Tuesday, June 25, 2019

নির্মল কুমার সেনঃ ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম ফরেনসিক সায়েন্টিষ্ট

ফরেনসিক সায়েন্স হল বিজ্ঞানের এমন একটি ফলিত শাখা যেখানে পদার্থবিদ্যা, রসায়নবিদ্যা, জীববিদ্যা কিংবা বিজ্ঞানের অন্যান্য বিশুদ্ধ শাখার জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে কোন অপরাধের সূত্র খোঁজা বা বিশদ তদন্ত চালানো হয়। বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখার তুলনায় এই শাখাটির বিকাশ হয়েছে বেশ ধীরলয়ে। আর তাই আধুনিক ফরেনসিক সায়েন্স বলতে আমরা যা বুঝি তার মূল গোড়াপত্তন শুরু হয় গত শতাব্দী থেকে। ভারতীয় উপমহাদেশে এই ফরেনসিক সায়েন্স সম্পর্কিত গবেষণায় যাকে পথিকৃৎ বলা যায় তিনি একজন বাঙালি বিজ্ঞানী। তার নাম নির্মলকুমার সেন।


অবিভক্ত বাংলার যশোর জেলার হরিনগর গ্রামে নির্মলকুমারের জন্ম। তার জন্মের কিছুদিন পরেই তার পিতা প্যারীমোহন সেন এবং মাতা সরোজিনী সপরিবারে পাবনায় চলে আসেন। পাবনাতেই নির্মলকুমারের প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয়। পাবনা ইন্সটিটিউশন থেকে থেকে ১৯১৫ সালে মাধ্যমিক পাশ করবার পর তিনি ভর্তি হন পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে। এই কলেজ থেকে তিনি প্রথম শ্রেণী পেয়ে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর তিনি ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি কৃতিত্বের সাথে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। সেসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন বিভাগে অধ্যাপনা করতেন প্রখ্যাত রসায়ন বিজ্ঞানী জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ। 

জ্ঞানচন্দ্র ঘোষের উৎসাহ এবং অনুপ্রেরণা নির্মল কুমার সেনকে অনেকখানি প্রভাবিত করে। আর তাই জ্ঞানচন্দ্র ঘোষের অধীনেই তিনি তাঁর ডক্টরেট গবেষণা শুরু করেন। বাংলার তৎকালীন অর্থনৈতিক অবস্থা বিচারে পাট শিল্পের গুরুত্ব ছিল ছিল অপরিসীম। আর তাই তিনি তাঁর গবেষণার বিষয়বস্তু হিসেবে পাট বীজের রাসায়নিক গঠন সম্পর্কে আরও বিশদরূপে জানবেন বলে সিদ্ধান্ত নিলেন। তাঁর অভিসন্দর্ভের শিরোনাম ছিল “কেমিক্যাল কম্পোজিশন অফ জুট সীডস”। এই গবেষণা চলাকালীন সময়েই তিনি তৎকালীন ঢাকা গভর্নমেন্টাল কলেজে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৩৩ সালে তিনি ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন এবং একই বছর পাটবীজের রাসায়নিক গঠনের উপর তার এই গবেষণার জন্য তিনি রয়্যাল এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে এলিয়ট প্রাইজ পান। 

১৯৪২ সালে নির্মল কুমার সেনকে হুগলী মহসিন কলেজে বদলি করা হয়। এরপরের বছর তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজের রসায়ন বিভাগে প্রফেসর হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৪৮ সালে তিনি রসায়ন বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। তাঁর মূল লেখাপড়া রসায়নের উপর হলেও অধ্যাপনা কাজের ফাঁকে তিনি বিভিন্ন বিষয়ের উপর নানা সময়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হন। ১৯৪২ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলার সময়ে তিনি সরকারের অধীনে সিভিল ডিফেন্স বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। পরবর্তীতে তিনি বাংলা ও সিকিমের সিভিল ডিফেন্স এর গুরুত্বপূর্ণ বিভাগে অধিষ্ঠিত হন। অধ্যাপনার পাশাপাশি এই দায়িত্বও তিনি সুষ্ঠুরূপে পালন করেন। পাশাপাশি তিনি ডেভিড হেয়ার কলেজে পাঠদান ও স্নাতক , স্নাতকোত্তর পর্যায়ের বিভিন্ন শিক্ষার্থীদের অভিসন্দর্ভ তদারক করতেন। কর্মজীবনের এই সকল ব্যস্ততার মধ্যেও তিনি গবেষণাকে আঁকড়ে রেখেছিলেন সবসময়। নির্মল কুমার সেন পোস্ট ডক্টরেট পর্যায়ে গবেষণা করার জন্য বিভিন্ন দেশের গুরুত্বপূর্ণ গবেষণাগারে উল্লেখযোগ্য কিছু গবেষণাকার্য সম্পন্ন করেন। লিভারপুল বিশ্ববিদ্যালয়ে বিখ্যাত বিজ্ঞানী থমাস পার্সি হিলডিচের গবেষণাগারে তিনি তাঁর পোস্টডক্টরেট গবেষণা সম্পন্ন করেন। এখানে থাকার সময় তিনি প্রাকৃতিক চর্বি সংশ্লেষণ এবং এর রাসায়নিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বিস্তারিত গবেষণা করেন। পরবর্তীতে সুইজারল্যান্ডের জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয়ে নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী পল ক্যারের – এর গবেষণাগারেও তিনি পোস্ট ডক্টরাল গবেষক হিসেবে যোগদান করেনরসায়নের মানুষ হওয়ায় প্রথম দিকে তিনি বিভিন্ন প্রাকৃতিক উপাদানের সংশ্লেশণ, উৎপাদন প্রক্রিয়া নিয়ে বেশি আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু ধীরে ধীরে তাঁর গবেষণার বিষয় আরও বিস্তৃত ও বৈচিত্র্যময় হওয়া শুরু করে । 

১৯৪৯ সালে তখনকার রাজ্য সরকার তাঁকে ফরেনসিক সায়েন্স সম্পর্কে উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য যুক্তরাজ্যে প্রেরণ করে। সেই সময় বাংলার মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়। তিনি অপরাধ বিজ্ঞান সম্পর্কে বিস্তারিত গবেষণা ও পাশাপাশি ফরেনসিক সায়েন্স বিষয়ক ল্যাবরেটরি প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা বোধ করেছিলেন। যুক্তরাজ্যে যাওয়ার পর প্রফেসর সেন লণ্ডনের মেট্রোপলিটন পুলিশ ল্যাবরেটরি, স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ গবেষণাগার ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন এবং ফরেনসিক সায়েন্স সম্পর্কিত বিশেষ প্রশিক্ষণ লাভ করেন। দেশে ফেরার পর ১৯৫২ সাল অব্দি তিনি ছিলেন কলকাতা পুলিশ বিভাগের ফরেনসিক সায়েন্স বিভাগের খণ্ডকালীন শিক্ষক। পাশাপাশি রাজ্য সরকারের অনুরোধে তিনি একটি ফরেনসিক সায়েন্স ল্যাবরেটরি গঠন ও গবেষণাকাজের জন্য একটি পরিকল্পনার খসড়া তৈরি শুরু করেন। তাঁর পরিকল্পনা অনুসারেই ১৯৫৩ সালের জুন মাসে প্রতিষ্ঠিত হয় রাজ্য ফরেনসিক সায়েন্স ল্যাবরেটরি। এই ল্যাবরেটরিটি পরিচালনার ভারও ন্যস্ত হয় তাঁর উপর। 

নির্মল কুমার সেন কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ফরেনসিক সায়েন্সের এই গবেষণাগারটি শুধু পশ্চিমবঙ্গে নয় , সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশে প্রথম হিসেবে বিবেচিত আর তাই এই উপমহাদেশে ফরেনসিক সায়েন্স সম্পর্কিত গবেষণায় অধ্যাপক সেন কেবলমাত্র উল্লেখযোগ্যই নন, পথিকৃৎ ও বটে। সেই সময় তাঁর এই ল্যাবে পশ্চিমবঙ্গ তো বটেই , দিল্লী, সিকিম, ওড়িশা থেকেও নানা ধরণের জটিল কেস আসত সমাধানের সূত্র উদ্ধার করবার জন্যে। 

শুধুমাত্র ফরেনসিক সায়েন্স ল্যাব প্রতিষ্ঠা করেই অধ্যাপক সেন বসে থাকেননি। যেহেতু অপরাধীদের কৃত অপরাধ বিভিন্ন প্যাটার্নে পরিবর্তিত হয় সেহেতু তিনিও গবেষণার মাধ্যমে অপরাধের সূত্র উদঘাটনের বিভিন্ন পন্থা আবিষ্কারে নিজেকে আত্মনিয়োগ করেন। ফরেনসিক সায়েন্স সম্পর্কিত গবেষণায় নির্মলকুমার সেনের অবদান অনস্বীকার্য। তাঁর মধ্যে প্রথমেই উল্লেখ করা যায় নরকঙ্কাল থেকে হারিয়ে যাওয়া মানুষকে শনাক্ত করবার কৌশল আবিষ্কারের ব্যাপারটি। অজ্ঞাতপরিচয় কোন মানুষের কঙ্কালের চেহারা খুলির আকৃতি, চক্ষুকোটরের বিস্তৃত বিশ্লেষণ প্রভৃতিকে কাজে লাগিয়ে ধীরে ধীরে ওই ব্যক্তির প্রকৃত চেহারাকে খুঁজে পাওয়া ই ছিল তাঁর এই অভিনব গবেষণার উদ্দেশ্য। তাঁর এই গবেষণাপত্র ” Identification by superimposed photographs” শিরোনামে ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে International Criminal Police Review জার্নালে প্রকাশিত হয়। পাশাপাশি ফরেনসিক সায়েন্স গবেষণা সম্পর্কিত তাঁর অন্যান্য গবেষণা ও ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন একের পর এক প্রকাশিত হয় কলকাতা পুলিশ জার্নালে ও “জ্ঞান-বিজ্ঞান” পত্রিকার বিভিন্ন সংখ্যায়। তিনি ফরেনসিক সায়েন্স সম্পর্কে তাঁর মৌলিক গবেষণার জন্য পুয়ের্তো রিকোতে লিগাল মেডিসিন ও ফরেনসিক সায়েন্স সম্পর্কিত প্রথম আমেরিকান কনফারেন্সেও বক্তা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। 

তাঁর নেতৃত্বে সেই সময়ের বেশ কিছু চাঞ্চল্যকর অপরাধের সমাধান করা সম্ভব হয়েছিল। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বেলারানি মৃত্যু রহস্য (১৯৫৪)- এর কথা। এই অপরাধের জট খুলে সমাধানে উপনীত হওয়ার ক্ষেত্রে নির্মল কুমার সেনের সন্ধানী ও বিশ্লেষণী দৃষ্টি ও মৌলিক গবেষণা প্রক্রিয়া উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছিল। তাঁর দ্বারা ই ফ্লোরোসেন্ট বা প্রতিপ্রভ বিকিরণ ব্যবহারের মাধ্যমে ব্যাংকের চেক জালিয়াতির মত অপরাধের সূত্র উদ্ঘাটন করা সম্ভব হয়েছিল। তাছাড়া দীনদয়াল মৃত্যু রহস্য ( ১৯৬৭ ), এটর্নি জেনারেল হেম সান্যাল মার্ডার কেস সহ বিভিন্ন চাঞ্চল্যকর অপরাধের সমাধান প্রক্রিয়ায় অধ্যাপক সেনের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ফরেনসিক সায়েন্স সম্পর্কিত গবেষণাকালীন বিভিন্ন সময়ে তিনি বেশ কিছু মৌলিক বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া আবিষ্কার করেন। তাঁর আরেকটি উল্লেখযোগ্য কাজ হচ্ছে কালিতে লেখা কাগজের কোন ডকুমেন্ট থেকে অপরাধের সূত্র খুঁজে বের করা। কালি দিয়ে লেখা কাগজের ডকুমেন্ট কত দিনের পুরনো , ক্রোমাটোগ্রাফি ব্যবহার করে তা উদ্ভাবনের অভিনব উপায় আবিষ্কার করেছিলেন তিনি। তাঁর এই গবেষণা প্রকাশিত হয়েছিল জার্নাল অফ ফরেনসিক সায়েন্সে ১৯৭১ সালে। সেই সময়ে ফরেনসিক সায়েন্সের প্রেক্ষাপটে তাঁর এই কাজটি মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হয়। এছাড়াও দেশ বিদেশের বহু গবেষণা পত্রিকায় অধ্যাপক সেন এর গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর গবেষণা জীবনের দিকে তাকালে বোঝা যায় তাঁর প্রথম দিককার গবেষণাগুলি জৈব ও প্রাকৃতিক রসায়নের উপর হলেও শেষ ভাগের অধিকাংশ গবেষণাপত্রই ফরেনসিক সায়েন্স সম্পর্কীয়। কিন্তু এ কথা বলতেই হয় ফরেনসিক সায়েন্স সম্পর্কিত তাঁর গবেষণাকর্মগুলি অন্য মাত্রা পেয়েছে কারণ তাঁর এই গবেষণাতে যুগপৎ মেলবন্ধন ঘটেছে রসায়নবিজ্ঞান সম্পর্কিত গবেষণা প্রক্রিয়ার। 

