একদিন
বাবা অঘোরনাথ চট্টোপাধ্যায় মেয়েকে অঙ্ক কষতে দিয়েছিলেন। কিন্তু মেয়েটি
বারবার চেষ্টা করেও অঙ্কটি কষতে পারছিলেন না। বিরক্ত হয়ে অঙ্কের খাতা বন্ধ
করে দিয়ে দাঁড়ালেন জানালার ধারে। বাইরে আকাশের মেঘ রোদ্দুর, দূরের গাছপালা,
সবুজ ঘাস এমন নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখে মুগ্ধ মেয়েটি একেবারে তন্ময় হয়ে গেলেন।
হুঁশ ফিরলে কিছুক্ষণ পর আবার অঙ্কের খাতাটি খুলে বসলেন। কিন্তু সেই খাতায়
অঙ্ক কষার পরিবর্তে মেয়েটি লিখে ফেলেন একটি কবিতা। সন্ধ্যায় রোজকার মতো
পিতা অঘোরবাবু বাড়ি ফিরে এসে খাতা দেখে অবাক হন। দেখেন খাতায় অঙ্কটি
কাটাকুটি। পরের পাতায় লেখা হয়েছে একটি ইংরাজি কবিতা। কৌতূহলী হয়ে নিজে
লেখাটি পড়লেন। কবিতাটিতে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বর্ণনা দিয়েই লেখা রয়েছে।
সেই মেয়েটি হলেন বিখ্যাত কবি, বাগ্মী, দক্ষ প্রশাসক ও রাজনীতিক সরোজিনী
নাইডু। তাঁর কাব্যচর্চার প্রতিভার স্ফুরণ ঘটেছিল শৈশবেই। তাঁর রচিত ইংরাজি
কবিতা শুধু দেশ নয়, বিদেশেও খ্যাতিলাভ করে। গান্ধীজি তাঁকে বলেছিলেন
‘নাইটেঙ্গেল অফ ইন্ডিয়া’। সরোজিনীর কবিতা ফরাসি ভাষাতেও অনুদিত হয়েছে।
সরোজিনীর ব্যক্তিত্বের মধ্যে শিল্পী মনের মাধুর্য ছিল। যা সকলকে স্পর্শ
করত। বিংশ শতাব্দীর শুভারম্ভে ভারতের সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অত্যন্ত
গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন তিনি। অনেকের মতে ভারতের নারী আন্দোলনের
পথিকৃত ছিলেন সরোজিনী।
গান্ধীজিকে সরোজিনী নাইডু বলেছিলেন, বাপু, আপনাকে দরিদ্র সাজিয়ে রাখতে গিয়ে সরকারি কোষাগারের প্রচুর অর্থ ব্যয় হয়ে যায়।এই বেফাঁস মন্তব্য একমাত্র কবির পক্ষেই সম্ভব নয় কি? এই দুঃসাহস কবি ছাড়া আর কে-ই-বা দেখাতে পারে?
