এক.
শিক্ষাজীবনে কাজী কাদের নেওয়াজ-এর লেখা ‘শিক্ষাগুরুর মর্যাদা’ কবিতাটি পড়েননি বা জানেন না এমন লোক খুঁজে পাওয়া যাবে না। যেখানে রাজকুমারকে একজন গৃহশিক্ষক কর্তৃক পাঠদান ও মূল্যবোধ তৈরির এক অসাধারণ আলেখ্য চিত্রিত হয়েছে। অন্য হাজারও দৃষ্টান্তের মতো এখানেও প্রমাণ পাওয়া যায় যে, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি গৃহে আলাদা শিক্ষক দ্বারা শিক্ষার্থীদের বাড়তি কিছু শিখানোর প্রথা অতিপ্রাচীনকাল থেকেই প্রচলিত ছিল। তাহলে এখন দোষ কোথায়? কয়েকবছর ধরে দেখছি, অযৌক্তিকভাবে প্রশাসনের বিভিন্ন বাহিনীকে শিক্ষকদের উপরে লেলিয়ে দেওয়া হচ্ছে। গৃহে শিক্ষাদান কিংবা শিক্ষার্থীদের বাড়তি সময়ে পাঠদানের অপরাধে শিক্ষদের টেনেহিঁচড়ে বের করে, হাতকড়া পরিয়ে, জরিমানা করে ছাত্র-ছাত্রীদের সামনেই অপমান-অপদস্থ করা হচ্ছে। এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি করা হচ্ছে যেন, শিক্ষকতা করাটাই অপরাধ। মেধা খাটিয়ে, পরিশ্রম করে, শিক্ষার্থী তথা সমাজকে জ্ঞানার্জনে সাহায্য করে কয়েকটি বৈধ পয়সা রোজগার করে শিক্ষকদের সংসার চালানোর এই পবিত্র সংগ্রামকে একটি মহল ‘বানিজ্য’ বলে সাড়ম্বরে প্রচার করছে। আমি অস্বীকার করছিনা যে কেউ কেউ সত্যিই বানিজ্য করে। আমি স্বীকার করছি, কিছু কিছু নামধারী তথাকথিত শিক্ষক প্লে-নার্সারী থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় লেভেল পর্যন্ত অর্থ ও কামনার লোভ সংবরণ করতে না পেরে বিভিন্নভাবে শিক্ষার্থীদের হয়রানি করে। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, এদেশে এহেন অপকর্মের মাত্রা ইদানিং এত চরমে গিয়ে পৌছেছে যে, নিজেকে শিক্ষক বলে পরিচয় দিতে গর্ববোধের চেয়ে কুণ্ঠাবোধ বেশি হয়। তবে হ্যাঁ, এমন শিক্ষকও সমাজে ঢের আছেন যে, তাঁদের দেখলে মাথা অবচেতন মনেই নত হয়ে যায়। যারা প্রকৃত শিক্ষক হিসেবে সমাজে দৃষ্টান্ত স্বরূপ-এমন সংখ্যা এখনও অনেক অনেক বেশি। তাহলে কেন সবাইকেই ঐরূপ রুচিহীন মানদন্ডে দন্ডিত করা হবে??
দুই.