চাকরি জীবন থেকে অবসর গ্রহণের পর অধ্যাপক সেন প্রায় তিন বছর এমিরেটাস সায়েন্টিস্ট হিসেবে কাজ করেছেন
” কাউন্সিল অফ সায়েন্টিফিক এন্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ, ইণ্ডিয়া” তে । রসায়নবিজ্ঞান এবং ফরেনসিক সায়েন্সে উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্য তিনি রয়্যাল ইনস্টিটিউট অফ কেমিস্ট্রির ফেলো হিসেবে নির্বাচিত হন ১৯৫০ সালে। এর পরের বছর ই তিনি ইন্ডিয়ান সায়েন্স আকাদেমির ফেলো হিসেবে নির্বাচিত হন। ১৯৭৬ সালে ইন্ডিয়ান আকাদেমি অফ ফরেনসিক সায়েন্স তাঁকে ফেলো হিসেবে নির্বাচিত করে। 

তবে উজ্জ্বল গবেষণা জীবন, সাফল্যমণ্ডিত কর্মজীবন ছাড়াও অধ্যাপক সেনের খেলাধুলায় ও সঙ্গীতে ছিল অসামান্য দক্ষতা। ছাত্রজীবনে তাঁর ডক্টরেট ডিগ্রি লাভের খবর সেই সময়ের বহুল প্রচারিত অমৃত বাজার পত্রিকা প্রকাশ করেছিল এভাবেঃ
” The degree of Doctor of Science has recently been conferred on Mr. Nirmal Kumar Sen, Lecturer of Dacca Intermediate College in Chemistry, by the Dacca University. Dr. Sen is well known in Dacca as a good cricketer and a musician. By his achievement Dr. Sen has shown that play and study can really go side by side in the Bengalees.”
(A New D.Sc., Our Own Correspondent, Dacca, Nov.30)

এই খবরটি যখন প্রকাশিত হয়েছিল তখন বাঙলায় তথা ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশেরা রাজত্ব করছিল । পরাধীন বাঙলায় একজন বাঙালির এই অসামান্য সাফল্যের গুরুত্ব ছিল যথেষ্ট। একই ব্যক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশুনায় কৃতী, অপরদিকে খেলার জগতে ও সংগীত জগতে সমান দক্ষ- এ ধরণের সব্যসাচীর ভূমিকায় থাকতে পারেন, তারই অসংখ্য প্রমাণে পূর্ণ হয়ে আছে নির্মলকুমার সেনের সমগ্র জীবন। 

জীবন সায়াহ্নে এসেও অধ্যাপক সেন নানা ভাবে ফরেনসিক গবেষণায় মূল্যবান উপদেশ কিংবা বিবিধ সহযোগিতার মাধ্যমে যুক্ত ছিলেন। ১৯৮৩ সালের ১৬ অক্টোবর তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ফরেনসিক সায়েন্স ও রসায়নবিজ্ঞানে যুগপৎ দক্ষ এই বাঙালি বিজ্ঞানী আমাদের বিস্মৃতির মেঘে অনেকখানি ঢেকে গেলেও বিজ্ঞানের স্মৃতির আকাশে আজও তিনি এতটুকু ম্লান হন নি । 

রেফারেন্সঃ
1. Biographical Memoir of Nirmal Kumar Sen, written by Asima Chatterjee (www.insaindia.res.in)
2. Sen, N.K. and Ghosh, P.C., 1971. Dating iron-base ink writings on documents. Journal of forensic sciences, 16(4), pp.511-520.

পরিশিষ্ট
নির্মল কুমার সেন রচিত উল্লেখযোগ্য গবেষণাপত্র “Dating iron-base ink writings on documents”

Abstract:
A new method for thin-layer chromatography evaluation of progressive oxidative changes of the blue dye and Fe content in the ink strokes on documents of known ages written with iron-base inks is described. The method is a photodensitometric evaluation of the size and intensity of the spots of blue dye and red ferric thiocyanate directly on the chromatograms. Ink samples were obtained from a number of personal diaries of known ages ranging from Jan. 1942 to Dec. 1969. They were written with the same type of ink on almost the same kind of paper and were stored under similar conditions. This method may prove to be of forensic importance in determination of the age of documents bearing such ink.
(Sen, N.K. and Ghosh, P.C., 1971. Dating iron-base ink writings on documents. Journal of forensic sciences, 16(4), pp.511-520.)

লেখক: অতনু চক্রবর্তী

Saturday, June 22, 2019

আরজ আলী মাতুব্বর: যেমন করে ছড়িয়ে গেল

 প্রথম পর্ব

বাংলা একাডেমীর বর্ধমান হাউসের পেছনের ভবনের সিঁড়িতে একজন কৃষক দর্শনের অপরিচিত মানুষকে দেখে একদিন থমকে দাঁড়ালাম। লম্বা, কৃশকায়, একহারা গড়ন তাঁর। পাঞ্জাবি-পাজামা পরনে। পায়ে রাবারের জুতো। একেবারে সাদামাটা। তামাটে গায়ের রং, পোড় খাওয়া মানুষ, দেখে আঁচ করা যায়। আপাদমস্তক সাধারণ, সাদাসিধে। তবে অসাধারণ তাঁর চোখ দুটো। তীক্ষ্ম, ধারালো, ভয়ানক বুদ্ধিদীপ্ত।

"বিদ্যাশিক্ষার ডিগ্রী আছে,
জ্ঞানের কোনো ডিগ্রী নেই.
জ্ঞান ডিগ্রীবিহীন ও সীমাহীন"
                                               -আরজ আলী মাতুব্বর

মনোযোগ দিয়ে চাইলে যে কেউ চোখ জোড়া দেখে আকর্ষণ বোধ করবেন। হঠাৎ করে আমি মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পড়লে তিনিও অনেকটা অপ্রস্তুত হয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন। জিজ্ঞাসু চোখে চাইলেন আমার দিকে। চোখের ভাষায় তাঁর পথ আটকাবার কারণ জানতে চাইলেন। আমি কিছুটা জড়তা নিয়ে শুধোলাম আপনাকে তো চিনলাম না! সেই মুহূর্তে মনে হয়েছিল, তিনি বুঝি কোনো গ্রামের চারণ কবি। পথ চলেন, আর স্বভাবসুলভ কবিতা বানান। উৎসুক শ্রোতা পেলে ধরে প্রবল উৎসাহে শুনিয়ে দেন। সেই কথাটি পেশ করে তিনি হয়তো পকেট হাতড়ে দুচারখান কবিতা বের করে পড়তে দেবেন। অথবা পাঠ করে শোনাবেন।


 আরজ আলী মাতুব্বরের বসতবাড়ী (আরজ মঞ্জিল) লামচরি

না, কোনোটাই করলেন না তিনি। আমার অনুমানের মতো করে বললেনও না কিছু। একটু রয়ে সয়ে বললেন তিনি, আমি একজন সামান্য কৃষক, থাকি গাঁও-গেরামে। আমাকে চিনবেন কেমন করে! তবে জগৎ ও জীবনের নানা বিষয় নিয়ে একটু আধটু ভাবনা ভাবি। মনের খেয়ালে সেই ভাবনাগুলো নিয়ে গুছিয়ে একটু লেখার চেষ্টা করি। অল্প কয়েকখানা বই বের করেছি নিজের কষ্টের পয়সায়। আমাদের এলাকায় কেউ কেউ হয়তো বইগুলো পড়েছেন। তাও সংখ্যায় খুব বেশি হবে না। বই এতদূর এই ঢাকা শহরে আসেনি। কখনো আসলেও কেউ তা পড়বে না।


  দ্বিতীয় পর্ব

এদেশের একজন অপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষিত অথচ প্রাজ্ঞ, শ্রমজীবী অথচ মুক্তবুদ্ধি চর্চায় প্রাগ্রসর, লোকায়ত অথচ বিজ্ঞানসম্মত চেতনায় পরিপূর্ণ ছিলেন। এমন একজন অনন্য মানুষ সম্পর্কে এদেশের অগ্রসর ও মনস্বী বুদ্ধিজীবী ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ওপরোক্ত মন্তব্য করেছেন আজ থেকে তিন যুগ আগে। তখনো তাঁকে চেনেন নি তেমন কেউ। নিভৃত পল্লী প্রান্তর থেকে শহুরে লেখক-পাঠকদের নজর কাড়তে পারেন নি। অনেক পরে, অনেক দেরিতে চিনেছি আমরা তাঁকে। তাঁর জীবন সায়াহ্নকালে, বেশ বিলম্বে আমরা এই প্রগ্রসর লৌকিক দার্শনিকের সাথে পরিচিত হতে আরম্ভ করেছিলাম। কিন্তু এই পরিচয়পর্বটি বিস্তৃত হবার আগেই, সকলে বুঝে ওঠার আগেই গত হয়েছেন তিনি।

আরজ আলী মাতুব্বর। নাগরিক পরিসর থেকে অনেক দূরে জন্ম তাঁর। জীবনভর একটানা সংগ্রাম-সংঘাতের মধ্য একই স্থানে সারাটি জীবন বসবাস করেছেন। ভীষণ একাকীত্বে, নিরিবিলিতে নিজ গ্রামে থেকে আপন যেটুকু জমি-জিরেত তাতে ফসল ফলিয়েছেন। আর তার ফাঁকে ফাঁকে জীবন ও জগতের সত্যানুসন্ধান করে ফিরেছেন।


ইংরেজিতে ‘সেল্ফ টট’ বলে প্রচলিত যে কথাটি তা খাঁটি অর্থেই প্রযোজ্য আরজ আলী মাতুব্বরের ক্ষেত্রে। সাধারণ অর্থে কোনো বিদ্যাপীঠে তার শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ হয়নি। বছর দেড়েক একটি মক্তবে ভর্তি হয়ে, অক্ষর জ্ঞানটুকু নেয়া হয়েছিল। ব্যস, অইটুকুই। এই সামান্য অক্ষরজ্ঞান পুঁজি করে জ্ঞানরাজ্যের বিশাল অঙ্গনে বিস্ময়কর পদাচারণা ঘটেছিল তাঁর। সুপুরী, নারকোল আর নদনদীর জন্য অধিক পরিচিত বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের বর্তমান বিভাগীয় শহর বরিশাল। বরিশাল শহরের কোল ঘেঁষে কীর্তনখোলা নদী। কীর্তনখোলার এক পাড়ে বরিশাল শহর। নদীর বিপরীত দিকে চরমোনাই গ্রাম। এই দুয়ের মাঝ বরাবর বয়ে গেছে কীর্তনখোলা।




শহর থেকে কীর্তনখোলা নদী বেয়ে ১০/১২ কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রম করলে পড়বে এক শান্তসমাহিত গ্রাম। গ্রামটির নাম লামচরি। নদীর ঘাট থেকে প্রায় এক কিলোমিটার পথের দূরত্বে লামচরি গ্রামের কেন্দ্রস্থ লে একটি দরিদ্র কৃষিজীবী পরিবারের বাস। ‘মাতুব্বর বাড়ি’ বলে পরিচিত। লামচরি গ্রামের এ বাড়িতেই বাংলা ১৩০৭ সালের ৩ পৌষ আরজ আলী মাতুব্বরের জন্ম। পূর্বপুরুষের বাড়ি ছিল একই জেলার কালিকাপুর ও ঝর্ণাভাঙা গ্রামে। লামচরি গ্রাম একসময় জলাভূমি ছিল। পরে চর জেগে উঠলে আরজ আলীর পিতামহ আমান উল্লা মাতুব্বর শেষ জীবনে লামচরি গ্রামে ঘরবাড়ি বানিয়ে বসত গড়ে তোলেন।


