বাংলাদেশ এখন অভিন্ন সড়ক নেটওয়ার্কে বাঁধা পড়েছে। খাল-নদী-বিলের এই দেশে যে কোনো স্থানে যাওয়া যায় সড়ক পথে। নৌকায় ভ্রমণ এখন নিছকই স্বল্প সময়ের আনন্দ লাভের জন্য। দূরে কেন, কাছের কোথাও নৌকায় যাওয়ারই বা সময় কোথায় মানুষের? অথচ এক সময় গ্রামের সচ্ছল প্রায় সব পরিবারের থাকত নিজস্ব নৌকা। তার জন্য ঘরের কাছেই থাকত ঘাট। এটা মানমর্যাদারও প্রতীক ছিল। হাতিশালে হাতি আর ঘোড়াশালে ঘোড়াও কারো কারো বাড়িতে দেখা যেত। তবে চলাচলের জন্য নৌকাই ছিল যুৎসই বাহন।
বরিশালের ঐতিহ্যবাহী একটি গ্রামের নাম গৈলা। এখানেই জন্ম হয়েছিল মনসা মঙ্গলের কবি বিজয় গুপ্তের। তবে সে সময়ে এ গ্রামেরই একটি অংশের নাম ছিল ফুল্লশ্রী, যাকে কবি অভিহিত করেছিলেন পণ্ডিত নগর হিসেবে। তিনি গ্রামীণ পরিবেশে বসবাস করে পাঁচ’শ বছর আগে রচনা করেছিলেন এমন এক গ্রন্থ, যা আজো কোটি কোটি মানুষের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে আছে। শ্রাবণ মাসে এ মঙ্গল কাব্য পাঠ হয় না, দক্ষিণাঞ্চলে এমন হিন্দু পরিবার কমই মিলবে। বিজয়গুপ্তের মনসা মন্দিরে একটি পিতলের মূর্তি ছিল, যা ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সহযোগীরা লুট করে নিয়ে যায়। যারা এ অপরাধ করেছিল তারা পরিচিত মুখ, হানাদার বাহিনীর সহযোগী লুটেরার দল। কিন্তু প্রতিবাদ করার মতো পরিস্থিতি ছিল না। স্বাধীনতার পরও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ কেন নেয়া হয়নি, সে প্রশ্ন উঠতেই পারে। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের এ এক বড় সমস্যা। তারা অন্যায়ের শিকার হলেও তার প্রতিকার সবসময় হয় না এবং অনেক ক্ষেত্রে এমনকি অন্যায় যে ঘটেছে সেটাও স্বীকার করা হয় না। তা নিয়ে কোনো আলোচনা হয় না, প্রশাসন বা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তার প্রতিকারের কথা সাধারণত ভাবে না। বরং অনেকেই ধরে নেয় যে এমনটি ঘটায় অস্বাভাবিকতা কিছু নেই। এভাবে দেশের নানা স্থানে লাখ লাখ হিন্দু পরিবারের সম্পত্তি বেহাত হয়েছে, দখল হয়ে গেছে দেবোত্তর হিসেবে চিহ্নিত মন্দিরের সম্পত্তি। প্রতিকারহীন শক্তির অপরাধে বিচারের বাণী নিরবে নিভৃতে কাঁদছে, কিন্তু এগিয়ে আসে না প্রশাসন বা পুলিশ।
বিজয়গুপ্তের মনসা মন্দির পিতলের দেবীমূর্তি লুট হয়ে যাওয়ার ৩২ বছর পর ২০০৩ সালের জুন মাসে এ মূর্তিটি নতুন করে তৈরি করার উদ্যোগ নেয় গৈলা-আগৈলঝাড়া-বাকাল-বাগধা-আসকর-চাঁদশী-গৌরনদী-টরকির অধিবাসীরা। বরিশাল শহর থেকেও অনেকে এগিয়ে আসেন। ওই অঞ্চলের যারা ঢাকায় বসবাস করেন তারাও মূর্তিটি নবরূপে তৈরির কাজে উদ্যোগী হন। মনসা মন্দিরে অনুষ্ঠিত এক সামাজিক সভায় ঠিক হয়, মনসা মঙ্গলের বিররণ অনুযায়ী মূর্তিটি তৈরি হবে। এ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ঢাকার শাঁখারি বাজারে মৃৎশিল্পী হরিপদ পাল এবং কাঁসা-পিতলের কাজে দক্ষ রামগোপাল কংসবণিকের সঙ্গে আমরা কয়েকজন আলোচনা করি। তারা এক বছরের কঠোর শ্রম ও সাধনায় নির্মাণ করেন প্রায় একটন পিতল দিয়ে তৈরি মনসা দেবীমূর্তি। ২০০৪ সালের ২৪ ডিসেম্বর ঢাকা থেকে এ মূর্তি গৈলা নেয়া হলে হাজার হাজার নারী-পুরুষ শাঁখ-ঢোল-করতাল বাজিয়ে দেবীকে বরণ করে নেয়। মূর্তিটি মন্দিরে নেয়ার পথে বহনকারী গাড়িটি গৈলার কর্মকার বাড়ির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় কয়েকশ’ নারী উলুধ্বনি দিয়ে ও শাঁখ বাজিয়ে আনন্দ প্রকাশ করে। তাদের অনেকে পরে বলেছেন, এমন আনন্দের দিন আসবে তা ভাবিনি কখনও।
