আমাদের দেশে কখনো এমন সরকার আসেনি, যাকে শওকত আলীর মতো লেখক সত্যিকারের
জনগণের সরকার বলতে পারেন। সে কারণে কোনো সরকারের সঙ্গেই তাঁর কোনো
দহরম-মহরম ছিল না। বরং সরকারি সমর্থনপুষ্ট লেখক ও তাঁদের কর্মসূচির সঙ্গে
দূরত্ব বজায় রাখতেন তিনি। বিদেশে বাংলাদেশের সাহিত্যের প্রতিনিধিত্ব করার
যোগ্যতা তাঁর ছিল অন্য প্রায় সবার চাইতে বেশি। কিন্তু কখনো তা করা হয়নি
তাঁর। কারণ সরকারি প্রতিনিধিদলে নাম লেখানোর জন্য যা যা করতে হয়, সেগুলো
তাঁর রুচির সঙ্গে মেলেনি কোনো দিন। অন্য ভাষায় নিজের লেখা অনূদিত হোক, এমন
স্বপ্ন প্রায় সব লেখক-কবিরই থাকে। কেননা, অনুবাদের মাধ্যমেই বিশ্বের অন্য
ভাষার পাঠকদের সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপন করা সম্ভব। কিন্তু শওকত আলী কোনো দিন
এসব কথা ভেবেছেন, এমন লক্ষণ দেখা যায়নি।
নিজেকে পাদপ্রদীপের আলোয় নিয়ে আসা বা সুযোগ পেলেই নিজেকে প্রাসঙ্গিক করে তোলার সুযোগ আমরা সহজে হাতছাড়া করতে চাই না। শওকত আলীর অসাধারণ মানসিক শক্তি ও সাহিত্যিক রুচি অবলীলায় অতিক্রম করে গেছে এই দুর্বলতাকে।
বাংলাদেশ লেখক শিবির বেশ কয়েক বছর বড় সেমিনার ও আলোচনা সভার মাধ্যমে পালন করে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের জন্মদিন। তারিখটি ১২ ফেব্রুয়ারি। অনেকগুলো বছর লেখক শিবিরের সভাপতি হিসেবে ওই অনুষ্ঠানেও সভাপতিত্ব করতে হয়েছে শওকত আলীকে। কিন্তু কোনো দিন কাউকে জানতে দেননি যে ওই দিনটি তাঁরও জন্মদিন। নিজেকে এইভাবে আড়ালে রাখতে পেরেছেন বলেই সাহিত্যই আজ শওকত আলীর মূল পরিচয় হয়ে উঠতে পেরেছে।
পূর্ব বাঙলার বাঙালিদের ‘নব জাগরণকালে’র বিকাশ ঘটেছে উপন্যাস, গান, কবিতা, নাটক সর্বত্র। বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশে বিশেষত: বিগত শতাব্দীর ষাটের দশক এক স্বর্ণালী অধ্যায়। কোলকাতা কেন্দ্রিক বাঙলা সাহিত্যের কেন্দ্র নির্ভরতার বাইরে ঢাকা কেন্দ্রিক সাহিত্য সংস্কৃতির বিকাশ বাঙলা ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাসের একটি উল্লেখযোগ্য অধ্যায়। এই সময়কালে পূর্ববঙ্গের সোঁদা মাটিতে সাহিত্যের সোনালী ফসল ফলানোর এক পরিশ্রমী সফল কৃষক শওকত আলী।
শওকত আলী মূলত: কথা সাহিত্যিক, ছোট গল্পে তাঁর দৃঢ় অবস্থান থাকলেও শক্তিশালী বিচরণ উপন্যাসে। শওকত আলীর জন্ম ও শৈশব-কৈশোরের পুরোটা সময় অবিভক্ত ভারতের পশ্চিমবঙ্গের দিনাজপুর জেলার রায়গঞ্জে, হুগলী জেলার শ্রী রামপুরে এবং তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের দিনাজপুর শহরে অভিবাসনের পূর্ব পর্যন্ত রায়গঞ্জে। পারিবারিকভাবে আলোকিত রাজনৈতিক পরিবারে তাঁর জন্ম। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকেই তাঁদের পরিবারে শিক্ষার প্রবেশ ঘটেছিল। সে হিসেবে পরিসংখ্যানগতভাবে বাঙালি মুসলিম পরিবার সমূহের শিক্ষার পশ্চাদপদতার মধ্যে তাঁর পরিবার অন্তর্ভূক্ত ছিল না। উত্তরবঙ্গের দিনাজপুরের রায়গঞ্জে ১৯৩৬ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি তাঁর জন্ম। বাবা খোরশেদ আলী সরকার এইচএমবি পাশ করা চিকিৎসক ছিলেন এবং ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের রাজনীতির সাথে সরাসরি যুক্ত ছিলেন। অপরদিকে মা সালেমা খাতুন মেদিনীপুর ও রায়গঞ্জে গার্লস স্কুলে আমৃত্যু শিক্ষকতা করেছেন। পারিবারিক আবহে শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি এবং প্রগতিশীল চেতনা তাঁকে সম্মৃদ্ধ করেছে।
১৯৫১ সালের শেষ দিকে মাত্র পনের বছর বয়সের শওকত আলী ভাইবোনদের নিয়ে রাতের অন্ধকারে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের দিনাজপুর শহরে আসেন এবং একটি স্বচ্ছল পরিবার হঠাৎ তীব্র আর্থিক সংকটের মুখোমুখি হয়ে জীবন যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। এ অবস্থাতেই তিনি দিনাজপুর এম এন কলেজে ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হন এবং নিজের লালিত চেতনার বিস্তৃতি ঘটান। সরাসরি বামপন্থি রাজনীতির সাথে যুক্ত হয়ে পড়েন। বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ও পাকিস্তান বিরোধী আন্দোলনে যুক্ত হন। ১৯৫৪’র ৯২(ক) ধারা জারী হলে এদেশের প্রগতিশীল রাজনীতির প্রবাদপুরুষ তাঁর ঘনিষ্টবন্ধু কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদসহ একই সাথে জেল খাটেন। প্রখ্যাত কৃষক নেতা হাজী মোহাম্মদ দানেশের সাথেও এই সময়েই যুক্ত হন তিনি।
বামপন্থি রাজনীতিতে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ, হাজী মোহাম্মদ দানেশের মত প্রখ্যাত কৃষক নেতার সাথে সম্পৃক্ততা সামগ্রিকভাবে শওকত আলীর চিন্তা, চেতনা, বিশ্বাস ও দর্শনকে পরিণত করেছে তৃণমূল মানুষের প্রতি গভীর দায়বদ্ধতাকে। শওকত আলীর জীবন ও দর্শন যে অন্তজ্যশ্রেণির প্রতি গভীরভাবে একাত্মবোধ ও মমত্ববোধ তার সূচনা পারিবারিক আবহের মধ্য দিয়ে অংকুরিত হলেও বিকাশ ঘটেছে কলেজ জীবনে প্রগতিশীল বাঙালি জাতীয়তাবাদের আন্দোলনে যুক্ত হওয়ার মাধ্যমেই।
প্রায় দশ মাস কারাগারে অন্তরীন থেকে মুক্ত হয়ে তিনি ১৯৫৩ সালে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেন, অনেক চড়াই-উৎরাই-আর্থিক সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও নিজের ঐকান্তিক চেষ্টা ও অধ্যাবসায়ের মাধ্যমে বিএ পাশ করেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫৮ সালে এমএ পাশ করে বীরগঞ্জ হাইস্কুলে অল্প কিছুদিন শিক্ষকতা করে ঠাকুরগাও-এ সদ্য প্রতিষ্ঠিত ঠাকুরগাও কলেজে টানা তিন বছর অধ্যাপনা করেন।