পূর্বপুরুষের সকলেই ছিলেন কৃষিজীবী। চরে তখনো মানুষের বসবাস শুরু হয়নি। ক্ষেত-খামারও হয়নি। কম মানুষজন, ঘরবাড়ি, হালচাষ হতে থাকে। বাড়ির আশেপাশের চরের জমিতে ফসল ফলানো শুরু করলেন আরজের বাবা এন্তাজ আলী মাতুব্বর। লামচরি চর পরিণত হয় লামচরি গ্রামে। ধনধান্যে ভরে ওঠে লামচরির মানুষের ঘর-গোলা। ধীরে ধীরে একসময় সম্পন্ন গ্রাম হয়ে ওঠে লামচরি। আরজ আলী মাতুব্বরের জন্মের চার বছর পর ১৩১১ সালে মারা যান তার বাবা। মৃত্যুর সময় তার উত্তরাধিকারীদের জন্য রেখে যান সামান্য আবাদি জমি এবং বসত বাড়িটি। জমির পরিমাণ ৫ বিঘা। আর টিনে ছাওয়া বসতের দুটো ঘর। এসময় উপর্যপুরি কয়েক বছর প্রাকৃতিক প্রতিকূলতার জন্য ফসল মারা যায়। আরজ আলীরা ৫ ভাইবোন। ৩ ভাই ২ বোন। জন্মের কিছুদিন পর এক ভাই কাছেম আলী মারা যায় ১৩০১ সালে। একই বছরে আরেক ভাই ছোমেদ আলী ৩ বছর বয়সে মারা যায়। এন্তাজ আলী মাতুব্বর তার বড় মেয়ে জিগীর জান বিবিকে বিয়ে দিয়ে যান। তার মৃত্যুর সময় থাকে দুই ভাই বোন, কুলসুম বিবি ও আরজ আলী। আরজ আলীর মা লালমন্নেছা বিবি স্বামী এবং ক্ষেতের ফসল হারিয়ে ছেলেমেয়েকে নিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েন। অনাহারে অর্ধাহারে দিন কাটে তাদের।


  তৃতীয় পর্ব
বরিশাল এলাকার দাপুটে জমিদার তখন লাকুটিয়ার রায় বাবুরা। জমিদারের খাজনা বাকি পড়ে। দু মুঠো খাবারের সংস্থানই যখন হয়না তখন খাজনা পরিশোধের প্রশ্নই আসে না। অত্যাচারী জমিদার তা বুঝবেন কেন! জমিদারি প্রথাই এমন-প্রজার সুখ-সুবিধার বিষয়টা সেখানে গৌণ। পাইক-বরকন্দাজ দিয়ে, অত্যাচার-নির্যাতন করে নিজেদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ নিশ্চিত করার জন্য প্রজাদের খাজনা আদায় করাটাই মুখ্য ব্যাপার। দরিদ্র প্রজা খাজনা প্রদানে অসমর্থ হলে তারা প্রথমে পীড়ন এবং শেষে ক্রোক বা নিলামের আয়োজন করতো।

১৩১৭ সালে আরজের মা জমির খাজনা দিতে না পারলে যে সামান্য জমিটুকু ছিল তা জমিদাররা নিলামে চড়িয়ে নিজেরা দখল করে। বেঁচে থাকার জন্য, টিকে থাকার জন্য লালমন্নেছাকে অন্যের নিকট হাত পাততে হলো। করতে হলো ধারকর্জ। বরিশাল শহরের সে সময়ের কুখ্যাত কুসীদজীবী জনার্দন সেনের নিকট থেকে চড়া সুদে টাকা কর্জ করলেন। এই দেনার দায়ে পরের বছরই অর্থাৎ ১৩১৮ সালে জনার্দন সেন আরজ আলীদের টিনের বসত বাড়িখানা নিলাম করে নেয়ার এক বছরের মধ্যে আরজের মা পুত্র-কন্যা নিয়ে বিত্ত-বেসাত ও গৃহহীন হয়ে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের নিñিদ্র অন্ধকারের অতলে নিমজ্জিত হন। 




রক্ষা এই, নিষ্ঠুর জমিদার বা কুসীদজীবী জমিছাড়া, ঘরহারা করলেও ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করে নি। একান্ত অনুগ্রহবশত ভিটেটুকুর মালিকানা বিধবার নিকট থেকে ছিনিয়ে নিতে পারেনি। পুরানো ভিটিতে তিনি কয়েকদিন কাঁদাকাটা করে অবশেষে সহানুভূতিশীল প্রতিবেশীদের সহায়তায় নতুন একখানা ঘর ওঠালেন। এক চিলতে একটি ঘর। ঘরখানি দৈর্ঘ্যে ছিল পাঁচ হাত। আর প্রস্থে চার হাত। ঘরের চাল ধৈঞ্চর, ছাউনি গুয়াপাতায়, মাদারের গাছের থাম আর ঢেকি লতা দিয়ে বাধা খেজুর পাতার বেড়া। ঘরের চারিদিকে রান্নার হাঁড়িপাতিল, পানির কলসি, চুলা, কাঁথা, বালিশ ইত্যাদি। এর মাঝে কোনোভাবে গুটিশুটি মেরে দু ভাইবোন ও মা বসবাস করতে শুরু করে নতুনভাবে। আর তাতে শুয়ে শুয়ে বালক আরজ আলী স্বপ্ন দেখতে থাকে। নানা এলোমেলো স্বপ্ন। এলোমেলো ভাবনা। তাদের দুর্দশার কথা। অত্যাচারী জমিদারের কথা। অফুরন্ত জিজ্ঞাসা তার মনে আকুলি-বিকুলি করে। বালক আরজ খেই হারিয়ে ফেলে। উত্তর মেলে না।


রাতে ঘুমের ঘোরে পা লেগে ঘরের একপাশে রাখা পানি ভরা কলসি ভেঙে পানি ঘরময় ছড়িয়ে কাঁথা বালিশ বিছানা ভিজে জবজবে একাকার কোনোদিন। আবার কোনোদিন পাতিলের পান্তাভাত ঘরময় ছিঁটিয়ে গেছে। এসময় তাদের দু’বেলার খাবার ছিল এঁটে কলার সাথে পান্তা ভাত। আরজের মা মানুষের বাড়ি বাড়ি কাজ করে, ঢেঁকিতে ধান কুটে কষ্টে সৃষ্টে কোনোভাবে দিনযাপন করেছেন। চোখের জল ফেলে মুখ বুঁজে কষ্ট সয়ে গেছেন তিনি। ভবিষ্যতের আশায় বুক বেঁধে উদয়াস্ত পরিশ্রম করেছেন। ছেলেমেয়ে দুটোকে আগলে রেখে সান্ত্বনা খুঁজেছেন। মানুষ করে গড়ে তুলতে সযত্ন চেষ্টা করেছেন। কিন্তু মানুষ করতে তো ছেলেকে লেখাপড়া করাতে হবে। তার সে সামর্থ্য কই? বেঁচেবর্তে থাকার জন্য খাবার চাই আগে। তারপর না লেখাপড়া। তাদের মুখের দু মুঠো খাবার জোটাতেই প্রাণান্ত। তায় আবার লেখাপড়া!


এসব প্রশ্নের তাড়নায় দীর্ঘদিন বিমোহিত মনে আচ্ছন্ন থেকেছি। হৃষ্টচিত্তে তাঁর বইগুলো সার্বক্ষণিকভাবে বহন করেছি। আর যখন যাকে পেয়েছি পড়ে পড়ে শুনিয়েছি। প্রথমত এটুকুই কর্তব্য বলে মনে হয়েছে। পরে মনে হয়েছে এটুকুতে সন্তুষ্ট হলে চলবে কেন? আমার আজীবন লালিত ধ্যানধারণা ও দর্শনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ এই রচনাগুলো আরো বৃহত্তর পরিসরে নিয়ে যাওয়ার আয়োজন করতে হবে। বহু পাঠককে আলোকিত করার, চিন্তার দাসত্ব থেকে মুক্ত করার অপরিমেয় গুণের অধিকারী কৃষক দার্শনিক আরজ আলী মাতুব্বরের রচনাগুলোকে একত্রিত করে পরিবেশন তো করা যায়। তবে আরো আগে এই লেখককে তো প্রকাশ করা দরকার। তার জীবনী প্রকাশের মাধ্যমে ব্যাপক মানুষের গোচরে নেয়া দরকার এই মহজ্জনকে। অনেকটা অন্ধ আবেগের আতিশয্যে নেমে গেলাম। পরে অবশ্য জেনেছিলাম দেশের প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বেশ আগে দৈনিক ইত্তেফাক-এর এক ঈদ সংখ্যায় তাঁকে নিয়ে লিখেছেন। মফিদুল হক সচিত্র সন্ধানীতে লিখেছেন। লিখেছেন এদেশের বিশিষ্ট স্পষ্টবাদী প্রবাদ পুরুষ অধ্যাপক আহমদ শরীফ, অগ্রসর লেখক-রাজনীতিক বদরুদ্দীন উমরও বুঝি লিখেছিলেন। বরিশালের দু’জন সংবাদকর্মী ও লেখক অরূপ তালুকদার এবং মিন্টু বসু লিখেছিলেন অথবা আরজ আলীর সাক্ষাৎকার প্রকাশ করেছিলেন। এগুলো সবকটি লেখাই পরে হাতে পেয়েছি। নাট্যকর্মী খায়রুল আলম সবুজের তৎপরতার কবি আসাদ চৌধুরী বাংলাদেশ টেলিভিশনে তার এক অনুষ্ঠানে আরজ আলীকে উপস্থাপন করেছিলেন। এগুলো জেনেছি পরে এবং ক্রমান্বয়ে। যাহোক এর পর টানা প্রায় ছয় বছর বরিশাল যাতায়াত। বরিশাল শহর থেকে লামচরি, নদীপথে। অনেকের সঙ্গে কথা, আলাপ, পরিচয়। পরিচয় হলো বরিশাল বিএম কলেজের দর্শনের অধ্যাপক কাজী আব্দুল কাদিরের সঙ্গে। একজন শুভ্র, øিগ্ধ, সাদাসিধে মানুষ। অতিশয় অমায়িক ও পাণ্ডিত্যের ভারে উন্নত এই মানুষটি আরজ আলী মাতুব্বরকে উদার ও অকৃপণ ভাবে সর্বতো সহায়তা করেছেন। হয়তো আরজ আলীর নিজেকে নির্মাণ করতে পারার পেছনে এই ভদ্রলোকের অবদান গরিষ্ঠভাগ।


জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে শুধু আপন বিশ্বাসই নয়, সকল মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া উচিত। সকল ধ্যান-ধারণা সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান লাভ করা দরকার প্রতিটি জ্ঞান পিপাসু মানুষের। শুধু সীমাবদ্ধ পরিমন্ডলে আবদ্ধ হলে চলেনা। সীমানাকে অতিক্রম করে যেতে হবে ক্রমান্বয়ে। এর মধ্যেই ক্রমশ অতিক্রম করা যাবে নিজেকে।

                                               -আরজ আলী মাতুব্বর

 


 চতুর্থ পর্ব
 সাহিত্য, সংস্কৃতি ও প্রশাসনের অনেক ব্যক্তির নিকট তাঁর সম্পর্কে খোঁজ-খবর। অতঃপর সিদ্ধান্ত নেয়া হলো আরজ আলীর জীবনী লেখার। কথা হলো বাংলা একাডেমীর তৎকালীন মহাপরিচালক ড, মাহমুদ শাহ কোরেশীর সঙ্গে। তিনি খুব স্বল্পকালের জন্য নিয়োগ পেয়েছিলেন বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক হিসেবে। এক ফেব্র“য়ারি থেকে আরেক ফেব্র“য়ারি এই এক বছর মাত্র তিনি এই দায়িত্বে নিয়োজিত হয়েছিলেন। নিযুক্তি পাবার পর তিনি দুটো বিষয় সামনে রেখে কাজ করে যাচ্ছিলেন। গতিশীলতা এবং বয়সে অপেক্ষাকৃত তরুণ লেখকদের বই প্রকাশ। ঘনিষ্ঠতার সুবাদে দ্বিতীয়োক্ত বিষয়টি আমার নিকট ব্যক্ত করে তিনি দ্রুত পাণ্ডুলিপি দিতে বললেন। আমি আরজ আলীর ব্যাপারটি বিবৃত করে মহাপরিচালক বরাবরে একখানি চিঠিও দিলাম। সম্মতি মিললো, তারা প্রকাশ করবেন জীবনী পুস্তক। এক সময় জীবনী পুস্তকের পাণ্ডুলিপি লেখা সমাপ্ত হলো। প্রকাশও হলো স্বল্পকালের মধ্যে। মহাপরিচালক জনাব মাহমুদ শাহ কোরেশীর ব্যক্তিগত উৎসাহে বইটি দ্রুত অনুমোদন ও সম্পাদনা লাভ করে ছাপাখানা থেকে বেরিয়ে এলো। ঠিক সে সময়ই বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক হাসনাত আবদুল হাই আরজ আলী মাতুব্বরের জীবনী লেখার উপকরণ সংগ্রহের জন্য আমাকে খোঁজাখুঁজি করছিলেন। তিনি আরজ আলী সম্পর্কে জেনেছিলেন সাহিত্য ও সঙ্গীত অন্তপ্রাণ অ্যাডভোকেট আলী নূর সাহেবের নিকট। প্রায় সমবয়সী এই বন্ধুযুগল পরস্পরকে মামা বলে সম্বোধন করেন। নিকটাত্মীয় কেউ না হলেও দূরাত্মীয় হলেও হতে পারে। আবার নাও হতে পারে। তবে দু’জনার বাড়ী একই জেলায়। দু’জনের মধ্যে সখ্য ভাব বেশ গভীর। একদিন দু’জনে ধানমন্ডির দু’নম্বরে গে্যঁটে ইনস্টিটিউটে মঞ্চায়িত সক্রেটিস নাটক দেখে ফেরার পথে নূর ভাই সক্রেটিস-তুল্য আরজ আলী মাতুব্বরের কথা হাসনাত ভাইয়ের নিকট উত্থাপন করেন। হাসনাত ভাই হতবাক!