আমরাই মনে হয় পৃথিবীর একমাত্র হতভাগা দেশ যেখানে হাস্যকরভাবে শিক্ষাব্যবস্থাকে দুই দৃষ্টিতে ভাগ করা হয়েছে। একটি সরকারি অংশ, অন্যটি বেসরকারি (পৃথিবীর অন্য সব দেশেই শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণকৃত)। এদেশে সরকারি ভাগটিকে ঘরে-বাইরে সবাই ‘উচ্চবর্ণের কুলীণ বংশ’ মনে করেন যাদের সাত খুন মাফ এবং সুযোগ-সুবিধা আর অধিকারের বেলায় শতভাগ। আর বেসরকারি অংশটিকে বেশিরভাগ মানুষই ‘নি¤œ বর্ণের অছ্যুত’ হিসেবে দেখেন। কেউ কেউ ব্যঙ্গ করে আবার বেসরকারিকে ‘বেদরকারি’ও বলে থাকেন। ব্যাপারটা এমন যে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের একজন শিক্ষার্থী বা শিক্ষককে চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দেওয়ার সব রকম ব্যবস্থা এমনভাবে করা আছে যে, বিভিন্ন ক্ষেত্রে সে নিজে হীনমন্যতায় ভুগতে বাধ্য হয়। এটা ঠিক যে, সরকারি অংশের শিক্ষার্থী বা শিক্ষক হতে গেলে তাকে অপেক্ষাকৃত বেশি কঠিন পরীক্ষা অতিক্রম করে আসতে হয়। সে যে মেধাবী (ব্যতিক্রমও রয়েছে অনেক) এতে সন্দেহ নেই। তাই বলে অপেক্ষাকৃত কম কঠিন পরীক্ষা দিয়ে আসা বেসরকারি অংশের মধ্যে যে মেধাবী শিক্ষার্থী বা মেধাবী শিক্ষক নেই, তাতো নয়। সবার প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, আমার মতো হাজারও মানুষের শিক্ষাজীবনে হাজারও এমন প্রত্যক্ষ ও প্রমাণিত উদাহরণ আছে যে, একজন সরকারি গেজেটেড শিক্ষকের তুলনায় একজন বেসরকারি অংশের শিক্ষক শিক্ষাদান সংক্রান্ত সকল কর্মকান্ডে বেশি পারদর্শী, বেশি পরিশ্রমী ও বেশি নিবেদিত। আবার বলছি, এক্ষেত্রেও ব্যতিক্রমতো আছেই। তবে বড় সার্টিফিকেট নিয়ে, বড় পরীক্ষা দিয়ে, বড় ডিগ্রী নিয়ে আসা আর ক্লাসে ছাত্র-ছাত্রীদের মন জয় করে, নিজেকে উজাড় করে প্রকৃত শিক্ষাদান করে জনপ্রিয় শিক্ষক হওয়া এক জিনিস নয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, এদেশে এই বেসরকারি অংশকে বেতন-ভাতাসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে ব্যাপক বৈষম্যের যাঁতাকলে প্রতিনিয়ত পিষ্ট করা হয়, কথায় কথায় এদের চাকরি হারানো আর বেতন বন্ধের হুমকি দেয়া হয়। অথচ এই অংশই পরিমানে ও অবদানে দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ। স্বাধীনতা অর্জনের প্রায় পাঁচ দশক পরেও এদেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বাবা-মার কষ্টার্জিত টাকায় ফি দিয়ে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা দিতে হয়, ভর্তি হতে হয়। আজও শিক্ষকদের বেতনÑভাতা নিয়ে দরকষাকষি চলে, বেতন আর পদোন্নতির অংক ক্রমান্বয়ে কমিয়ে চূড়ান্ত নীতি আসতে থাকে একের পর এক। এ যে কি লজ্জার, অসম্মানের আর ঘৃণার তা বলাই বাহুল্য। এদেশে কোনো এক সরকারি অফিসের একজন পিয়ন যেখানে তার বেতন আর ঘুষের টাকার অংক বেশ হাসিমুখে দাপটের সাথে ঘোষণা করে, সেখানে একজন শিক্ষক বেতনের অংক উচ্চারণ করতেই লজ্জাবোধ করেন, আর ঘুষতো নেই এই মহান শিক্ষকতা পেশায়। তাহলে বলুন, পেট না চললে মেধা আর জ্ঞান চলে কি??
তিন.
