, সে মন অন্যের মনের সঙ্গে এক হতে পারে কখনও?

এই প্রশ্নটি নিয়ে নাড়াচাড়া করলেই দেখব, 'আমার মন' কথাটার মধ্যে কী পরিমাণ অহংকার লুকিয়ে আছে । এটা আমার মন, আমারই মন । এ মন আমার সম্পত্তি ! কী ভয়ঙ্কর অহংকার ! একটু নিজের মনের দিকে তাকালেই আমি বুঝব, যাকে আমি বলছি 'আমার মন', তা গড়ে উঠেছে কত মানুষের দানে, পিতামাতা বন্ধুমিত্র শিক্ষকগ্রন্থ পরিজন -- কত মানুষের চিন্তার আকলন করে কত জন্ম ধরে গড়ে উঠেছে এই মন, যাকে আমি আজ ভুল করে 'আমার' বলছি । আর যতক্ষণ এই 'আমি' আর 'আমার'-এর স্বৈরতন্ত্র চলবে, ততক্ষণ বিচ্ছেদের বিষে নীল হয়ে থাকবে না আমার স্নায়ুকোষ, আমার হৃদয়?

এ বিষ নাশ করার একমাত্র বিশল্যকরণী -- প্রেম । আর এই প্রেম এমনই এক আশ্চর্য আলোক, যা অহংকারকে গলা টিপে হত্যা করে না, তাকে বড় করে দেয় । এত বড় যে, সে মৎস্যগন্ধা থেকে পদ্মগন্ধা হয়ে যায় । ক্ষুদ্রত্বের অভিমান থেকে বিরাটত্বের আয়তিতে পৌঁছে দেয় । কিন্তু কোন্‌ কৌশলে?

প্রেম বলে, দুটো মন আলাদা, বেশ তো । কিন্তু তুমি তোমার মনটিতে, তোমার হৃদয়টিতে অন্যের অধিকার স্বীকার করে নাও । আর অন্যের হৃদয়টিকে দখল করে নাও । অন্যের হৃদয় হোক তোমারই হৃদয় । তোমার হৃদয় হোক অন্যের । দুজনার মাঝে বেড়া ভেঙে দাও । তোমার প্রিয় যেন তোমার মনের ভিতর আসতে পারে, তোমার হৃদয় হোক তারও সাম্রাজ্য । আর তুমি যেন যেতে পারো তোমার প্রিয়ের হৃদয়পুরে,  প্রিয়ের বা প্রিয়ার হৃদয় হোক তোমারও রাজ্যপাট । দুটি হৃদয় এক হোক, আর সেই একাকার হয়ে যাওয়া, কাঁটাতারহীন, বিভাজকরেখাহীন হৃদয়সাম্রাজ্যের হৃদয়েশ্বর, হৃদয়েশ্বরী হয়ে থাকো তোমরা দুজন ।

এক ভাবে দেখলে, এ শুধু বিবাহের মন্ত্র নয় । জীবনের মন্ত্র । পরিবারজীবনে, সাহিত্যজীবনে, সমাজজীবনে, রাষ্ট্রনৈতিক জীবনে সর্বত্রই এই প্রেমের মন্ত্র সমানভাবে প্রযোজ্য ।

“সংগচ্ছধ্বং সংবদধ্বং সং বো মনাংসি জানতাম্‌।
দেবাভাগং যথা পূর্বে সঞ্জানানা উপাসতে।।( ঋগ্বেদ-সংহিতা ১০।।১৯১।।২ )

-- একসঙ্গে চল,  একভাবে বলো, তোমাদের সকলের মনকে নিয়ে এক বিরাট মন সৃষ্টি ক’র।
পূর্বকালে দেবতারা যেরূপ মিলিতভাবে যজ্ঞের হবিঃ গ্রহণ করতেন, তোমরাও তদ্রূপ মিলিতভাবে জগতের যাবতীয় সম্পদ ব্যবহার ক’র।

"সমানো মন্ত্রঃ সমিতিঃ সমানী সমানাং মনঃ সহ চিত্তমেষাম্। ( ঋগ্বেদ-সংহিতা ১০।।১৯১।।৩ )
-- তোমাদের মন্ত্র এক হোক, সঙ্কল্প এক হোক । এক হোক তোমাদের মন ।

আর এই একত্বের প্রার্থনাই তো প্রেমের সারনিষ্কর্ষ ।

লেখক: সন্মাত্রানন্দ
লেখক (পশ্চিমবঙ্গ)

জয়দেব মুখোপাধ্যায় : চৈতন্য মৃত্যুরহস্যের কিনারা করতে গিয়ে প্রাণ দিয়েছিলেন যে গবেষক

জয়দেব মুখোপাধ্যায়ের যেন এক কিংবদন্তির নাম যার কথা অনেকেই শুনেছে , বহু মানুষই তাকে খুঁজে ফেরে কিন্ত তার ব্যাপারে বিশদে কেউ কিছু বলতে পারেনা...