বাংলাদেশে এমন একজন ব্যক্তি আমাদের অগোচরে থাকতে পারে, এতো ভাবনারও অতীত। নূর ভাইয়ের বয়ানের সঙ্গে হাসনাত ভাইয়ের বিস্ময় একাকার হবার এক পর্যায়ে হাসনাত ভাইয়ের উত্তেজিত ঘোষণাÑ এবার ঈদ সংখ্যায় তাঁর উপন্যাসের প্রধান চরিত্র আরজ আলী মাতুব্বর। এরপরই আমাকে খোঁজাখুঁজি।




আরজ আলীর জীবনী লিখেছি আমি, এটা নূর ভাই জানতেন। তিনিই হাসনাত ভাইকে আমার কথা বলেন এবং একদিন আমাদের দু’জনকে মুখোমুখিও করে দিলেন তার বাসায়। তারপর অসংখ্য দিন নূর ভাইয়ের লালমাটিয়ার বাসার বৈঠকখানায় আমরা বসেছি। এর অদূরে লালমাটিয়াস্থ আমার অপরিসর ডেরায়ও কয়েকদিন বসেছি। আবার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় অবধি অধ্যাপক মুহম্মদ শামসুল হকের নিকটও আমরা সদলবলে গিয়েছি। যথার্থ একজন গ্রন্থকীট এবং অতিশয় সজ্জন ও প্রগতি চিন্তার এই মানুষটি আরজ আলীকে উদার সহায়তায় সর্বতোভাবে ঋদ্ধ করেছেন। নিয়ামানুগভাবে বিষয়ওয়ারি পুস্তক নির্বাচন, সংগ্রহ ও আলোচনা এগুলো করেছেন তিনি পরম ঐকান্তিকতায়। আরজ আলীর উচ্চতা ও অসামান্যতা উপলব্ধি করে তিনি সহায়তায় মুক্তহাত প্রসারিত করেছিলেন। বস্তুত আরজের জ্ঞানচর্চার শৃঙ্খলা স্থাপনে শামসুল হকের অবদান অসামান্য। সৎ, জ্ঞানভুক ও নির্মল এই মানুষটি দীর্ঘদিন রোগে ভুগে প্রায় এক দশক আগে প্রয়াত হয়েছেন। ক্রমাগত আড্ডায় ও তথ্যাধারে তাঁর জুড়ি সত্যিই বিরল। আশঙ্কাজনকভাবে আমাদের সমাজে এমন মানুষের সংখ্যা ইদানীং কমে যাচ্ছে।


 পঞ্চম ও শেষ পর্ব
উপন্যাসখানি লেখা হলো। আরজের জীবনচর্যা ও দার্শনিক অবস্থান পর্যবেক্ষণ করে বিমুগ্ধ লেখক হাসনাত আবদুল হাই সীমাহীন দ্রুততায় জীবনীভিত্তিক উপন্যাস লিখে ফেললেন। এই ধারার উপন্যাসের তিনি সূচনা করেছেন শিল্পী এস এম সুলতানের জীবনচরিত অবলম্বনে রচিত উপন্যাস ‘সুলতান’-এর মাধ্যমে। ‘একজন আরজ আলী’ নামের একখনি উপন্যাস অতি দ্রুততায় নামিয়ে ফেললেন হাসনাত ভাই এবং শাহাদত চৌধুরী সম্পাদিত তৎকালীন সাপ্তাহিক বিচিত্রার ঈদ সংখ্যায় তা ছাপাও হয়ে গেল। অত্যন্ত সুলিখিত এবং আরজ-জীবনের খুব প্রাসঙ্গিক অংশগুলো উপন্যাসের মেজাজে অতিশয় মুনশিয়ানায় উপস্থাপন করে উপন্যাসটি রচিত।

প্রায় কাছাকাছি সময়ে বাংলা একাডেমী প্রকাশিত আমার রচিত জীবনী ও একজন আরজ আলী উপন্যাস প্রকাশিত হলো। দুটো পুস্তক খুব দ্রুত পাঠকনন্দিতও হলো এবং আরজ আলী মাতুব্বরের প্রতি মানুষের গভীর মনোযোগ আকর্ষণ করলো। নূর ভাই সবিশেষ আগ্রহ নিয়ে বইখানির প্রকাশনা অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রস্তাব করলে আমরা তাৎক্ষণিক উৎসাহী হয়ে উঠি। জাতীয় জাদুঘরের শিশু মিলনায়তনে কেবল প্রকাশনা অনুষ্ঠানের আয়োজন নয়, আরজ আলী মাতুব্বরের পরিবারের সদস্য ও আরজ আলী সান্নিধ্যধন্য বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সম্মিলনী হয়ে গেল। এতে শিল্পী আবুল কাসেম, সরদার ফজলুল করিম, অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, অধ্যাপক মুহম্মদ শামসুল হক প্রমুখসহ বেশ কয়েকজন স্মৃতিচারণের পাশাপাশি দার্শনিক তত্ত্বের আলোচনা করেছিলেন। হলভর্তি উপচে পড়া নিবিষ্ট শ্রোতা। সকলে তন্ময় হয়ে শুনেছেন, আরজ আলীকে শ্রদ্ধার সঙ্গে উপলব্ধিতে মনোযোগি হয়েছেন।
অনুষ্ঠানটির সংবাদ প্রকাশে দৈনিক জনকণ্ঠ সে সময় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। এখানে বিশেষত জনকণ্ঠ সম্পাদক বর্ষীয়ান সাংবাদিক তোয়াব খানের কথা উল্লেখ করতেই হয়। তাঁর ব্যক্তিগত আগ্রহে খুব গুরুত্বের সঙ্গে খবর এবং উপর্যুপরি কয়েকটি ফিচার ও পুস্তক আলোচনা প্রকাশিত হয়। তিনি শিল্পী শামসুদ্দীনকে দিয়ে আরজ আলীর একটি মনোজ্ঞ স্কেচ করান। তিনি পরে আমাকে মূল ডিজাইনটি দিয়েছেন ব্যবহারের জন্য এবং স্কেচটি রচনাবলী ও বিভিন্ন স্থানে বহুল ব্যবহৃত ও পরিচিত। এমনকি স্কেচটি অনুসরণে পোস্টারও ছাপা হয়েছে।




এ সকল উদ্যোগে ও তৎপরতায় এতো দ্রুতলয়ে আরজ আলীর নাম, তাঁর দর্শন তত্ত্ব তরুণ বয়সী লেখক ও পাঠকের মধ্যে তাঁর প্রভাব ছড়িয়ে গেল যে তা একরকম অবিশ্বাস্য। দুদশক আগের কথার বয়ান এটুকুই থাক।
আরজ আলী মাতুব্বরের সঙ্গে কিয়ৎকালীন ব্যক্তিগত পরিচয় ও তাঁর সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে ওঠার বিবরণ পাঠক সমীপে তুলে ধরার তাগিদ থেকে এই বিবরণের অবতারণা করা হলো। বর্তমান প্রজন্ম আরজ আলীকে জানার প্রাথমিক তৃষ্ণা মিটবে এ পুস্তকখানির মাধ্যমে। বর্তমান জীবনী গ্রন্থের সংক্ষিপ্ত সংস্করণ প্রথম বাংলা একাডেমী প্রকাশ করেছিল ১৯৯৩ সালে। দ্রুত নিঃশেষিত হওয়ায় ২০০১ সালে দ্বিতীয় সংস্করণ হয়েছে। তাও অনেক আগে ফুরিয়ে গেছে। অথচ নতুন প্রজন্মের পাঠকদের মধ্যে আরজ আলী সম্পর্কে রয়েছে অপার কৌতূহল। তাঁর জীবন এবং দর্শনের সঙ্গে পরিচিত হবার তাগিদ অনুভব করেন তারা। প্রজন্মের তাগিদ ও চাহিদা বিবেচনা করে বর্তমান সংস্করণ বর্ধিত কলেবরে প্রকাশ করা হলো। এই সম্প্রসারণকৃত সংস্করণ পাঠককে আরজ আলী অনুধাবনে আরো সহায়ক হবে বলে আমরা ধারণা করি। আরজ আলীর প্রতি যতোটা মনোযোগ ফেরানো যাবে ততটাই আমাদের সমাজ যুক্তিসিদ্ধ ও বিজ্ঞানমুখী হয়ে উঠতে পারবে। সেটাই তো আমাদের কাম্য।


লেখক:  আইয়ুব হোসেন, গবেষক ও সাংবাদিক

নীলিমা ইব্রাহিম: অন্তরে-বাহিরে সৎ একজন মানুষ।

অষ্টম শ্রেণীর ক্লাস চলছে।মাষ্টার মশাই অংক করাচ্ছেন। ইন্সপেক্টর এসেছেন স্কুল পরিদর্শনে, ইন্সপেক্টর প্রশ্ন করলেন- 'Bisect a straight line into five equal Parts.’
শিক্ষার্থীরা হতভম্ভ। কেউ দাঁড়ানোর সাহস পাচ্ছে না। অংকের শিক্ষক মাথা নিচু করে এক কোণে দাঁড়িয়ে আছেন। কিন্তু শিক্ষার্থীদের মধ্যে থেকে একজন উঠে দাঁড়ালো। সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। সে উত্তর দিল, ম্যাডাম Bisect অর্থ তো সমান দুভাগ করা।
একটা সরল রেখাকে Bisect করে সমান পাঁচ ভাগে ভাগ করা কিভাবে সম্ভব? রাগে গরগর করতে করতে বেরিয়ে গেলেন ইন্সপেক্টর। শিক্ষকের মুখে গর্ব মিশ্রিত হাসি দেখা দিল।
সেদিনের সেই শিক্ষার্থীর নাম নীলিমা রায় চৌধুরী, আমরা যাঁকে চিনি নীলিমা ইব্রাহিম নামে। সাদাকে সাদা এবং কালোকে কালো বলার সত্‍সাহস যিনি রাখতেন। কখনোই আপোস করেননি অন্যায় কাজের সাথে। আর তাই অবলীলায় ফিরিয়ে দিতে পেরেছেন মন্ত্রীত্বের প্রস্তাব। তিনি জানতেন তিনি একজন শিক্ষক। সেটাই ছিল তাঁর অহংকার। ১৯৭৪ সালের শেষার্ধে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু তাঁকে সরাসরি প্রশ্ন করেছিলেন, ‘রাজনীতি করবেন?’ তিনি স্পষ্ট জবাব দিয়েছিলেন, ‘না।’ ‘কেন?’ ‘বুঝি না, আমি মাস্টার, হ্যাঁ বললে হ্যাঁ আর না বললে না বুঝি। আমার পক্ষে রাজনীতি করা সম্ভব নয়।’ বঙ্গবন্ধু গম্ভীর হয়ে উঠে দাঁড়িয়েছিলেন, অনুরোধ করেছিলেন শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব নিতে। বঙ্গবন্ধু জানিয়েছিলেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে তিনি অনেক টাকা বরাদ্দ করেছেন, কারও ওপর নির্ভর করতে পারছেন না, তাই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব তিনি (ড. নীলিমা ইব্রাহিম) নিলে বঙ্গবন্ধু অনেকটা আশ্বস্ত হতে পারতেন। তিনি সবিনয়ে সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, বলেছিলেন, ‘বঙ্গবন্ধু, প্রথমত আমি শিক্ষক হিসেবে মরতে চাই। শেষ যাত্রার সম্মানটুকুর প্রতি আমার লোভ...।’
অথচ শিক্ষক হওয়ারই কথা ছিল না তাঁর। ১৯৬৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছিলেন পিএইচডি করতে। ভেবেছিলেন বছর খানেক বিশ্ববিদ্যালয়ে যাতায়াত করে থিসিস জমা দিয়ে ফিরে যাবেন ঘর গেরস্থালীতে, খুলনায় যেখানে রয়েছে তাঁর স্বামী ডা: মুহম্মদ ইব্রাহিম ও পাঁচ কন্যা। কিন্তু সব সময় মানুষের ভাবনার সাথে বিধাতার ভাবনা মেলেনা। তাই পিএইচডি করতে আসার দুসপ্তাহের মধ্যে বাংলা বিভাগের প্রফেসর আব্দুল হাইয়ের কথায় একরকম বাধ্য হয়েই যোগ দিলেন বাংলা বিভাগে। ১৯৫৬ সালে শুরু হওয়া সেই দায়িত্ব তিন দশককাল পরম নিষ্ঠার সাথে পালন করেছেন নীলিমা ইব্রাহিম। দায়িত্ব পালনের পথে ফুল বিছানো ছিল না, ছিল কন্টকপূর্ণ। কাঁটাগুলো সরাতে গিয়ে ক্ষত বিক্ষত হয়েছেন। তারপরও কাজ করে গেছেন অবিচলতার সাথে। বাংলাদেশের মুষ্টিমেয় যে কজন ব্যক্তি নিজ কর্মগুণে জগৎবিখ্যাত হয়েছেন নীলিমা ইব্রাহিম ছিলেন তাঁদের অন্যতম।
নীলিমা ইব্রাহিম জন্মেছিলেন ১৯২১ সালের ১১ জানুয়ারী খুলনা জেলার বাগেরহাট মহকুমার মূলঘর গ্রামে। জন্ম হয়েছিলো জমিদার পরিবারে। পিতা প্রফুল্ল রায়চৌধুরী, মাতা- কুসুমকুমারী দেবী। শৈশব কাটিয়েছেন খুলনায়। শৈশবে তিনি খুব দুরন্ত প্রকৃতির ছিলেন। তাঁর নিজের ভাষায় 'গেছো' প্রকৃতির। বাড়ীর আশে পাশে পুকুরে ঝাপাঝাপি, কুল, জামরুল আর কাঁচা আমের বংশ লোপ ইত্যাদিতে ছিল তাঁর জন্মগত অধিকার। রীতিমতো ফুটবল খেলতেন ভাইদের সাথে। মেয়ের প্রকৃতির সাথে সাথে গায়ের রং নিয়েও চিন্তিত ছিলেন মা কুসুমকুমারী। সকল ভাইবোনের মধ্যে একমাত্র নীলিমাই ছিলেন কৃষ্ণবর্ণা। সম্ভবত এজন্যই মার কাছ থেকে কিছুটা অবহেলা তিনি পেয়েছিলেন। আর সেটা পুষিয়ে দিতেন তাঁর বাবা। বলতেন, "আমার এই মেয়ের আমি বিয়ে দিব না। শ্বশুরবাড়ীতে লোকেরা মুখের কাপড় তুলে বলবে 'এমা এ বউ কালো' সে আমি সইতে পারব না।" তাঁর জীবনে তাঁর বাবার প্রভাব ছিল খুব বেশি। বাবা প্রফুল্ল কুমার বিদ্ধান, সাহিত্য রসিক ও সঙ্গীত প্রিয় ছিলেন। আর বাবার এই গুণগুলিই দেখা যায় মেয়ে নীলিমার মাঝে।

