Saturday, June 1, 2019

মহাত্মা অশ্বিনী কুমার দত্ত

“আমি মহাত্মা নই, মহাত্মা দেখতে হলে তোরা বরিশালে যা, ওখানে অশ্বিনী দত্ত’কে দেখ। সেই মহাত্মা”
-মহাত্মা গান্ধী

মহাত্মা অশ্বিনী কুমার দত্ত ছিলেন ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম বিপ্লবী। পিতা ব্রজমোহন দত্ত ছিলেন একজন সাব-জজ। মা প্রসন্নময়ী ছিলেন বানরীপাড়ার রাধাকিশোর গুহের মেয়ে। বাবার মতো মাও ছিলেন মানবতাবাদী ও দেশপ্রেমিক। ব্রজমোহন দত্ত ও প্রসন্নময়ীর সংসারে ৪ ছেলে ও ২ মেয়ে। অশ্বিনীকুমার দত্ত ছিলেন ভাইদের মধ্যে সবথেকে বড়। জন্ম ১৮৫৬ সালের ২৫ জানুয়ারি। তৎকালীন বরিশাল জেলার পটুয়াখালী মহকুমা শহরে। বরিশাল জেলার গৌরনদী উপজেলার বাটাজোর গ্রামে বাড়ি।

বাবা ব্রজমোহন দত্ত’র কর্মের কারনে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় বিভিন্ন স্কুল-কলেজে তার পড়াশুনা শেষ করতে হয়। ১৮৭০ খ্রি. রংপুর থেকে প্রবেশিকা, ১৮৭৮ খ্রি. কৃষ্ণনগর কলেজ থেকে বি.এ, ১৮৭৯ খ্রি. এম.এ., বি.এল. পাশ করে সাত মাসের জন্য শ্রীরামপুর চাতরা ইংরেজি বিদ্যালয়ে প্রধানশিক্ষকের পদে নিযুক্ত ছিলেন। পরের বছর ওকালতির করার জন্য বরিশালে আসেন। কলকাতায় রাজনারায়ণ বসুর প্রভাবে ব্রাহ্ম ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হন এবং ১৮৮২ খ্রি. বরিশালে ব্রাহ্ম সমাজের সদস্যপদ গ্রহণ করেন।

ওকালতি ত্যাগ করে বরিশালের তদানীন্তন ম্যাজিস্ট্রেট রমেশ চন্দ্র দত্তের পরামর্শে পিতার নামে ব্রজমোহন স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন (২৭. ৬. ১৮৮৪)। ১৮৮৫ খ্রি. বরিশাল মিউনিসিপ্যাল বোর্ডের কমিশনার নিযুক্ত হন। দুর্নীতির বিরুদ্ধে সংগ্রামের জন্য পিপল্স অ্যাসোসিয়েশন স্থাপন করেন ও জাতীয় কংগ্রেসের অনুমোদন লাভ করেন (১৮৮৬)। এই বছরই বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর নিকট দীক্ষা নেন। তাঁর চেষ্টায় বাখরগঞ্জ ডিস্ট্রিক্ট বোর্ড স্থাপিত হয় (১৮৮৭)। স্ত্রীশিক্ষা প্রসারের উদ্দেশ্যে ‘বাখরগঞ্জ হিতৈষিণী সভা’ এবং বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন (১৮৮৭)। বাংলার প্রতিনিধি দলের সদস্যরূপে তিনি জাতীয় কংগ্রেসের মাদ্রাজ অধিবেশনে যোগ দেন। ১৮৮৮ খ্রি. বরিশাল মিউনিসিপ্যালিটির ভাইস-চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন। ১৮৮৯ খ্রি. ব্রজমোহন কলেজ স্থাপন করে পঁচিশ বছর সেখানে বিনা বেতনে কাজ করেন। ১৮৯৮ খ্রি. কলেজটি প্রথম শ্রেণির কলেজে পরিণত হয়। ব্রজমোহন স্কুল ও ব্রজমোহন কলেজ কেবল ছাত্রদের লেখাপড়া ও ব্যক্তিগত চরিত্রগঠনের দিক দিয়েই আদর্শ স্থাপন করেনি, অশ্বিনীকুমার তাঁর যাবতীয় সৎকর্মের সঙ্গে ব্রজমোহন বিদ্যালয়ের ছাত্র ও শিক্ষকদের যুক্ত করেছিলেন। বিদ্যালয়ের মূলমন্ত্র ছিল ‘সত্য প্রেম পবিত্রতা’।