মহান মুক্তিযুদ্ধে লক্ষ লক্ষ জীবন-মানের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশে এখন কোথাকার কোন তথাকথিত ধর্মগুরু প্রথম শ্রেণি থেকে উচ্চ-মাধ্যমিক শ্রেণি পর্যন্ত পাঠ্যবইয়ের সিলেবাস নির্ধারণ করে দেন। তারই নির্দেশনায় সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে বিভিন্ন শ্রেণির পাঠ্যপুস্তক থেকে ষোল-সতের জন খ্যাতিমান কবি-লেখকদের লেখা সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। (প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখি, লেখার শুরুতে যে কবিতাটির রেফারেন্স টেনেছিলাম সেটিও পঞ্চম শ্রেণির বই থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে) এর পরিবর্তে সাম্প্রদায়িক ইঙ্গিতমূলক অসংখ্য লেখা কৌশলে পাঠ্যপুস্তকে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। সাম্প্রদায়িকতার নোংরা কারসাজিতে প্রাচীন ও সর্বাধিক পঠিত সেই সীতানাথ বসাক-এর “আদর্শলিপি” বাজার থেকে দূর করে শিশুদের জন্য নতুন নতুন বইয়ের সংস্করণ আনা হয়েছে যা কিনা অন্তঃসারশুন্য। উল্লেখ্য, পাকিস্তান আমলেও মোনায়েম খানের সময়ে পাঠ্যবইয়ে জসীমউদ্দীনের ‘নিমন্ত্রণ’ কবিতাটিকে ‘দাওয়াত’ নামে এবং নজরুলের ‘মহাশ্মশান’ কবিতাটিকে ‘গোরস্থান’ নামে চালিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আবহমান বাঙালী এই দিনগুলোই কি দেখতে চেয়েছিল? বর্তমান বাংলাদেশে শিক্ষা প্রশাসন শিক্ষকদের দ্বারা চলে না, চালানো হয় শিক্ষক জগতের বাইরে কিছু স্তরের আমলাদের দিয়ে। যেহেতু তারা শিক্ষক নন, তাই তাদের সকালে-বিকালে শিক্ষানীতি পরিবর্তন করতে আর বই পাল্টাতে সময় লাগে না। কারন, শিক্ষদের বুকের ব্যাথ্যা তারা বুঝবেন কি করে? একই দেশে একই ক্ষেত্রে দুই নীতি দেখেছেন কি? এদেশে আছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় নামক প্রতিষ্ঠানটি যেখানে বলে কোন প্রতিষ্ঠান চালাতে গেলে পদ সৃষ্টিপূর্বক শিক্ষক কর্মচারী নিয়োগ দিতে হবে, না হলে অনুমোদন মিলবে না। সেখানে সরকারের শিক্ষা অধিদপ্তর বলে “নিয়োগ দিতে পারেন কিন্তু বেতন-ভাতা আমরা দেব না।” তাহলে এই দ্বিচারিতা আর তামাশার মানে কি??
চার.
দেশ বরেণ্য কিছু শিক্ষাবিদগণ যখন মঞ্চে ওঠেন তখন তাদের উপদেশ বানী শুনে আমরা হাততালি দেই। তাদের সভা-কাঁপানো মুখরোচক বুলি এরকম, ‘তোমরা যারা কোমলমতি শিক্ষার্থী আছো, তোমরা এ-প্লাসের পিছনে ছুটবে না, তোমরা ভাল মানুষ হওয়ার জন্য ছুটতে থাকো। আর আপনারা যারা অভিভাবক আছেন তাদের বলি, আপনার সন্তানকে পরীক্ষায় এ-প্লাস পাওয়ার জন্য চাপ দেবেন না। ওদের মানবিক বিকাশ ঘটাতে সাহায্য করবেন’ .......... ইত্যাদি ইত্যাদি। ও শিক্ষাবিদ মহোদয়, বিনয়ের সাথে বলছি, আপনারাই যখন বুয়েট কিংবা ভার্সিটির ভর্তি কমিটিতে নীতি-নির্ধারক তকমায় থাকেন তখন আপনারাই তো বড় অক্ষরে ঘোষণা দেন যে, এস.এস.সি বা এইস.এস.সিতে এ-প্লাস না থাকলে ওমুক প্রতিষ্ঠানে ওমুক বিষয়ে আবেদন করা যাবে না। তাহলে এটাকি আমাদের প্রজন্মের সামনে সার্কাস দেখাচ্ছেন? বছরের ছয় মাস পার হয়ে যাওয়ার পর আপনাদের হঠাৎ মনে পরে পঞ্চম, অষ্টম কিংবা দশম শ্রেণিতে এতগুলো বিষয়ের পরীক্ষা নেওয়ার দরকার নেই। স্কুল-কলেজে নোটিশ আসে কিছু বিষয় অপ্রয়োজনীয়, তাই এগুলো বাদ দেওয়া হয়েছে। চৌদ্দ বছরে সাতবার বই পরিবর্তন, একাধিকবার প্রশ্নপত্র পরিবর্তন, পরীক্ষা পদ্ধতি পরিবর্তন, বছরের এ-মাথায় ও-মাথায় উত্তরপত্র মূল্যায়ন পদ্ধতি পরিবর্তন- এসব কি?? তাহলে বইগুলো ছাপালেন কেন? কাদের টাকায় ছাপালেন? শিশুদের ছয় মাস ধরে ওগুলো টানালেন কেন? পড়াতে বললেন কেন? ওহে শিক্ষার মহাজন, আমার মতো নরাধমকে একটু বুঝিয়ে বলবেন কি- কোন্ দেশ থেকে অংক বা গণিতকে সৃজণশীল করার ধারণা পেয়েছেন? (গণিত শাস্ত্র বা অর্থনীতির মতো মৌলিক বিষয়গুলো কিভাবে সৃজনশীল হয় তা আমার বোধগম্য নয়, কেউ জানলে একটু দয়াকরে জানাবেন)। দাতা সংস্থাগুলোর হুকুমে পৃথিবীর অনেক দেশের সাথে তাল মিলিয়ে নাকি সৃজনশীল পদ্ধতি আনলেন, ঠিক আছে- কিন্তু সেই সব দেশের শিক্ষার পরিবেশ-প্রক্রিয়া, প্রশিক্ষণ, প্রশাসন সেগুলো তো নিয়ে আসেননি!! বেতন-মানের প্রসঙ্গে নাহয় নাই গেলাম। এটা কি ‘ঘরে বেড়া নাই, দুয়ারে তালা মারা’র মতো অবস্থা নয়??
