একাদশ শতকের প্রথমদিকে অতীশ দীপঙ্কর বৌদ্ধধর্ম ও সংশ্লিষ্ট জ্ঞানভাণ্ডার নিয়ে বাংলা থেকে তিব্বতে গিয়েছিলেন সেখানকার রাজার বিশেষ অনুরোধে। অতীশ তিব্বত এবং সুমাত্রা (বর্তমান ইন্দোনেশিয়া) সহ পূর্ব ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার বিস্তৃর্ণ ভূভাগে বৌদ্ধ ধর্ম ও দর্শনের বিস্তারে এক নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেন এবং এক মহামানবে পরিণত হন। তাঁকে বিশেষভাবে জানাবোঝার এক আগ্রহ তৈরি হয় সেখানকার বিদ্বৎসমাজে। তাঁদের কেউ কেউ চলে আসেন অতীশের দেশে, যে দেশ তাঁদের পরম পুজ্য গৌতম বুদ্ধেরও। অতীশের তিব্বত যাত্রার দুশো বছর পরে অতীশকে নিবিড়ভাবে জানাবোঝার তাগিদে এদেশে আসেন তিব্বতী লামা চাগ্ লোচাবা। তিনি যখন নালন্দায় আসেন সেই মুহূর্তে নালন্দা জ্বলছে তুর্কি আক্রমণে। ইখতিয়ার উদ্দীন মহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজীর সেই আক্রমণের ক্ষণেই নালন্দায় তার সাথে দেখা হয় বৃদ্ধ ভিক্ষু আর্য শ্রীভদ্রর। শ্রীভদ্র লোচাবাকে পালিয়ে যেতে বলেন দূরে, আর উপহার দেন অতীশের ব্যবহৃত সামগ্রী ও লিখিত পুঁথি সমেত এক কাষ্ঠপেটিকা।
এর আটশো বছর পর আমাদের কালখণ্ডে দাঁড়িয়ে এই কাষ্টপেটিকাটি পুনরাবিষ্কৃত হচ্ছে – এমনই এক কাহিনীর সামনে আমাদের দাঁড় করান ‘নাস্তিক পণ্ডিতের ভিটা’র আখ্যানকার সন্মাত্রনন্দ। বাংলাদেশের বিক্রমপুর এলাকায় এই কাষ্ঠপেটিকা পুনরাবিষ্কৃত হওয়ার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সেটি বিস্তারিত গবেষণার জন্য পাঠিয়ে দেয় আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়াকে। সেখানকার আধিকারিক শুদ্ধশীল ভট্টাচার্য পুরাতত্ত্ববিদ সম্যক ঘোষকে এটা গবেষণার জন্য দেন। তা নিয়েই আলোচনা শুরু হয় সম্যক ও তার প্রাক্তন ও বর্তমান দুই গবেষক ছাত্রছাত্রী শ্রীপর্ণা ও অমিতায়ুধের মধ্যে। বস্তুতপক্ষে এই ত্রিবেণীবদ্ধ আখ্যানটির বর্তমান সংলগ্ন কাহিনীটির কেন্দ্রে রয়েছে পুরাতত্ত্ব গবেষক অমিতায়ুধ। ত্রয়োদশ শতাব্দীর কাহিনীর কেন্দ্রে তিব্বতী বৌদ্ধ ভিক্ষু চাগ্ লোচাবা এবং এই দুই কাহিনীর দুই কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব খুঁজে চলেছেন প্রথম কাহিনীর নায়ক অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানের জীবন ও শিক্ষাকে, যিনি একাদশ শতাব্দীতে বৌদ্ধ জ্ঞানচর্চার ইতিহাসে এক মহাদেশজোড়া প্রভাবসঞ্চারী ব্যক্তিত্ব হিসেবে চিরায়ত স্থান পেয়েছেন ইতিহাসে।