১৮৭৯ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি হায়দ্রাবাদ শহরে জন্মগ্রহণ করেন সরোজিনী চট্টোপাধ্যায়। পিতা অঘোরনাথ চট্টোপাধ্যায় ছিলেন পাশ্চাত্য শিক্ষায় প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত সুপণ্ডিত। সরোজিনীর মায়ের নাম বরদাসুন্দরী। তিনিও ছিলেন সুগায়িকা। কবিতাও লিখতেন। ফলে বাড়ির সাংস্কৃতিক পরিবেশের মধ্যেই বেড়ে উঠেছিলেন সরোজিনী। তাঁর আদি বাড়ি ছিল বাংলাদেশের ঢাকার ব্রাহ্মণগাঁতে।
সরোজিনী মাত্র বারো বছর বয়সে প্রবেশিকা পাশ করেন। তিনি ইংরাজিতে দু’হাজার লাইনের একটি নাটিকা রচনা করে সকলকে চমকে দেন। পাশাপাশি মাত্র ছয় দিনেই তেরশো লাইনের এক কাব্য লিখে ফেলেছিলেন। তাঁর এই অভাবনীয় কীর্তি দেখে চমৎকৃত হন পিতা অঘোরনাথ। এরপর সেই ঘটনা জানতে পেরে হায়দ্রাবাদ নিজাম বাহাদুরের কাছ থেকেও প্রশংসিত হন।
এই সরোজিনী পরবর্তী সময়ে নিজাম বাহাদুরের কাছ থেকে বিদেশে শিক্ষার জন্য বার্ষিক ৩০০ পাউন্ড বৃত্তি পান। ১৮৯৮ সালে সরোজিনী অসুস্থ হয়ে পড়লে বিদেশ থেকে ফিরে আসেন হায়দ্রাবাদে। সুস্থ হলে তিন মাস পর ডাঃ মোতিয়ালা গোবিন্দ রাজুলু নাইডুকে বিয়ে করেন। ইংরেজি কবিতা রচনার জন্যে তিনি ‘প্রাচ্যের নাইটেঙ্গল’ নামে পরিচিতি পান। ১৯১৫ সালে সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে যোগ দেন। ১৯১৯ সালে ভারতীয় নারীর অধিকার সাব্যস্ত করার জন্যে ইংল্যান্ডে যান সরোজিনী। তিনিই ছিলেন দেশে প্রথম মহিলা রাজ্যপাল।
১৯১৫ সালে তিনি অল ইন্ডিয়া ন্যাশনাল কংগ্রেসে যোগ দেন। তিনি সমগ্র ভারতে সভা সমাবেশ করে নারী মুক্তি, শ্রমিক অধিকার রক্ষা ও জাতীয়তাবাদের সমর্থনে তাঁর বার্তা প্রচার করেন। তিনি ১৯১৬ সালে বিহারে নীল চাষীদের অধিকারের দাবিতে প্রচারাভিযানে অংশ নেন। ১৯১৭ সালে নারীর ভোটাধিকারের দাবিতে অ্যানি বেসান্তকে সভাপতি করে উইমেন ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন গঠিত হলে নাইডু এই সংগঠনের সদস্য হন।
১৯১৯ সালে সরোজিনী নাইডু অল ইন্ডিয়া হোম রুল ডেপুটেশনের সদস্য হিসেবে ইংল্যান্ডে গমন করেন এবং ১৯২০ সালের জুলাই মাসে ভারতে ফিরে আসেন।
১৯২০ সালের ১ আগস্ট তিনি মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনের ঘোষণা দেন। ১৯২৪ সালের জানুয়ারি মাসে পূর্ব আফ্রিকান ভারতীয় কংগ্রেসে যে দুজন কংগ্রেস দলীয় প্রতিনিধি অংশ নেন, সরোজিনী নাইডু ছিলেন তাঁর একজন। ১৯২৫ সালে তিনি কানপুরে অনুষ্ঠিত অল ইন্ডিয়া ন্যাশনাল কংগ্রেসের বার্ষিক সম্মেলনে সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯২৬ সালে অল ইন্ডিয়া উইমেন কনফারেন্স গঠিত হলে সরোজিনী এর সভাপতি নির্বাচিত হন এবং নারী শিক্ষা অধিকার আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন।