যে-কোন সার্বজনীন কাজে তিনি এক ডাকে শত শত স্বেচ্ছাসেবক একত্রিত করতে পারতেন। স্বদেশপ্রীতি ও স্বদেশি ভাবের অনুশীলন ছাত্রদের শিক্ষার আবশ্যিক অঙ্গ বলে মনে করতেন। ‘স্বদেশি’তে এবং ‘বিদেশি বয়কটে’র ব্যাপারে কৃতিত্ব যে সারা ভারতবর্ষে সর্বাগ্রগণ্য হয়েছিল, তার কারণ বঙ্গভঙ্গ ও স্বদেশি আন্দোলনের অনেক আগে থেকেই বরিশালে তিনি স্বদেশি প্রচার ও জনসাধারণের মধ্যে কাজ আরম্ভ করেছিলেন এবং সে সময় তাঁর মতো প্রকৃত অর্থে জননায়ক বিরল ছিল।

 

১৮৯৭-৯৮ খ্রি. সরকারি বার্ষিক শিক্ষাবিবরণীতে ব্রজমোহন বিদ্যালয় সম্বন্ধে মন্তব্য ছিল ‘The school is unrivalled in point of discipline and efficiency. It is an institution that ought to serve as a model to all schools, government and private’. এই সরকারই স্বদেশি আন্দোলনের কালে এই বিদ্যালয়কে পিষে মারার চেষ্টায় ব্রজমোহন স্কুল ও কলেজের ছাত্ররা পরীক্ষায় যোগ্য নম্বর পেয়ে পাশ করলেও সরকারি বৃত্তি তাদের দেওয়া হল না। দৃষ্টান্ত- দেবপ্রসাদ ঘোষ প্রবেশিকা পরীক্ষায় প্রথম হয়েও বৃত্তি থেকে বঞ্চিত হন: মধুসূদন সরকার তৃতীয় স্থান অধিকার করেও বৃত্তি পাননি।

১৮৯৭ খ্রি. তিনি বরিশাল মিউনিসিপ্যালিসির চেয়ারম্যান হন। অমরাবতী কংগ্রেসে এক বক্তব্য রাখেন যে, কংগ্রেসকে শক্তিশালী করতে হলে কতিপয় ইংরেজি শিক্ষিত ব্যক্তির বাৎসরিক তামাশা না করে গ্রামে গ্রামে সর্বসাধারণের সক্রিয় সহযোগিতা সংগ্রহ করা প্রয়োজন। স্বদেশি আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর ‘স্বদেশ বান্ধব সমিতি’ ঐতিহাসিক প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল। ১৯০৮ খ্রি. সমিতি ও তার শাখাগুলিকে সরকার যখন বেআইনি ঘোষণা করে, সে সময়ে সমিতির ১৭৫টি শাখা ছিল। পরের বছর বরিশালে ‘প্রাদেশিক রাষ্ট্রীয় সমিতি’র অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতি নিযুক্ত হন। এই অধিবেশনে আইন অমান্য করা হয়। এটি রাজনীতির ক্ষেত্রে প্রথম সত্যাগ্রহ আন্দোলন। পুলিশ লাঠিচার্জ করলে নেতৃত্বস্থানীয়রা আহত হন। এই বছরই কংগ্রেসের কলকাতা অধিবেশন তিনি অভ্যর্থনা সমিতির অন্যতম সম্পাদক হন এবং কুখ্যাত বরিশাল দুর্ভিক্ষে অতুলনীয় সেবা-কাজ করেন। তাঁর রচিত পুস্তকগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- ‘ভক্তিযোগ’, ‘কর্মযোগ’, ‘প্রেম’, ‘দুর্গোৎসবতত্ত্ব’, ‘আত্মপ্রতিষ্ঠা’ ও ‘ভারতগীতি’।