বিজয়গুপ্তের মনসা মন্দিরে স্থাপিত মূর্তি প্রথম থেকেই দেশ-বিদেশের দর্শনার্থীদের বিপুলভাবে আকৃষ্ট করে। গৈলা বাজারের মিষ্টি ব্যবসায়ীদের ভাষ্য : এখন বেশি বেশি দর্শনার্থী আসছে, তাই বিক্রি বেড়েছে। দুধ বিক্রেতাদেরও একই মত। রিকশাচালরা বলছে, তারা বেশি যাত্রী পাচ্ছে। বৃহত্তর বরিশালের নানা এলাকা থেকে গাড়ি করে ভক্তরা আসছে এ মন্দিরে। বরিশাল জেলা প্রশাসন জেলার বিশেষ দ্রষ্টব্য স্থানগুলোর যে তালিকা করেছে তাতে স্থান পেয়েছে গৈলার বিজয়গুপ্তের মনসা মন্দির।
এখন মূর্তিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠছে মন্দির। প্রকৌশলী অরুণ চক্রবর্তী এর ডিজাইন করেছেন। মন্দিরের চত্বরে আয়োজিত এক সমাবেশে ডিজাইন ল্যাপটপে প্রদর্শন করেন অরুণ চক্রবর্তী। এ সময়ে বরিশালের এডভোকেট ফনিভুষণ দাস বলেন, সামনে একটু বেশি স্থান রাখলে ভাল হয়। সভায় উপস্থিত অন্যরাও তাতে সায় দেন এবং ডিজাইনে সঙ্গে সঙ্গেই এ পরিবর্তন আনা হয়। আলোচনা চলতে চলতেই অরুণ চক্রবর্তী মন্দিরের আশপাশ ঘুরে দেখেন এবং পরে সভায় এসে বলেন, মন্দিরের একটি সিঁডি পাশের দিঘীতে নেমে গেলে কেমন হয়? তবে এতে ৩-৪ লাখ টাকা ব্যয় বাড়বে। উপস্থিত সবাই তাতে সায় দেয় আনন্দচিত্তে।
মন্দিরের কাজ শুরুর জন্য বহুকাল আগে প্রতিষ্ঠিত ঐতিহ্যের মন্দিরটি ভেঙে ফেলার প্রয়োজন পড়ে। আশির দশকে গৈলার অধিবাসী সুনীল কুমার গুপ্ত মন্ত্রী থাকার সময়ে এর সংস্কার কাজ করিয়েছিলেন। স্থানীয় জনগণ সর্বসম্মতভাবে একটি আকর্ষণীয় মন্দির নির্মাণের পক্ষে রায় দিলে আর কোনো বাধা থাকে না। তহবিল সংগ্রহের কাজও শুরু হয়ে যায়। গৈলার বাসিন্দা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম এ মালেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক প্রধান উপদেষ্টা ড. ফকরুদ্দিন আহমদের বিশেষ সহকারী থাকার সময় আরেক উপদেষ্টা জনাব আনোয়ার ইকবালকে দিয়ে প্রায় ৬ লাখ টাকা মনসা মন্দিরের জন্য বরাদ্দ করেন। কিন্তু সরকারের তহবিলের টাকা তো পাওয়া যাবে কাজ শুরু হলে? কাজ শুরু করা হবে কীভাবে? এ নিয়ে বৈঠক বসলে আশীষ তফাদার বলেন, তিনি ৫০ হাজার টাকা ধার দেবেন। বরিশালের কৃতী পুরুষ শিল্প উদ্যোক্তা ও সমাজসেবী শ্রী বিজয় কৃষ্ণ দে তার বাসভবনে শহরের কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তির এক সভা ডাকেন। সেখানে উপস্থিত ছিলেন শ্রী নিখিল সেন, প্রাণ কুমার সেনগুপ্ত, আশীষ দাশগুপ্ত, এডভোকেট ফনিভুষণ দাস, পবিত্র কুমার দাস, অসীম দাশগুপ্ত প্রমুখ। বিজয় কৃষ্ণ দে বলেন, মন্দিরের কাজ শুরুর জন্য রড-সিমেন্ট-ইট-বালু যা দরকার তার ব্যবস্থা তিনি করবেন। এর ফলে আর কোনো সমস্যা থাকে না। ডিজাইন অনুযায়ী কাজ এগিয়ে চলে। মন্দিরটি ভক্তদের মনের মতো গড়ে উঠছে। ধাপে ধাপে চলছে এর সাজসজ্জার কাজ। যারা দেখছেন সবাই বলছেন, এ এক চমৎকার শিল্পকর্ম নির্মাণ করা হচ্ছে। শুধু বরিশাল নয়, গোটা দেশের মানুষকে তা আকৃষ্ট করবে। অনেক বছর ধরেই বরিশালের গৈলা এ মন্দিরের কারণে এক গুরুত্বপূর্ণ পর্যটনের স্থান। মন্দিরটির নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হলে পর্যটকদের যাতায়াত আরও বেড়ে যাবে। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় সাংস্কৃতিক পর্যটনের স্থান হিসেবে বিজয়গুপ্তের মনসা মন্দিরকে চিহ্নিত করার উদ্যোগ নিয়েছেন। ধর্মপ্রতিমন্ত্রী এডভোকেট শাহজাহান মিয়ার অনুরোধে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ মন্দিরটি নির্মাণে সব ধরনের সহায়তা প্রদানের নির্দেশ দিয়েছেন। সংস্কৃতি ও ধর্মীয় ঐতিহ্যের এ স্থানটি নিয়ে আমাদের যে পরিকল্পনা তা এভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে।
গৈলার সাবেক আমলের কথায় ফিরে যাই। এ গ্রামেই একটি বড় দীঘি আছে, যা দাশের বাড়ির দীঘি নামে পরিচিত। গ্রামটির পত্তন আর এ দীঘি খনন সম্ভবত একই সময়ে হয়েছিল। এ জলাশয়ের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল গ্রামের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া প্রশস্ত খালের। এখন খালটি ক্ষীণকায়। কিন্তু একদা শুধু বর্ষা নয়, বছর জুড়েই জল থই থই করত। গ্রামের যারা ব্যবসা, চাকরি বা পড়াশোনা উপলক্ষে বাইরে যেত তাদের এ খাল ব্যবহার করতে হতো। আজ থেকে প্রায় ষাট-সত্তর বছর আগের সময়ে আমরা ফিরে যেতে পারি। তখন গৈলায় এমন হিন্দু পরিবার কমই ছিল, যাদের কেউ না কেউ কলিকাতায় নেই। ঢাকাসহ অন্যত্রও ছিল যাতায়াত, তবে সংখ্যায় কম। ব্যবসায় কিংবা পড়াশোনা উপলক্ষে বাইরে থাকা সবাই শারদীয় দুর্গা পূজায় গ্রামে আসবে, এটা ছিল রেওয়াজ। এ সময়ে ছুটিও মিলত অনেকদিন। কীভাবে গৈলার বাসিন্দারা ভারতবর্ষের এক সময়ের রাজধানী কলিকাতা শহরে যেত? মিথ ছিল এ রকম : খুব ভোর বেলা নৌকায় রওনা হয়ে যেতে হতো গোপালগঞ্জের পাটগাতি গ্রামে। যেতে যেতে সন্ধ্যা হতো। পথেই নৌকায় রান্না করা গরম ভাত আর মধুমতি নদীর সুস্বাদু ইলিশ মাছে শুধু পেট নয়, মনও ভরে যেত। বরিশাল শহর থেকে খুলনার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাওয়া স্টিমার কিছুটা রাত হলে থামত পাটগাতিতে। কলিকাতার যাত্রীরা উঠতো স্টিমারে। পরদিন সকালে খুলনা থেকে বরিশালগামী স্টিমারে গৈলা বা আশপাশের গ্রামের যেসব যাত্রী থাকতেন, তারা ওই নৌকায় ফিরতেন নিজের ঘরে। খুলনায় স্টিমার থেকে নেমে কলকাতা যাত্রীদের চাপতে হতো রেলগাড়িতে। পথে বেনাপোল-পেট্রাপোলে চেকিং শেষে সন্ধ্যার কিছু পরে পৌঁছানো যেত কলিকাতায়।
কলিকাতা থেকে বাড়ির পথে সকালে ট্রেনে চেপে বসতে হতো শিয়ালদহ থেকে। সঙ্গে থাকত প্রিয়জনদের জন্য কেনা নানা বাহারি পণ্য। দেড় দিনের যাত্রা শেষে সন্ধ্যায় গৈলা দাশের বাড়ির দিঘীতে কিংবা খালের দুই তীরের কোনো বাড়িতে। শরতের সন্ধ্যার মনোরম পরিবেশে তাই দিঘীর পাড়ে জমে যেত ভিড়Ñ নারী-পুরুষ-শিশু সবাই প্রিয়জনের মুখ কে আগে দেখবে, উন্মুখ সেজন্য। এক একটি নৌকা ঘাটে থামত, আর সবাই ছুটে যেত। যার স্বজন এতে আছে তাদের চোখ-মুখে আনন্দের বান। অন্যরা জানতে চাইত, ‘ওর’ নৌকা কত দূর? যখন কেউ শুনতে পেত, তার প্রিয়জন বিশেষ সমস্যা কিংবা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ায় আসতে পারবে না, হতাশা আর যন্ত্রণায় অন্ধকারেও ধরা পড়ত মুখ যেন আরও কালো হয়ে গেছে। বাড়ি ফিরত বিষণœ মনে। অন্যরা সান্ত্বনা দিত। কিন্তু মন যে মানে না তাতে। উৎসবের আনন্দ তাদের জন্য মাটি হয়ে যেত। এখনকার মতো মোবাইল ফোনের যুগ হলে তারা অনেক আগেই হয়তো সব খবর পেয়ে যেত। কিন্তু তখন যে পোস্ট কার্ডে চিঠি আসতেও ৮-১০ দিন!
