বিজ্ঞান-প্রযুক্তির ক্ষেত্রে মানুষ যে অগ্রগতি অর্জন করেছে তা রীতিমত আভাবিত। নিত্যনতুন আবিস্কারাদির ফলে জীবনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে ঘটেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন, গোটা পৃথিবী পরিণত হয়েছে এক বিশ্বপল্লীতে এবং মাটির মানুষ এগিয়ে চলেছে মহাকাশ বিজয়ের পথে। কিন্তু এত অর্জন-আবিস্কারের পরও শান্তি নেই কেথাও না আমাদের এই দুর্ভাগা বাংলাদেশে, না কোনো বিত্তবান পরাশক্তিমান দেশে। ক্ষুধা দারিদ্র্যের মধ্যে যেমন, বিপুল বিত্তের মধ্যেও তেমনি দেখা দিয়েছে চিত্তের এক মহাশূণ্যতা, নৈতিক-মানবিক দিক থেকে মানুষ যেন আজ প্রায় নিঃস্ব। অবাক কাণ্ড! এত কৃতি-কীর্তি ও অর্জন আবিস্কারের মধ্যেও মানুষের জীবন সমস্যা সমাধানের লক্ষণ নেই কোনোদিকে, বরঞ্চ সর্বত্র ঘটছে তার উল্টোটি দুঃখ যন্ত্রণা ও জটিলতা দিন দিন বেড়েই চলেছে। বিশ্বপল্লীতে যেন আজ লেগেছে আগুন। জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে মানুষের সব স্নিগ্ধ ধ্যান-ধারণা, ভাব-কল্পনা ও সনাতন মূল্যবোধ। নৈতিক ও নান্দনিক গুণাবলির চেয়ে আজ অনেক বেশি শক্তিশালী হয়ে দেখা দিয়েছে হীন জান্তব প্রবৃত্তিগুলো। কবিগুরুর ভাষায়:রুচি আশা অভিলাষ
যা মিলিয়ে জীবনের স্বাদ
তার হোলো রসবিপর্যয়।
বিশেষ করে আন্তর্জাতিক মানব সম্পর্কের ক্ষেত্রে চলছে সীমাহীন নৈরাজ্য, প্রতাপশালীদের চরম খামখেয়াল ও শক্তিমদমত্ততা। তাইতো দেশে দেশে, এমনকি একই দেশের বিভিন্ন সম্প্রদায়ে চলছে নরমেধযজ্ঞ। একই কারনে যুদ্ধের শিকার হলো ইরাকের নীরহ জনগণ, চূর্ণ হয়ে গেল দেশটির স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব। শুধু ইরাকই নয় কোরীয় উপদ্বীপ, ইরান, ফিলিস্তিনিসহ গোটা মধ্যপ্রাচ্যে এবং উপমহাদেশ ও আফ্রিকার আরো অনেক ঝঞ্ঝাবিধ্বস্ত রাষ্ট্রে মানুষের যে চেহারা দেখা যাচ্ছে তা নিঃসন্দেহে এক অসহায় পীড়িত চেহারা। বুঝতে কষ্ট হচ্ছে না যে, বিশ্বময় একাধিপত্য বিস্তারের জন্য শক্তি, প্রতারণা, মিথ্যাচার, নৃশংসতা, কপটতা প্রভৃতি সব ম্যাকিয়্যাভেলীয় কূটকৌশল ব্যবহার করে চলছে বিশ্বের একমাত্র পরাশক্তি ও তার কিছু তাবেদার রাষ্ট্র। ভাবতে অবাক লাগে, এ শক্তিচক্র কিছুতেই আঁচ করতে পারছেন না সেই সম্ভাব্য মহাপ্রলয়ের ভয়াবহতা, যা অন্য সকলকে ধ্বংস করার সঙ্গে ধ্বংস করে ফেলবে তাদের নিজেদেরকেও। এ কেবল কারো মনগড়া কথার কথা নয়, এ এক অভ্রান্ত অকাট্য সত্য। এ সত্য অতীতের অনেকবার প্রমাণিত হয়েছে মানুষের সভ্যতা-সংস্কৃতির ইতিহাসে, বহু সাম্রাজ্যের উত্থান পতন রাজ-রাজড়াদের গ্লানিকর ক্ষমতাচ্যুতি ও মর্মান্তিক পরিণতির মধ্য দিয়ে।
এসব কথা বলার অর্থ এই যে, হালের চরম বস্তুবাদী ভোগবাদী মনোবৃত্তি, প্রযুক্তির একপেশে অগ্রগতি মানুষকে বিপুল বিত্ত ও যন্ত্রশক্তি উপহার দিয়েছে বটে, কিন্তু তার চিত্তের প্রসার ঘটাতে, ঐক্য ও প্রেমানুভূতির পরিবেশ সৃষ্টিতে ব্যর্থ হয়েছে। এমতাবস্থায় ধর্ম, বিজ্ঞান, রাজনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য তথা দ্রুত প্রসারমাণ বিজ্ঞান-প্রযুক্তির সঙ্গে সুনীতির সংযোজন ও সমন্বয় সময়ের এক জরুরী প্রয়োজন। আমার মতে, এ নবনৈতিকতার নির্যাস হবে মানবকল্যাণ। ব্যাপক ও দীর্ঘস্থায়ী মানবকল্যাণ। এ মানদণ্ড অনুসারে মানুষের একটি কাজ ভাল ও বাঞ্ছনীয় বলে বিবেচতি হতে পারে কেবল তখনই, যখন তা তার নিজের জন্য যেমন, সমাজের অন্যান্য মানুষের জন্যও তেমনি কল্যাণকর। যে কাজ মানুষের ন্যায্য অধিকারের স্বীকৃতি এবং মানুষ্যত্বের প্রতি শ্রদ্ধার ওপর প্রতিষ্ঠিত, যা সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তাবোধ সৃষ্টি করে তাই ভাল, তাই বাঞ্ছনীয় ও অনুমোদনযোগ্য। আর যে কাজের ফলাফল এর উল্টো, অর্থাৎ যা সমাজে হিংসা-বিদ্বেষ হানাহানি সৃষ্টি করে, তাই গর্হিত ও অমানবোচিত কাজ। আমরা এই নতুন মতের নাম দিতে পারি কল্যাণবাদ। কল্যাণবাদ অনুসারে পারস্পরিক আদান প্রদান ও সহযোগিতা সমঝোতারভিত্তেতে অর্জন করতে হবে মানুষের ব্যাপক কল্যাণ, নিশ্চিত করতে হবে সামজিক ন্যায় ও সুবিচার। মনে রাখতে হবে যে, সামাজিক চেতনা মানুষের একটি মূল্যবান গুণ। ব্যক্তি নিজে বেঁচে থেকেই কিংবা তার নিজের অস্তিত্বকে সংগঠিত করেই সুখী হতে পারে না। জোর যার মুল্লুক তার এই নীতি মানবসমাজে সুখ শান্তি বয়ে আনতে পারে না। যেকোনো মানবিক সমস্যার সমাধান হওয়া উচিত পারস্পরিক সহযোগিতা সমঝোতা ও সৌহার্দ্য-সম্প্রীতির মাধ্যমে। এরই পারিভাষিক নাম মর্যালিটি বা নৈতিকতা। একেই আবার আমরা বলি কালচার, ভদ্রতা বা নীতিপরায়ণতা। আপন অধিকার সংরক্ষণ যেমন মানুষের কর্তব্য, অপরের অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীলতাও তার সামাজিক ও নৈতিক দায়িত্ব। মানুষ স্বাধীন হয় অপরের স্বাধীনতাকে হরণ করে নয়, শ্রদ্ধা ও স্বীকার করে। তাই তো অন্ধ প্রবৃত্তির চাপের মুখেও কত না মহৎপ্রাণ মানুষ ব্রতী হয়েছেন সমাজকল্যাণ প্রতিষ্ঠায়, এমন কি অকাতরে প্রাণ পর্যন্ত উৎসর্গ করেছেন আর্তমানবতার দুঃখ দুর্দশা মোচনে। এ যুক্তিতেই তো মহামতি এরিস্টটল বলেছিলেন, মানুষ একটি সামাজিক জীব; আর যে সমাজে বাস করে না সে মানুষ নয়, বরং হয় একজন ফেরেস্তা নয়তো একটি জানোয়ার। সমাজের আর দশজনকে বাদ দিয়ে কখনো কারো নিজের ব্যক্তিত্ব বিকশিত হতে পারে না; একক প্রচেষ্টায় কেউই কখনো তার সব অভাব মেটাতে পারে না। রবীন্দ্রনাথ যথার্থই বলেছেন, একটি প্রদীপ যেমন একা রাতের অন্ধকার ঘোচাতে পারে না, তেমনি কোন ব্যক্তিবিশেষের একক চেষ্টায়ও মানবসমাজের ব্যাপক কল্যাণ সাধিত হয় না। এর জন্য প্রয়োজন ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সব মহলের সমবেত প্রচেষ্টা।