এ কাহিনীর প্রথমদিকে অবশ্য শ্রীজ্ঞান অতীশ চন্দ্রগর্ভ নামেও উল্লেখিত হয়েছেন। এসেছে রাজপুত্র হিসেবে দেখা শ্রেণি বর্ণে বিভক্ত সমাজজীবনের বাস্তবতা সম্পর্কে তার বেদনাবহ বীতরাগের কথা। এসেছে এক জটিল সম্পর্কের প্রসঙ্গ, যার বেদনাবহ পরিণতি তার জীবনপথকে অনেক নতুন প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়েছিল। রাজকুমার চন্দ্রগর্ভকে ভালোবেসেছিল কুন্তলা বলে এক কিশোরী। সেজন্য অনেক সামাজিক কলঙ্কও জুটেছিল তার। প্রথম তারুণ্যেই নিজেকে যে দৌবারিকের স্থানে বসিয়ে সমাজলাঞ্ছিত মানুষের যাতনাকে বোঝার চেষ্টা করেছিলেন চন্দ্রগর্ভ, এই কুন্তলা ছিল তারই কন্যা। সেই নিরিখে কুন্তলা চন্দ্রগর্ভের চোখেও হয়ে উঠেছিল কন্যাপ্রতিম। তাদের কৈশোরের অনায়াস বিনিময়ে পরস্পরকে দেখার চোখ ছিল আলাদা। দীর্ঘ ব্যবধানের পর রাহুলগুপ্তের কাছ থেকে শিক্ষালাভ করে যখন ফেরে চন্দ্রগর্ভ, তখনই এই ভিন্ন দৃষ্টিকোণের কথা তার থেকে জানতে পারে কুন্তলা। বেদনার প্রাগাঢ়তায় আত্মহনন করে সে। চন্দ্রগর্ভ কুন্তলার আত্মহনন পরবর্তী পর্বে যখন বিমর্ষ, তখনই বারবার তার স্বপ্নে দেখা দেন গৌতম বুদ্ধ, এক মহাশ্রমণের বেশে। অবশেষে রাহুলগুপ্তের একদা তান্ত্রিক শিষ্য চন্দ্রগর্ভ পারিবারিক তান্ত্রিক ধর্ম পরিত্যাগ করে চলে আসেন ওদন্তপুরী মহাবিহারে। সেখানেই আচার্য শীলরক্ষিতের কাছে তিনি শ্রামণ্যে দীক্ষিত হন। ‘তমসাচ্ছন্ন ধরিত্রীকে অজ্ঞাননিদ্রা হ’তে প্রতিপ্রবুদ্ধ’ করার ভার অর্পণ করে আচার্য শীলরক্ষিত বলেন এই শিষ্য তা পারবেন, কারণ –‘চিরজাগ্রত জ্ঞানদীপ তোমারই হৃদয়কন্দরে সতত দেদীপ্যমান! আজ থেকে তোমার নাম – দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান’।
সমকাললগ্ন কাহিনীটিকে কোলকাতার কসমোপলিটন আবহাওয়া আর বাংলাদেশের মুনশিগঞ্জের বজ্রযোগিনী গ্রামের বিপ্রতীপ পরিবেশে ভাগ করে দেন আখ্যানকার। কোলকাতার গবেষক অমিতায়ুধ বর্ধমানের গ্রাম্য পরিবেশেই বড় হয়েছে, তাই ওপার বাংলার গ্রামের মধ্যে সে সহজেই খুঁজে পায় তার ছেলেবেলার কিছু নস্টালজিয়া। চানঘরের জমানো জলের চেয়ে সবুজ পানাপুকুরে অবগাহনেই তাই তার বেশি উৎসাহ। গ্রামীণ শিক্ষকের অতিথি আপ্যায়ণের আয়োজনের আন্তরিকতা ও বিপুল খাদ্যতালিকাও আমাদের সামনে হাজির থাকে। “কাঁসার থালায় ধোঁয়া ওঠা সরু চালের ভাত, ছোট একটি কাচের বাটিতে গন্ধলেবু, লঙ্কা, লবণ আর সরু সরু করে কাটা পেঁয়াজ। আর একটি কাঁসার বাটিতে ঘন মুসুরির ডাল। তারপর ফুলকাটা কাঁসার বাটি পরপর আসতেই লাগল। সুক্তুনি, আলুভাজা, পাটশাক ভাজা, ডাঁটাশাক, আলু বেগুনের চচ্চড়ি, কলাপাতায় মোড়া ইলিশের পাতুরি, টাটকা রুই