বিদ্যা-বুদ্ধিতে ঘাটতি থাকা সত্ত্বেও বলছি, ধর্মবিশ্বাসী তো বটেই, বড় হয়ে যারা নিজেদের জ্ঞান্তবুদ্ধি দিয়ে ধর্মের
অসারতা বুঝতে পেরেছে, তারাসহ প্রায় প্রতিটি মানুষই কমবেশি সাম্প্রদায়িক। কারণ ছেলেবেলা আমরা সর্বপ্রথম যে
জ্ঞানার্জন করি, তার নাম ধর্ম। মুখে বুলি ফোটার আগে, মাতৃভাষা উচ্চারণ ঠিকভাবে শোখার আগেই ধর্ম শিখি। অথচ ধর্মের মধ্যেই যে সাম্প্রদায়িকতার বীজ, তা বুঝি না, জানি না, পরবর্তীতে কেউ কেউ বুঝলেও ধর্ম, সমাজ এবং রাষ্ট্রের দাপটে, তা স্বীকার করি না। ধর্ম যদি সাম্প্রদায়িক না-ই হবে, এক ধর্ম যদি অন্য ধর্মকে সম্মানই করবে, ভালোবাসবে, শ্রদ্ধা করবে, তাহলে কী করে এতো ধর্মের সৃষ্টি হলো? অর্থাৎ এক ধর্ম অন্য ধর্মকে আঘাত করে, দোষারোপ করে, খারাপ, এমনকি জঘন্য-ঘৃণ্য… প্রমাণ করেই তো নতুন নতুন ধর্ম সৃষ্টি করেছে। যদি দ্বিতীয় ধর্মটি সৃষ্টির সময় এর সৃষ্টিকর্তা পূর্বের ধর্মেকে খারাপ বা জঘন্য বা ঘৃণ্য ইত্যাদি প্রমাণ করতে না-ই পারতো, তাহলে কী প্রথম ধর্মটির অনুসারীরা দ্বিতীয় ধর্মটি গ্রহণ করতো? প্রশ্নই ওঠে না। পূর্বেরটার চেয়ে নতুনটা ভালো প্রমাণ করতে প্রতিটি ধর্মই পূর্বের ধর্মগুলোকে যে যতো পেরেছ আঘাত করেছে, দোষ দিয়েছে, এমনকি সাধারণ, অসাধারণ সব মানুষের মনেই প্রচণ্ড ঘৃণার সৃষ্টি করতে হয়েছে। যে ঘৃণার জাল ছিঁড়ে সম্পূর্ণরূপে বেরিয়ে আসা বাঙালির সংখ্যা হাতে গোনা। নতুন ধর্ম সৃষ্টিকারীরা শুধু ঘৃণা ছড়িয়েই ক্ষান্ত হয়নি, খুন করেছে, যুদ্ধ করেছে, যুদ্ধবন্দি হিসেবে কঠোর শাস্তি দিয়ে নতুন ধর্ম গ্রহণের বাধ্য করেছে, ধর্ষণ করেছে, দাস্তদাসী বনিয়েছে, যুদ্ধের মতো নিকৃষ্ট একটি ব্যবস্থাকে চিরস্থায়ীভাবে বৈধতা দিয়েছে… (ব্যতিক্রম যে নেই তা নয়, তবে ঘৃণা, হিংসা, বিদ্বেষ এসবই বেশি ছিলো, যা এখনো আছে, ধর্মগুলো ধ্বংস না হওয়া পর্যন্ত চিরকালই থাকবে)। অতএব কম আর বেশি, ধর্ম পালনকারীরা সবাই সাম্প্রদায়িক। হয়তো কারো মনে এটি সুপ্ত, কেউ সহজে উত্তপ্ত হয় না, অধিকাংশই অতি সামান্যতেই উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। এছাড়া কোনোদিন