এখানে নৈতিকতার সঙ্গে মানুষের অধিকার ও দায়িত্ববোধের সম্বন্ধের বিষয়টা প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে। কারণ, অধিকার ও দায়িত্ববোধ এমন দুটি জিনিস যা থাকা না থাকার ওপর বহুলাংশে নির্ভর করে মানুষের সুখ দুঃখ, শান্তি নিরাপত্তা। এমতাবস্থায় অন্ন,বস্ত্র,বাসস্থান, শিক্ষা, প্রভৃতি যেকোন এক বা একাধিক মৌলিক অধিকার না থাকার কারনে কারো স্বাভাবিক জীবনযাত্রা যদি ব্যাহত হয়, তাহলে তা রাষ্ট্রের কাছে প্রত্যাশা ও দাবি করার অধিকার সে নাগরিকের আছে। আর তা পূরণ করাও রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের দায় দায়িত্বের অন্তর্গত। মানবাধিকার ইদানীংকালের একটি বহুল আলোচিত বিষয় বটে। তবে এ বিষয়ে মানুষের চিন্তা ভাবনা ও আলাপ আলোচনার সূত্রপাত বহুকাল আগে। অতীতে এক সময় অধিকারকে দেখা হতো প্রকৃতি থেকে প্রাপ্ত জন্মগত অধিকার হিসেবে। এ মতে, এমন কিছু অধিকার আছে যেগুলো মানুষমাত্রই জন্মসূত্রে পেয়ে থাকে। এসব অধিকার যেহেতু প্রকৃতিদত্ত ও জন্মগত, সুতরাং এরা মৌলিকও বটে। এরা অলঙ্ঘনীয় ও অপরিবর্তনীয় মৌলিক অধিকার; সুতরাং এগুলোর নিশ্চয়তা বিধান সমাজ ও রাষ্ট্রের দায়িত্ব। ব্যক্তি নিজে যেমন তার কোন মৌলিক অধিকার অন্যের কাছে হস্তান্তর করতে পারে না, তেমনি সমাজ বা রাষ্ট্রও কারো মৌলিক অধিকারে হস্তক্ষেপ করতে কিংবা কারো কাছ থেকে তার মৌলিক অধিকারে হস্তক্ষেপ করতে কিংবা কারো কাছ থেকে তার মৌলিক অধিকার ছিনিয়ে নিতে পারে না। অধিকারমাত্রই, মানবিক অধিকার এবং এসব অধিকার মানুষের উদ্দেশ্য সাধনে, জীবনের নূন্যতম চাহিদা পূরণে সহায়ক। যথার্থ অধিকার তাই যা নিশ্চিত করে ব্যক্তির স্বচ্ছন্দ জীবন, সহজ ও সুগম করে দেশ ও দশের সামগ্রিক কল্যাণ।
অতীতে একসময় একচ্ছত্রবাদ নামে যে রাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থা প্রচলিত ছিল এবং যা এখন ক্রমবিলীয়মান, তাতে ব্যক্তির মৌলিক অধিকারের কোন স্বীকৃতি ছিল না। এ ব্যবস্থা ছিল পুরোপুরি রাষ্ট্রবাদী এবং এতে ‘ব্যক্তির জন্য সমাজ’ কথাটার পরিবর্তে ‘সমাজের জন্য ব্যক্তি’ কথাটা বিবেচিত হতো সঙ্গত বলে। এ ব্যবস্থায় অধিকার বলতে বোঝাতো রাষ্ট্রের অধিকার; আর নাগরিক সাধারণের যা প্রাপ্য বলে প্রচার করা হত, তা অধিকার নয়, রাষ্ট্রের প্রতি ব্যক্তির কেবল কর্তব্যপালন। এ ব্যবস্থায় নাগরিক অধিকার বলে যা কিছু থাকবে, তা কোন প্রাকৃতিক বা মানবিক অলঙ্ঘনীয় অধিকার নয়, বরং রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের মর্জিমাফিক নাগরিকদের দেয়া কিছু সুযোগ সুবিধা।
এ ধরনের একচ্ছত্রবাদী মত বহুলাংশে স্বেচ্ছাচারী, এবং এজন্যই তা গ্রহণযোগ্য নয়, হতেও পারে না। মনে রাখতে হবে যে, রাষ্ট্র রক্ত মাংসে গড়া কোনো সচেতন সত্তা নয়; আর নাগরিকদের সুখ দুঃখ, সুবিধা-অসুবিধার কথা বাদ দিয়ে রাষ্ট্রের আলাদা কোনো লক্ষ্যের কথাও ভাবা যায় না। আমরা যাকে রাষ্ট্র বলি, তা নিজে কখনো ন্যায়, সুনীতি ও সামাজিক কল্যাণ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নয়, বরং নাগরিক সাধারণের লক্ষ্য অর্জনের একটি উপায় বা মাধ্যমমাত্র। সমাজ, রাষ্ট্র প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানকে ভাল বা মন্দ বলা হয় তাদের নিজস্ব দোষগুণের জন্য নয়, বরং তাদের মাধ্যমে নাগরিকদের ভাল কিংবা অনিষ্ট করা হয় বলে। মানবাধিকারের যথার্থ বিকাশ ঘটে সমাজের গণমানুষের সুযোগ-সুবিধার সঠিক সংরক্ষণ ও বিলি বণ্টনের মধ্য দিয়ে। আর মানুষের মৌলিক অধিকার যথার্থভাবে সংরক্ষিত হতে পারে উগ্র ব্যক্তিবাদ ও সর্বাত্মক একচ্ছত্রবাদ এ দুই চরম একপেশে মতবাদের কোন একটির মাধ্যমে নয়, বরং এদের মধ্যবর্তী এক সমন্বয়ী রাষ্ট্রব্যবস্থায়। এ যুক্তিতেই মানবিক মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকার, যোগ্যতা অনুযায়ী প্রত্যেকের কর্মসংস্থানের, কাজের বিনিময়ে পারিশ্রমিকের এবং ব্যবসা-বাণিজ্য করার অধিকারের দাবি আজ ধাবিত হচ্ছে দিকে দিকে। অতীতে কৃষিভিত্তিক সমাজব্যবস্থায় এ অধিকার তেমন একটা গুরুত্ব পায়নি। কিন্তু আধুনিক শিল্পকেন্দ্রিক সমাজের বিকাশ প্রক্রিয়ায় জীবনধারণের উপায় অনেক ক্ষেত্রে ব্যক্তির নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। এসব বিষয় যেহেতু সামাজিক আওতার অন্তর্গত, সেজন্যই সমাজকে প্রতিটি ব্যক্তির বেঁচে থাকার অধিকার স্বীকার করতে হয়। সাধারণত মানুষ যেহেতু কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতে পারে, সেজন্য তাকে কাজ থেকে বঞ্চিত করার মানেই হলো ব্যক্তিত্ব বিকাশের সুযোগ বঞ্চিত করা। যদি কোনো একজনকে কাজ দেয়া না যায়, তা হলে সমাজ ও রাষ্ট্রেকে দেখতে হবে যে, মানুষ হিসেবে সুখ শান্তিতে বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় সব সুযোগ সুবিধা সেও যেন সকলের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিতে পারে। এ যুক্তিতেই পাশ্চাত্যের অনেক দেশে আজকাল বেকারভাতা, বেকারবীমা প্রভৃতি নানারকম সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয়।