১৯০৭খ্রি. সুরাট কংগ্রেস প- হবার পর তিনি নরম ও চরমপন্থীদের ঐক্যের জন্য চেষ্টা করেছিলেন। ১৯০৮খ্রি. রাজনৈতিক নেতারূপে গ্রেপ্তার হয়ে লক্ষেèৗ জেলে আটক ছিলেন। এই সময় থেকে সরকারি রোষ ব্রজমোহন স্কুল ও কলেজের ওপর পড়ে। সরকারের নানারকম নিপীড়নের জন্য শিক্ষালয়-দু-টির অবস্থা ক্রমেই অবনতির দিকে যায়। ১৯১০খ্রি. কারামুক্তির পর শিক্ষালয়-দু-টির অবনতি রোধের জন্য ১৯১১খ্রি. তিনি সরকারি সাহায্য গ্রহণ করেন। পরের বছর কলেজ ও স্কুল পৃথক করে কলেজ-পরিচালনা ট্রাস্টি কাউন্সিলের হাতে দিতে বাধ্য হন। ১৯১৩খ্রি. ঢাকায় প্রাদেশিক রাষ্ট্রীয় সমিতির অধিবেশনে সভাপতি হন এবং ১৯১৮ খ্রি. কংগ্রেসের মুম্বাই অধিবেশনে যোগদান করেন।
বরিশাল ঝড়ের বছর (১৯১৯) আর্তত্রাণে তাঁর স্মরণীয় ভূমিকা ছিল। ১৯২১ খ্রি. বরিশাল প্রাদেশিক সমিতির অধিবেশনে অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতি হন এবং এই বছরই কংগ্রেসের কলকাতা অধিবেশনে অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের প্রস্তাবে সক্রিয় সমর্থন জানান। ব্রজমোহন স্কুল বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে জাতীয় বিদ্যালয় পরিণত হয় (১৯২১)। এই বছর মহাত্মা গান্ধী প্রথম বরিশালে এসে জেলার অদ্বিতীয় নেতা অশ্বিনীকুমারকে শ্রদ্ধা জানান। ১৯২২ খ্রি. অসমের চা-বাগানের কুলিদের প্রতি অত্যাচারের প্রতিবাদে অসম-বাংলা রেলপথ ও স্টিমার কোম্পানির ধর্মঘটে অসুস্থ অবস্থায়ও বরিশাল সমিতির সভাপতিত্ব করেন।

ভুল সময়ে; ভুল মাটিতে জন্ম নিয়েছিলে তুমি। তোমারই দান করা সম্পদের উপর গড়ে ওঠা প্রতিষ্ঠানে আজও তোমার একটা মুর‌্যাল স্থাপন করা যায় না- যার জন্য যুদ্ধ করতে হয় আমাদের। সত্য-প্রেম-পবিত্রতার যে অগ্নিমন্ত্রে তুমি জাগ্রত করতে চেয়েছিলে আমাদের ভূমিকে- সে ভূমি অভিষপ্ত।

লেখক: কাজল, ব্লগার ও ডিজাইনার

No comments:

Post a Comment

জয়দেব মুখোপাধ্যায় : চৈতন্য মৃত্যুরহস্যের কিনারা করতে গিয়ে প্রাণ দিয়েছিলেন যে গবেষক

জয়দেব মুখোপাধ্যায়ের যেন এক কিংবদন্তির নাম যার কথা অনেকেই শুনেছে , বহু মানুষই তাকে খুঁজে ফেরে কিন্ত তার ব্যাপারে বিশদে কেউ কিছু বলতে পারেনা...