মাছে ঝোল, মোরগের কালিয়া, আমসির টক, আবার ছোটো কাঁসার বাটিতে এক অপূর্ব আস্বাদের চাটনি... খাওয়ার শেষপাতে এল পায়েস, দই, মিষ্টি”। আবু তাহেরের পাশাপাশি সাদর অভ্যর্থণা জোটে বনেদী বাড়ির বৃদ্ধ মোতালেব মিয়াঁর থেকেও। তিনি অমিয়ায়ুধকে প্রায় জোর করেই নিয়ে এসে আতিথ্য দেন তার বাড়িতে, শোনান অতীতের নানা গল্প। আবু তাহেরের বাড়িতেই অমিতায়ুধ দেখে পড়শি জাহ্নবীকে। সেই কিশোরীই আবহমান কালের কুন্তলা হয়ে তার সামনে ধরা দেয়, যে নানা রূপে ঘুরে ফিরে আসে অতীশের সময়ে, চাগ্ লোচাবার সময়ে বা সমকালে অমিতায়ুধ এর সামনে।
একাদশ শতকে দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান সংশ্লিষ্ট আখ্যানটিতে স্বাভাবিকভাবেই বৌদ্ধ দর্শন ও তার বিভিন্ন ধারার জটিল ছায়াপাত রয়েছে যা সাধারণ আখ্যান পাঠককে খানিক আবর্তে ফেলতে পারে। পাঠক যখন পড়েন, “অবিদ্যা, সংস্কার, বিজ্ঞান, নামরূপ, ষড়ায়তন, স্পর্শ, বেদনা, তৃষ্ণা, উপাদান, ভব, জাতি, দুঃখ – এই দ্বাদশ নিদান। একটি থাকলেই আরেকটি থাকবে। একটি চলে গেলেই, অপরটি নির্বাপিত হয়ে যাবে।” – এই ধরনের অংশ বা এরপরে যখন আসে এগুলির ব্যাখ্যা – তখন তিনি খানিকটা প্রতিহত হন বৈকি। বৌদ্ধ দর্শন বিষয়ে খুব দীক্ষিত পাঠক ছাড়া আখ্যানের এই ধরনের বেশ কিছু অংশ অনেকের কাছেই ছড়ানো উপলখণ্ড বলে মনে হতে পারে।
দশম একাদশ শতাব্দীর সন্ধিক্ষণে অতীশ যখন আচার্য শীলরক্ষিতের ছাত্র ওদন্তপুরী মহাবিহারে, তখন সেখানে বিভিন্ন বৌদ্ধশাখার মধ্যেকার বিতর্ক এবং তার মধ্যে থেকে প্রকৃত বুদ্ধবাণী বের করে আনা কতটা কঠিন ছিল, সেটা বেশ বিস্তারিতভাবেই এখানে এসেছে। এসেছে বিভিন্ন বৌদ্ধ ধারার মধ্যেকার ভেদাভেদ এর কথাও। - “ এ সঙ্ঘারাম, এ ভিক্ষুবিহারও কিন্তু সেই ভেদাভেদ হতে মুক্ত নয়। বৌদ্ধমত গণনাতীত শাখায় বিভক্ত হয়ে পড়েছে। প্রতিটি শাখার অনুগামীবৃন্দ একেক গোষ্ঠীভুক্ত। ইনি মহাসঙ্ঘিক, ইনি স্থবির, ইনি বাৎসীপুত্রীয়, ইনি সম্মিতিয়, উনি সর্বাস্তিবাদী। পরস্পর পরস্পরের সাথে বিবদমান। একেক সম্প্রদায়ের একেক বিনয়। মৃত্তিকাবিহারে অবস্থানকালে শীলরক্ষিতের নিকট বিনয়পিটকের পাঠ গ্রহণে দীপংকরকে সর্বাধিক শ্রম করতে হয়েছিল। ভিন্ন ভিন্ন মতাবলম্বীগণের ভিন্ন ভিন্ন বিনয়পিটক, তার মধ্য হতে সর্ববাদিসম্মত নির্বিবাদ মত আবিষ্কার করা হয় দুর্ঘট, নয় অসম্ভব”। “শাস্ত্ররচনাকালে একেক সম্প্রদায়ের একেক ভাষানিষ্ঠা! এ কি নিষ্ঠা, নাকি ভাষান্ধতা? ... মহাসঙ্খিকগণ প্রাকৃত ভাষায়, সর্বাস্তিবাদীগণ সংস্কৃত ভাষায়, স্থবিরবাদীগণ পৈশাচী ভাষায়, সম্মিতীয়গণ অপভ্রংশ বাঙময়ে শাস্ত্রচর্চা করেন। প্রকৃত বুদ্ধবচন কোনটি, বিভিন্ন মতাবলম্বীর মতভেদ কী বিষয়ে – সেকথা জানবার জন্য দীপংকরকে বিভিন্ন ভাষা ও তার ব্যাকরণ স্বল্পকালের মধ্যে শিক্ষা করতে হয়েছে”।