সরোজিনী নাইডু ১৯২৮ সালের অক্টোবর মাসে গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনের বার্তা নিয়ে আমেরিকা গমন করেন। আমেরিকা থেকে প্রত্যাবর্তনের পর তিনি কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। আইন অমান্য আন্দোলনে অংশ নেয়ার জন্য ১৯৩০ সালের মে মাসে মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে তিনি গ্রেফতার হন এবং ১৯৩১ সালের ৩১ জানুয়ারি মুক্তিলাভ করেন। ১৯৩১ সালে কংগ্রেসের প্রতিনিধি হিসেবে তিনি গান্ধীর সঙ্গে গোলটেবিল বৈঠকে অংশ নেন। ১৯৩২ সালে নাইডু লবণ সত্যাগ্রহ আন্দোলনে অংশগ্রহণের জন্য গ্রেফতার হন কিন্তু অসুস্থতার কারণে পরে তাঁকে ছেড়ে দেয়া হয়। ১৯৪২ সালের ২ অক্টোবর ভারত ছাড় আন্দোলনে জড়িত থাকায় তাঁকে গ্রেফতার করে ২১ মাস কারান্তরীণ রাখা হয়। ১৯৪৭ সালের মার্চ মাসে এশিয়ান রিলেশন্স কনফারেন্সে তিনি সভাপতিত্ব করেন। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর সরোজিনী নাইডু ভারতের উত্তর প্রদেশের গভর্নর নিযুক্ত হন এবং আমৃত্যু এ পদে দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৪৯ সালের ২রা মার্চ সত্তর বছর বয়সে সরোজিনী নাইডুর জীবনাবসান ঘটলেও তাঁর মুক্ত চিন্তা, সংগ্রাম ও রাজনৈতিক জীবনের বহুমুখী কর্মপন্থা অনুপ্রেরণা জোগাবে নব প্রজন্মকে।
লেখক: ব্লগার, কবি, প্রাবন্ধিক
গান্ধীজিকে সরোজিনী নাইডু বলেছিলেন, বাপু, আপনাকে দরিদ্র সাজিয়ে রাখতে গিয়ে সরকারি কোষাগারের প্রচুর অর্থ ব্যয় হয়ে যায়।এই বেফাঁস মন্তব্য একমাত্র কবির পক্ষেই সম্ভব নয় কি? এই দুঃসাহস কবি ছাড়া আর কে-ই-বা দেখাতে পারে?
১৮৭৯ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি হায়দ্রাবাদ শহরে জন্মগ্রহণ করেন সরোজিনী চট্টোপাধ্যায়। পিতা অঘোরনাথ চট্টোপাধ্যায় ছিলেন পাশ্চাত্য শিক্ষায় প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত সুপণ্ডিত। সরোজিনীর মায়ের নাম বরদাসুন্দরী। তিনিও ছিলেন সুগায়িকা। কবিতাও লিখতেন। ফলে বাড়ির সাংস্কৃতিক পরিবেশের মধ্যেই বেড়ে উঠেছিলেন সরোজিনী। তাঁর আদি বাড়ি ছিল বাংলাদেশের ঢাকার ব্রাহ্মণগাঁতে।
সরোজিনী মাত্র বারো বছর বয়সে প্রবেশিকা পাশ করেন। তিনি ইংরাজিতে দু’হাজার লাইনের একটি নাটিকা রচনা করে সকলকে চমকে দেন। পাশাপাশি মাত্র ছয় দিনেই তেরশো লাইনের এক কাব্য লিখে ফেলেছিলেন। তাঁর এই অভাবনীয় কীর্তি দেখে চমৎকৃত হন পিতা অঘোরনাথ। এরপর সেই ঘটনা জানতে পেরে হায়দ্রাবাদ নিজাম বাহাদুরের কাছ থেকেও প্রশংসিত হন।
এই সরোজিনী পরবর্তী সময়ে নিজাম বাহাদুরের কাছ থেকে বিদেশে শিক্ষার জন্য বার্ষিক ৩০০ পাউন্ড বৃত্তি পান। ১৮৯৮ সালে সরোজিনী অসুস্থ হয়ে পড়লে বিদেশ থেকে ফিরে আসেন হায়দ্রাবাদে। সুস্থ হলে তিন মাস পর ডাঃ মোতিয়ালা গোবিন্দ রাজুলু নাইডুকে বিয়ে করেন। ইংরেজি কবিতা রচনার জন্যে তিনি ‘প্রাচ্যের নাইটেঙ্গল’ নামে পরিচিতি পান। ১৯১৫ সালে সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে যোগ দেন। ১৯১৯ সালে ভারতীয় নারীর অধিকার সাব্যস্ত করার জন্যে ইংল্যান্ডে যান সরোজিনী। তিনিই ছিলেন দেশে প্রথম মহিলা রাজ্যপাল।