তবে এখানে এ কথাও বলে রাখা দরকার যে বেঁচে থাকার জন্য মানুষমাত্রেরই অন্ন, বস্ত্র ও বাসস্থানের প্রয়োজন অনস্বীকার্য হলেও এ প্রাথমিক প্রয়োজন মেটানোই মানুষের জন্য যথেষ্ট নয়। কথায় বলে, ম্যান ডাজ নট লিভ বাই ব্রেড এলোনÑ মানুষ কেবল খেয়ে পরেই বেঁচে থাকতে চায় না। মানুষ ভালোভাবে, মানুষের মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকতে চায়। আর তা চায় বলেই অন্ন বস্ত্র বাসস্থানের বাইরেও সে কিছু বাড়তি জিনিস প্রত্যাশা করে। এমতাবস্থায় মুষ্টিমেয় কিছু লোক আরাম আয়েশে থাকবে, আর বিপুল সংখ্যক সাধারণ মানুষ দুঃখ-দারিদ্র্য-বাঞ্চনায় কাল কাটাবে, এটা হতে পারে না, কোনো সচেতন মানুষই তা মেনে নিতে পারে না। আর তাই ‘অন্ন চাই’ ‘বস্ত্র চাই’ প্রভৃতি দাবির পাশাপাশি মানুষ আজ ‘বাঁচার মতো বাঁচাতে চাই’ ধ্বনি তুলছে সোচ্চার কণ্ঠে। এ দাবি আজ সুবিদিত যে, মৌলিক মানবাধিকার সার্বজনীন; এ অধিকার কারো প্রতি অন্য কারো (ব্যক্তি গোষ্ঠী বা রাষ্ট্র) বিশেষ করুণা কিংবা অনুগ্রহের ব্যাপার নয়। মানবাধিকারমাত্রই মানুষের ন্যায্য অধিকার; আর এজন্যই এসব মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রাথমিক কর্তব্য। একই সঙ্গে এও মনে রাখা দরকার যে, সমাজ ও রাষ্ট্রের বৃহত্তর কল্যাণে ব্রতী হওয়া প্রত্যেকেরই কর্তব্য; কারণ প্রত্যেকেই সমাজ ও রাষ্ট্রের একজন সদস্য এবং সেই সামাজিক কল্যাণ অকল্যাণের অংশীদার। তবে সামাজিক কল্যাণের দোহাই দিয়ে কারো নাগরিক অধিকার ও সুখ-সুবিধাকে কিছুতেই উপেক্ষা করা যায় না। একথা সহজেই বোধগম্য যে, কোনো সচেতন সভ্য সমাজে জোর যার ম্ল্লুুক তার এ নীতি চলে না, চলতে পারে না। সমাজের সবার ন্যায্য অধিকার সুরক্ষার পারস্পরিক সহিষ্ণুতা, সদ্ভাব-সম্প্রীতি ও আদান প্রদান অপরিহার্য। অন্য কথায়, হিংসা বিদ্বেষ, সংঘাত সহিংসতা নয়, পারস্পরিক সহযোগিতা ও সমঝোতারভিত্তিতেই রচনা করতে হবে দেশ ও দেশের ব্যাপক কল্যাণ। নিশ্চিত করতে হবে সামাজিক ন্যায়-সুবিচার ও সুখ-শান্তি। এটাই হওয়া উচিত বিজ্ঞান-রাষ্ট্র-ধর্ম-দর্শন ও নীতিবিজ্ঞানের মূল লক্ষ্য।
এখানেই প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে যথার্থ শিক্ষা অধিকার ও প্রয়োজনীয়তার কথা। মা-বাবার আর্থিক অবস্থা যাই হোক না কেন, সমাজের প্রত্যেকটি শিশুরই লেখাপড়া করার এবং নিজেকে ও পরিবেশকে জানার অধিকার আছে। শিক্ষা-দীক্ষার মাধ্যমে জ্ঞানার্জন সফল ও স্বাভাবিক জীবনের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় এবং এ অধিকার অন্যান্য অধিকার অর্জনের জন্য অপরিহার্য। জগৎ ও জীবন সম্পর্কে ধারণা আত্মরক্ষার জন্য যেমন, সৃষ্টিশীল অর্জনের জন্যও তেমনি প্রয়োজনীয়। আমরা জানি সফল জীবনযাত্রা এক সুকঠিন সার্বক্ষণিক সংগ্রাম। বহুবিধ জটিলতা ও চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে আমাদের অগ্রসর হতে হবে প্রতিনিয়ত। এসব জটিলতা নিরসন ও চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় যথার্থ শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু প্রকৃত শিক্ষার মূল লক্ষণ কী? এ প্রশ্নের সদুত্তর বর্তমান যন্ত্রকেন্দ্রিক সভ্যতার সঙ্কটময় সময়ের এক বড় প্রয়োজন। শিক্ষাকে অব্যশই হতে হবে এমন যেখানে মানুষ একদিকে হবে বিদ্বান এবং অন্যদিকে হবে হৃদয়বান ও মহৎপ্রাণ। যে শিক্ষা ব্যবস্থায় দৈনিক ও জৈবিক চাহিদা মোটবার ব্যবস্থা আছে, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি বিকাশের যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা আছে, কিন্তু দয়া-মায়া প্রেম প্রভৃতি মানবিক মূল্যবোধের স্বীকৃতি ও তাগিদ নেই, সে শিক্ষা একপেশে ও অকার্যকর সন্দেহ নেই। বিজ্ঞান-প্রযুক্তিতে সর্বাধুনিক প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে, অথচ শিক্ষার্থী মানুষ হচ্ছে না, সজ্জন হচ্ছে না এটা আর যাই হোক প্রকৃত শিক্ষা নয়। ফ্রান্সিস বেকন শিক্ষাকে শক্তি বলে অভিহিত করেছেন। কিন্তু এই শক্তিকে যদি আমরা অস্ত্র বলি, তাহলে সে অস্ত্র দিয়ে যেমন অস্ত্রোপচার করে একটি মুমূর্ষু রোগীকে বাঁচানো যায়, আবার একই অস্ত্র দিয়ে মানুষ দিয়ে মানুষ খুনও করা যায়। জার্মানির নাজি এবং ইতালির ফ্যাসিস্ট সরকারসহ অনেক স্বৈরশাসকই শিক্ষাকে ব্যবহার করছে তাদের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার অসৎ উদ্দেশ্যে। সুতরাং শিক্ষারূপ আলো বা অস্ত্র দিয়ে কে কী করবে তা পুরোপুরি নির্ভরশীল সংশিষ্ট ব্যক্তি বা গোষ্ঠির সদিচ্ছা, মূল্যবোধ ও নীতিবোধ থাকা না থাকার ওপর। ইতিহাস থেকে এমন দৃষ্টান্ত পাই যে, শিক্ষা একটি সভ্যতা-সংস্কৃতিকে যেমন গড়তে পারে, তেমনি আবার চূর্ণও করে দিতে পারে। তার মানে শিক্ষাব্যবস্থার মূলে একটা নৈতিক ও মানবিক লক্ষ্য থাকা চাই। তা না হলে শিক্ষা (তা বৈষয়িক ও প্রায়োগিক দিক থেকে যত বড় অর্জনই বয়ে আনুক না কেন) ব্যথর্, এমন কি প্রাণঘাতী হতে পারে। যাই হোক, এর আগে বিশ্বপরিস্থিতি সম্পর্কে যেসব দুঃখ ও ক্ষোভের কথা বললাম সেগুলো আমাদের দেশের বেলায়ও কমবেশি প্রযোজ্য। তামাম দুনিয়া জানে বহু ত্যাগ তিতিক্ষার মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করলাম, যাত্রা শুরু করলাম ন্যায় ও সুনীতিভিত্তিক এক গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার দিকে। কিন্তু সেই থেকে দীর্ঘ চার দশক অতিক্রান্তির পরও আজ পর্যন্ত আমরা পারলাম না ঐক্যবদ্ধ হতে, পেলাম না শান্তি ও স্বস্তির স্বাদ। আমাদের জাতীয় জীবনের মূলমন্ত্রটা যেখানে হওয়া উচিত ছিল ‘যত মত তত পথ’, সেখানে ক্রমাগত লক্ষ্য করছি ‘যত মত তত সংঘাত’। বিশেষ করে পীড়াদায়ক মনে হয় সরকার ও বিরোধী দলের অব্যাহত দূরত্ব ও দ্বন্দ্বের ব্যাপারটিকে। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ বিকাশের পক্ষে মারাত্মক অন্তরায় এই বিরোধ সব সরকারের আমলেই একইভাবে অব্যাহত রয়েছে। স্বাভাবতই প্রশ্ন ওঠে অতীতের বহু বিপদ আপদে বিশেষ করে স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে এককাতারে দাঁড়িয়ে লড়াই করলেন যাঁরা (বিশেষ করে দুটি প্রধান রাজনৈতিক দল), এখন কেন তাঁরা পারছেন না সুস্থ গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ অনুশীলন করতে, এমনকি এক দল অন্য দলকে সহ্য করতে? এ এক গুরুতর মনস্তাত্ত্বিক প্রশ্ন বটে। এই জটিল প্রশ্নের সদুত্তর আবিস্কারের স্থান এটা নয়, এ ক্ষুদ্র পরিসরে সে আলোচনাও সম্ভব নয়। তবে এ অনাকাক্সিক্ষত উপদ্রব থেকে অব্যাহতির উপায় সম্পর্কে এটুকু বলা যায় যে, এর জন্য চাই সংশ্লিষ্ট নেতা-নেত্রী ও রাজনৈতিক কর্মীদের সেই সযতœ আত্ম-নির্দেশনা যার পারিভাষিক নাম ‘auto-suggestion’। দেশ ও দশের সামগ্রিক স্বার্থেই কি, সংসদ কি রাজপথ সর্বত্রই তাঁদের অনুসরণ করতে হবে সহিষ্ণুতা ও সহমর্মিতার মহান পথ। একথা যতটুকু প্রযোজ্য সরকারের বেলায়, ততটুকুই প্রযোজ্য বিরোধী দলের বেলায়; কারণ সরকার যেমন জনগণের নির্বাচিত সরকার, বিরোধী দলও একই জনগণেরই নির্বাচিত ছায়া সরকার। সুতরাং উভয়কেই পারস্পরিক শ্রাদ্ধাবোধ ও সুস্থ প্রতিযোগিতার মানসিকতা নিয়ে কাজ করার রাজনৈতিক কালচার গড়ে তুলতে হবে। তাঁরা যখন তা করবেন, তখনই জনগণ পাবে স্বস্তি, তখনই দেশে আসবে প্রকৃত শান্তি ও সমৃদ্ধি, এবং তখনই সাথর্ক হবে আমাদের রক্তক্ষয়ী মহান স্বধীনতা ও এ সংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অপার আত্মত্যাগ ও নিঃস্বার্থ রক্তদান।
এই একই সহযোগিতা, সহমর্মিতা ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ অপরিহার্য আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্বন্ধ ও আন্তর্জাতিক মানবসম্পর্কের বিস্ফোরণ স্পর্কে ক্ষেত্রে। হিংসা-বিদ্বেষ, অন্যায় আগ্রাসন, বিচ্ছিন্নতা শূণ্যতাবোধ প্রভৃতির সমবায়ে আজ বিশ্বব্যাপী যে মনস্তাত্ত্বিক মন্দ্ভাব, অনাস্থা ও মানবিক সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে, তার হাত থেকে অব্যাহতি পেতে হলে সংশিষ্ট সকলকে উপলব্ধি করতে হবে যে, বিজ্ঞান প্রযুক্তির কল্যাণে জল-স্থল-অন্তরীক্ষে মানুষের আধিপত্য যতই বাড়–ক না কেন, পরাশক্তি যতই পরাক্রমশালী হোক না কেন, মানবিক মূল্যবোধের আন্তরিক মনন ও অনুশীলন ব্যতিরেকে মাটির পৃথিবীতে কখনো শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরে আসবে না। আগেই বলছি এ সত্য বারবার প্রমাণিত হয়েছে মানুষের অতীত ইতিহাসে সাম্রাজ্যের উত্থান-পতন ও শক্তিমদমত্ত রাজ-রাজাড়াদের গ্লানিকর পরিণতির মধ্য দিয়ে। আজ যারা বিশ্বে একধিপত্য প্রতিষ্ঠার অভিলাষে কথায় কথায় শক্তি প্রয়োগের হুমকি দিচ্ছেন, অনৈতিক আগ্রাসনের পথ বেছে নিচ্ছেন, তাদের উদ্দেশ্যে বলি : অতীতে যা ঘটেছে অবিবেচক ও অত্যাচারীদের বেলায় তা যে আপনাদের বেলায়ও ঘটতে পারে, এ কথা একবার ভেবে দেখেছেন কি? একথা তো অনস্বীকার্য যে জন্ম থেকে শুরু করে রোগ, শোক, জরা, মৃত্যু পর্যন্ত এমন কিছু মৌলিক বিষয় আছে যেগুলো সসীম মানুষের ( এমন কি পরাশক্তির) নিয়ন্ত্রণের বাইরে; আর তাই নতুন নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবন দ্বারা প্রাকৃতিক দুর্যোগ অনেকাংশে ঠেকাতে পারলেও মাটির মানুষ কখনো জরা-মৃত্যুর অনিবার্যতাকে ঠেকাতে পারবে না। যৌবনের পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মানুষ (এমনকি পরাশক্তিমান দেশের খোদ শীর্ষ ব্যক্তিটিও) ক্রমশ ক্ষয় হবেই। যোশেফ নীডহ্যাম মানুষের এই সীমাবদ্ধতাটাকেই অভিহিত করেছেন ক্রীচারলিনেস বলে। এখানেই অসীমের সঙ্গে সসীমের, বিশ্ববিধাতার সঙ্গে মানুষের পার্থক্য; এটাই সৃষ্টির সেরা মানুষের পরম অসহায়তা, যা-কিনা কোনো পঞ্চবর্ষিকী পরিকল্পনা কিংবা অন্য কোনো মানিবিক কলাকৌশল দ্বারা নিরসনযোগ্য নয়।
যাই হোক, বর্তমান বিশ্বব্যাপী শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা ও চরম হা-হুতাশের মধ্যেও কিছু আশার কথা বলতে চাই। পরাক্রমশীলদের বোধোদয় কবে হবে, আদৌ হবে কিনা জানি না কিন্তু তবু আমি দুঃখ-ক্লেশ ও বিপদ আপদের কালোমেঘ দেখে ভয় পেতে চাই না। কোনো অপ্রীতিকর অবস্থাকেই জগৎ ও জীবনের শেষ পর্যায় বলে মনে করি না; কারণ এ জগৎসংসার ও মানবজীবন সুন্দর কুৎসিতে ইষ্টানিষ্টে ও আনন্দ বেদনায় মিথুনীকৃত। এখানে যেমন আছে আধি-ব্যাধি-দুঃখ-বঞ্চনা তেমনি আছে সুস্বাস্থ্য, সুখ, সৌন্দর্য ও আনন্দ। এমতাবস্থায় সুস্থ ও সুখকর জীবনের জন্য যে দৃষ্টিভঙ্গি ও জীবনদর্শনকে যুক্তিসঙ্গত বলে মনে করি এবং যা অনুশীলনের পক্ষপাতী, তা একপেশে নৈরাশ্যবাদ নয়, আবার আত্মতৃপ্ত কল্যাণবাদও নয়। আমার এ জীবনদর্শনের নাম দিতে চাই উন্নয়নবাদ। এ মতে জগৎ সম্পূর্ণ শুভ কিংবা সবৈধ অশুভ এ দুয়ের কোনটিই নয়।
মানুষের শ্রম ও সদিচ্ছার মাধ্যমে দুঃখ বিমোচন ও কল্যাণ প্রতিষ্ঠা সম্ভব। ঘোর দুর্দিনের মধ্যেও রচনা করা যায় সুদিনের ভিত্তি। হালের পরিস্থিতি অবশ্য খুবই নাজুক, নীতিবোধ মূল্যবোধের অবক্ষয় সুস্পষ্ট, প্রাকৃতিক দুর্দৈব ও মানবিক নৃশংসতার মাত্রাও লোমহর্ষক। এ সবকিছু মিলিয়ে গতি মন্থর হলেও একেবারে অনুপস্থিত নয়। একদিকে হৃদয়হীন যুদ্ধবাজ নেতারা যেমন আগ্রাসনে নিরীহ ও সাধারণ মানুষের প্রাণসংহারে অটল, অন্যদিকে যুদ্ধবিরোধী আন্দোলন এবং শান্তির আকাক্সক্ষা দেশে দেশে প্রবল। অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে বিবেকের প্রতিবাদ প্রতিরোধের সংকেতও সুস্পষ্ট। এমতাবস্থায় জগতের আধি-ব্যাধি,দ্বন্দ্ব-কলহ, দুর্ভিক্ষ-দারিদ্র প্রভৃতি রূঢ় বাস্তবতাকে মেনে নিয়েই আমাদের অগ্রসর হতে হবে এবং উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে প্রতিকূল শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করেই সংহত করতে হবে নৈতিক ও মানবিক আদর্শকে। এ কথারই সংকেত ও সমর্থন পাওয়া যায় প্লেটোর সংলাপে। বন্ধু গ্লোকনকে লক্ষ্য করে সক্রোটিস বলেন, হে গ্লোকন পৃথিবী থেকে কোনোদিনই অশুভ-অমঙ্গল সম্পূর্ণ উবে যাবে না। আর যাবেই বা কী করে? আমরা যাকে অশুভ বলি তাতো সেই অপূর্ণতারই নাম যার সঙ্গে অব্যাহত লড়াই করে অর্জন করতে হয় নৈতিক উৎকর্ষ, সমুন্নত রাখতে হয় মানবজীবনের মহত্ত্ব ও মর্যাদা।