মূলত: ঠাকুরগাও কলেজে অধ্যাপনা করার সময়টিতেই আধুনিক বাঙলা গদ্য সাহিত্যের অন্যতম কালোত্তীর্ণ কথা সাহিত্যিক শওকত আলীর লেখক জীবনের বিকাশ ঘটে। যে কারণে তাঁর দীর্ঘ লেখালেখির তালিকায় বারংবার উঠে এসেছে বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের তৃণমূল প্রান্তজনের কথা। অতি দরিদ্র কিষাণ-কিষাণী, অধিবাসী, সাঁওতাল, ওঁড়াও এবং রাজবংশীদের কথা।
শওকত আলীর প্রথম উপন্যাস ‘পিঙ্গল আকাশ (১৯৬৩) ঠাকুরগাঁও কলেজে অধ্যাপনাকালীন রচিত। যদিও পিঙ্গল আকাশের ক্যানভাসে গ্রামীণ জনজীবনের দৈনন্দিন যুদ্ধ ছিল না। সৎবাপের সংসারে একটি মেয়ের বেড়ে ওঠা এবং তার পারিবারিক ও সামাজিক ভূমিকা এবং সামাজিক অসঙ্গতি ও অভাজনের জীবনমথিত কান্নাই উপন্যাসের মূল সুর তবে এই অসঙ্গতি শুধু পরিবার ও সমাজের মধ্যেই সীমিত নয় বরং আইয়ুবের দানবীয় সামরিক শাষণের বিরূদ্ধে এটি একটি প্রতীকি প্রতিবাদ।
একজন শক্তিমান কথা সাহিত্যিক শওকত আলী ছোটগল্প ও উপন্যাস দু’টো ক্ষেত্রেই সমানভাবে সফল। সব মিলিয়ে ৩২টি উপন্যাস এবং চারটি গল্পগ্রন্থের সবগুলোই জীবন নির্ভর এবং যার বড় অংশ জুড়েই রয়েছে তৃণমূলের জীবন উপন্যাস।
শওকত আলী জীবনকে দেখেছেন সাদা চোখে-রূঢ় বাস্তবতায়। সে জীবন মধ্যবিত্ত নাগরিক জীবনের টানা পোড়েন অথবা তীব্র উচ্চাশার কারণে স্বার্থপরতা এবং নষ্ট জীবনই হোক কিংবা তৃণমূলের মানুষের জীবন সংগ্রামেরই হোক। তাঁর ৩২টি উপন্যাস এবং ০৪টি গল্পগ্রন্থকে মূলত: তিনভাগে ভাগ করা যায়।
নাগরিক জীবন ঘনিষ্ট বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজের বিকাশ এবং সমাজ-সংস্কৃতির দ্বন্দ্ব, শ্রেণিচরিত্র, জীবনবোধ, জাতীয়তাবাদী চেতনা, ষাট ও সত্তরের দশকের রাজনৈতিক চেতনা ও মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি ভিত্তিক ‘পিঙ্গল আকাশ’ দক্ষিণায়নের দিন, কুলায় কালস্রোত, পূর্বরাত্রি পূর্বদিন, ওয়ারিশ, অবশেষে প্রপাত, দলিল, স্ববাসে প্রবাসে, বসত, পতন, জোড় বিজোড়, শেষ বিকেলের রোদ, স্থায়ী ঠিকানা ইত্যাদি উপন্যাস।
শওকত আলীর অসাধারণ উপন্যাস ‘প্রদোষে প্রাকৃত জন’ যদিও ইতিহাস ও ঐতিহ্য নির্ভর, তবে বহুল আলোচিত এই উপন্যাসটিও মূলত: একটি নির্দিষ্ট সময়ের প্রান্তজনের মানুষের বেঁচে থাকার যুদ্ধকেই বিস্তৃত করেছে। জীবন যুদ্ধ অথবা বেঁচে থাকার যুদ্ধ তো শুধুই অন্নের জন্য যুদ্ধ নয় বরং এটি সামগ্রিকভাবে প্রেম, ভালোবাসা, সমাজব্যবস্থা, কাম, দ্রোহ এবং সর্বোপরি আত্মপরিচয় বিনির্মাণের য্দ্ধু। আর সামগ্রিক ক্যানভাসটি শাষকের দৃষ্টিতে নয় বরং সাধারণের মানসে অন্তর্দৃর্ষ্টি দিয়ে চিত্রনের যে মুন্সীয়ানা শওকত আলী দেখিয়েছেন তা মানিক বন্দোপাধ্যায়ের মত বাংলা সাহিত্যের প্রবাদ প্রতিম কথা সাহিত্যিকের কথা মনে করিয়ে দেয়। প্রদোষে প্রাকৃতজন সম্পর্কে শওকত আলী নিজের জবানীতেই বলেছেন ‘এটাকে ঠিক ঐতিহাসিক উপন্যাস বলা যাবে