সেকালের এই যে দীর্ঘ অপেক্ষা তার আনন্দও তো কোনো অংশে কম ছিল না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে কর্মরত আমার ছোট কাকার কাছে শুনেছি, পূজায় গ্রামে আমাদের দাশের বাড়িতে সবচেয়ে বেশি লোক আসত। বাড়িতে অনেক ঘর ছিল। তারপরও এত লোক প্রবাস থেকে ফিরত পূজায় যে সবার ঘরে ঠাঁই হতো না। পুরুষ সবাইকেই ঘুমাতে হতো উঠানে খোলা আকাশের নিচে। পূজায় বৃষ্টি হবে, সেটা সংস্কারের মতোই ছিল। বৃষ্টি নামলে উঠানের পুরুষদের ঘরে চলে যেতে হত। কিন্তু ঘুমানোর অবকাশ মিলত না। স্থান যে নেই...। তাতে কি? রাত জাগার মধ্যেও মিলত পরম তৃপ্তি ও আনন্দ।
আমাদের জীবনের এ আনন্দ-উচ্ছাস কে কেড়ে নিল? শারদীয় দুর্গোৎসব এবং অন্যান্য অনুষ্ঠান এলেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পদস্থ কর্মকর্তাদের সভা হয় শান্তি বজায় রাখার বিষয়ে। সরকারের দিক থেকে কঠোর নির্দেশ যায় এমন দিনগুলোতে যেন হিন্দুদের মন্দিরে কেউ টোকাটিও দিতে না পারে। সন্দেহভাজন সন্ত্রাসীদের আগেভাগেই পাকড়াওয়ের জন্য বলে দেওয়া হয়। কোথাও মন্দিরে হামলা ও ভাংচুরের ঘটনা থাকলে সবাই উদ্বেগ প্রকাশ করে। এসবই ভাল লক্ষণ। প্রশংসনীয় মনোভাব। কিন্তু যাদের হিন্দু কিংবা সংখ্যালঘু বলা হয়, তারা কি কেবল এ কয়টা দিনই নিরাপত্তার ঘেরাটোপে থেকে ‘সুখি-সুন্দর’ জীবন কাটাবে? অন্য সময়ে চলবে অত্যাচার? কিংবা সেটা না হলেও প্রতি মুহুর্ত কাটাবে অবদমিত মনোভাবে? যদি সমঅধিকারের কথা বলা হয়, তবে তারা মোটেই ভাল নয়Ñ যদি মাথা নত করে সুবোধ বালকের মতো থাকে তবে এমন ভাল মানুষ আর হয় না এটাই কি তাদের নিয়তি?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে যেসব ছাত্র থাকার সুযোগ পায় তারা সবাই মেধাবী। তদবির-সুপারিশে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া যায় না। কিন্তু তাদের বেশিরভাগের আর্থিক অবস্থা ভাল নয়। অনেকেই টিউশানি করে পড়ার খরচ চালায়। এমনকি কেউ কেউ এ আয় থেকে বাড়িতেও টাকা পাঠায়। টিউশানির বাজারে এ হলের ছাত্রদের খুব চাহিদা কারণ তারা যে ভাল ও সুবোধ ছেলে! বিকেলে অন্য হলের ছাত্ররা যখন মাঠে আড্ডা দেয় কিংবা নিউমার্কেটসহ আশপাশে বেড়াতে যায়, তখন জগন্নাথ হল থেকে দলে দলে ছাত্ররা যায় ছাত্র পড়াতে। এরপরও পরীক্ষায় জগন্নাথ হলের ছাত্ররা অনেকেই ভাল ফল করে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের তালিকা দেখুন, হাজার দেড়েক শিক্ষকের মধ্যে পঞ্চাশজনও মিলবে না ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে যাত্রা শুরু করা এ হলের মেধাবী মুখগুলো থেকে। সিনেট-সিন্ডিকেটে জগন্নাথ হলের সাবেক ছাত্রদের কোনো প্রতিনিধি কদাচিৎ দেখা যায়। অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর চিত্রও ভিন্ন কিছু নয়। সর্বত্রই ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে অবদমিত চিত্র। এমন পরিস্থিতিতে তাদের মেধার বিকাশ ব্যাহত হয়। কর্মস্থলে আসে হতাশা। এতে শুধু যে তাদের ক্ষতি, সেটা নয়। সমাজেরও ক্ষতি। একটি উদাহরণ দেই। পুলিশের সর্বোচ্চ পদটি শূণ্য হয়েছিল। এ পদে নিয়োগ প্রদানের জন্য সিনিয়র লোক রয়েছেন। তারা যোগ্য ও নিষ্ঠাবান। কিন্তু সমস্যা রয়েছেÑ ধর্মীয় পরিচয়ে তারা হিন্দু। তাই বিবেচনাতেই এলেন না। সমাজে যোগ্য লোক আছে, কিন্তু তাদের কাজে লাগানো হচ্ছে না। এতে ব্যক্তির বঞ্চনা যথেষ্ট। কিন্তু সব চেয়ে বেশি বঞ্চনা তো দেশেরই। যে হাত সৃজনের তা কেন অলস হয়ে থাকবে? কিংবা ব্যবহার হবে আংশিক? এ অন্যায় যত বেশিদিন চলতে থাকবে, দেশ তত বেশি সময় পিছিয়ে থাকবে। এ নিয়তি নিশ্চয়ই আধুনিক সমাজ বেশিদিন মেনে নেবে না।