Image may contain: one or more people, closeup and text

নীলিমা মেধাবী ছিলেন ছোট বেলা থেকেই। ভর্তি হয়েছিলেন খুলনা করনেশন গার্লস স্কুলে। এই স্কুল থেকে মাধ্যমিক পাশের পর বাবা তাঁকে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিলেন কলকাতার বিখ্যাত ভিক্টোরিয়া ইনস্টিটিউশনে। সেখান থেকেই উচ্চমাধ্যমিক ও অনার্স (অর্থনীতি) সম্পন্ন পাশ করেন। তারপর এম.এ. পড়া শুরু করলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে। তবে অর্থনীতিতে এম.এ. আর করা হয়ে উঠেনি। শেষ পর্যন্ত স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে বি.টি. সম্পন্ন করেন। কিন্তু এম.এ. পাশের অদম্য ইচ্ছা থেকেই গিয়েছিল তাঁর। এরপর ভর্তি হলেন বাংলায়, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে, এবার অবশ্য এম.এ. সম্পন্ন করতে পেরেছিলেন তিনি।
মাধ্যমিক পরীক্ষার পর বসে থেকে তাঁর কোনো পরীক্ষা দেওয়া হয়নি। কারণ গুরুতর অসুখ নিয়ে বার্লি খেয়ে, আক্কেল দাঁতের অপারেশন নিয়ে দিয়েছেন উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা। কোরামিন ইনজেকশন নিয়ে বি.এ. পরীক্ষা, আর মুখে একটা গোটা ইরিসিপ্লাস নিয়ে দিয়েছেন বি.টি. পরীক্ষা। এম.এ. তেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। সে সময় হয় ডেঙ্গু জ্বর। প্রতিবারই অদম্য ইচ্ছাশক্তির জোরে কাটিয়ে উঠেছেন সব প্রতিকূলতা। পরীক্ষার আট মাস আগে স্ট্রোক হওয়াতে অর্থনীতিতে অনার্স পরীক্ষায় দ্বিতীয় শ্রেণী লাভ করেন। এছাড়া সব গুলোতেই ছিল প্রথম বিভাগ। অসুস্থার কারণে সব পরীক্ষা তাঁকে 'সিক বেড' এ শুয়ে দিতে হয়েছে। নানা রকম বিপদ আর ঝড়-ঝঞ্ঝা এসেছে তাঁর সমগ্র পাঠ্য জীবনে।
শিক্ষা জীবনে নীলিমা যে সকল শিক্ষকের সান্নিধ্যে এসেছেন তাঁদের কাছ থেকে সব সময় শেখার চেষ্টা করেছেন।

লেখক: আকবর দীপু

রামরাম বসু: ইতিহাসের ছায়ায় ঢাকা পড়ে যাওয়া এক আলো

পলাশীর যুদ্ধের পর ভারতবর্ষে ইংরেজ কোম্পানির প্রভাব বাড়তেই থাকে, ইংল্যান্ড থেকে দলে দলে ভিড়তে থাকে ব্যবসায়ী জাহাজ। সেই জাহাজে ব্যবসায়ীদের ভিড়ে খুব অল্প হলেও খ্রিস্ট ধর্ম প্রচারে আসতে শুরু করেন মিশনারীরা। কিন্তু ব্যবসা কিংবা ধর্মপ্রচারে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায় ভাষা।

পলাশীর যুদ্ধ, এর পর থেকেই ভারতে ইংরেজ বণিকদের আধিপত্য বাড়তে থাকে; Image source: Wikimedia Commons
ভারতবর্ষ আশ্চর্য এক এলাকা, এর ভাষার ভীষণ বাহার। কয়েকশো মাইল পাড়ি দিলেই মানুষের মুখের ভাষা বদলে যায়। হিন্দি, বাংলা, উর্দু, ফারসি, তামিল আরো কত শত ভাষা। তাই সাধারণ মানুষের সাথে যোগাযোগ করার জন্য ইংরেজির পাশাপাশি বেশ অনেকগুলো ভারতীয় ভাষা জানে এমন কিছু পণ্ডিত নিয়োগ দেওয়া জরুরী হয়ে পড়ে। তাদেরকে মুন্সী নামে ডাকা হতো। মূলত, ফারসি ভাষায় মুন্সী শব্দের অর্থ পণ্ডিত। মুন্সীদের প্রধান দায়িত্ব ছিল দোভাষীর কাজ করা এবং ব্যবসায়িক ব্যাপারে পরামর্শ দেওয়া।
এই মুন্সীগিরি করে অনেকেই সমাজে বিশাল প্রতিপত্তি অর্জন করেছিলেন সেই আমলে। মহারাজা নবকৃষ্ণ বাহাদুর প্রথম জীবনে ছিলেন ওয়ারেন হেস্টিংসের মুন্সী। উর্দু, ফারসি, আরবি আর ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা ছিল তার। তুখোড় বুদ্ধির অধিকারী নবকৃষ্ণ বাহাদুর পরে রবার্ট ক্লাইভেরও মুন্সী হয়েছিলেন। মুন্সীর কাজ করতে গিয়েই দুই ক্ষমতাধর ব্যক্তির খুব কাছের মানুষ হয়ে উঠেন তিনি। ইংরেজদের আনুকূল্যে মহারাজা উপাধি নিয়ে কলকাতার মাথা হয়ে উঠেছিলেন এই নবকৃষ্ণ বাহাদুর।

নবকৃষ্ণ বাহাদুরের শোভাবাজার রাজবাড়িতে দুর্গাপূজা দেখতে এসেছিলেন রবার্ট ক্লাইভ; Image source: Wikimedia Commons 
তবে সব মুন্সীদের ভাগ্যে এমন জমিদারি আর প্রভাব প্রতিপত্তি জুটেনি। অনেকেই নীরবে কাজ করে গেছেন। ধর্মপ্রচার করতে গেলে মানুষের মনের ভাষা বুঝতে পারা আর মুখের ভাষা পড়তে পারা দুইটাই জরুরী। এই কাজে মুন্সীরা সেতুবন্ধন তৈরি করে দিতেন। এমনই এক মুন্সী ছিলেন রামরাম বসু, অল্প বয়সেই তিনি মুন্সীগিরি শুরু করেন। উইলিয়াম চেম্বার্সের সাথে ফারসী দোভাষী হিসেবে কাজ করে ইংরেজীও শিখে নিয়েছিলেন ভালোই।
১৭৮৩ সালে ভারতে আসেন ব্যাপটিস্ট ধর্মপ্রচারক জন টমাস। এদেশের মানুষের সাথে কথা বলে তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন খ্রিস্ট ধর্ম প্রচার করবেন। কিন্তু দরকার ভাষা শিক্ষা, উইলিয়াম চেম্বার্সের সুপারিশে রামরাম বসুকে টমাস তার মুন্সী নিয়োগ দিয়েছিলেন ১৭৮৭ সালে। সেই থেকে রামরাম বসুর যাত্রা শুরু, এরপর সারা জীবনই তিনি মিশনারীদের মুন্সীগিরি করেছেন, সাথে বাংলা ভাষায় সাহিত্য চর্চায় এক নতুন পথ তৈরি করে দিয়েছেন।

সে বছরেই ধর্ম প্রচারের লক্ষ্যে টমাস বেরিয়ে পড়লেন মালদহে, সেখানে কোম্পানির রেশম কুঠির রেসিডেন্ট জর্জ উডনীর সাথে আগে থেকেই যোগাযোগ ছিল তার। মুন্সীর সহায়তায় খুব দ্রুত বাংলা আর ফারসী শিখে সাধারণের মাঝে বেরিয়ে পড়লেন টমাস।
মুন্সী রামরাম বসুও ছিলেন চালাক চতুর লোক। তিনিও খুব দ্রুত বাইবেল আত্মস্থ করে নিলেন। কথায় কথায় বাইবেলের প্রসঙ্গ টেনে মুগ্ধ করে দিতেন টমাসকে। পাশাপাশি হিন্দু ধর্মশাস্ত্রের ব্যাখ্যাও দিতে শুরু করলেন। টমাস খুব দ্রুতই বুঝতে পেরেছিলেন তার মুন্সী বিদ্বান লোক, তাকে ছাড়া কাজ চালিয়ে যাওয়া মুশকিল হবে।
১৭৯২ সালে টমাস টমাস যখন ইংল্যান্ডে ফিরে যাচ্ছেন তখন সাথে নিয়ে গেলেন মুন্সী রাম বসুর রচনাকৃত ‘খ্রীস্ট মহিমা সংগীত’। টমাস ইংল্যান্ডে গিয়ে প্রস্তাব দিলেন উইলিয়াম কেরীকে ভারতে গিয়ে ধর্মপ্রচারের জন্য। স্ত্রী ডরোথির অনিচ্ছা সত্ত্বেও কেরী ইংল্যান্ডের নিশ্চিত জীবন ছেড়ে সপরিবারে পাড়ি জমালেন অনিশ্চিত রাজ্য ভারতের দিকে। ভারতে বিশেষ করে বাংলা ভাষাভাষীদের মধ্যে ধর্মপ্রচার করার সংকল্প নিয়ে জাহাজে বসেই টমাসের কাছে বাংলা শেখা শুরু করে দিয়েছিলেন।
কলকাতার বন্দরে নেমেই কেরীর সাথে টমাস পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন মুন্সী রামরাম বসুকে। সেই শুরু, তারপর তিনি দীর্ঘ সময় কেরীর সাথে বাংলা ভাষা নিয়ে কাজ করেছেন।

কেরী আর রাম বসু; Image source: missionariesoftheworld.org
উইলিয়াম কেরী আর তার মুন্সীর এই দীর্ঘ পথচলা নিয়ে আছে উপন্যাসও। ‘কেরী সাহেবের মুন্সী’  নামের ঐতিহাসিক উপন্যাসে কেরী আর রাম বসুর পথচলার পাশাপাশি তখনকার সমাজের চিত্রটিও তুলে ধরেছেন উপন্যাসের লেখক প্রমথনাথ বিশী।
উপন্যাসের শুরুতেই দেখা যায়, কলকাতার ঘাটে নামার পরেই কথাবার্তা শুরু হয়ে যায় কেরী আর বসুর। বসুর সাথে কথা বলে মুগ্ধ না হয়ে উপায় নেই। বাকপটু রাম বসু জানেন কীভাবে মানুষের মন রক্ষা করতে হয়। মাসপ্রতি বিশ টাকা বেতনে কেরী তৎক্ষণাৎ রাম বসুকে মুন্সী হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন।