না। ঐতিহাসিক একটি সময় বা পর্যায়ের উপন্যাস। কারণ, আমি তো সময় বা ঘটনার প্রামাণিক কোনো কিছুকে উপস্থাপন করিনি। কাহিনি ও ইতিহাস যখন পড়তাম, তখন আমার মনে অনেক জিজ্ঞাসার সৃষ্টি হতো। যেমন লক্ষণ সেন। রাতের খাবার না খেয়েই লক্ষণ সেন পালিয়ে গেল। বখতিয়ার খিলজি কিন্তু তখনও বাগেরহাট সীমানায় আসেননি। এই যে ইতিহাসের এসব ঘটনা – আমাকে খুব ভাবায়। সেই সাথে আমার মনে জাগে ইতিহাসের এই পালাবদল – এসব ঘটনার প্রেক্ষিতে সাধারণ মানুষের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া কেমন ছিল? এসব ভাবতে ভাবতেই ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ লেখার চিন্তা হয়। যারা শাসক গোষ্ঠী, রাজা-মহারাজা তারা যে জনগণের কথা ভাবত না এবং জনগণের সমর্থন পেত না, তার কল্পনা করেই এ উপন্যাস লেখা হয়। উপন্যাসের নামকরণটাও কিন্তু সে চিন্তা থেকেই এসেছে। প্রদোষকাল মানে দিন ও রাত্রির মাঝামাঝি সময়। হিন্দু শাসন চলে যাচ্ছে, মুসলমান শাসকেরা আসছেন, এই মাঝামাঝি সময়ে সাধারণ মানুষের কী অবস্থা, তারা কী ভাবছে? ওই উপন্যাসে কিন্তু সাম্প্রদায়িকতার কোনো কথা নেই। সাধারণ মানুষের যে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া, তা-ই উপস্থাপন করা হয়েছে’।
এ কথা নিঃসন্দেহে স্বীকার্য যে শওকত আলীর মতো দমদার ঔপন্যাসিক বাংলা সাহিয়ত্যে বিরল। তাঁর এই অফুরন্ত শক্তির পরিচয় মেলে ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ ছাড়াও ‘নাঢ়াই’, ‘মাদারডাঙার কথা’, ‘দলিল’, ‘উত্তরের ক্ষেপ’ বা ‘ওয়ারিশ’-এর মতো উপন্যাসগুলোতে। ভবিষ্যতের পাঠকের কাছে প্রত্যাশা করি, তারা শওকত আলীকে পাঠ করবে আগ্রহে, আনন্দে ও নিজস্ব অন্তর্গত তাগিদ থেকে। তিনি বেঁচে থাকবেন আমাদের পাঠের ভেতরে।
লেখক: লুৎফুল কবির রণী, কবি ও প্রাবন্ধিক
নিজেকে পাদপ্রদীপের আলোয় নিয়ে আসা বা সুযোগ পেলেই নিজেকে প্রাসঙ্গিক করে তোলার সুযোগ আমরা সহজে হাতছাড়া করতে চাই না। শওকত আলীর অসাধারণ মানসিক শক্তি ও সাহিত্যিক রুচি অবলীলায় অতিক্রম করে গেছে এই দুর্বলতাকে।
বাংলাদেশ লেখক শিবির বেশ কয়েক বছর বড় সেমিনার ও আলোচনা সভার মাধ্যমে পালন করে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের জন্মদিন। তারিখটি ১২ ফেব্রুয়ারি। অনেকগুলো বছর লেখক শিবিরের সভাপতি হিসেবে ওই অনুষ্ঠানেও সভাপতিত্ব করতে হয়েছে শওকত আলীকে। কিন্তু কোনো দিন কাউকে জানতে দেননি যে ওই দিনটি তাঁরও জন্মদিন। নিজেকে এইভাবে আড়ালে রাখতে পেরেছেন বলেই সাহিত্যই আজ শওকত আলীর মূল পরিচয় হয়ে উঠতে পেরেছে।