১৯১৫ সালে তিনি অল ইন্ডিয়া ন্যাশনাল কংগ্রেসে যোগ দেন। তিনি সমগ্র ভারতে সভা সমাবেশ করে নারী মুক্তি, শ্রমিক অধিকার রক্ষা ও জাতীয়তাবাদের সমর্থনে তাঁর বার্তা প্রচার করেন। তিনি ১৯১৬ সালে বিহারে নীল চাষীদের অধিকারের দাবিতে প্রচারাভিযানে অংশ নেন। ১৯১৭ সালে নারীর ভোটাধিকারের দাবিতে অ্যানি বেসান্তকে সভাপতি করে উইমেন ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন গঠিত হলে নাইডু এই সংগঠনের সদস্য হন।
১৯১৯ সালে সরোজিনী নাইডু অল ইন্ডিয়া হোম রুল ডেপুটেশনের সদস্য হিসেবে ইংল্যান্ডে গমন করেন এবং ১৯২০ সালের জুলাই মাসে ভারতে ফিরে আসেন।
১৯২০ সালের ১ আগস্ট তিনি মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনের ঘোষণা দেন। ১৯২৪ সালের জানুয়ারি মাসে পূর্ব আফ্রিকান ভারতীয় কংগ্রেসে যে দুজন কংগ্রেস দলীয় প্রতিনিধি অংশ নেন, সরোজিনী নাইডু ছিলেন তাঁর একজন। ১৯২৫ সালে তিনি কানপুরে অনুষ্ঠিত অল ইন্ডিয়া ন্যাশনাল কংগ্রেসের বার্ষিক সম্মেলনে সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯২৬ সালে অল ইন্ডিয়া উইমেন কনফারেন্স গঠিত হলে সরোজিনী এর সভাপতি নির্বাচিত হন এবং নারী শিক্ষা অধিকার আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন।
সরোজিনী নাইডু ১৯২৮ সালের অক্টোবর মাসে গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনের বার্তা নিয়ে আমেরিকা গমন করেন। আমেরিকা থেকে প্রত্যাবর্তনের পর তিনি কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। আইন অমান্য আন্দোলনে অংশ নেয়ার জন্য ১৯৩০ সালের মে মাসে মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে তিনি গ্রেফতার হন এবং ১৯৩১ সালের ৩১ জানুয়ারি মুক্তিলাভ করেন। ১৯৩১ সালে কংগ্রেসের প্রতিনিধি হিসেবে তিনি গান্ধীর সঙ্গে গোলটেবিল বৈঠকে অংশ নেন। ১৯৩২ সালে নাইডু লবণ সত্যাগ্রহ আন্দোলনে অংশগ্রহণের জন্য গ্রেফতার হন কিন্তু অসুস্থতার কারণে পরে তাঁকে ছেড়ে দেয়া হয়। ১৯৪২ সালের ২ অক্টোবর ভারত ছাড় আন্দোলনে জড়িত থাকায় তাঁকে গ্রেফতার করে ২১ মাস কারান্তরীণ রাখা হয়। ১৯৪৭ সালের মার্চ মাসে এশিয়ান রিলেশন্স কনফারেন্সে তিনি সভাপতিত্ব করেন। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর সরোজিনী নাইডু ভারতের উত্তর প্রদেশের গভর্নর নিযুক্ত হন এবং আমৃত্যু এ পদে দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৪৯ সালের ২রা মার্চ সত্তর বছর বয়সে সরোজিনী নাইডুর জীবনাবসান ঘটলেও তাঁর মুক্ত চিন্তা, সংগ্রাম ও রাজনৈতিক জীবনের বহুমুখী কর্মপন্থা অনুপ্রেরণা জোগাবে নব প্রজন্মকে।
লেখক: ব্লগার, কবি, প্রাবন্ধিক
No comments:
Post a Comment