অতীশ দীপংকরের আখ্যান বর্ণনার সূত্রে সমকালীন ভারত ইতিহাসের জটিল আবর্তকেও আখ্যানকার উপস্থিত করেছেন তখন বাংলার সিংহাসনে পালসম্রাট মহীপাল। গোটা ভারতে সেই সময়ে বিভিন্ন রাজারা পরস্পরের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও যুদ্ধে রত। পাল, কনৌজ (কান্যকুব্জ), চন্দেল, চেদী, পান্ড্য রাজাদের পারস্পরিক বিবাদ ও যুদ্ধবিগ্রহ অস্বীকার করে চলেছে পশ্চিম দিক থেকে গজনীর সুলতান মাহমুদের ক্রম আগ্রাসন, যা পরে এই সমস্ত অঞ্চলগুলির জন্যই ভয়াবহ হয়ে উঠবে।
এই আখ্যানে বিভিন্ন কালের বিভিন্ন চরিত্রকে পরস্পরের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেন আখ্যানকার। একুশ শতকের অমিতায়ুধ কখনো দাঁড়ায় ত্রয়োদশ শতকের চাগ্ লোচাবার সামনে, কখনো একাদশ শতকের দীপংকরের সামনে। কিন্তু দেখতে পায় না যেন। রাতের সব তারা দিনের আলোর গভীরে লুকিয়ে থাকলেও যেমন দেখা যায় না। এখানেই এক বিশেষ ইতিহাস দর্শনকে নিয়ে আসেন সন্মাত্রনন্দ। একই রকম অভিজ্ঞতা বা কথাবার্তার সামনে বিভিন্ন কালখন্ডকে দুলিয়ে দেওয়ার এক আশ্চর্য ন্যারেটিভ টেকনিককে ব্যবহার করে। এই ইতিহাস দর্শনের ব্যাখ্যাও মেলে আচার্য শীলরক্ষিতের জবানীতে, পালসাম্রাজ্যের যুবরাণী কাঞ্চনবর্ণার মনোবেদনা দূর করার সময় - “অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যের ভিতর একই ধর্মসমূহ বা পদার্থনিচয় বর্তমান। কিন্তু ঐ সকল পদার্থনিচয়ের পারস্পরিক অবস্থান পরিবর্তিত হওয়ার কারণে এক প্রকারের সজ্জাকে বর্তমান,এক প্রকারের সজ্জাকে অতীত এবং আরো এক প্রকারের সজ্জা বা বিন্যাসকে ভবিষ্যৎ বলা হয়ে থাকে। বস্তুত অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সকলই এখানেই আছে। সকলই অস্তি। সর্বম অস্তি”। সর্বাস্তিবাদী বৌদ্ধদর্শনের এই ইতিহাসচেতনাই এই আখ্যানে পরিব্যাপ্ত হয়ে আছে। তবে প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তির নিরিখে এই বৌদ্ধ মতের সীমাবদ্ধতাও দীপংকরের শাণিত মেধার সূত্রে হাজির করেছেন আখ্যানকার, যেখানে তিনি তার গুরু শীলরক্ষিতের ব্যাখ্যা মানতে পারেন না। অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যতে সব উপাদান একভাবে থাকলেও তা প্রাপ্ত নয় বিশেষ কালে দাঁড়ানো একজনের কাছে। শুধু অস্তির স্বান্ত্বনা প্রাপ্য অপ্রাপ্যের