পাঁচ.
পরিশেষে পরিতাপের বিষয় বলি, আফ্রিকার স্বনামধন্য এক বিশ্ববিদ্যালয়ের তোরণদ্বারে বড় হরফে লেখা উক্তিটি, “একটি দেশকে ধ্বংস করতে চাইলে কোন অস্ত্র কিংবা পারমানবিক বোমার দরকার নেই, সে দেশের শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে অসৎ প্রবণতা ঢুকালেই হলো, ঐ জাতি আপনা-আপনিই ধসে পড়বে।’ তাহলে কি আমরা এখন এদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় সেরকমই কোনো দেশীয় বা আন্তর্জাতিক নীলনক্শার লাগামহীন আয়োজন দেখছি?? এ কি শুধুই ধোকা, কেবলই ফক্কিকার??
লেখক: অধ্যাপক পিযুষ বন্দ্যোপাধ্যায়
ইংরেজি বিভাগ, বেগম তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া মহিলা কলেজ, বরিশাল
শিক্ষাজীবনে কাজী কাদের নেওয়াজ-এর লেখা ‘শিক্ষাগুরুর মর্যাদা’ কবিতাটি পড়েননি বা জানেন না এমন লোক খুঁজে পাওয়া যাবে না। যেখানে রাজকুমারকে একজন গৃহশিক্ষক কর্তৃক পাঠদান ও মূল্যবোধ তৈরির এক অসাধারণ আলেখ্য চিত্রিত হয়েছে। অন্য হাজারও দৃষ্টান্তের মতো এখানেও প্রমাণ পাওয়া যায় যে, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি গৃহে আলাদা শিক্ষক দ্বারা শিক্ষার্থীদের বাড়তি কিছু শিখানোর প্রথা অতিপ্রাচীনকাল থেকেই প্রচলিত ছিল। তাহলে এখন দোষ কোথায়? কয়েকবছর ধরে দেখছি, অযৌক্তিকভাবে প্রশাসনের বিভিন্ন বাহিনীকে শিক্ষকদের উপরে লেলিয়ে দেওয়া হচ্ছে। গৃহে শিক্ষাদান কিংবা শিক্ষার্থীদের বাড়তি সময়ে পাঠদানের অপরাধে শিক্ষদের টেনেহিঁচড়ে বের করে, হাতকড়া পরিয়ে, জরিমানা করে ছাত্র-ছাত্রীদের সামনেই অপমান-অপদস্থ করা হচ্ছে। এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি করা হচ্ছে যেন, শিক্ষকতা করাটাই অপরাধ। মেধা খাটিয়ে, পরিশ্রম করে, শিক্ষার্থী তথা সমাজকে জ্ঞানার্জনে সাহায্য করে কয়েকটি বৈধ পয়সা রোজগার করে শিক্ষকদের সংসার চালানোর এই পবিত্র সংগ্রামকে একটি মহল ‘বানিজ্য’ বলে সাড়ম্বরে প্রচার করছে। আমি অস্বীকার করছিনা যে কেউ কেউ সত্যিই বানিজ্য করে। আমি স্বীকার করছি, কিছু কিছু নামধারী তথাকথিত শিক্ষক প্লে-নার্সারী থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় লেভেল পর্যন্ত অর্থ ও কামনার লোভ সংবরণ করতে না পেরে বিভিন্নভাবে শিক্ষার্থীদের হয়রানি করে। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, এদেশে এহেন অপকর্মের মাত্রা ইদানিং এত চরমে গিয়ে পৌছেছে যে, নিজেকে শিক্ষক বলে পরিচয় দিতে গর্ববোধের চেয়ে কুণ্ঠাবোধ বেশি হয়। তবে হ্যাঁ, এমন শিক্ষকও সমাজে ঢের আছেন যে, তাঁদের দেখলে মাথা অবচেতন মনেই নত হয়ে যায়। যারা প্রকৃত শিক্ষক হিসেবে সমাজে দৃষ্টান্ত স্বরূপ-এমন সংখ্যা এখনও অনেক অনেক বেশি। তাহলে কেন সবাইকেই ঐরূপ রুচিহীন মানদন্ডে দন্ডিত করা হবে??