পূর্ব বাঙলার বাঙালিদের ‘নব জাগরণকালে’র বিকাশ ঘটেছে উপন্যাস, গান, কবিতা, নাটক সর্বত্র। বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশে বিশেষত: বিগত শতাব্দীর ষাটের দশক এক স্বর্ণালী অধ্যায়। কোলকাতা কেন্দ্রিক বাঙলা সাহিত্যের কেন্দ্র নির্ভরতার বাইরে ঢাকা কেন্দ্রিক সাহিত্য সংস্কৃতির বিকাশ বাঙলা ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাসের একটি উল্লেখযোগ্য অধ্যায়। এই সময়কালে পূর্ববঙ্গের সোঁদা মাটিতে সাহিত্যের সোনালী ফসল ফলানোর এক পরিশ্রমী সফল কৃষক শওকত আলী।
শওকত আলী মূলত: কথা সাহিত্যিক, ছোট গল্পে তাঁর দৃঢ় অবস্থান থাকলেও শক্তিশালী বিচরণ উপন্যাসে। শওকত আলীর জন্ম ও শৈশব-কৈশোরের পুরোটা সময় অবিভক্ত ভারতের পশ্চিমবঙ্গের দিনাজপুর জেলার রায়গঞ্জে, হুগলী জেলার শ্রী রামপুরে এবং তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের দিনাজপুর শহরে অভিবাসনের পূর্ব পর্যন্ত রায়গঞ্জে। পারিবারিকভাবে আলোকিত রাজনৈতিক পরিবারে তাঁর জন্ম। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকেই তাঁদের পরিবারে শিক্ষার প্রবেশ ঘটেছিল। সে হিসেবে পরিসংখ্যানগতভাবে বাঙালি মুসলিম পরিবার সমূহের শিক্ষার পশ্চাদপদতার মধ্যে তাঁর পরিবার অন্তর্ভূক্ত ছিল না। উত্তরবঙ্গের দিনাজপুরের রায়গঞ্জে ১৯৩৬ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি তাঁর জন্ম। বাবা খোরশেদ আলী সরকার এইচএমবি পাশ করা চিকিৎসক ছিলেন এবং ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের রাজনীতির সাথে সরাসরি যুক্ত ছিলেন। অপরদিকে মা সালেমা খাতুন মেদিনীপুর ও রায়গঞ্জে গার্লস স্কুলে আমৃত্যু শিক্ষকতা করেছেন। পারিবারিক আবহে শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি এবং প্রগতিশীল চেতনা তাঁকে সম্মৃদ্ধ করেছে।
১৯৫১ সালের শেষ দিকে মাত্র পনের বছর বয়সের শওকত আলী ভাইবোনদের নিয়ে রাতের অন্ধকারে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের দিনাজপুর শহরে আসেন এবং একটি স্বচ্ছল পরিবার হঠাৎ তীব্র আর্থিক সংকটের মুখোমুখি হয়ে জীবন যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। এ অবস্থাতেই তিনি দিনাজপুর এম এন কলেজে ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হন এবং নিজের লালিত চেতনার বিস্তৃতি ঘটান। সরাসরি বামপন্থি রাজনীতির সাথে যুক্ত হয়ে পড়েন। বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ও পাকিস্তান বিরোধী আন্দোলনে যুক্ত হন। ১৯৫৪’র ৯২(ক) ধারা জারী হলে এদেশের প্রগতিশীল রাজনীতির প্রবাদপুরুষ তাঁর ঘনিষ্টবন্ধু কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদসহ একই সাথে জেল খাটেন। প্রখ্যাত কৃষক নেতা হাজী মোহাম্মদ দানেশের সাথেও এই সময়েই যুক্ত হন তিনি।