বাস্তব যন্ত্রণাকে ঢেকে ফেলতে পারে না। আর তাই জীবন জটিল ও দুঃখময়। এই বিষয়ে আরো অনুসন্ধানের জন্যই দীপঙ্করকে সুমাত্রা যাওয়ার প্রেরণা দিয়েছিলেন আচার্য শীলরক্ষিত। কারণ আচার্য শান্তিদেবের পর এই মহাযান মত নিয়ে আর বেশি চর্চা এদেশে হয় নি। তিব্বতেই এই চর্চা প্রবহমান। এইভাবে ইতিহাসচেতনা ও দর্শনের নানা ধারা ও সেই সংক্রান্ত আলোচনা এ আখ্যানে বারবার ভিড় করেছে। বস্তুতপক্ষে বঙ্গদেশের অন্যতম প্রধান পণ্ডিতের জীবন অবলম্বনে রচিত আখ্যানে এই ধরণের দার্শনিক প্রসঙ্গ ও বিতর্ক অত্যন্ত স্বাভাবিক। সন্মাত্রনন্দের বিশেষ কৃতিত্ত্ব এই দার্শনিক প্রস্থান ও কাহিনীর সহজগতিকে তিনি পাশাপাশি প্রবহমান রাখতে পেরেছেন।
দীপঙ্করের জীবন কাহিনীর তিনটি অধ্যায়কে অবলম্বন করে এই আখ্যানের তিনটি বিভাগকে গড়ে তুলেছেন লেখক। প্রতিটি বিভাগকে এক একটি পীঠিকার নামে নামাঙ্কিত করা হয়েছে। সুমাত্রা যাত্রার আগে পর্যন্ত আখ্যান নিয়ে প্রথম অধ্যায় যার নাম পূর্বপীঠিকা। পরবর্তী দক্ষিণপীঠিকার কাহিনী অতীশের সুমাত্রাবাস পর্বকে আশ্রয় করেছে। সুমাত্রায় এসে অতীশ শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন ধর্মরক্ষিতের কাছে। এইসময় তার সহপাঠী ছিলেন ভিক্ষু কমলরক্ষিত ও ভিক্ষু শান্তি। ধর্মকীর্তির অভিসময় অলঙ্কার নামক জটিল গ্রন্থের যথার্থ ও প্রাঞ্জল টীকা রচনা করে অতীশ তাঁর মেধার পরিচয় রাখেন। এখানেই ধর্মকীর্তি ও দীপঙ্করের আলোচনার সময় একঝাঁক পাখির ঘরে ঢুকে আটকে পড়া ও একটি পাখির পথ খুঁজে পেয়ে নিজে উড়ে যাওয়া ও অন্য এক পাখির পথ খুঁজে পেয়ে অন্যদের সেই পথ দেখানোর সূত্রে ধর্মকীর্তির মুখ দিয়ে হীনযান ও মহাযান পথের মুক্তির কথা এনেছেন লেখক। প্রথম যে পাখিটি কেবল নিজ মুক্তি বা নির্বাণের জন্য ব্যস্ত হল, তার পথকে থেরবাদী/হীনযান চিন্তার সঙ্গে ও দ্বিতীয় যে পাখিটি সকলকে নির্বাণের পথ দেখাতে চাইল, তার পথকে মহাযানের সাথে তুলনা করেন ধর্মকীর্তি। এই পশ্চিম পীঠিকাতে সুমাত্রায় শিক্ষালাভ শেষে দীপংকরের দেশে ফেরা এবং বোধগয়ার বজ্রাসন বিহারে তর্কযুদ্ধে অবতীর্ণ হবার অংশটিও সংযুক্ত। এই কালেই এক ভিন্ন দেশ তিব্বতের রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সেখানে বৌদ্ধধর্মের অবক্ষয়ে রাজার বেদনার কথা আমরা শুনি। তিব্বতে ধর্মকে বিকৃতি মুক্ত করতে অতীশকে সেখানে নিয়ে যাওয়ার মনোবাসনাও প্রকাশ করেন রাজা।