উইলিয়াম কেরী তার মুন্সী রামরাম বসু এবং তৎকালীন বাংলার চিত্রের উপর ভিত্তি করে রচিত ঐতিহাসিক উপন্যাস; Image source: rokomari.com
উপন্যাসে কেরী, রামরাম বসু, টমাসের মতো খাঁটি ঐতিহাসিক চরিত্র ছাড়াও আরো কিছু চরিত্র আছে যেগুলোকে লেখক আখ্যা দিয়েছেন ইতিহাসের সম্ভাবনা-সঞ্জাত। প্রথমেই বলতে হয় টুশকি চরিত্রের কথা, রাম বসুর সাথে এক অদ্ভুত সম্পর্ক টুশকির। স্ত্রীর সাথে ঝগড়া বিবাদ করে টুশকির কাছে আশ্রয় খুঁজে রাম বসু। তার ঘরে বসেই যীশু খ্রীস্টকে নিয়ে গীত রচনা করে।
কেরীর সংসারেও শান্তি নেই। কেরীর স্ত্রী ডরোথি ভারতের ব্যাপারে শুরু থেকেই নানা ভয়ের গল্প শুনে এসেছিল, বন জঙ্গল সাফ করে ঘেঁষে গড়ে উঠা লোকালয় কলকাতা, সন্ধ্যার পরেই শেয়ালের ডাক চারদিক থেকে। বাঘ শেয়ালের ভয়ে শুরু থেকেই কাবু ছিলেন তিনি। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত ভারতবর্ষের ব্যাপারে তার ভয় থেকে গিয়েছিল। 
নানা ঘটনাচক্রের সম্মুখীন হয়ে কেরী চিন্তা করলেন কলকাতার বাইরে গিয়ে ধর্মপ্রচার করবেন। জর্জ উডনী নামে এক ধর্মপ্রাণ ব্যবসায়ীর নীল আর রেশমের কুঠির দায়িত্ব নিয়ে কেরী গেলেন মালদহ জেলার মদনাবাটিতে।
বজরা নিয়ে কলকাতা থেকে মদনাবাটির পথে কেরী সতীদাহের হাত থেকে রক্ষা করলেন এক তরুণী বিধবা রেশমীকে। চিতা থেকে পালিয়ে যাওয়ায় গ্রামের গোঁড়া নেতাদের ক্রোধানলে পড়ে যায় রেশমী। তাদের আসল উদ্দেশ্য ছিল পিতা-মাতাহীন রেশমীকে সরিয়ে দিয়ে তার সম্পত্তি দখল করা। রেশমী পালিয়ে যাওয়ায় তাদের উদ্দেশ্য বানচাল হয়ে যায়।

উইলিয়াম কেরী পরবর্তীতে সতীদাহ প্রথা নিষিদ্ধে ভূমিকা রেখেছিলেন; Image source: theculturetrip.com
অন্যদিকে রামরাম বসু মদনাবাটিতে কেরীকে বাংলা, সংস্কৃতের শিক্ষা দিতে থাকেন। কেরী সাহেবের উদ্দীপনায় নীলকুঠীতে চালু হয় ছেলে-মেয়েদের স্কুল। সেখানেও চলতে থাকে শিক্ষা। রেশমী খুব দ্রুতই শিখে নিতে থাকে ইংরেজী। সময় গড়িয়ে যায়, রেশমীকে ভালো লেগে যায় রামরাম বসুর।
আলোকে সামনে রেখে দাঁড়ালে পেছনে যেমন ছায়া পড়ে, ঠিক সেভাবে ‘কেরী সাহেবের মুন্সী’ উপন্যাসে ইতিহাসের আলোতে তুলে আনা হয়েছে কেরী, রামরাম বসুকে। তাদের মূল চরিত্রকে দিয়ে এই উপন্যাস কখনোই বিচার কিংবা যাচাই করা সম্ভব নয়।
ইংরেজদের আসার পর বাংলাসহ পুরো ভারতে এক পরিবর্তনের রেশ শুরু হয়েছিল। ইংরেজ কুঠিগুলোর আশপাশ থেকে ধীরে ধীরে প্রত্যন্ত অঞ্চলে সেই পরিবর্তন ছড়িয়ে যায়। সতীদাহ প্রথা অমানবিক ঠেকে দূরদেশ থেকে আসা হর্তাকর্তা এই বণিক আর পাদ্রীদের কাছে। কিন্তু কুসংস্কারাচ্ছন্ন এক সমাজে চিতার আগুন থেকে বাঁচালেই কি তাকে মানুষের লালসার আগুন থেকে বাঁচানো যায়?
তবে উপন্যাস কিংবা ইতিহাসের পাতায়, দৃঢ় প্রত্যয়ী উইলিয়াম কেরী ছাড়িয়ে গেছেন সবাইকে। স্ত্রী, পুত্রকে হারিয়েছেন কিন্তু মনোবল অটুট রেখে কাজ করে গেছেন। কেরী আর তার মুন্সীর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে শ্রীরামরামপুরে স্থাপিত প্রেস থেকে বাইবেলের বাংলা আর সংস্কৃত অনুবাদ বেরিয়েছে। তেরোটি ভারতীয় ভাষাকে আয়ত্ত্ব করে একটি বহুভাষিক অভিধানও রচনা করেছিলেন কেরী। তবে অভিধান ছাপাকালীন সময়ে শ্রীরামপুর প্রেসে আগুন লেগে হাজারখানেক মূল্যবান বই, পাণ্ডুলিপি আর কাগজ পুড়ে যায়।

শ্রীরামপুর কলেজের ছবি, এই আঙ্গিনা থেকেই বেড়ে উঠেছে বাংলা গদ্য সাহিত্যের ভিত্তি; Image source: John Brown Myers; London 1887
কেরীকে সহায়তার পাশাপাশি তার মুন্সী হিসেবে রামরাম বসুও বাংলা সাহিত্যের ভিত গড়ার কাজটি করে দিয়ে গিয়েছেন। ১৮০১ সালে যখন ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ চালু হয় সেখানে রামরাম বসুকে সহকারী মুন্সী হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। কলেজের ছাত্রদের পাঠ্যপুস্তক হিসেবে বারো ভুঁইয়াদের একজন রাজা প্রতাপাদিত্যকে নিয়ে গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। ‘রাজা প্রতাপাদিত্য চরিত্র’ নামের এই বইটিকেই বাংলা ভাষায় বাঙালীর রচিত প্রথম গদ্যগ্রন্থ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
ইতিহাসের সাক্ষী এই বইটিও ১৮০১ সালে প্রকাশিত হয়েছিল শ্রীরামপুরের মিশন প্রেস থেকে। এই বইয়ের জন্য ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ কাউন্সিল তাকে পুরস্কৃত করে। এর পরের বছর ‘লিপিমালা’ নামে বিভিন্ন কাজের উপযোগী একটি চিঠিপত্রের সংকলন রচনা করেন, এটিও মিশন প্রেস থেকে ছাপা হয়। এছাড়া খ্রিস্টের প্রশংসা করে স্তবগান রচনায়ও তিনি ছিলেন পটু। তার স্তবগানে খ্রিস্টের প্রতি ভক্তি আর খ্রিস্ট ধর্মের প্রতি অনুরাগ দেখে পাদ্রীরা ভাবতেন এই বুঝি রামরাম বসু খ্রিস্টধর্মে দীক্ষা নেবে। কিন্তু সেটি আর কোনোদিনই হয়নি। বাকপটু, জ্ঞানী আর চালাকচতুর এই মানুষটি শেষজীবনের পুরোটাই কাটিয়েছেন ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের সহকারী মুন্সী হিসেবে। 

লেখক: শাহ্ মো: মিনহাজুল আবেদিন

(প্রথম প্রকাশ রোয়ার বাংলা)

Thursday, June 20, 2019

সুফিয়া কামাল মানে বাংলাদেশের ছোঁয়া

“আমাদের যুগে আমরা যখন খেলেছি পুতুল খেলা
তোমরা এ যুগে সেই বয়সেই লেখাপড়া কর মেলা।
আমরা যখন আকাশের তলে ওড়ায়েছি শুধু ঘুড়ি
তোমরা এখন কলের জাহাজ চালাও গগন জুড়ি।”
(‘আজিকার শিশু’ কবিতার অংশবিশেষ)


কবি সুফিয়া কামাল, নামটির সাথে মিশে আছে অসংখ্য আবেগ, অনুভূতি, ভালো লাগা ও ভালোবাসার সরলতা ও নারীর আত্মবিশ্বাস দৃঢ় করার মনোবল। শুধুমাত্র কবিই নন, তিনি ছিলেন একাধারে সাহিত্যিক, দার্শনিক, সমাজ সেবক, শিক্ষক ও সংগ্রামী নেতৃত্ব । তার কবিতার স্তবকে মিশে আছে প্রেম, প্রকৃতি, ব্যক্তিগত অনুভূতি, বেদনাময় স্মৃতি, স্বদেশের প্রতি মমতা, মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণা এবং ধর্মীয় আবেগ।
সহজ কিন্তু আবেগী ভাষার প্রয়োগ ও মননশীল শব্দচয়ন তার প্রতিটি কবিতায় অন্য মাত্রা যুক্ত করে। তার লেখার ঝুলিতে কবিতা ছাড়াও আরও আছে ভ্রমণ কাহিনী, ডায়েরি, ছোট গল্প, উপন্যাস ও শিশুতোষ গ্রন্থ। সব মিলিয়ে প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ২০টিরও বেশি। সেসবের মধ্যে কেয়ার কাঁটা, মায়া কাজল, মন ও জীবন, উদাত্ত পৃথিবী, অভিযাত্রিক, ভ্রমণ কাহিনী ‘সোভিয়েত দিনগুলি’, স্মৃতিকথা ‘একাত্তরের ডায়েরি’ ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
জীবনের শুরুটা কবি সুফিয়ার জন্যে মোটেও আনন্দদায়ক ছিল না। নারীরা তখন সমাজে অনেকটাই পশ্চাৎপদ ছিল। চার দেয়ালের বদ্ধ ঘরে জীবন কাটানোর জন্য প্রস্তুত হতে চাননি তিনি, সমাজের সাথে ঠিকভাবে খাপ খাইয়ে নিতে পারছিল না তার মন। প্রেরণা ছিলেন শুধুই কবির মা সৈয়দা খাতুন। রক্ষণশীল পরিবার বলে, ঘরে মেয়েদের পড়ালেখা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ছিল। মায়ের হাত ধরে হাতে প্রথম বই পাওয়ার আনন্দ পান তিনি। বাড়িতে উর্দুর চল থাকলেও নিজের চেষ্টায় বাংলায় লিখতে পড়তে শিখেন তিনি। গৃহবন্দী জীবনে নিজেকে ধীরে ধীরে স্বশিক্ষিত করে গড়ে তুলতে থাকেন কবি সুফিয়া।
সুফিয়া কামালের জীবনের দিক পরিবর্তনের সূচনা হয় আরেক মহিয়সী নারী বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের সাথে সাক্ষাতের মাধ্যমে। ১৯১৮ সালে মায়ের সাথে যখন প্রথম কলকাতায় যান তিনি, তখন তার পরিচয় হয় বেগম রোকেয়ার সাথে। বেগম রোকেয়ার দর্শন, নারী জাগরণের মনোভাব এবং সাহিত্যানুরাগ ভীষণভাবে নাড়া দেয় শৈশবের সুফিয়াকে।
রক্ষণশীল মুসলমান সমাজে জন্ম নিয়ে ও সেখান থেকে সুফিয়া কামাল শুধু উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা হিসেবে বেরিয়ে আসেননি দুঃসহ নিগড়ে আবদ্ধ বাঙালি মুসলমান নারী সমাজকে তিনি জাগরণের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করেছেন , শৃঙ্খলমুক্ত জীবনের পথিকৃৎ । রক্ষণশীল ও আভিজাত্যের বৃত্ত ভেঙেই তিনি সাহসী কিন্তু দৃঢ় পদচারণা শুরু ।
১৯৭১সালের ১ সালের মার্চে অসহযোগ আন্দোলনে নারীদের মিছিলে নেতৃত্ব দেন। ১৯৯০ সালে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে শরিক হয়েছেন, কার্ফ্যু উপেক্ষা করে নীরব শোভাযাত্রা বের করেছেন। মুক্তবুদ্ধির পক্ষে এবং সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদের বিপক্ষে আমৃত্যু তিনি সংগ্রাম করেছেন। প্রতিটি প্রগতিশীল আন্দোলনের সাথে জড়িয়ে আছে যে নাম, তিনি সুফিয়া কামাল, জননী সাহসিকা ।
পূর্ব পাকিস্তানের সংস্কৃতিকর্মীদের একটি দলকে ডেকে পাঠিয়েছিল জল্লাদ ইয়াহিয়া । নেতৃত্বে ছিলেন সুফিয়া কামাল । এক পর্যায়ে ইয়াহিয়া বলল , '' পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা সব জানোয়ার । '' সুফিয়া কামালের উত্তর ''আপনি তাহলে জানোয়ারদের প্রেসিডেন্ট । ''
বাঙালির নারীর সত্যিকার রূপ এভাবেই পুরো জীবন আপোষ না করে মুক্তির লড়াইয়ে সাহসের প্রতীক হয়েছিলেন , আছেন । এই বাঙালি হারবে না , পথ হারাবে না ।