কথায় বলে, truth triumphs in the long run আর আমার নিজেরও বিশ্বাস আজ হোক কাল হোক মনুষ্যত্বের কাছে পাশবিকতা এক দিন হার মানবেই, সব বিপাক-বিপত্তির মধ্যেও জগৎ নৈতিক প্রগতির দিকে অগ্রসর হবে এবং পরিণামে মানুষ শুভ শ্রেয় সুন্দরের সন্ধান পাবে। আর তাই শত ঝড়-ঝাপ্টার মধ্যেও ভাঙ্গা হাল ও ছেঁড়া পাল নিয়েই আমাদের ক্রমান্বয়ে এগিয়ে যেতে হবে সুখশান্তি ও অগ্রগতির পথে এবং পাশব শক্তির মোকাবেলা করেই সংহত করতে হবে সত্য সুন্দর কল্যাণের শক্তিকে। তাতেই আশা করি একদিন পরিসমাপ্তি ঘটবে বর্তমান মানবসঙ্কটের, তাতেই সহজ ও সুগম হবে মানবজাতির সুখ-শান্তি ও নিরাপত্তার পথ।
লেখক: অধ্যাপক, দর্শন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
যা মিলিয়ে জীবনের স্বাদ
তার হোলো রসবিপর্যয়।
বিশেষ করে আন্তর্জাতিক মানব সম্পর্কের ক্ষেত্রে চলছে সীমাহীন নৈরাজ্য, প্রতাপশালীদের চরম খামখেয়াল ও শক্তিমদমত্ততা। তাইতো দেশে দেশে, এমনকি একই দেশের বিভিন্ন সম্প্রদায়ে চলছে নরমেধযজ্ঞ। একই কারনে যুদ্ধের শিকার হলো ইরাকের নীরহ জনগণ, চূর্ণ হয়ে গেল দেশটির স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব। শুধু ইরাকই নয় কোরীয় উপদ্বীপ, ইরান, ফিলিস্তিনিসহ গোটা মধ্যপ্রাচ্যে এবং উপমহাদেশ ও আফ্রিকার আরো অনেক ঝঞ্ঝাবিধ্বস্ত রাষ্ট্রে মানুষের যে চেহারা দেখা যাচ্ছে তা নিঃসন্দেহে এক অসহায় পীড়িত চেহারা। বুঝতে কষ্ট হচ্ছে না যে, বিশ্বময় একাধিপত্য বিস্তারের জন্য শক্তি, প্রতারণা, মিথ্যাচার, নৃশংসতা, কপটতা প্রভৃতি সব ম্যাকিয়্যাভেলীয় কূটকৌশল ব্যবহার করে চলছে বিশ্বের একমাত্র পরাশক্তি ও তার কিছু তাবেদার রাষ্ট্র। ভাবতে অবাক লাগে, এ শক্তিচক্র কিছুতেই আঁচ করতে পারছেন না সেই সম্ভাব্য মহাপ্রলয়ের ভয়াবহতা, যা অন্য সকলকে ধ্বংস করার সঙ্গে ধ্বংস করে ফেলবে তাদের নিজেদেরকেও। এ কেবল কারো মনগড়া কথার কথা নয়, এ এক অভ্রান্ত অকাট্য সত্য। এ সত্য অতীতের অনেকবার প্রমাণিত হয়েছে মানুষের সভ্যতা-সংস্কৃতির ইতিহাসে, বহু সাম্রাজ্যের উত্থান পতন রাজ-রাজড়াদের গ্লানিকর ক্ষমতাচ্যুতি ও মর্মান্তিক পরিণতির মধ্য দিয়ে।
এসব কথা বলার অর্থ এই যে, হালের চরম বস্তুবাদী ভোগবাদী মনোবৃত্তি, প্রযুক্তির একপেশে অগ্রগতি মানুষকে বিপুল বিত্ত ও যন্ত্রশক্তি উপহার দিয়েছে বটে, কিন্তু তার চিত্তের প্রসার ঘটাতে, ঐক্য ও প্রেমানুভূতির পরিবেশ সৃষ্টিতে ব্যর্থ হয়েছে। এমতাবস্থায় ধর্ম, বিজ্ঞান, রাজনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য তথা দ্রুত প্রসারমাণ বিজ্ঞান-প্রযুক্তির সঙ্গে সুনীতির সংযোজন ও সমন্বয় সময়ের এক জরুরী প্রয়োজন। আমার মতে, এ নবনৈতিকতার নির্যাস হবে মানবকল্যাণ। ব্যাপক ও দীর্ঘস্থায়ী মানবকল্যাণ। এ মানদণ্ড অনুসারে মানুষের একটি কাজ ভাল ও বাঞ্ছনীয় বলে বিবেচতি হতে পারে কেবল তখনই, যখন তা তার নিজের জন্য যেমন, সমাজের অন্যান্য মানুষের জন্যও তেমনি কল্যাণকর। যে কাজ মানুষের ন্যায্য অধিকারের স্বীকৃতি এবং মানুষ্যত্বের প্রতি শ্রদ্ধার ওপর প্রতিষ্ঠিত, যা সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তাবোধ সৃষ্টি করে তাই ভাল, তাই বাঞ্ছনীয় ও অনুমোদনযোগ্য। আর যে কাজের ফলাফল এর উল্টো, অর্থাৎ যা সমাজে হিংসা-বিদ্বেষ হানাহানি সৃষ্টি করে, তাই গর্হিত ও অমানবোচিত কাজ। আমরা এই নতুন মতের নাম দিতে পারি কল্যাণবাদ। কল্যাণবাদ অনুসারে পারস্পরিক আদান প্রদান ও সহযোগিতা সমঝোতারভিত্তেতে অর্জন করতে হবে মানুষের ব্যাপক কল্যাণ, নিশ্চিত করতে হবে সামজিক ন্যায় ও সুবিচার। মনে রাখতে হবে যে, সামাজিক চেতনা মানুষের একটি মূল্যবান গুণ। ব্যক্তি নিজে বেঁচে থেকেই কিংবা তার নিজের অস্তিত্বকে সংগঠিত করেই সুখী হতে পারে না। জোর যার মুল্লুক তার এই নীতি মানবসমাজে সুখ শান্তি বয়ে আনতে পারে না। যেকোনো মানবিক সমস্যার সমাধান হওয়া উচিত পারস্পরিক সহযোগিতা সমঝোতা ও সৌহার্দ্য-সম্প্রীতির মাধ্যমে। এরই পারিভাষিক নাম মর্যালিটি বা নৈতিকতা। একেই আবার আমরা বলি কালচার, ভদ্রতা বা নীতিপরায়ণতা। আপন অধিকার সংরক্ষণ যেমন মানুষের কর্তব্য, অপরের অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীলতাও তার সামাজিক ও নৈতিক দায়িত্ব। মানুষ স্বাধীন হয় অপরের স্বাধীনতাকে হরণ করে নয়, শ্রদ্ধা ও স্বীকার করে। তাই তো অন্ধ প্রবৃত্তির চাপের মুখেও কত না মহৎপ্রাণ মানুষ ব্রতী হয়েছেন সমাজকল্যাণ প্রতিষ্ঠায়, এমন কি অকাতরে প্রাণ পর্যন্ত উৎসর্গ করেছেন আর্তমানবতার দুঃখ দুর্দশা মোচনে। এ যুক্তিতেই তো মহামতি এরিস্টটল বলেছিলেন, মানুষ একটি সামাজিক জীব; আর যে সমাজে বাস করে না সে মানুষ নয়, বরং হয় একজন ফেরেস্তা নয়তো একটি জানোয়ার। সমাজের আর দশজনকে বাদ দিয়ে কখনো কারো নিজের ব্যক্তিত্ব বিকশিত হতে পারে না; একক প্রচেষ্টায় কেউই কখনো তার সব অভাব মেটাতে পারে না। রবীন্দ্রনাথ যথার্থই বলেছেন, একটি প্রদীপ যেমন একা রাতের অন্ধকার ঘোচাতে পারে না, তেমনি কোন ব্যক্তিবিশেষের একক চেষ্টায়ও মানবসমাজের ব্যাপক কল্যাণ সাধিত হয় না। এর জন্য প্রয়োজন ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সব মহলের সমবেত প্রচেষ্টা।