কী শুনেছেন, একটি ধর্ম অন্য একটি ধর্মকে প্রশংসা করছে? শুনেছেন, নিজের ধর্মের চেয়ে কেউ অন্য ধর্মকে বেশি শ্রদ্ধা করে (ভালো হলেও)…? একটি ধর্মের ভালো দিকগুলোকেও অন্য একটি ধর্ম মেনে নেয় না, প্রশংসা করে না, অথচ খারাপ দিকগুলো নিয়েই যতো পারে কুৎসা রটায়, বানিয়ে বানিয়ে গল্পকারে তা ব্যাখ্যা করে… এবং এটা সর্বত্রই, পার্থক্য হলো- কেউ করে প্রকাশ্যে, কেউ গোপনে। অথচ ৫৭ ধারা শুধু ব্লগারদের বেলায় ওদের বেলায় নয়, কেনো? অতএব ধর্ম যখন সাম্প্রদায়িক, তখন প্রায় শতভাগ ধার্মিকদের এই দেশের মানুষ কীভাবে অসাম্প্রদায়িকতা হয়, এ বোকার বোধগম্য নয়। সুতরাং সম্পূর্ণরূপে ধর্মের বেড়াজাল থেকে মুক্ত না হতে পারলে, তিনি অসাম্প্রদায়িক হতে পারেন না।
মনের মধ্যে ধর্মের প্রতি সামান্য একটু টান থাকলেও সম্ভব না, কারণ ছেলেবেলার ওই শিক্ষার বাইরে যেতে অবচেতন মন বারবার বাধা দেবেই। ধর্ম এমন এক মারাত্মক এবং অদ্বিতীয় ভাইরাস, যা অধিকাংশ ধার্মিকের মনে নয়, মগজে থাকে। যারা কম ধার্মিক বা তথাকথিত মডারেট তাদের মগজে না থাকলেও, মনের মধ্যে থাকে। মানুষের মগজ এবং মননই এর প্রধান খাদ্য। অন্য ভারাইসগুলো তা নয়। এ এমনই মারাত্মক ভাইরাস, যা বংশগতই শুধু নয় স্বভাবজাতও বটে। যার কোনো প্রতিকার নেই, কোনো ওষুধ নেই, আছে শুধু মলম। ধর্মীয় সমপ্রতী রক্ষার জন্য মাঝে মাঝেই বিজ্ঞজনেরা আন্তঃধর্মীয় সম্মেলন করেন, যা মলমের মতো এক-আধটু উপশম দেয়। অতএব, ধর্ম এবং ধর্মপ্রতিষ্ঠানগুলো সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস না করে কীভাবে ধর্মীয় সমপ্রীতি রক্ষা করা সম্ভব? একদিকে মলম লাগাবেন, অন্যদিকে ক্যান্সারের বিষ ঢোকাবেন (যা চলছে হরদম), এ কেমন খেলা? এরূপ বিষাক্ত, অপ্রতিরোধ্য ভাইরাসটিকে দমন করার সুস্পষ্ট পরিকল্পনা বা প্রচেষ্টা কোনোটাই বিশ্ববাসীর নেই। বিশ্বের প্রায় সবাই বলেন ধর্ম, বর্ণ, জাতি-গোষ্ঠি নিয়ে সমালোচনা করা উচিত নয়, তারা এগুলোকে বৈষম্যের মধ্যে ফেলেন। তবে বর্ণ, জাতি-গোষ্ঠি এসব নিয়ে কুটুক্তি করা বৈষম্য হলেও, ধর্ম নিয়ে কুটুক্তি করা কীভাবে বৈষম্যের মধ্যে পড়ে?