বামপন্থি রাজনীতিতে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ, হাজী মোহাম্মদ দানেশের মত প্রখ্যাত কৃষক নেতার সাথে সম্পৃক্ততা সামগ্রিকভাবে শওকত আলীর চিন্তা, চেতনা, বিশ্বাস ও দর্শনকে পরিণত করেছে তৃণমূল মানুষের প্রতি গভীর দায়বদ্ধতাকে। শওকত আলীর জীবন ও দর্শন যে অন্তজ্যশ্রেণির প্রতি গভীরভাবে একাত্মবোধ ও মমত্ববোধ তার সূচনা পারিবারিক আবহের মধ্য দিয়ে অংকুরিত হলেও বিকাশ ঘটেছে কলেজ জীবনে প্রগতিশীল বাঙালি জাতীয়তাবাদের আন্দোলনে যুক্ত হওয়ার মাধ্যমেই।
প্রায় দশ মাস কারাগারে অন্তরীন থেকে মুক্ত হয়ে তিনি ১৯৫৩ সালে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেন, অনেক চড়াই-উৎরাই-আর্থিক সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও নিজের ঐকান্তিক চেষ্টা ও অধ্যাবসায়ের মাধ্যমে বিএ পাশ করেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫৮ সালে এমএ পাশ করে বীরগঞ্জ হাইস্কুলে অল্প কিছুদিন শিক্ষকতা করে ঠাকুরগাও-এ সদ্য প্রতিষ্ঠিত ঠাকুরগাও কলেজে টানা তিন বছর অধ্যাপনা করেন।
মূলত: ঠাকুরগাও কলেজে অধ্যাপনা করার সময়টিতেই আধুনিক বাঙলা গদ্য সাহিত্যের অন্যতম কালোত্তীর্ণ কথা সাহিত্যিক শওকত আলীর লেখক জীবনের বিকাশ ঘটে। যে কারণে তাঁর দীর্ঘ লেখালেখির তালিকায় বারংবার উঠে এসেছে বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের তৃণমূল প্রান্তজনের কথা। অতি দরিদ্র কিষাণ-কিষাণী, অধিবাসী, সাঁওতাল, ওঁড়াও এবং রাজবংশীদের কথা।
শওকত আলীর প্রথম উপন্যাস ‘পিঙ্গল আকাশ (১৯৬৩) ঠাকুরগাঁও কলেজে অধ্যাপনাকালীন রচিত। যদিও পিঙ্গল আকাশের ক্যানভাসে গ্রামীণ জনজীবনের দৈনন্দিন যুদ্ধ ছিল না। সৎবাপের সংসারে একটি মেয়ের বেড়ে ওঠা এবং তার পারিবারিক ও সামাজিক ভূমিকা এবং সামাজিক অসঙ্গতি ও অভাজনের জীবনমথিত কান্নাই উপন্যাসের মূল সুর তবে এই অসঙ্গতি শুধু পরিবার ও সমাজের মধ্যেই সীমিত নয় বরং আইয়ুবের দানবীয় সামরিক শাষণের বিরূদ্ধে এটি একটি প্রতীকি প্রতিবাদ।
একজন শক্তিমান কথা সাহিত্যিক শওকত আলী ছোটগল্প ও উপন্যাস দু’টো ক্ষেত্রেই সমানভাবে সফল। সব মিলিয়ে ৩২টি উপন্যাস এবং চারটি গল্পগ্রন্থের সবগুলোই জীবন নির্ভর এবং যার বড় অংশ জুড়েই রয়েছে তৃণমূলের জীবন উপন্যাস।
শওকত আলী জীবনকে দেখেছেন সাদা চোখে-রূঢ় বাস্তবতায়। সে জীবন মধ্যবিত্ত নাগরিক জীবনের টানা পোড়েন অথবা তীব্র উচ্চাশার কারণে স্বার্থপরতা এবং নষ্ট জীবনই হোক কিংবা তৃণমূলের মানুষের জীবন সংগ্রামেরই হোক। তাঁর ৩২টি উপন্যাস এবং ০৪টি গল্পগ্রন্থকে মূলত: তিনভাগে ভাগ করা যায়।
নাগরিক জীবন ঘনিষ্ট বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজের বিকাশ এবং সমাজ-সংস্কৃতির দ্বন্দ্ব, শ্রেণিচরিত্র, জীবনবোধ, জাতীয়তাবাদী চেতনা, ষাট ও সত্তরের দশকের রাজনৈতিক চেতনা ও মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি ভিত্তিক ‘পিঙ্গল আকাশ’ দক্ষিণায়নের দিন, কুলায় কালস্রোত, পূর্বরাত্রি পূর্বদিন, ওয়ারিশ, অবশেষে প্রপাত, দলিল, স্ববাসে প্রবাসে, বসত, পতন, জোড় বিজোড়, শেষ বিকেলের রোদ, স্থায়ী ঠিকানা ইত্যাদি উপন্যাস।