এখানে নৈতিকতার সঙ্গে মানুষের অধিকার ও দায়িত্ববোধের সম্বন্ধের বিষয়টা প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে। কারণ, অধিকার ও দায়িত্ববোধ এমন দুটি জিনিস যা থাকা না থাকার ওপর বহুলাংশে নির্ভর করে মানুষের সুখ দুঃখ, শান্তি নিরাপত্তা। এমতাবস্থায় অন্ন,বস্ত্র,বাসস্থান, শিক্ষা, প্রভৃতি যেকোন এক বা একাধিক মৌলিক অধিকার না থাকার কারনে কারো স্বাভাবিক জীবনযাত্রা যদি ব্যাহত হয়, তাহলে তা রাষ্ট্রের কাছে প্রত্যাশা ও দাবি করার অধিকার সে নাগরিকের আছে। আর তা পূরণ করাও রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের দায় দায়িত্বের অন্তর্গত। মানবাধিকার ইদানীংকালের একটি বহুল আলোচিত বিষয় বটে। তবে এ বিষয়ে মানুষের চিন্তা ভাবনা ও আলাপ আলোচনার সূত্রপাত বহুকাল আগে। অতীতে এক সময় অধিকারকে দেখা হতো প্রকৃতি থেকে প্রাপ্ত জন্মগত অধিকার হিসেবে। এ মতে, এমন কিছু অধিকার আছে যেগুলো মানুষমাত্রই জন্মসূত্রে পেয়ে থাকে। এসব অধিকার যেহেতু প্রকৃতিদত্ত ও জন্মগত, সুতরাং এরা মৌলিকও বটে। এরা অলঙ্ঘনীয় ও অপরিবর্তনীয় মৌলিক অধিকার; সুতরাং এগুলোর নিশ্চয়তা বিধান সমাজ ও রাষ্ট্রের দায়িত্ব। ব্যক্তি নিজে যেমন তার কোন মৌলিক অধিকার অন্যের কাছে হস্তান্তর করতে পারে না, তেমনি সমাজ বা রাষ্ট্রও কারো মৌলিক অধিকারে হস্তক্ষেপ করতে কিংবা কারো কাছ থেকে তার মৌলিক অধিকারে হস্তক্ষেপ করতে কিংবা কারো কাছ থেকে তার মৌলিক অধিকার ছিনিয়ে নিতে পারে না। অধিকারমাত্রই, মানবিক অধিকার এবং এসব অধিকার মানুষের উদ্দেশ্য সাধনে, জীবনের নূন্যতম চাহিদা পূরণে সহায়ক। যথার্থ অধিকার তাই যা নিশ্চিত করে ব্যক্তির স্বচ্ছন্দ জীবন, সহজ ও সুগম করে দেশ ও দশের সামগ্রিক কল্যাণ।
অতীতে একসময় একচ্ছত্রবাদ নামে যে রাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থা প্রচলিত ছিল এবং যা এখন ক্রমবিলীয়মান, তাতে ব্যক্তির মৌলিক অধিকারের কোন স্বীকৃতি ছিল না। এ ব্যবস্থা ছিল পুরোপুরি রাষ্ট্রবাদী এবং এতে ‘ব্যক্তির জন্য সমাজ’ কথাটার পরিবর্তে ‘সমাজের জন্য ব্যক্তি’ কথাটা বিবেচিত হতো সঙ্গত বলে। এ ব্যবস্থায় অধিকার বলতে বোঝাতো রাষ্ট্রের অধিকার; আর নাগরিক সাধারণের যা প্রাপ্য বলে প্রচার করা হত, তা অধিকার নয়, রাষ্ট্রের প্রতি ব্যক্তির কেবল কর্তব্যপালন। এ ব্যবস্থায় নাগরিক অধিকার বলে যা কিছু থাকবে, তা কোন প্রাকৃতিক বা মানবিক অলঙ্ঘনীয় অধিকার নয়, বরং রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের মর্জিমাফিক নাগরিকদের দেয়া কিছু সুযোগ সুবিধা।
এ ধরনের একচ্ছত্রবাদী মত বহুলাংশে স্বেচ্ছাচারী, এবং এজন্যই তা গ্রহণযোগ্য নয়, হতেও পারে না। মনে রাখতে হবে যে, রাষ্ট্র রক্ত মাংসে গড়া কোনো সচেতন সত্তা নয়; আর নাগরিকদের সুখ দুঃখ, সুবিধা-অসুবিধার কথা বাদ দিয়ে রাষ্ট্রের আলাদা কোনো লক্ষ্যের কথাও ভাবা যায় না। আমরা যাকে রাষ্ট্র বলি, তা নিজে কখনো ন্যায়, সুনীতি ও সামাজিক কল্যাণ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নয়, বরং নাগরিক সাধারণের লক্ষ্য অর্জনের একটি উপায় বা মাধ্যমমাত্র। সমাজ, রাষ্ট্র প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানকে ভাল বা মন্দ বলা হয় তাদের নিজস্ব দোষগুণের জন্য নয়, বরং তাদের মাধ্যমে নাগরিকদের ভাল কিংবা অনিষ্ট করা হয় বলে। মানবাধিকারের যথার্থ বিকাশ ঘটে সমাজের গণমানুষের সুযোগ-সুবিধার সঠিক সংরক্ষণ ও বিলি বণ্টনের মধ্য দিয়ে। আর মানুষের মৌলিক অধিকার যথার্থভাবে সংরক্ষিত হতে পারে উগ্র ব্যক্তিবাদ ও সর্বাত্মক একচ্ছত্রবাদ এ দুই চরম একপেশে মতবাদের কোন একটির মাধ্যমে নয়, বরং এদের মধ্যবর্তী এক সমন্বয়ী রাষ্ট্রব্যবস্থায়। এ যুক্তিতেই মানবিক মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকার, যোগ্যতা অনুযায়ী প্রত্যেকের কর্মসংস্থানের, কাজের বিনিময়ে পারিশ্রমিকের এবং ব্যবসা-বাণিজ্য করার অধিকারের দাবি আজ ধাবিত হচ্ছে দিকে দিকে। অতীতে কৃষিভিত্তিক সমাজব্যবস্থায় এ অধিকার তেমন একটা গুরুত্ব পায়নি। কিন্তু আধুনিক শিল্পকেন্দ্রিক সমাজের বিকাশ প্রক্রিয়ায় জীবনধারণের উপায় অনেক ক্ষেত্রে ব্যক্তির নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। এসব বিষয় যেহেতু সামাজিক আওতার অন্তর্গত, সেজন্যই সমাজকে প্রতিটি ব্যক্তির বেঁচে থাকার অধিকার স্বীকার করতে হয়। সাধারণত মানুষ যেহেতু কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতে পারে, সেজন্য তাকে কাজ থেকে বঞ্চিত করার মানেই হলো ব্যক্তিত্ব বিকাশের সুযোগ বঞ্চিত করা। যদি কোনো একজনকে কাজ দেয়া না যায়, তা হলে সমাজ ও রাষ্ট্রেকে দেখতে হবে যে, মানুষ হিসেবে সুখ শান্তিতে বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় সব সুযোগ সুবিধা সেও যেন সকলের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিতে পারে। এ যুক্তিতেই পাশ্চাত্যের অনেক দেশে আজকাল বেকারভাতা, বেকারবীমা প্রভৃতি নানারকম সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয়।
তবে এখানে এ কথাও বলে রাখা দরকার যে বেঁচে থাকার জন্য মানুষমাত্রেরই অন্ন, বস্ত্র ও বাসস্থানের প্রয়োজন অনস্বীকার্য হলেও এ প্রাথমিক প্রয়োজন মেটানোই মানুষের জন্য যথেষ্ট নয়। কথায় বলে, ম্যান ডাজ নট লিভ বাই ব্রেড এলোনÑ মানুষ কেবল খেয়ে পরেই বেঁচে থাকতে চায় না। মানুষ ভালোভাবে, মানুষের মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকতে চায়। আর তা চায় বলেই অন্ন বস্ত্র বাসস্থানের বাইরেও সে কিছু বাড়তি জিনিস প্রত্যাশা করে। এমতাবস্থায় মুষ্টিমেয় কিছু লোক আরাম আয়েশে থাকবে, আর বিপুল সংখ্যক সাধারণ মানুষ দুঃখ-দারিদ্র্য-বাঞ্চনায় কাল কাটাবে, এটা হতে পারে না, কোনো সচেতন মানুষই তা মেনে নিতে পারে না। আর তাই ‘অন্ন চাই’ ‘বস্ত্র চাই’ প্রভৃতি দাবির পাশাপাশি মানুষ আজ ‘বাঁচার মতো বাঁচাতে চাই’ ধ্বনি তুলছে সোচ্চার কণ্ঠে। এ দাবি আজ সুবিদিত যে, মৌলিক মানবাধিকার সার্বজনীন; এ অধিকার কারো প্রতি অন্য কারো (ব্যক্তি গোষ্ঠী বা রাষ্ট্র) বিশেষ করুণা কিংবা অনুগ্রহের ব্যাপার নয়। মানবাধিকারমাত্রই মানুষের ন্যায্য অধিকার; আর এজন্যই এসব মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রাথমিক কর্তব্য। একই সঙ্গে এও মনে রাখা দরকার যে, সমাজ ও রাষ্ট্রের বৃহত্তর কল্যাণে ব্রতী হওয়া প্রত্যেকেরই কর্তব্য; কারণ প্রত্যেকেই সমাজ ও রাষ্ট্রের একজন সদস্য এবং সেই সামাজিক কল্যাণ অকল্যাণের অংশীদার। তবে সামাজিক কল্যাণের দোহাই দিয়ে কারো নাগরিক অধিকার ও সুখ-সুবিধাকে কিছুতেই উপেক্ষা করা যায় না। একথা সহজেই বোধগম্য যে, কোনো সচেতন সভ্য সমাজে জোর যার ম্ল্লুুক তার এ নীতি চলে না, চলতে পারে না। সমাজের সবার ন্যায্য অধিকার সুরক্ষার পারস্পরিক সহিষ্ণুতা, সদ্ভাব-সম্প্রীতি ও আদান প্রদান অপরিহার্য। অন্য কথায়, হিংসা বিদ্বেষ, সংঘাত সহিংসতা নয়, পারস্পরিক সহযোগিতা ও সমঝোতারভিত্তিতেই রচনা করতে হবে দেশ ও দেশের ব্যাপক কল্যাণ। নিশ্চিত করতে হবে সামাজিক ন্যায়-সুবিচার ও সুখ-শান্তি। এটাই হওয়া উচিত বিজ্ঞান-রাষ্ট্র-ধর্ম-দর্শন ও নীতিবিজ্ঞানের মূল লক্ষ্য।