দুই.
আমরাই মনে হয় পৃথিবীর একমাত্র হতভাগা দেশ যেখানে হাস্যকরভাবে শিক্ষাব্যবস্থাকে দুই দৃষ্টিতে ভাগ করা হয়েছে। একটি সরকারি অংশ, অন্যটি বেসরকারি (পৃথিবীর অন্য সব দেশেই শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণকৃত)। এদেশে সরকারি ভাগটিকে ঘরে-বাইরে সবাই ‘উচ্চবর্ণের কুলীণ বংশ’ মনে করেন যাদের সাত খুন মাফ এবং সুযোগ-সুবিধা আর অধিকারের বেলায় শতভাগ। আর বেসরকারি অংশটিকে বেশিরভাগ মানুষই ‘নি¤œ বর্ণের অছ্যুত’ হিসেবে দেখেন। কেউ কেউ ব্যঙ্গ করে আবার বেসরকারিকে ‘বেদরকারি’ও বলে থাকেন। ব্যাপারটা এমন যে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের একজন শিক্ষার্থী বা শিক্ষককে চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দেওয়ার সব রকম ব্যবস্থা এমনভাবে করা আছে যে, বিভিন্ন ক্ষেত্রে সে নিজে হীনমন্যতায় ভুগতে বাধ্য হয়। এটা ঠিক যে, সরকারি অংশের শিক্ষার্থী বা শিক্ষক হতে গেলে তাকে অপেক্ষাকৃত বেশি কঠিন পরীক্ষা অতিক্রম করে আসতে হয়। সে যে মেধাবী (ব্যতিক্রমও রয়েছে অনেক) এতে সন্দেহ নেই। তাই বলে অপেক্ষাকৃত কম কঠিন পরীক্ষা দিয়ে আসা বেসরকারি অংশের মধ্যে যে মেধাবী শিক্ষার্থী বা মেধাবী শিক্ষক নেই, তাতো নয়। সবার প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, আমার মতো হাজারও মানুষের শিক্ষাজীবনে হাজারও এমন প্রত্যক্ষ ও প্রমাণিত উদাহরণ আছে যে, একজন সরকারি গেজেটেড শিক্ষকের তুলনায় একজন বেসরকারি অংশের শিক্ষক শিক্ষাদান সংক্রান্ত সকল কর্মকান্ডে বেশি পারদর্শী, বেশি পরিশ্রমী ও বেশি নিবেদিত। আবার বলছি, এক্ষেত্রেও ব্যতিক্রমতো আছেই। তবে বড় সার্টিফিকেট নিয়ে, বড় পরীক্ষা দিয়ে, বড় ডিগ্রী নিয়ে আসা আর ক্লাসে ছাত্র-ছাত্রীদের মন জয় করে, নিজেকে উজাড় করে প্রকৃত শিক্ষাদান করে জনপ্রিয় শিক্ষক হওয়া এক জিনিস নয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, এদেশে এই বেসরকারি অংশকে বেতন-ভাতাসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে ব্যাপক বৈষম্যের যাঁতাকলে প্রতিনিয়ত পিষ্ট করা হয়, কথায় কথায় এদের চাকরি হারানো আর বেতন বন্ধের হুমকি দেয়া হয়। অথচ এই অংশই পরিমানে ও অবদানে দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ। স্বাধীনতা অর্জনের প্রায় পাঁচ দশক পরেও এদেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বাবা-মার কষ্টার্জিত টাকায় ফি দিয়ে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা দিতে হয়, ভর্তি হতে হয়। আজও শিক্ষকদের বেতনÑভাতা নিয়ে দরকষাকষি চলে, বেতন আর পদোন্নতির অংক ক্রমান্বয়ে কমিয়ে চূড়ান্ত নীতি আসতে থাকে একের পর এক। এ যে কি লজ্জার, অসম্মানের আর ঘৃণার তা বলাই বাহুল্য। এদেশে কোনো এক সরকারি অফিসের একজন পিয়ন যেখানে তার বেতন আর ঘুষের টাকার অংক বেশ হাসিমুখে দাপটের সাথে ঘোষণা করে, সেখানে একজন শিক্ষক বেতনের অংক উচ্চারণ করতেই লজ্জাবোধ করেন, আর ঘুষতো নেই এই মহান শিক্ষকতা পেশায়। তাহলে বলুন, পেট না চললে মেধা আর জ্ঞান চলে কি??