আখ্যানের তৃতীয় তথা অন্তিম বিভাগটির নাম পশ্চিম পীঠিকা। এই অংশে দীপংকরের তিব্বত যাত্রার পটভূমি, যাত্রা ও তিব্বতের কর্মকাল বর্ণিত হয়েছে। পশ্চিম পীঠিকার শুরুতে আমরা দীপংকরকে বিক্রমশীল মহাবিহারের অধ্যাপক হিসেবে দেখি, যার খ্যাতি তখন আকাশস্পর্শী। পালরাজা মহীপাল বা তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ – সকলেরই তাঁর প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা। তবে মহীপালের পুত্র যুবরাজ নয়াপালের মধ্যে যৌবনের অহংকার কিছু প্রবল এবং তিনি যেভাবে মাঝেসাঝে বিক্রমশীল মহাবিহারের ওপর কিছু নির্দেশিকা জারি করেন, তা অতীশকে বিরক্ত করে। রাজগৃহে উৎসব উপস্থিত হলে তিনি মহাবিহারের পঠনপাঠনকে বন্ধ রেখে সমগ্র ভিক্ষুমণ্ডলীকে রাজাদেশে রাজগৃহে যেতে নির্দেশ দেন। এ নিয়ে নিবেদন করেও কোনও ফল হয় নি। বিহার পরিচালনায় আরো নানাভাবে যুবরাজ নয়াপাল অনুপ্রবেশ করেন, যেন বুঝিয়ে দিতে চান – পালরাজারাই এই মহাবিহারের প্রতিষ্ঠাতা ও পৃষ্ঠপোষক। চেদির কলচুরিরাজ গাঙ্গেয়দেবের ক্ষমতারূঢ় রাজপুত্র কর্ণ এইসময় পালরাজ্য আক্রমণ করায় সঙ্কট উপস্থিত হয়। অতীশ দীর্ঘকাল ধরে চলে আসা বাংলার পাল ও চেদি কলচুরিদের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব মেটাতে ও বাইরের শত্রুর দিকে দৃষ্টি ফেরাতে সচেষ্ট হন। রাজনৈতিক সঙ্কট মোকাবিলায় অতীশের ভূমিকা ও বিক্রমশীল মহাবিহারের বিশিষ্টতা নয়াপালের মধ্যেও নতুন শ্রদ্ধার বীজ বপন করে। উনষাট বছর বয়সী প্রৌঢ় অধ্যাপক অতীশ, যাঁর খ্যাতি ও প্রতিপত্তি যখন এদেশে কিংবদন্তীতুল্য, তিনি কেন শেষপর্যন্ত তিব্বত যেতে সম্মত হলেন, সে কাহিনীও এই পীঠিকায় বর্ণিত হয়েছে। বীর্যসিংহ ও বিনয়ধর – যারা তিব্বতের রাজার পক্ষ থেকে অতীশকে যাত্রার অনুরোধ জানাতে এসেছিল, তাদের কাছ থেকে তিব্বতের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক সামাজিক সঙ্কটের কথা শোনেন অতীশ। বস্তুতপক্ষে তিব্বতের ধর্মীয় সঙ্কটের সঙ্গে রাজনৈতিক সঙ্কটের গভীর সম্পর্ক ছিল। তিব্বতের রাজারা ছিলেন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। আর প্রবল প্রতাপশালী অমাত্যকুল ছিলেন তিব্বতের পোন বা বন ধর্মের পৃষ্ঠপোশক। উভয়েই জনসাধারণকে নিজ নিজ কর্তৃত্ব ও ধর্মাচরণের মধ্যে আবদ্ধ রাখতে চাইতেন। পোন ধর্মের প্রভাবে ও সঠিক দিশার অভাবে তিব্বতের বৌদ্ধধর্মও অনেকাংশে বিকৃত হয়েছিল এবং জনগণকে পথ দেখাতে অসমর্থ হচ্ছিল। বস্তুত অতীশ ও বীর্যসিংহ বিনয়ধরের আলোচনাসূত্রে তিব্বতের বৌদ্ধধর্মের রূপরেখাটি কয়েকটি বাক্যে হাজির করেছেন সন্মাত্রনন্দ। রাজা দেউচানের আমন্ত্রণে ভারত থেকে তিব্বতে প্রথমে যান আচার্য শান্তরক্ষিত, যিনি ছিলেন অতীশের