এখানেই প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে যথার্থ শিক্ষা অধিকার ও প্রয়োজনীয়তার কথা। মা-বাবার আর্থিক অবস্থা যাই হোক না কেন, সমাজের প্রত্যেকটি শিশুরই লেখাপড়া করার এবং নিজেকে ও পরিবেশকে জানার অধিকার আছে। শিক্ষা-দীক্ষার মাধ্যমে জ্ঞানার্জন সফল ও স্বাভাবিক জীবনের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় এবং এ অধিকার অন্যান্য অধিকার অর্জনের জন্য অপরিহার্য। জগৎ ও জীবন সম্পর্কে ধারণা আত্মরক্ষার জন্য যেমন, সৃষ্টিশীল অর্জনের জন্যও তেমনি প্রয়োজনীয়। আমরা জানি সফল জীবনযাত্রা এক সুকঠিন সার্বক্ষণিক সংগ্রাম। বহুবিধ জটিলতা ও চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে আমাদের অগ্রসর হতে হবে প্রতিনিয়ত। এসব জটিলতা নিরসন ও চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় যথার্থ শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু প্রকৃত শিক্ষার মূল লক্ষণ কী? এ প্রশ্নের সদুত্তর বর্তমান যন্ত্রকেন্দ্রিক সভ্যতার সঙ্কটময় সময়ের এক বড় প্রয়োজন। শিক্ষাকে অব্যশই হতে হবে এমন যেখানে মানুষ একদিকে হবে বিদ্বান এবং অন্যদিকে হবে হৃদয়বান ও মহৎপ্রাণ। যে শিক্ষা ব্যবস্থায় দৈনিক ও জৈবিক চাহিদা মোটবার ব্যবস্থা আছে, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি বিকাশের যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা আছে, কিন্তু দয়া-মায়া প্রেম প্রভৃতি মানবিক মূল্যবোধের স্বীকৃতি ও তাগিদ নেই, সে শিক্ষা একপেশে ও অকার্যকর সন্দেহ নেই। বিজ্ঞান-প্রযুক্তিতে সর্বাধুনিক প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে, অথচ শিক্ষার্থী মানুষ হচ্ছে না, সজ্জন হচ্ছে না এটা আর যাই হোক প্রকৃত শিক্ষা নয়। ফ্রান্সিস বেকন শিক্ষাকে শক্তি বলে অভিহিত করেছেন। কিন্তু এই শক্তিকে যদি আমরা অস্ত্র বলি, তাহলে সে অস্ত্র দিয়ে যেমন অস্ত্রোপচার করে একটি মুমূর্ষু রোগীকে বাঁচানো যায়, আবার একই অস্ত্র দিয়ে মানুষ দিয়ে মানুষ খুনও করা যায়। জার্মানির নাজি এবং ইতালির ফ্যাসিস্ট সরকারসহ অনেক স্বৈরশাসকই শিক্ষাকে ব্যবহার করছে তাদের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার অসৎ উদ্দেশ্যে। সুতরাং শিক্ষারূপ আলো বা অস্ত্র দিয়ে কে কী করবে তা পুরোপুরি নির্ভরশীল সংশিষ্ট ব্যক্তি বা গোষ্ঠির সদিচ্ছা, মূল্যবোধ ও নীতিবোধ থাকা না থাকার ওপর। ইতিহাস থেকে এমন দৃষ্টান্ত পাই যে, শিক্ষা একটি সভ্যতা-সংস্কৃতিকে যেমন গড়তে পারে, তেমনি আবার চূর্ণও করে দিতে পারে। তার মানে শিক্ষাব্যবস্থার মূলে একটা নৈতিক ও মানবিক লক্ষ্য থাকা চাই। তা না হলে শিক্ষা (তা বৈষয়িক ও প্রায়োগিক দিক থেকে যত বড় অর্জনই বয়ে আনুক না কেন) ব্যথর্, এমন কি প্রাণঘাতী হতে পারে। যাই হোক, এর আগে বিশ্বপরিস্থিতি সম্পর্কে যেসব দুঃখ ও ক্ষোভের কথা বললাম সেগুলো আমাদের দেশের বেলায়ও কমবেশি প্রযোজ্য। তামাম দুনিয়া জানে বহু ত্যাগ তিতিক্ষার মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করলাম, যাত্রা শুরু করলাম ন্যায় ও সুনীতিভিত্তিক এক গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার দিকে। কিন্তু সেই থেকে দীর্ঘ চার দশক অতিক্রান্তির পরও আজ পর্যন্ত আমরা পারলাম না ঐক্যবদ্ধ হতে, পেলাম না শান্তি ও স্বস্তির স্বাদ। আমাদের জাতীয় জীবনের মূলমন্ত্রটা যেখানে হওয়া উচিত ছিল ‘যত মত তত পথ’, সেখানে ক্রমাগত লক্ষ্য করছি ‘যত মত তত সংঘাত’। বিশেষ করে পীড়াদায়ক মনে হয় সরকার ও বিরোধী দলের অব্যাহত দূরত্ব ও দ্বন্দ্বের ব্যাপারটিকে। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ বিকাশের পক্ষে মারাত্মক অন্তরায় এই বিরোধ সব সরকারের আমলেই একইভাবে অব্যাহত রয়েছে। স্বাভাবতই প্রশ্ন ওঠে অতীতের বহু বিপদ আপদে বিশেষ করে স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে এককাতারে দাঁড়িয়ে লড়াই করলেন যাঁরা (বিশেষ করে দুটি প্রধান রাজনৈতিক দল), এখন কেন তাঁরা পারছেন না সুস্থ গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ অনুশীলন করতে, এমনকি এক দল অন্য দলকে সহ্য করতে? এ এক গুরুতর মনস্তাত্ত্বিক প্রশ্ন বটে। এই জটিল প্রশ্নের সদুত্তর আবিস্কারের স্থান এটা নয়, এ ক্ষুদ্র পরিসরে সে আলোচনাও সম্ভব নয়। তবে এ অনাকাক্সিক্ষত উপদ্রব থেকে অব্যাহতির উপায় সম্পর্কে এটুকু বলা যায় যে, এর জন্য চাই সংশ্লিষ্ট নেতা-নেত্রী ও রাজনৈতিক কর্মীদের সেই সযতœ আত্ম-নির্দেশনা যার পারিভাষিক নাম ‘auto-suggestion’। দেশ ও দশের সামগ্রিক স্বার্থেই কি, সংসদ কি রাজপথ সর্বত্রই তাঁদের অনুসরণ করতে হবে সহিষ্ণুতা ও সহমর্মিতার মহান পথ। একথা যতটুকু প্রযোজ্য সরকারের বেলায়, ততটুকুই প্রযোজ্য বিরোধী দলের বেলায়; কারণ সরকার যেমন জনগণের নির্বাচিত সরকার, বিরোধী দলও একই জনগণেরই নির্বাচিত ছায়া সরকার। সুতরাং উভয়কেই পারস্পরিক শ্রাদ্ধাবোধ ও সুস্থ প্রতিযোগিতার মানসিকতা নিয়ে কাজ করার রাজনৈতিক কালচার গড়ে তুলতে হবে। তাঁরা যখন তা করবেন, তখনই জনগণ পাবে স্বস্তি, তখনই দেশে আসবে প্রকৃত শান্তি ও সমৃদ্ধি, এবং তখনই সাথর্ক হবে আমাদের রক্তক্ষয়ী মহান স্বধীনতা ও এ সংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অপার আত্মত্যাগ ও নিঃস্বার্থ রক্তদান।