শারদীয় উৎসবে কিংবা অন্যান্য ধর্মীয় ও সামাজিক আনন্দের দিনগুলোতে আমরা দলে দলে নিজের শেকড়ে যেতে চাই। সবার সঙ্গে আনন্দ ভাগ করে নিতে চাই। এজন্য উপযুক্ত পরিবেশ দরকার। সেটা যে আমাদের সমাজ চায় না, তা বলা যাবে না। সমাজের বেশিরভাগ মানুষই ধর্ম নির্বিশেষে শান্তি চায়। আর মুষ্টিমেয়রা চায় অশান্তি। তাদের রুখতে প্রধান ভূমিকা নিতে হবে সরকারকেই। সবসময়ই দেখা গেছে, সরকার কঠোর অবস্থানে থাকলে অশান্তি সৃষ্টিকারীরা হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে, এমন সময় অনেক রক্ত দিয়ে অর্জিত আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিতে খুব বেশিদিন পাওয়া যায়নি। সরকার কঠোর হয় না বরং প্রশ্রয় দেয়, লালন পালন করে অশুভ শক্তির। আগামীতে এ অমানিশা কেটে যাবে, আসবে সুদিন, এবারের শারদীয় উৎসবে এটাই হোক প্রার্থনা। আমরা আন্দময় জীবন কাটাতে চাই। উৎকণ্ঠার চির অবসান চাই। দেশকে কিছু দিতে চাই। সভ্যতার বিকাশ চাই। এ চাওয়ায় অন্যায় কিছু নেই। আর এ কারণেই একটি স্পষ্ট চাওয়া কেউ এ পথে যেন বাধা হয়ে না দাঁড়ায়। তাতে কারো মঙ্গল নেই।
লেখক : সাংবাদিক।
বরিশালের ঐতিহ্যবাহী একটি গ্রামের নাম গৈলা। এখানেই জন্ম হয়েছিল মনসা মঙ্গলের কবি বিজয় গুপ্তের। তবে সে সময়ে এ গ্রামেরই একটি অংশের নাম ছিল ফুল্লশ্রী, যাকে কবি অভিহিত করেছিলেন পণ্ডিত নগর হিসেবে। তিনি গ্রামীণ পরিবেশে বসবাস করে পাঁচ’শ বছর আগে রচনা করেছিলেন এমন এক গ্রন্থ, যা আজো কোটি কোটি মানুষের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে আছে। শ্রাবণ মাসে এ মঙ্গল কাব্য পাঠ হয় না, দক্ষিণাঞ্চলে এমন হিন্দু পরিবার কমই মিলবে। বিজয়গুপ্তের মনসা মন্দিরে একটি পিতলের মূর্তি ছিল, যা ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সহযোগীরা লুট করে নিয়ে যায়। যারা এ অপরাধ করেছিল তারা পরিচিত মুখ, হানাদার বাহিনীর সহযোগী লুটেরার দল। কিন্তু প্রতিবাদ করার মতো পরিস্থিতি ছিল না। স্বাধীনতার পরও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ কেন নেয়া হয়নি, সে প্রশ্ন উঠতেই পারে। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের এ এক বড় সমস্যা। তারা অন্যায়ের শিকার হলেও তার প্রতিকার সবসময় হয় না এবং অনেক ক্ষেত্রে এমনকি অন্যায় যে ঘটেছে সেটাও স্বীকার করা হয় না। তা নিয়ে কোনো আলোচনা হয় না, প্রশাসন বা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তার প্রতিকারের কথা সাধারণত ভাবে না। বরং অনেকেই ধরে নেয় যে এমনটি ঘটায় অস্বাভাবিকতা কিছু নেই। এভাবে দেশের নানা স্থানে লাখ লাখ হিন্দু পরিবারের সম্পত্তি বেহাত হয়েছে, দখল হয়ে গেছে দেবোত্তর হিসেবে চিহ্নিত মন্দিরের সম্পত্তি। প্রতিকারহীন শক্তির অপরাধে বিচারের বাণী নিরবে নিভৃতে কাঁদছে, কিন্তু এগিয়ে আসে না প্রশাসন বা পুলিশ।
বিজয়গুপ্তের মনসা মন্দির পিতলের দেবীমূর্তি লুট হয়ে যাওয়ার ৩২ বছর পর ২০০৩ সালের জুন মাসে এ মূর্তিটি নতুন করে তৈরি করার উদ্যোগ নেয় গৈলা-আগৈলঝাড়া-বাকাল-বাগধা-আসকর-চাঁদশী-গৌরনদী-টরকির অধিবাসীরা। বরিশাল শহর থেকেও অনেকে এগিয়ে আসেন। ওই অঞ্চলের যারা ঢাকায় বসবাস করেন তারাও মূর্তিটি নবরূপে তৈরির কাজে উদ্যোগী হন। মনসা মন্দিরে অনুষ্ঠিত এক সামাজিক সভায় ঠিক হয়, মনসা মঙ্গলের বিররণ অনুযায়ী মূর্তিটি তৈরি হবে। এ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ঢাকার শাঁখারি বাজারে মৃৎশিল্পী হরিপদ পাল এবং কাঁসা-পিতলের কাজে দক্ষ রামগোপাল কংসবণিকের সঙ্গে আমরা কয়েকজন আলোচনা করি। তারা এক বছরের কঠোর শ্রম ও সাধনায় নির্মাণ করেন প্রায় একটন পিতল দিয়ে তৈরি মনসা দেবীমূর্তি। ২০০৪ সালের ২৪ ডিসেম্বর ঢাকা থেকে এ মূর্তি গৈলা নেয়া হলে হাজার হাজার নারী-পুরুষ শাঁখ-ঢোল-করতাল বাজিয়ে দেবীকে বরণ করে নেয়। মূর্তিটি মন্দিরে নেয়ার পথে বহনকারী গাড়িটি গৈলার কর্মকার বাড়ির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় কয়েকশ’ নারী উলুধ্বনি দিয়ে ও শাঁখ বাজিয়ে আনন্দ প্রকাশ করে। তাদের অনেকে পরে বলেছেন, এমন আনন্দের দিন আসবে তা ভাবিনি কখনও।