কারণ ধর্ম নিজেই তো বৈষম্যের আতুরঘর এবং সর্বোচ্চ শিখর। কারণ প্রতিটি ধর্মই অন্য ধর্মকে নগ্নভাবে বৈষম্য করে। অতএব, ধর্ম সমালোচনায় কোনো অপরাধ হতে পারে না। যারা এসব বলেন, তারা ভন্ড, প্রতারক, মতলবাজ, স্বার্থপর…। ধর্ম বা সামপ্রদায়িকতা কী কঠিন, মারাত্মক, অপ্রতিরোধ্য, চিরঞ্জীবি… ভাইরাস এর উদাহরণ প্রতিদিন দেখছি ও শুনছি। এমনকি একই ধর্মালম্বীরাও নিরন্তন খুনাখুনিতে লিপ্ত। ধর্মশিক্ষা কতোটা বৈষম্যের, কতোটা ভয়ংকর, কতোটা সামপ্রদায়িক হলে নিজেদের জন্মদাত্রীকে পর্যন্ত খুন করতে পারে? কতোটা উলঙ্গ হলে (অনার কিলিং-এর নামে) পিতা-মাতারা আপন সন্তানকে হত্যা করতে পারে? এর প্রচুর উদাহরণের মধ্যে একটি দেখুন:- “মাকে কুপিয়ে খুন করল দুই আইএস জঙ্গি ভাই! …যমজ দুই ভাই তাদের বাবা-মা এবং ভাইয়ের উপর হামলা চালায়। প্রথমে ভাইকে ধাওয়া করে ছাদে নিয়ে যায়। সেখানে ধারাল অস্ত্র দিয়ে তাকে একাধিক বার কোপানো হয়। …এর পর মাকে কুপিয়ে হত্যা করে। বাধা দিতে গেলে বাবাকেও জখম করে। …বহু দিন ধরেই তারা আইএসের মতাদর্শে বিশ্বাসী। …বছরখানেক আগেও রিয়াধে এইরকমই একটি হত্যার ঘটনা ঘটেছিল। সে বারও দুই ভাই প্রথমে তাদের অন্য এক ভাইকে হত্যা করে। বাধা দিতে গেলে আরও তিন জনকে খুন করে তারা।” আনন্দবাজার (২৫ জুন/১৬)। এবার বলুন, ধর্মীয় সন্ত্রাবাদের প্রধান শিকড়টি কোথায়! এরা সরাসরি আইএস যোদ্ধা নয়, সমর্থক মাত্র। এরপরও কী বলবেন, ধর্মে সামপ্রদায়িকতা এবং সন্ত্রাসবাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় নেই? কোনো হিংস্র জানোয়ারকে দেখেছেন কী, নিজের বাচ্চা মেরে ফেলে অথবা বাচ্চারা জন্মদাত্রীকে মেরে ফেলে? অথচ সর্বশ্রেষ্ঠ জীবেরাই এটা করে (যদিও কতিপয়)! কারণ, সর্বনাশ মহাশক্তিশালী ওই ভারাস যাদের মগজে বাস করে তারাই কেবল আত্মজকে এভাবে খুন করতে পারে। ভাইরাসটি যাদের মনে বাস করে, তারা খুন না করলেও নানারূপ বিদ্রুপ করে, ভয়ভীতি দেখায়, মারধোর এবং কড়া শাসন করে, মামলা-মোকদ্দমা করে, কখনো কখনো ভাড়াটে খুনি দিয়ে খুনও করায়…। কিন্তু পশুর মজগে ও মননে ধর্ম নামক কোনো ভাইরাস নেই, তাই তারা এসব করে না। ধর্ম নিজেই যখন সাম্প্রদায়িক, তখন ধর্মবিশ্বাসী মানুষ কী করে অসাম্প্রদায়িক হয়? ধর্ম মানুষের মনোজগতকে যেভাবে আচ্ছন্ন করে রাখে, অন্য কোন মতবাদ বা দর্শন তেমনটা আচ্ছন্ন করতে পারে কী? এছাড়া, ধর্মীয় সন্ত্রাস যে কোনো সন্ত্রাসের চাইতে হাজারগুণ মারাত্মক, যা আলোর গতির চেয়েও বেশি গতিসম্পন্ন। জানি না, ধর্মকে আঘাত না করে, মনোজগতকে পরিবর্তন না করে, কীভাবে ধর্মীয় সন্ত্রাস বা সাম্প্রদায়িকতা