মতোই চন্দ্রবংশজাত, তার পূর্বপুরুষ। পোন ধর্ম অনুসারীদের রোষ এবং অমাত্যদের চক্রান্তে শান্তরক্ষিতকে কিছুদিন পরে নেপালে নির্বাসিত হতে হয়। এরপর ভারত থেকে নেপালে যান গুরু পদ্মসম্ভব এবং তিব্বতে তিনি রিন্পোচে নামে পরিচিত ছিলেন। তন্ত্রমন্ত্রে দক্ষ পদ্মসম্ভবের ধর্মপ্রচার পোন ধর্মীদের প্রভাবকে স্থিমিত করে এবং নেপাল থেকে ফিরে আসেন শান্তরক্ষিত। এরপর শান্তরক্ষিতের শিষ্য কমলশীল সেখানে বৌদ্ধধর্ম প্রচারের কাজে ব্যাপৃত হন। এইসময় হোসাঙ নামে এক পোন ধর্মপ্রচারক সক্রিয় হয়ে ওঠেন। কমলশীল তাকে বাকযুদ্ধে পরাজিত করেন। কিন্তু অমাত্যদের চক্রান্তে চারজন গুপ্তঘাতক কমলশীলকে হত্যা করে। ক্রমশ পদ্মসম্ভবের শিক্ষা কালের গতিতে ও নানা কুপ্রভাবে আবিল হয়ে পড়ে। ভারতাগত পণ্ডিতেরা তিব্বতে বিকৃত ধর্মচর্চায় ব্যস্ত থাকেন। নির্বিচার সুরাপান, পশুহত্যা, নারীসম্ভোগ, নরবলিতে ধর্ম অ সমাজ আবিল হয়ে পড়ে। এর থেকে মুক্তির পথ হিসেবেই তিব্বতের রাজা এশেওদ এবং তার ভ্রাতুষ্পুত্র চ্যাংচুবওদ অতীশকে তিব্বতে যাওয়ার অনুরোধ করেন। ভারতে অধ্যাপকের অনন্য সম্মান ও প্রতিষ্ঠাকে পেছনে ফেলে রেখে তিব্বতে বৌদ্ধ ধর্মের রক্ষা ও প্রসারের জন্য যেতে সম্মত হন প্রৌঢ়ত্বের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়ানো অতীশ।
উপন্যাসের শেষদিকে অতীশের তিব্বতযাত্রা ও তিব্বতে ধর্মপ্রচারের ইতিহাস-অনুগ কাহিনী বর্ণনা করেছেন সন্মাত্রনন্দ। দস্যুদলের দ্বারা আক্রান্ত হওয়া, নেপালে অধিষ্ঠান, সেখান থেকে পালরাজা নয়পালকে লেখা বিখ্যাত চিঠি, মানস সরোবর দর্শন এবং তারপর তিব্বতভূমিতে প্রবেশের আখ্যানের মধ্যেই থেকেছে বৈদিক ষড়দর্শন সম্পর্কে তার উপলব্ধির কথা, বিভিন্ন গাছগাছড়ার ভেষজগুণ সম্পর্কে আরো নিবিড় শিক্ষার কথা। তিব্বতে এসে প্রথমে পূর্ব তিব্বত এবং তারপর মধ্য তিব্বতে অজাচার, যৌনাচারে কলুষিত হয়ে পড়া তন্ত্রসাধনার নির্মোক ভেঙে দিয়ে মহাজান বৌদ্ধধর্মের শিক্ষাকে অবলম্বন করে কীভাবে এক নতুন দেশ গড়ে তুললেন দীপঙ্কর, সে কথা ঐতিহাসিক সূত্রের সঙ্গে আদ্যন্ত সঙ্গতি রেখেই এখানে বর্ণিত হয়েছে। এই বর্ণনার সূত্রে তাঁর মহাগ্রন্থ বোধিপাঠপ্রদীপের কিছু শিক্ষাকেও পাঠকের সামনে তুলে ধরেন সন্মাত্রনন্দ। আমাদের শোনান চন্দ্রগর্ভ থেকে অতীশ ও তারপর দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান হয়ে ততদিনে জোবোজে বা প্রভুতে রূপান্তরিত হওয়া এই আলোকসামান্য মানুষটির শেষ জীবনের কিংবদন্তীতুল্য মহাকীর্তির গল্প।
লেখক: সৌভিক ঘোষাল
No comments:
Post a Comment