বিজয়গুপ্তের মনসা মন্দিরে স্থাপিত মূর্তি প্রথম থেকেই দেশ-বিদেশের দর্শনার্থীদের বিপুলভাবে আকৃষ্ট করে। গৈলা বাজারের মিষ্টি ব্যবসায়ীদের ভাষ্য : এখন বেশি বেশি দর্শনার্থী আসছে, তাই বিক্রি বেড়েছে। দুধ বিক্রেতাদেরও একই মত। রিকশাচালরা বলছে, তারা বেশি যাত্রী পাচ্ছে। বৃহত্তর বরিশালের নানা এলাকা থেকে গাড়ি করে ভক্তরা আসছে এ মন্দিরে। বরিশাল জেলা প্রশাসন জেলার বিশেষ দ্রষ্টব্য স্থানগুলোর যে তালিকা করেছে তাতে স্থান পেয়েছে গৈলার বিজয়গুপ্তের মনসা মন্দির।
এখন মূর্তিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠছে মন্দির। প্রকৌশলী অরুণ চক্রবর্তী এর ডিজাইন করেছেন। মন্দিরের চত্বরে আয়োজিত এক সমাবেশে ডিজাইন ল্যাপটপে প্রদর্শন করেন অরুণ চক্রবর্তী। এ সময়ে বরিশালের এডভোকেট ফনিভুষণ দাস বলেন, সামনে একটু বেশি স্থান রাখলে ভাল হয়। সভায় উপস্থিত অন্যরাও তাতে সায় দেন এবং ডিজাইনে সঙ্গে সঙ্গেই এ পরিবর্তন আনা হয়। আলোচনা চলতে চলতেই অরুণ চক্রবর্তী মন্দিরের আশপাশ ঘুরে দেখেন এবং পরে সভায় এসে বলেন, মন্দিরের একটি সিঁডি পাশের দিঘীতে নেমে গেলে কেমন হয়? তবে এতে ৩-৪ লাখ টাকা ব্যয় বাড়বে। উপস্থিত সবাই তাতে সায় দেয় আনন্দচিত্তে।
মন্দিরের কাজ শুরুর জন্য বহুকাল আগে প্রতিষ্ঠিত ঐতিহ্যের মন্দিরটি ভেঙে ফেলার প্রয়োজন পড়ে। আশির দশকে গৈলার অধিবাসী সুনীল কুমার গুপ্ত মন্ত্রী থাকার সময়ে এর সংস্কার কাজ করিয়েছিলেন। স্থানীয় জনগণ সর্বসম্মতভাবে একটি আকর্ষণীয় মন্দির নির্মাণের পক্ষে রায় দিলে আর কোনো বাধা থাকে না। তহবিল সংগ্রহের কাজও শুরু হয়ে যায়। গৈলার বাসিন্দা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম এ মালেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক প্রধান উপদেষ্টা ড. ফকরুদ্দিন আহমদের বিশেষ সহকারী থাকার সময় আরেক উপদেষ্টা জনাব আনোয়ার ইকবালকে দিয়ে প্রায় ৬ লাখ টাকা মনসা মন্দিরের জন্য বরাদ্দ করেন। কিন্তু সরকারের তহবিলের টাকা তো পাওয়া যাবে কাজ শুরু হলে? কাজ শুরু করা হবে কীভাবে? এ নিয়ে বৈঠক বসলে আশীষ তফাদার বলেন, তিনি ৫০ হাজার টাকা ধার দেবেন। বরিশালের কৃতী পুরুষ শিল্প উদ্যোক্তা ও সমাজসেবী শ্রী বিজয় কৃষ্ণ দে তার বাসভবনে শহরের কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তির এক সভা ডাকেন। সেখানে উপস্থিত ছিলেন শ্রী নিখিল সেন, প্রাণ কুমার সেনগুপ্ত, আশীষ দাশগুপ্ত, এডভোকেট ফনিভুষণ দাস, পবিত্র কুমার দাস, অসীম দাশগুপ্ত প্রমুখ। বিজয় কৃষ্ণ দে বলেন, মন্দিরের কাজ শুরুর জন্য রড-সিমেন্ট-ইট-বালু যা দরকার তার ব্যবস্থা তিনি করবেন। এর ফলে আর কোনো সমস্যা থাকে না। ডিজাইন অনুযায়ী কাজ এগিয়ে চলে। মন্দিরটি ভক্তদের মনের মতো গড়ে উঠছে। ধাপে ধাপে চলছে এর সাজসজ্জার কাজ। যারা দেখছেন সবাই বলছেন, এ এক চমৎকার শিল্পকর্ম নির্মাণ করা হচ্ছে। শুধু বরিশাল নয়, গোটা দেশের মানুষকে তা আকৃষ্ট করবে। অনেক বছর ধরেই বরিশালের গৈলা এ মন্দিরের কারণে এক গুরুত্বপূর্ণ পর্যটনের স্থান। মন্দিরটির নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হলে পর্যটকদের যাতায়াত আরও বেড়ে যাবে। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় সাংস্কৃতিক পর্যটনের স্থান হিসেবে বিজয়গুপ্তের মনসা মন্দিরকে চিহ্নিত করার উদ্যোগ নিয়েছেন। ধর্মপ্রতিমন্ত্রী এডভোকেট শাহজাহান মিয়ার অনুরোধে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ মন্দিরটি নির্মাণে সব ধরনের সহায়তা প্রদানের নির্দেশ দিয়েছেন। সংস্কৃতি ও ধর্মীয় ঐতিহ্যের এ স্থানটি নিয়ে আমাদের যে পরিকল্পনা তা এভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে।