দমন সম্ভব? আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে বুঝি, এটা সম্পূর্ণরূপে অসম্ভব। কারণ যা স্বভাবজাত তাতে সামান্য আঘাত লাগলেই মানুষ চরম উত্তেজিত হয়ে পড়ে এবং এ সুযোগকে কাজে লাগাতে কিছু ধার্মিকরা (নাস্তিকরা নয়) সব সময়ই প্রস্তত থাকে। কারণ স্বভাবজাত অভ্যেসগুলো মনোগজতকে ছেলেবেলা থেকেই এমনভাবে আচ্ছন্ন করে রাখে যে ইহজীবনেও সেখান থেকে কমপক্ষে ৯০%ই আর ফিরতে পারে না। এমনকি যারা নিজেদের অধার্মিক বা ধর্মহীন বলে দাবি করেন, তারাও পিতৃধর্মের প্রতি কিছুটা হলেও দুর্বল থাক।
শিশুর যেমন আতুর ঘর আছে, সাম্প্রদায়িকতারও আছে। সাম্প্রদায়িকতা মূলত আতুর ঘরে প্রতিটি শিশুর সাথেই জন্ম
নেয় এবং বেড়ে ওঠে প্রথমত পরিবার, পরে সমাজ এবং ধর্মজীবিদের পৃষ্ঠপোষকতায়।
পরবর্তীতে যা রাষ্ট্র ছাড়িয়ে সারা বিশ্বে বিস্তার লাভ করে। ধর্মজীবিদের
সাম্প্রদায়িকতা জ্বলন্তই থাকে, মাঝে মধ্যে শুধু উষ্কে দেয়। অন্যদিকে
বেশিরভাগ সাধারণ ধার্মিকদের মনেও এটা তুষের আগুনের ন্যায় থাকে, যখন ধর্মজীবিরা বরুদ ছিটায় তখন আগ্নেয়গিরির সৃষ্টি করে।
সাম্প্রদায়িকতার জন্য প্রথমত ও প্রধানত দায়ী পারিবারিক, সামাজিক এবং ধর্মপ্রতিষ্ঠানগুলোর প্রাথমিক ধর্মশিক্ষা। কারণ সর্বপ্রথম শিশুর সাদা মগজে যে শব্দগুলো লেখা হয় তা ধর্মীয় বাণী বা ধর্মশিক্ষা, যা পরিবর্তন, পরিমার্জন, সংশোধন… সর্বোপরি বন্ধ না করে মানুষের মন থেকে সাম্প্রদায়িকতা দূর করবেন কীভাবে? যুগ যুগান্তরের এ শিক্ষাই তো সাম্প্রদায়িকতার প্রধান উৎস। অথচ এখানে কেউ হাত দিতে সাহস পাচ্ছেন না। অতএব তথাকথিত ক্রসফায়ার, জেল-জরিমানাসহ যে কোনো আইন প্রয়োগ হোক না কেনো, ধর্মকে আঘাত না করে, নিরাপদে রেখে আর যাইহোক, সাম্প্রদায়িকতা বন্ধ অসম্ভব। কারণ হাজার হাজার বছরের গোড়ামিপূর্ণ ধর্মশিক্ষা বহু আগেই ক্রোনিক ডিজিজে পরিণত হয়েছে। স্বীকার করুন আর না-ই করুন, …আমার ধর্মই সর্বশ্রেষ্ঠ, আমিই সর্বশ্রেষ্ঠ ঈশ্বরের অনুসারী, অন্যরা নয়, তার ভ্রান্ত, পাপী, নারকী, ঘৃণ্য, অস্পৃশ্য, শয়তানের উপাসক… ছেলেবেলার এসব শিক্ষা কে না পেয়েছে? এরূপ শিক্ষায় আমাদের প্রত্যেকের কী হাতেখড়ি হয়নি? অতএব ধর্মশিক্ষার পীঠস্থান পরিবার, সামাজ ও ধর্মালয় থেকে এরূপ শিক্ষা দূরীভূত না করে, সাম্প্রদায়িকতা নির্মূল আর সোনার পাথর বাটি- এক কথা। এ মরণব্যাধি ক্যান্সার থেকে মুক্তি পেতে মলম লাগালে চলবে না, প্রয়োজন কেমো থেরাপি।
অথচ সকলেই মলম দিচ্ছেন!
লেখক: স্নেহাংশু বিশ্বাস
প্রভাষক, রসায়ন, তালুকদার হাট স্কুল ও কলেজ, সাধারণ সম্পাদক, উদীচী বরিশাল
No comments:
Post a Comment