১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতির ওপর আগ্রাসনের কারণে রবীন্দ্রনাথকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। কবি সুফিয়া কামাল এই নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধেও তীব্র প্রতিবাদ জানান। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবর্ষে তিনি ‘সাংস্কৃতিক স্বাধিকার আন্দোলন’ নামে একটি আন্দোলন পরিচালনা করেন। ১৯৬৯ সালে ‘মহিলা সংগ্রাম পরিষদ’ যা বর্তমানে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ নামে পরিচিত, তার হাত ধরেই গঠিত হয়। এছাড়াও তিনি বাংলাদেশ মহিলা পুনর্বাসন বোর্ড, বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন কমিটি এবং দুস্থ পুনর্বাসন সংস্থা, ছায়ানট, বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী ফাউন্ডেশন এবং নারী কল্যাণ সংস্থার গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫৬ সালে শিশুদের সংগঠন কচিকাঁচার মেলা প্রতিষ্ঠার সাথেও সরাসরি জড়িত ছিলেন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মহিলা হোস্টেলকে ‘রোকেয়া হল’ নামকরণের দাবিও তোলেন কবি সুফিয়া কামাল।
সুফিয়া কামাল ১৯২৫ সালে অবিভক্ত ভারতে ব্রিটিশবিরোধী অসহযোগ আন্দোলনের সময় গান্ধীজি বরিশাল এলে নিজে চরকায় সুতা কেটে গান্ধীজির হাতে তুলে দেন।
তাঁর ভাষ্য অনুযায়ী জানা যায়- 'চৌদ্দ বছর বয়সে বরিশালে প্রথমে সমাজ সেবার সুযোগ পাই। বাসন্তী দেবী ছিলেন অশ্বিনীকুমার দত্তের ভাইয়ের ছেলের বৌ। তাঁর সঙ্গে দুঃস্থ মেয়েদের বিশেষ করে মা ও শিশুদের জন্য মাতৃসদনে আমি কাজ শুরু করি।'
১৯৪৬-এ কলকাতায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় সুফিয়া কামাল এ দাঙ্গা প্রতিরোধে কাজ করার সময় তার সাথে পরিচয় হয় সেই সময়ের বাংলা দেশের দুই উদীয়মান তরুণ শিল্পী কামরুল হাসান ও জয়নুল আবেদিনের সাথে, যারা সেই সময় থেকেই তার নিজের ভাই এ পরিণত হন ।
কবিদের মৃত্যু নেই; তাই তো তিনি এখনো পাঠকদের সাথে মিশে আছেন তার লেখা কবিতার প্রতিটি চরণে।
“হোক, তবু বসন্তের প্রতি কেন এই তব তীব্র বিমুখতা?”
কহিলাম “উপেক্ষায় ঋতুরাজে কেন কবি দাও তুমি ব্যথা?”
কহিল সে কাছে সরি আসি-
“কুহেলী উত্তরী তলে মাঘের সন্ন্যাসী-
গিয়াছে চলিয়া ধীরে পুষ্পশূন্য দিগন্তের পথে
রিক্ত হস্তে। তাহারেই পড়ে মনে, ভুলিতে পারি না কোন মতে।”
(তাহারেই মনে পড়ে কবিতার শেষ কিছু পঙক্তি)


লেখক: লুৎফুল কবির রনি

প্রাতিষ্ঠানিক বিবাহ ও নারীর শরীরের অধিকার

বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠানটি নারীর শরীরের ওপর কেবল একটি পু্রুষের মালিকানা নয় , পারিবারিক মালিকানা এনে দেয় । আমাদের মহাকাব্যগুলোর দিকে তাকালে এমনটাই দেখা যায় । প্রাচীনকালে কন্যারা স্বয়ংবরা হতেন , এই নিয়ে অনেককেই বেশ শ্লাঘা করতে দেখেছি , কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এইসব স্বয়ংবরের পেছনে থাকতো পৌরুষ দেখিয়ে নারীকে ""জয়"" করে নেবার কোনো না কোনো প্রতিযোগিতা !! তাকিয়ে দেখুন সীতার , তাকিয়ে দেখুন দ্রৌপদীর স্বয়ংবরের দিকে !! একটি নারীশরীরের মালিকানা পাবার জন্য শৌর্যবান সব পুরুষদের দ্বৈরথ !! প্রতিযোগিতা দ্বারা নারীকে জয় করে নেবার প্রদর্শনী , যা শুনলেই মেলার মাঠে লটারি বা জুয়া খেলার কথা মনে পড়ে । পণ্য সাজানো থাকবে, বিভিন্ন কসরত করে যিনি খেলায় জিতবেন , পণ্যটি তাঁর । আর্য ভারতের ইতিহাসে নারীর পণ্যায়ণের পত্তন এই প্রথাগুলোর হাত ধরেই । গুহাজীবন বা গোষ্ঠীজীবনে নারীর অধিকার ছিলো স্বাধীনভাবে সঙ্গী চয়ন করবার , কিন্তু আর্যসংস্কৃতির এই স্বয়ম্বর ইত্যাদি প্রথা মূলত নারীর আপাত চয়নের অধিকারের আড়ালে নারীর শরীরের অধিকার নিয়ে জুয়া খেলা । সেখানে লক্ষ্যভেদ বা শর্তপূরণ যিনি করবেন, নারীটি তাঁর ভোগ্যা হবেন , তাঁর নিজের সেই বীরপুরুষটিকে পছন্দ হোক বা না হোক । আর শর্তগুলোও ঠিক করে দিতেন কন্যার পিতারা , কন্যা নিজে নন ।

দ্রৌপদীকে "জয়" করে আনলেন অর্জুন , শাশুড়ির সিদ্ধান্তে তিনি হয়ে গেলেন পঞ্চভর্তারিকা , নিজের কোনো অধিকার ছিলোনা না বলার । মুহূর্তে তাঁর শরীরকে পাঁচ পুরুষের ভোগ্য করে দেয়া হলো , তাঁর অনুমতির বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা কেউ করলেন না , এমনকী অর্জুন‌ও নন !! কারণ বিজিত নারীর শরীর কেবল প্রভু পুরুষটির নয় , পরিবারের সম্পত্তি । জ্যেষ্ঠ স্বামী যুধিষ্ঠিরের সিদ্ধান্তে তিনি মুহূর্তের মধ্যে রাজেন্দ্রাণী থেকে পরিণত হলেন দাসীতে , পাশাখেলায় পণ বা বাজি রাখা হলো তাঁকে । একজন মানুষ আরেকজন মানুষকে বাজি রেখে জুয়া খেলতে পারে কারণ নারীটি তার বা তার পরিবারের সম্পত্তি !! কোনোমতেই একজন স্বাধীন মানুষ নন !! নারীর এর চেয়ে চরম অগৌরবের আর কী হতে পারে ?? অন্তঃপুর থেকে প্রকাশ্য রাজসভায় চূড়ান্ত অপমানের মুখোমুখি হতে হলো তাঁকে । নিজের কোনো মতামত ছিলোনা সেখানেও !!

এছাড়াও স্বয়ংবরে নারীকে হরণ করবার প্রথাও ছিলো । কাশীরাজকন্যা অম্বা , অম্বিকা, অম্বালিকা তিন বোনকে স্বয়ংবর থেকেই হরণ করে এনেছিলেন ভীষ্ম , বৈমাত্রেয় ভাই বিচিত্রবীর্যের বিবাহের জন্য । এই হরণ প্রথা বা রাক্ষসবিবাহ প্রথাও অগৌরবের ছিলোনা পুরুষের পক্ষে বরং গৌরবের ছিলো । বাহুবল দ্বারা নারীকে জয় করা , তা সে নারীর তাকে পছন্দ হোক বা না হোক, সমাজের চোখেও অপার গৌরবের‌ই ছিলো । কাশীরাজকন্যা অম্বা মহারাজ শাল্বের বাগদত্তা ছিলেন , ভীষ্ম দ্বারা অপহৃত হবার পর তিনি আগুন জ্বেলে আত্মহত্যা করেন ।

নারীর নিজের সিদ্ধান্তে অপর পুরুষের সন্তানের মা হ‌ওয়া সমাজসিদ্ধ না হলেও , স্বামী বা পরিবারের অনুমতিতে সেসব ঢালাওভাবে সমাজসিদ্ধ ছিলো । কুন্তী বিবাহের পূর্বে নিজের সিদ্ধান্তে কর্ণের জন্ম দিয়েও তাঁকে ভাসিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন , অথচ বিবাহের পর স্বামীর অনুমতিসাপেক্ষে যখন তিনজন ভিন্ন পুরুষের তিন সন্তানের মা হলেন , সেই পুত্রেরা পেলেন "বৈধ" রাজবংশগৌরব !! কাশীকন্যা অম্বিকা ও অম্বালিকাও ইচ্ছার সম্পূর্ণ বিরুদ্ধে বাধ্য হয়েছিলেন শাশুড়ি সত্যবতীর আদেশে ভাসুর ব্যাসদেবের অঙ্কশায়িনী হতে , বংশরক্ষার তাগিদে !! অথচ স্বামী বিচিত্রবীর্য তখন মৃত , অর্থাৎ পৃথিবী জানবে যে সন্তান স্বামীর নয় , তাতে দোষ‌ও নেই !! বংশের সন্তান তো !! বংশধারা , পরিবার, এসবের কাছে নারীর নিজের শরীর , নিজের ইচ্ছে নির্মম এবং অবিসংবাদিতভাবে বলিপ্রদত্ত !!

অধুনা সুপ্রিমকোর্ট যে ৪৯৭ ধারাটি বাতিল করেছেন , সেখানেও এই কথাটিই ছিলো । নারী নিজের সিদ্ধান্তে কারোর সাথে শরীর ভাগ করতে পারবেনা , স্বামীর অনুমতিসাপেক্ষে পারবে । একেবারে মহাকাব্যিক নিদান । অনুমতি নিয়ে যা খুশি করুন কোনো অসুবিধে নেই । ও হ্যাঁ , স্বামীটির কিন্তু স্ত্রীর অনুমতির দরকার পড়বেনা অপর নারীর শয্যা ভাগ করতে অথবা স্ত্রী তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাও নিতে পারবেন না সেক্ষেত্রে !! তবুও কতো না গেলো গেলো হায় হায় রব চারদিকে !!