গৈলার সাবেক আমলের কথায় ফিরে যাই। এ গ্রামেই একটি বড় দীঘি আছে, যা দাশের বাড়ির দীঘি নামে পরিচিত। গ্রামটির পত্তন আর এ দীঘি খনন সম্ভবত একই সময়ে হয়েছিল। এ জলাশয়ের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল গ্রামের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া প্রশস্ত খালের। এখন খালটি ক্ষীণকায়। কিন্তু একদা শুধু বর্ষা নয়, বছর জুড়েই জল থই থই করত। গ্রামের যারা ব্যবসা, চাকরি বা পড়াশোনা উপলক্ষে বাইরে যেত তাদের এ খাল ব্যবহার করতে হতো। আজ থেকে প্রায় ষাট-সত্তর বছর আগের সময়ে আমরা ফিরে যেতে পারি। তখন গৈলায় এমন হিন্দু পরিবার কমই ছিল, যাদের কেউ না কেউ কলিকাতায় নেই। ঢাকাসহ অন্যত্রও ছিল যাতায়াত, তবে সংখ্যায় কম। ব্যবসায় কিংবা পড়াশোনা উপলক্ষে বাইরে থাকা সবাই শারদীয় দুর্গা পূজায় গ্রামে আসবে, এটা ছিল রেওয়াজ। এ সময়ে ছুটিও মিলত অনেকদিন। কীভাবে গৈলার বাসিন্দারা ভারতবর্ষের এক সময়ের রাজধানী কলিকাতা শহরে যেত? মিথ ছিল এ রকম : খুব ভোর বেলা নৌকায় রওনা হয়ে যেতে হতো গোপালগঞ্জের পাটগাতি গ্রামে। যেতে যেতে সন্ধ্যা হতো। পথেই নৌকায় রান্না করা গরম ভাত আর মধুমতি নদীর সুস্বাদু ইলিশ মাছে শুধু পেট নয়, মনও ভরে যেত। বরিশাল শহর থেকে খুলনার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাওয়া স্টিমার কিছুটা রাত হলে থামত পাটগাতিতে। কলিকাতার যাত্রীরা উঠতো স্টিমারে। পরদিন সকালে খুলনা থেকে বরিশালগামী স্টিমারে গৈলা বা আশপাশের গ্রামের যেসব যাত্রী থাকতেন, তারা ওই নৌকায় ফিরতেন নিজের ঘরে। খুলনায় স্টিমার থেকে নেমে কলকাতা যাত্রীদের চাপতে হতো রেলগাড়িতে। পথে বেনাপোল-পেট্রাপোলে চেকিং শেষে সন্ধ্যার কিছু পরে পৌঁছানো যেত কলিকাতায়।
কলিকাতা থেকে বাড়ির পথে সকালে ট্রেনে চেপে বসতে হতো শিয়ালদহ থেকে। সঙ্গে থাকত প্রিয়জনদের জন্য কেনা নানা বাহারি পণ্য। দেড় দিনের যাত্রা শেষে সন্ধ্যায় গৈলা দাশের বাড়ির দিঘীতে কিংবা খালের দুই তীরের কোনো বাড়িতে। শরতের সন্ধ্যার মনোরম পরিবেশে তাই দিঘীর পাড়ে জমে যেত ভিড়Ñ নারী-পুরুষ-শিশু সবাই প্রিয়জনের মুখ কে আগে দেখবে, উন্মুখ সেজন্য। এক একটি নৌকা ঘাটে থামত, আর সবাই ছুটে যেত। যার স্বজন এতে আছে তাদের চোখ-মুখে আনন্দের বান। অন্যরা জানতে চাইত, ‘ওর’ নৌকা কত দূর? যখন কেউ শুনতে পেত, তার প্রিয়জন বিশেষ সমস্যা কিংবা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ায় আসতে পারবে না, হতাশা আর যন্ত্রণায় অন্ধকারেও ধরা পড়ত মুখ যেন আরও কালো হয়ে গেছে। বাড়ি ফিরত বিষণœ মনে। অন্যরা সান্ত্বনা দিত। কিন্তু মন যে মানে না তাতে। উৎসবের আনন্দ তাদের জন্য মাটি হয়ে যেত। এখনকার মতো মোবাইল ফোনের যুগ হলে তারা অনেক আগেই হয়তো সব খবর পেয়ে যেত। কিন্তু তখন যে পোস্ট কার্ডে চিঠি আসতেও ৮-১০ দিন!
সেকালের এই যে দীর্ঘ অপেক্ষা তার আনন্দও তো কোনো অংশে কম ছিল না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে কর্মরত আমার ছোট কাকার কাছে শুনেছি, পূজায় গ্রামে আমাদের দাশের বাড়িতে সবচেয়ে বেশি লোক আসত। বাড়িতে অনেক ঘর ছিল। তারপরও এত লোক প্রবাস থেকে ফিরত পূজায় যে সবার ঘরে ঠাঁই হতো না। পুরুষ সবাইকেই ঘুমাতে হতো উঠানে খোলা আকাশের নিচে। পূজায় বৃষ্টি হবে, সেটা সংস্কারের মতোই ছিল। বৃষ্টি নামলে উঠানের পুরুষদের ঘরে চলে যেতে হত। কিন্তু ঘুমানোর অবকাশ মিলত না। স্থান যে নেই...। তাতে কি? রাত জাগার মধ্যেও মিলত পরম তৃপ্তি ও আনন্দ।