শওকত আলীর অসাধারণ উপন্যাস ‘প্রদোষে প্রাকৃত জন’ যদিও ইতিহাস ও ঐতিহ্য নির্ভর, তবে বহুল আলোচিত এই উপন্যাসটিও মূলত: একটি নির্দিষ্ট সময়ের প্রান্তজনের মানুষের বেঁচে থাকার যুদ্ধকেই বিস্তৃত করেছে। জীবন যুদ্ধ অথবা বেঁচে থাকার যুদ্ধ তো শুধুই অন্নের জন্য যুদ্ধ নয় বরং এটি সামগ্রিকভাবে প্রেম, ভালোবাসা, সমাজব্যবস্থা, কাম, দ্রোহ এবং সর্বোপরি আত্মপরিচয় বিনির্মাণের য্দ্ধু। আর সামগ্রিক ক্যানভাসটি শাষকের দৃষ্টিতে নয় বরং সাধারণের মানসে অন্তর্দৃর্ষ্টি দিয়ে চিত্রনের যে মুন্সীয়ানা শওকত আলী দেখিয়েছেন তা মানিক বন্দোপাধ্যায়ের মত বাংলা সাহিত্যের প্রবাদ প্রতিম কথা সাহিত্যিকের কথা মনে করিয়ে দেয়। প্রদোষে প্রাকৃতজন সম্পর্কে শওকত আলী নিজের জবানীতেই বলেছেন ‘এটাকে ঠিক ঐতিহাসিক উপন্যাস বলা যাবে না। ঐতিহাসিক একটি সময় বা পর্যায়ের উপন্যাস। কারণ, আমি তো সময় বা ঘটনার প্রামাণিক কোনো কিছুকে উপস্থাপন করিনি। কাহিনি ও ইতিহাস যখন পড়তাম, তখন আমার মনে অনেক জিজ্ঞাসার সৃষ্টি হতো। যেমন লক্ষণ সেন। রাতের খাবার না খেয়েই লক্ষণ সেন পালিয়ে গেল। বখতিয়ার খিলজি কিন্তু তখনও বাগেরহাট সীমানায় আসেননি। এই যে ইতিহাসের এসব ঘটনা – আমাকে খুব ভাবায়। সেই সাথে আমার মনে জাগে ইতিহাসের এই পালাবদল – এসব ঘটনার প্রেক্ষিতে সাধারণ মানুষের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া কেমন ছিল? এসব ভাবতে ভাবতেই ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ লেখার চিন্তা হয়। যারা শাসক গোষ্ঠী, রাজা-মহারাজা তারা যে জনগণের কথা ভাবত না এবং জনগণের সমর্থন পেত না, তার কল্পনা করেই এ উপন্যাস লেখা হয়। উপন্যাসের নামকরণটাও কিন্তু সে চিন্তা থেকেই এসেছে। প্রদোষকাল মানে দিন ও রাত্রির মাঝামাঝি সময়। হিন্দু শাসন চলে যাচ্ছে, মুসলমান শাসকেরা আসছেন, এই মাঝামাঝি সময়ে সাধারণ মানুষের কী অবস্থা, তারা কী ভাবছে? ওই উপন্যাসে কিন্তু সাম্প্রদায়িকতার কোনো কথা নেই। সাধারণ মানুষের যে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া, তা-ই উপস্থাপন করা হয়েছে’।
এ কথা নিঃসন্দেহে স্বীকার্য যে শওকত আলীর মতো দমদার ঔপন্যাসিক বাংলা সাহিয়ত্যে বিরল। তাঁর এই অফুরন্ত শক্তির পরিচয় মেলে ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ ছাড়াও ‘নাঢ়াই’, ‘মাদারডাঙার কথা’, ‘দলিল’, ‘উত্তরের ক্ষেপ’ বা ‘ওয়ারিশ’-এর মতো উপন্যাসগুলোতে। ভবিষ্যতের পাঠকের কাছে প্রত্যাশা করি, তারা শওকত আলীকে পাঠ করবে আগ্রহে, আনন্দে ও নিজস্ব অন্তর্গত তাগিদ থেকে। তিনি বেঁচে থাকবেন আমাদের পাঠের ভেতরে।
লেখক: লুৎফুল কবির রণী, কবি ও প্রাবন্ধিক
No comments:
Post a Comment