এই একই সহযোগিতা, সহমর্মিতা ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ অপরিহার্য আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্বন্ধ ও আন্তর্জাতিক মানবসম্পর্কের বিস্ফোরণ স্পর্কে ক্ষেত্রে। হিংসা-বিদ্বেষ, অন্যায় আগ্রাসন, বিচ্ছিন্নতা শূণ্যতাবোধ প্রভৃতির সমবায়ে আজ বিশ্বব্যাপী যে মনস্তাত্ত্বিক মন্দ্ভাব, অনাস্থা ও মানবিক সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে, তার হাত থেকে অব্যাহতি পেতে হলে সংশিষ্ট সকলকে উপলব্ধি করতে হবে যে, বিজ্ঞান প্রযুক্তির কল্যাণে জল-স্থল-অন্তরীক্ষে মানুষের আধিপত্য যতই বাড়–ক না কেন, পরাশক্তি যতই পরাক্রমশালী হোক না কেন, মানবিক মূল্যবোধের আন্তরিক মনন ও অনুশীলন ব্যতিরেকে মাটির পৃথিবীতে কখনো শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরে আসবে না। আগেই বলছি এ সত্য বারবার প্রমাণিত হয়েছে মানুষের অতীত ইতিহাসে সাম্রাজ্যের উত্থান-পতন ও শক্তিমদমত্ত রাজ-রাজাড়াদের গ্লানিকর পরিণতির মধ্য দিয়ে। আজ যারা বিশ্বে একধিপত্য প্রতিষ্ঠার অভিলাষে কথায় কথায় শক্তি প্রয়োগের হুমকি দিচ্ছেন, অনৈতিক আগ্রাসনের পথ বেছে নিচ্ছেন, তাদের উদ্দেশ্যে বলি : অতীতে যা ঘটেছে অবিবেচক ও অত্যাচারীদের বেলায় তা যে আপনাদের বেলায়ও ঘটতে পারে, এ কথা একবার ভেবে দেখেছেন কি? একথা তো অনস্বীকার্য যে জন্ম থেকে শুরু করে রোগ, শোক, জরা, মৃত্যু পর্যন্ত এমন কিছু মৌলিক বিষয় আছে যেগুলো সসীম মানুষের ( এমন কি পরাশক্তির) নিয়ন্ত্রণের বাইরে; আর তাই নতুন নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবন দ্বারা প্রাকৃতিক দুর্যোগ অনেকাংশে ঠেকাতে পারলেও মাটির মানুষ কখনো জরা-মৃত্যুর অনিবার্যতাকে ঠেকাতে পারবে না। যৌবনের পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মানুষ (এমনকি পরাশক্তিমান দেশের খোদ শীর্ষ ব্যক্তিটিও) ক্রমশ ক্ষয় হবেই। যোশেফ নীডহ্যাম মানুষের এই সীমাবদ্ধতাটাকেই অভিহিত করেছেন ক্রীচারলিনেস বলে। এখানেই অসীমের সঙ্গে সসীমের, বিশ্ববিধাতার সঙ্গে মানুষের পার্থক্য; এটাই সৃষ্টির সেরা মানুষের পরম অসহায়তা, যা-কিনা কোনো পঞ্চবর্ষিকী পরিকল্পনা কিংবা অন্য কোনো মানিবিক কলাকৌশল দ্বারা নিরসনযোগ্য নয়।
যাই হোক, বর্তমান বিশ্বব্যাপী শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা ও চরম হা-হুতাশের মধ্যেও কিছু আশার কথা বলতে চাই। পরাক্রমশীলদের বোধোদয় কবে হবে, আদৌ হবে কিনা জানি না কিন্তু তবু আমি দুঃখ-ক্লেশ ও বিপদ আপদের কালোমেঘ দেখে ভয় পেতে চাই না। কোনো অপ্রীতিকর অবস্থাকেই জগৎ ও জীবনের শেষ পর্যায় বলে মনে করি না; কারণ এ জগৎসংসার ও মানবজীবন সুন্দর কুৎসিতে ইষ্টানিষ্টে ও আনন্দ বেদনায় মিথুনীকৃত। এখানে যেমন আছে আধি-ব্যাধি-দুঃখ-বঞ্চনা তেমনি আছে সুস্বাস্থ্য, সুখ, সৌন্দর্য ও আনন্দ। এমতাবস্থায় সুস্থ ও সুখকর জীবনের জন্য যে দৃষ্টিভঙ্গি ও জীবনদর্শনকে যুক্তিসঙ্গত বলে মনে করি এবং যা অনুশীলনের পক্ষপাতী, তা একপেশে নৈরাশ্যবাদ নয়, আবার আত্মতৃপ্ত কল্যাণবাদও নয়। আমার এ জীবনদর্শনের নাম দিতে চাই উন্নয়নবাদ। এ মতে জগৎ সম্পূর্ণ শুভ কিংবা সবৈধ অশুভ এ দুয়ের কোনটিই নয়।
মানুষের শ্রম ও সদিচ্ছার মাধ্যমে দুঃখ বিমোচন ও কল্যাণ প্রতিষ্ঠা সম্ভব। ঘোর দুর্দিনের মধ্যেও রচনা করা যায় সুদিনের ভিত্তি। হালের পরিস্থিতি অবশ্য খুবই নাজুক, নীতিবোধ মূল্যবোধের অবক্ষয় সুস্পষ্ট, প্রাকৃতিক দুর্দৈব ও মানবিক নৃশংসতার মাত্রাও লোমহর্ষক। এ সবকিছু মিলিয়ে গতি মন্থর হলেও একেবারে অনুপস্থিত নয়। একদিকে হৃদয়হীন যুদ্ধবাজ নেতারা যেমন আগ্রাসনে নিরীহ ও সাধারণ মানুষের প্রাণসংহারে অটল, অন্যদিকে যুদ্ধবিরোধী আন্দোলন এবং শান্তির আকাক্সক্ষা দেশে দেশে প্রবল। অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে বিবেকের প্রতিবাদ প্রতিরোধের সংকেতও সুস্পষ্ট। এমতাবস্থায় জগতের আধি-ব্যাধি,দ্বন্দ্ব-কলহ, দুর্ভিক্ষ-দারিদ্র প্রভৃতি রূঢ় বাস্তবতাকে মেনে নিয়েই আমাদের অগ্রসর হতে হবে এবং উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে প্রতিকূল শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করেই সংহত করতে হবে নৈতিক ও মানবিক আদর্শকে। এ কথারই সংকেত ও সমর্থন পাওয়া যায় প্লেটোর সংলাপে। বন্ধু গ্লোকনকে লক্ষ্য করে সক্রোটিস বলেন, হে গ্লোকন পৃথিবী থেকে কোনোদিনই অশুভ-অমঙ্গল সম্পূর্ণ উবে যাবে না। আর যাবেই বা কী করে? আমরা যাকে অশুভ বলি তাতো সেই অপূর্ণতারই নাম যার সঙ্গে অব্যাহত লড়াই করে অর্জন করতে হয় নৈতিক উৎকর্ষ, সমুন্নত রাখতে হয় মানবজীবনের মহত্ত্ব ও মর্যাদা।
কথায় বলে, truth triumphs in the long run আর আমার নিজেরও বিশ্বাস আজ হোক কাল হোক মনুষ্যত্বের কাছে পাশবিকতা এক দিন হার মানবেই, সব বিপাক-বিপত্তির মধ্যেও জগৎ নৈতিক প্রগতির দিকে অগ্রসর হবে এবং পরিণামে মানুষ শুভ শ্রেয় সুন্দরের সন্ধান পাবে। আর তাই শত ঝড়-ঝাপ্টার মধ্যেও ভাঙ্গা হাল ও ছেঁড়া পাল নিয়েই আমাদের ক্রমান্বয়ে এগিয়ে যেতে হবে সুখশান্তি ও অগ্রগতির পথে এবং পাশব শক্তির মোকাবেলা করেই সংহত করতে হবে সত্য সুন্দর কল্যাণের শক্তিকে। তাতেই আশা করি একদিন পরিসমাপ্তি ঘটবে বর্তমান মানবসঙ্কটের, তাতেই সহজ ও সুগম হবে মানবজাতির সুখ-শান্তি ও নিরাপত্তার পথ।
লেখক: অধ্যাপক, দর্শন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments:
Post a Comment