তিন.
মহান মুক্তিযুদ্ধে লক্ষ লক্ষ জীবন-মানের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশে এখন কোথাকার কোন তথাকথিত ধর্মগুরু প্রথম শ্রেণি থেকে উচ্চ-মাধ্যমিক শ্রেণি পর্যন্ত পাঠ্যবইয়ের সিলেবাস নির্ধারণ করে দেন। তারই নির্দেশনায় সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে বিভিন্ন শ্রেণির পাঠ্যপুস্তক থেকে ষোল-সতের জন খ্যাতিমান কবি-লেখকদের লেখা সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। (প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখি, লেখার শুরুতে যে কবিতাটির রেফারেন্স টেনেছিলাম সেটিও পঞ্চম শ্রেণির বই থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে) এর পরিবর্তে সাম্প্রদায়িক ইঙ্গিতমূলক অসংখ্য লেখা কৌশলে পাঠ্যপুস্তকে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। সাম্প্রদায়িকতার নোংরা কারসাজিতে প্রাচীন ও সর্বাধিক পঠিত সেই সীতানাথ বসাক-এর “আদর্শলিপি” বাজার থেকে দূর করে শিশুদের জন্য নতুন নতুন বইয়ের সংস্করণ আনা হয়েছে যা কিনা অন্তঃসারশুন্য। উল্লেখ্য, পাকিস্তান আমলেও মোনায়েম খানের সময়ে পাঠ্যবইয়ে জসীমউদ্দীনের ‘নিমন্ত্রণ’ কবিতাটিকে ‘দাওয়াত’ নামে এবং নজরুলের ‘মহাশ্মশান’ কবিতাটিকে ‘গোরস্থান’ নামে চালিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আবহমান বাঙালী এই দিনগুলোই কি দেখতে চেয়েছিল? বর্তমান বাংলাদেশে শিক্ষা প্রশাসন শিক্ষকদের দ্বারা চলে না, চালানো হয় শিক্ষক জগতের বাইরে কিছু স্তরের আমলাদের দিয়ে। যেহেতু তারা শিক্ষক নন, তাই তাদের সকালে-বিকালে শিক্ষানীতি পরিবর্তন করতে আর বই পাল্টাতে সময় লাগে না। কারন, শিক্ষদের বুকের ব্যাথ্যা তারা বুঝবেন কি করে? একই দেশে একই ক্ষেত্রে দুই নীতি দেখেছেন কি? এদেশে আছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় নামক প্রতিষ্ঠানটি যেখানে বলে কোন প্রতিষ্ঠান চালাতে গেলে পদ সৃষ্টিপূর্বক শিক্ষক কর্মচারী নিয়োগ দিতে হবে, না হলে অনুমোদন মিলবে না। সেখানে সরকারের শিক্ষা অধিদপ্তর বলে “নিয়োগ দিতে পারেন কিন্তু বেতন-ভাতা আমরা দেব না।” তাহলে এই দ্বিচারিতা আর তামাশার মানে কি??
চার.