মহাকাব্যে এমন নিদান দিয়েও দেখানো হয়েছে, পুরুষের কেটে দেয়া গণ্ডীর মধ্যে থাকলে নারী নিরাপদ , গণ্ডীর বাইরে গেলেই বিপদ !! লক্ষ্মণের গণ্ডী তো আসলে পুরুষতন্ত্রের দ্বারা নারীর জন্য মেপে দেয়া , নির্ধারণ করে দেয়া সীমারেখা । হে নারী তুমি পুরুষ বিনে একা , অসুরক্ষিত , অসহায় , খাদ্যবৎ !! অত‌এব গৃহের পরিধির মধ্যে থাকো , গণ্ডীর বাইরে বেরিওনা । গণ্ডীর মধ্যে থাকার অমোঘ নিদান তো মেয়েদের প্রতি পদে পদে !! অপর কেউ তোমায় ছুঁয়েছে কি ছোঁয়নি সেটা বিচার্য নয় , ছোঁয়ার সম্ভাবনামাত্রেই তুমি অসতী !! তোমায় ছুঁড়ে ফেলা যাবে আগুনে , ছুঁড়ে ফেলা যাবে নির্বাসনে , গর্ভাবস্থার মতো অবস্থাতেও ,নির্বিচারে !! আর তারপরেও ভাবীকালের নারী এহেন কর্মের কর্তাপুরুষের নামে জয়ধ্বনি তুলবে , ভক্তিগদগদ চিত্তে নত হবে । নিজের অপমান অসম্মান নির্যাতন পরিত্যাগ সবকিছু ভুলে গিয়ে প্রভুত্বস্বীকার আর ভৃত্যবৎ আনুগত্য নারীর মতোন আর কেউ দিতে পারবেনা পৃথিবীতে । এতোখানি পরিহাস নিজেদের নিয়ে আর কেউ করতে পারবেনা ।

অধিকৃত নারীশরীরটি বা তার গর্ভের মালিকানা বংশের বাইরে যেতে দেয়া যাবেনা , এ প্রথা কেবল আর্য নয় , অনার্য সমাজেও ছিলো । কিস্কিন্ধ্যাপতি বানররাজ বালীর রামের দ্বারা হত্যার পর তাঁর মহারাণী তারা বালীর অনুজ সুগ্রীবের দ্বারা এবং লঙ্কাপতি রাক্ষসরাজ রাবণের মৃত্যুর পর তাঁর রাণী মন্দোদরীকে রাবনানুজ বিভীষণের দ্বারা গৃহীতা হতে দেখা গেছে । অনার্য নারী সঙ্গীচয়নের ক্ষেত্রে আর্যনারী অপেক্ষা স্বাধীনতর হলেও বিবাহের পর তাদের শরীরের অধিকার স্বামী এবং তার কুল বা পরিবারের কুক্ষিগত‌ই ছিলো । স্বাধীনভাবে নিজ শরীরের চূড়ান্ত পর্যায়ের মালিকানা বা অধিকার তাদের‌ও ছিলোনা ।

নারীর শরীর , গর্ভ , যোনি , সমস্ত‌ই পুরুষতন্ত্রের , পরিবারতন্ত্রের অধিকারে , কবজায় !! মহাকাব্যের সময়ের কিছু নিয়মের খোলস হয়তো পাল্টেছে, নিয়োগ প্রথা হয়তো আজ আর সেভাবে প্রকাশ্যে আইনত প্রচলিত নেই , কিন্তু ভেতরে ভেতরে আদৌ কতোটা পাল্টেছে ?? আইন খানিকটাও এগোতে চাইলে প্রগতির মুখোশ ছিঁড়ে এতো চিলচীৎকার জুড়ছে চারদিকে সবাই ...... আবার না এসব ফিরে আসে !! সময়টাওতো ভালো নয় , বরং দুঃসময় বড় ।


লেখক: শিলা চক্রবর্তী

Monday, June 17, 2019

ঘর কোথায়!

সারাদিন এ পথে ও পথে এ পাড়ায় ও পাড়ায় ঘুরে ঘুরে দানাপানির জোগাড় করতে করতে রাত হয়। পথের পাশে কুপি জ্বেলে বসে থাকে সবজিওয়ালারা, ফুল আর মালার পসরা সাজিয়ে রাতের পসারিনী, হাইওয়ে দিয়ে সারি সারি মালভর্তি ট্রাক কোথায় যেন যায় সারারাত ধরে। মনে হয়, রাত হল, ঘরে যাই।
ভাবি, কোথায় আমার সেই ঘর? কোথাও তো নেই। আকৈশোর ঘরছাড়া, ভবঘুরেগিরি করেই জীবন কাটল। কতো জায়গায় যে থেকেছি, কতো জায়গায় যে ঘুমিয়েছি মঠে, মন্দিরে, আশ্রমে, পথে, গৃহস্থের ঘরে, খোলা ছাদে কোথায় নয়। তার পরেও যেখানে যখন রাতে ফিরি তখন সেই জায়গাকেই ঘর মনে হয়। কিন্তু তাকে ঘর কি আর বলা চলে?
রাস্তা দিয়ে ফিরতে ফিরতে দেখি কোনো এক বাড়ির আলো ঝলমলে জানালা, খাওয়ার টেবিলে এসে বসেছে সে বাড়ির মানুষজন। স্বামী, স্ত্রী, ছেলে, মেয়ে, ছেলের বৌ। হৈ হৈ ব্যাপার। তারা রাতের খাবার খেতে খেতে গল্প করছে, হাসছে, মজা করছে। দূর থেকে দেখতে বেশ লাগে তাদের এই সুখের পৃথিবীর খণ্ড মুহূর্ত। ভাবি, যদি এই সুখ চিরস্থায়ী হত!
ওই পুরুষটি তার স্ত্রীকে ঘিরে যে স্বপ্ন দেখেছিল, তা কি মিলে গেছে পুরোপুরি? সবটা নয়। স্ত্রী যে স্বপ্ন দেখেছিল তার স্বামীকে নিয়ে, কিংবা মা-বাবা যে স্বপ্ন দেখেছে তাদের ছেলেমেয়েদের নিয়ে, তার ছিটেফোঁটাও কি মিলবে বাস্তবের সঙ্গে? অল্প একটু মিলবে, বাকি অনেকটাই অধরা থেকে যাবে। মানুষের স্বপ্ন বড় ব্যক্তিগত, বাস্তবের সঙ্গে সেই স্বপ্নের সচরাচর দেখা হয় না। সারা জীবন পাশাপাশি থেকেও দুজন মানুষ একে অপরের কাছে অচেনা থেকে যায়। যে এই কথার বিরোধিতা করে, সে হয় মিথ্যাবাদী, নয় মোহগ্রস্ত। সকলেই সকলের কাছে শেষাবধি অচেনা।
অচেনা, অপরিচিত মানুষ সব...কেউ স্বামী-স্ত্রী, কেউ সন্তানসন্ততি সেজে ডাইনিং টেবিলে কয়েক মুহূর্তের জন্য খেতে বসেছে, আনন্দ করছে, হাসছে। কেউ কারুর নয়, তবুও। এখানে আচমকাই সব দেখা, কিছুদিন একসাথে থাকা, তারপর চলে যাওয়া যে যার পথে। এই একসঙ্গে থাকাটার নামই ঘর? 'ঘর' শব্দটির মধ্যে এই অভিপ্রায় তো ছিল না। নিশ্চিন্ত, পরম, অচ্ছেদ্য ভালবাসার নীড়কেই তো আশা করেছে মানুষ 'ঘর' শব্দটি উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে। কিন্তু এ কেমন ঘর? একদল অপরিচিত মানুষের সঙ্গে একজীবন থাকাথাকি, এই-ই ঘর? আর তা ছাড়া সত্যিকারের ঘর কোথায় এই পৃথিবীতে, যেখানে ব্যক্তিমানুষের স্বপ্ন সাকার হয়ে বিরাজ করে? দেয় চিরস্থায়িত্বের নিশ্চিন্ত আশ্বাস?
ভাল লাগছে না তো? ভাল লাগবেই বা কেন? অপ্রিয় সত্য কার ভাল লাগে, বলুন? থাক ওসব কথা। চলুন, দেড়শো বছর আগের একটা গল্প বলি।
এ শহরেরই উত্তর প্রান্তে গঙ্গাঘেঁষা কোনো এক অঞ্চলে জন্মেছিলেন এক অন্যরকম মানুষ। নাম তাঁর হরিনাথ। যুবাবয়সে অত্যন্ত বলিষ্ঠ ছিলেন তিনি। এক হাজার বুকডন দিতে পারতেন। সাঁতরে গঙ্গা এপার ওপার করা তাঁর কাছে ছেলেখেলা ছিল। শৈশবেই পিতৃমাতৃহীন। দাদা-বৌদির কাছে মানুষ। ব্রাহ্মণ যুবক। গম্ভীর প্রকৃতির। একবেলা স্বপাক হবিষ্যান্ন আহার করতেন। সংস্কৃত ভাষায় অসামান্য অধিকার। বেদান্তশাস্ত্রের পঠনপাঠনে অতিশয় মনোযোগ ছিল হরিনাথের।
তারপর বহুদিন কেটে গেছে। দক্ষিণেশ্বরের এক সাধুর কাছে যাতায়াত ছিল। তাঁর কাছ থেকেই ধর্মজীবনের দিশা পেয়েছিলেন। পেয়েছিলেন ত্যাগ ও প্রেমের অনুপম আদর্শ, শাস্ত্রে যার আভাসটুকু মাত্র আছে।
গুরুদেবের মহাসমাধির পর ত্যাগব্রতী গুরুভ্রাতারা একসঙ্গে থাকতে শুরু করেছিলেন বরানগরের একটা জীর্ণ বাড়িতে। সকলেই প্রায় যুবক। নরেন, রাখাল, তারক, শশী, হরিনাথ, নিরঞ্জন...। সেই তাঁদের প্রথম মঠ। যথাসময়ে সন্ন্যাস নিলেন তাঁরা। হরিনাথ হলেন তুরীয়ানন্দ।
কয়েক মাস থাকবার পর হরিনাথের এই মঠে আটকে থাকা ভাল লাগল না। একদিন কাউকে কিছু না বলে বেরিয়ে পড়লেন পথে। মাঝে মাঝে বরানগরে খবর আসত তাঁর। তারপর আর কোনো খবর নেই। বরানগরের সাধুভাইয়েরা-- তাঁরাও একে একে বেরিয়ে পড়লেন অনিকেত যাত্রায়। কেউ কারুর খবর পেতেন না আর। কখনও এর ওর সঙ্গে দেখা হয়ে যেত পথের বাঁকে। কিন্তু হরিনাথের খবর খুব কমজনই পেতেন। অনেকে ধরে নিলেন, হরিনাথ মারা গেছেন।
হরিনাথ কিন্তু তখন গঙ্গোত্রীতে। একা। দুটি বহির্বাস, কম্বল একটা, একটি কমণ্ডলু, কটা বই। আর কিছু নেই। ঘুরতে ঘুরতে এ বিজন স্থানে এসে পড়েছেন। একটি পরিত্যক্ত গুহা পাওয়া গেল। এখানেই থাকতে শুরু করলেন। অনেক নীচে একটা ছত্র আছে। সপ্তাহে দুদিন সেখান থেকে ভিক্ষা করে নিয়ে আসেন। তাতেই চলে যায়। দিনের বেশিরভাগ সময় ধ্যানধারণা ও শাস্ত্রাধ্যয়নে ডুবে থাকেন। এইভাবে জীবনের কতো কতো নিমগ্ন বছর চলে গেল।
একটু রাত হলে গঙ্গার ধারে এসে বসেন। কনকনে হাড়হিম ঠান্ডা। ঘোর অন্ধকার রাত্রি, নিঃশব্দ চরাচর, শুধু গঙ্গার নিরবধি স্রোতোধ্বনি। সেই নীরব নিশীথের প্রহর জুড়ে হরিনাথ অন্তর্বহিঃশূন্য অনুভবে মগ্ন হয়ে থাকেন। কখনও কখনও ধ্যান ছেড়ে নিশ্চুপে অন্ধকারে উদাস হয়ে বসে থাকেন। প্রহরের পর প্রহর কেটে যায়।
রাত গাঢ়তর হলে ধীরে ধীরে গুহায় ফিরে আসেন হরিনাথ।
এক রাত্রে এরকম গঙ্গাতীরে বসে থাকতে থাকতে মনে হল, বড্ড শীত লাগছে। গুহায় ফিরে যাবেন। অন্যমনস্কভাবে নিজেকেই বলে উঠলেন, রাত হল। ঘরে চলো।
অমনই সম্বিত ফিরে এল। এ আমি কী বললাম? ঘরে চলো? ঘর? আমার আবার ঘর কোথায়? কোন সুদূর কৈশোরে ঘর ছেড়েছি...এখন আবার ঘর? এখনও ঘর? হায় হায়! এখনও আমার গৃহসংস্কার রয়ে গেছে?
ভয়ানক আত্মক্ষোভ হল তাঁর। দ্রুতপদে গুহাতে ফিরে ধ্যানে বসলেন। অবিরত বিচার, ধ্যান, তপশ্চর্যায় নিরত থেকে ছয় মাসের চেষ্টায় মনের অবচেতনা থেকে ঘর, ঘরের স্বপ্ন, ঘরের ধারণা, ঘরের স্মৃতিকে ঘষে ঘষে মুছে তুলে দিলেন। ছয়মাস পর একদিন সানন্দে বলে উঠলেন, নাহ, আমার মনে আর ঘর নেই। আমি যথার্থই অনিকেত হয়েছি!
এই জীবন আসলে একটা সেতু। সেতুর উপরে কেউ ঘর বানায়? সেতু বেয়ে পার হয়ে চলে যেতে হয় শুধু। আর কিছু নয়।

লেখক: সন্মাত্রানন্দ

জয়দেব মুখোপাধ্যায় : চৈতন্য মৃত্যুরহস্যের কিনারা করতে গিয়ে প্রাণ দিয়েছিলেন যে গবেষক

জয়দেব মুখোপাধ্যায়ের যেন এক কিংবদন্তির নাম যার কথা অনেকেই শুনেছে , বহু মানুষই তাকে খুঁজে ফেরে কিন্ত তার ব্যাপারে বিশদে কেউ কিছু বলতে পারেনা...