আমাদের জীবনের এ আনন্দ-উচ্ছাস কে কেড়ে নিল? শারদীয় দুর্গোৎসব এবং অন্যান্য অনুষ্ঠান এলেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পদস্থ কর্মকর্তাদের সভা হয় শান্তি বজায় রাখার বিষয়ে। সরকারের দিক থেকে কঠোর নির্দেশ যায় এমন দিনগুলোতে যেন হিন্দুদের মন্দিরে কেউ টোকাটিও দিতে না পারে। সন্দেহভাজন সন্ত্রাসীদের আগেভাগেই পাকড়াওয়ের জন্য বলে দেওয়া হয়। কোথাও মন্দিরে হামলা ও ভাংচুরের ঘটনা থাকলে সবাই উদ্বেগ প্রকাশ করে। এসবই ভাল লক্ষণ। প্রশংসনীয় মনোভাব। কিন্তু যাদের হিন্দু কিংবা সংখ্যালঘু বলা হয়, তারা কি কেবল এ কয়টা দিনই নিরাপত্তার ঘেরাটোপে থেকে ‘সুখি-সুন্দর’ জীবন কাটাবে? অন্য সময়ে চলবে অত্যাচার? কিংবা সেটা না হলেও প্রতি মুহুর্ত কাটাবে অবদমিত মনোভাবে? যদি সমঅধিকারের কথা বলা হয়, তবে তারা মোটেই ভাল নয়Ñ যদি মাথা নত করে সুবোধ বালকের মতো থাকে তবে এমন ভাল মানুষ আর হয় না এটাই কি তাদের নিয়তি?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে যেসব ছাত্র থাকার সুযোগ পায় তারা সবাই মেধাবী। তদবির-সুপারিশে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া যায় না। কিন্তু তাদের বেশিরভাগের আর্থিক অবস্থা ভাল নয়। অনেকেই টিউশানি করে পড়ার খরচ চালায়। এমনকি কেউ কেউ এ আয় থেকে বাড়িতেও টাকা পাঠায়। টিউশানির বাজারে এ হলের ছাত্রদের খুব চাহিদা কারণ তারা যে ভাল ও সুবোধ ছেলে! বিকেলে অন্য হলের ছাত্ররা যখন মাঠে আড্ডা দেয় কিংবা নিউমার্কেটসহ আশপাশে বেড়াতে যায়, তখন জগন্নাথ হল থেকে দলে দলে ছাত্ররা যায় ছাত্র পড়াতে। এরপরও পরীক্ষায় জগন্নাথ হলের ছাত্ররা অনেকেই ভাল ফল করে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের তালিকা দেখুন, হাজার দেড়েক শিক্ষকের মধ্যে পঞ্চাশজনও মিলবে না ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে যাত্রা শুরু করা এ হলের মেধাবী মুখগুলো থেকে। সিনেট-সিন্ডিকেটে জগন্নাথ হলের সাবেক ছাত্রদের কোনো প্রতিনিধি কদাচিৎ দেখা যায়। অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর চিত্রও ভিন্ন কিছু নয়। সর্বত্রই ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে অবদমিত চিত্র। এমন পরিস্থিতিতে তাদের মেধার বিকাশ ব্যাহত হয়। কর্মস্থলে আসে হতাশা। এতে শুধু যে তাদের ক্ষতি, সেটা নয়। সমাজেরও ক্ষতি। একটি উদাহরণ দেই। পুলিশের সর্বোচ্চ পদটি শূণ্য হয়েছিল। এ পদে নিয়োগ প্রদানের জন্য সিনিয়র লোক রয়েছেন। তারা যোগ্য ও নিষ্ঠাবান। কিন্তু সমস্যা রয়েছেÑ ধর্মীয় পরিচয়ে তারা হিন্দু। তাই বিবেচনাতেই এলেন না। সমাজে যোগ্য লোক আছে, কিন্তু তাদের কাজে লাগানো হচ্ছে না। এতে ব্যক্তির বঞ্চনা যথেষ্ট। কিন্তু সব চেয়ে বেশি বঞ্চনা তো দেশেরই। যে হাত সৃজনের তা কেন অলস হয়ে থাকবে? কিংবা ব্যবহার হবে আংশিক? এ অন্যায় যত বেশিদিন চলতে থাকবে, দেশ তত বেশি সময় পিছিয়ে থাকবে। এ নিয়তি নিশ্চয়ই আধুনিক সমাজ বেশিদিন মেনে নেবে না।
শারদীয় উৎসবে কিংবা অন্যান্য ধর্মীয় ও সামাজিক আনন্দের দিনগুলোতে আমরা দলে দলে নিজের শেকড়ে যেতে চাই। সবার সঙ্গে আনন্দ ভাগ করে নিতে চাই। এজন্য উপযুক্ত পরিবেশ দরকার। সেটা যে আমাদের সমাজ চায় না, তা বলা যাবে না। সমাজের বেশিরভাগ মানুষই ধর্ম নির্বিশেষে শান্তি চায়। আর মুষ্টিমেয়রা চায় অশান্তি। তাদের রুখতে প্রধান ভূমিকা নিতে হবে সরকারকেই। সবসময়ই দেখা গেছে, সরকার কঠোর অবস্থানে থাকলে অশান্তি সৃষ্টিকারীরা হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে, এমন সময় অনেক রক্ত দিয়ে অর্জিত আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিতে খুব বেশিদিন পাওয়া যায়নি। সরকার কঠোর হয় না বরং প্রশ্রয় দেয়, লালন পালন করে অশুভ শক্তির। আগামীতে এ অমানিশা কেটে যাবে, আসবে সুদিন, এবারের শারদীয় উৎসবে এটাই হোক প্রার্থনা। আমরা আন্দময় জীবন কাটাতে চাই। উৎকণ্ঠার চির অবসান চাই। দেশকে কিছু দিতে চাই। সভ্যতার বিকাশ চাই। এ চাওয়ায় অন্যায় কিছু নেই। আর এ কারণেই একটি স্পষ্ট চাওয়া কেউ এ পথে যেন বাধা হয়ে না দাঁড়ায়। তাতে কারো মঙ্গল নেই।
লেখক : সাংবাদিক।
No comments:
Post a Comment