দেশ বরেণ্য কিছু শিক্ষাবিদগণ যখন মঞ্চে ওঠেন তখন তাদের উপদেশ বানী শুনে আমরা হাততালি দেই। তাদের সভা-কাঁপানো মুখরোচক বুলি এরকম, ‘তোমরা যারা কোমলমতি শিক্ষার্থী আছো, তোমরা এ-প্লাসের পিছনে ছুটবে না, তোমরা ভাল মানুষ হওয়ার জন্য ছুটতে থাকো। আর আপনারা যারা অভিভাবক আছেন তাদের বলি, আপনার সন্তানকে পরীক্ষায় এ-প্লাস পাওয়ার জন্য চাপ দেবেন না। ওদের মানবিক বিকাশ ঘটাতে সাহায্য করবেন’ .......... ইত্যাদি ইত্যাদি। ও শিক্ষাবিদ মহোদয়, বিনয়ের সাথে বলছি, আপনারাই যখন বুয়েট কিংবা ভার্সিটির ভর্তি কমিটিতে নীতি-নির্ধারক তকমায় থাকেন তখন আপনারাই তো বড় অক্ষরে ঘোষণা দেন যে, এস.এস.সি বা এইস.এস.সিতে এ-প্লাস না থাকলে ওমুক প্রতিষ্ঠানে ওমুক বিষয়ে আবেদন করা যাবে না। তাহলে এটাকি আমাদের প্রজন্মের সামনে সার্কাস দেখাচ্ছেন? বছরের ছয় মাস পার হয়ে যাওয়ার পর আপনাদের হঠাৎ মনে পরে পঞ্চম, অষ্টম কিংবা দশম শ্রেণিতে এতগুলো বিষয়ের পরীক্ষা নেওয়ার দরকার নেই। স্কুল-কলেজে নোটিশ আসে কিছু বিষয় অপ্রয়োজনীয়, তাই এগুলো বাদ দেওয়া হয়েছে। চৌদ্দ বছরে সাতবার বই পরিবর্তন, একাধিকবার প্রশ্নপত্র পরিবর্তন, পরীক্ষা পদ্ধতি পরিবর্তন, বছরের এ-মাথায় ও-মাথায় উত্তরপত্র মূল্যায়ন পদ্ধতি পরিবর্তন- এসব কি?? তাহলে বইগুলো ছাপালেন কেন? কাদের টাকায় ছাপালেন? শিশুদের ছয় মাস ধরে ওগুলো টানালেন কেন? পড়াতে বললেন কেন? ওহে শিক্ষার মহাজন, আমার মতো নরাধমকে একটু বুঝিয়ে বলবেন কি- কোন্ দেশ থেকে অংক বা গণিতকে সৃজণশীল করার ধারণা পেয়েছেন? (গণিত শাস্ত্র বা অর্থনীতির মতো মৌলিক বিষয়গুলো কিভাবে সৃজনশীল হয় তা আমার বোধগম্য নয়, কেউ জানলে একটু দয়াকরে জানাবেন)। দাতা সংস্থাগুলোর হুকুমে পৃথিবীর অনেক দেশের সাথে তাল মিলিয়ে নাকি সৃজনশীল পদ্ধতি আনলেন, ঠিক আছে- কিন্তু সেই সব দেশের শিক্ষার পরিবেশ-প্রক্রিয়া, প্রশিক্ষণ, প্রশাসন সেগুলো তো নিয়ে আসেননি!! বেতন-মানের প্রসঙ্গে নাহয় নাই গেলাম। এটা কি ‘ঘরে বেড়া নাই, দুয়ারে তালা মারা’র মতো অবস্থা নয়??
পাঁচ.
পরিশেষে পরিতাপের বিষয় বলি, আফ্রিকার স্বনামধন্য এক বিশ্ববিদ্যালয়ের তোরণদ্বারে বড় হরফে লেখা উক্তিটি, “একটি দেশকে ধ্বংস করতে চাইলে কোন অস্ত্র কিংবা পারমানবিক বোমার দরকার নেই, সে দেশের শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে অসৎ প্রবণতা ঢুকালেই হলো, ঐ জাতি আপনা-আপনিই ধসে পড়বে।’ তাহলে কি আমরা এখন এদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় সেরকমই কোনো দেশীয় বা আন্তর্জাতিক নীলনক্শার লাগামহীন আয়োজন দেখছি?? এ কি শুধুই ধোকা, কেবলই ফক্কিকার??
লেখক: অধ্যাপক পিযুষ বন্দ্যোপাধ্যায়
ইংরেজি বিভাগ, বেগম তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া মহিলা কলেজ, বরিশাল
No comments:
Post a Comment