আমাদের একটা পুরনো ঐতিহ্য আছে; বলতে পারেন এটা আমাদের একটা অর্জনও। “হুজুগে বাঙ্গালী”- শব্দটার সাথে আপনারা অনেকেই কম-বেশী পরিচিত। আমাদের পূর্বপুরষরাও সে ঐতিহ্যকে সযত্নে লালন করে রেখেছিলেন- তাদের কর্মের মাধ্যমে। বাংলায় আমাদের একটি অতি পরিচিত শব্দ আছে- “গুজব” যার ইংরেজীতে অর্থ অনেক- Rumor, Idle Gossip, Bruit এরকম। এসব শব্দকে বিভিন্ন দেশের ভাষাভাষিরা বিভিন্ন অর্থে ব্যবহার করলেও এর মূলকথা- “গুজব”। গুজবের ইতিহাস অনেক পুরনো- সেই অন্ধকারের সময় থেকেই গুজবের জন্ম। কিন্তু সেসব ইতিহাসে আমার অত বেশী আগ্রহ নেই। আমরা বরংচ আমাদের গুজবের সভ্যতা আর ইতিহাসকেই একটু তুলে ধরার চেষ্টা করছি।

আসুন, তাহলে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস দিয়েই শুরুটা করা যাক্। ৭১’এ এদেশে দুটো পক্ষ ছিলো; একদল বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে এবং অন্যদল স্বাধীনতার বিপক্ষে। যারা স্বাধীনতার পক্ষে ছিলো তারা মূলত এদেশের মানুষের উপর পাকিস্থানের বর্বরতা-অত্যাচার আর স্বৈরতন্ত্রকে মেনে নিতে পারেননি। আর অন্যদল চাচ্ছিলেননা যে- পাকিস্থান ভেঙ্গে যাক। কিন্তু যেহেতু তারা এ বিষয়টিকে এভাবে এদেশের সাধারন মানুষকে বোঝাতে অক্ষম ছিলেন; কারন তাতে সাধারন মানুষের মনে তাদের বিরুদ্ধে একটা বিরুপ প্রভাব সৃষ্টি হতে পারে- তাই তারা বেছে নিলেন ভিন্নপথ। কি সেই পথ? তারা বিভিন্ন মসজিদে-মাদ্রাসায়-আলোচনায় এদেশের সহজ-সরল মানুষকে বোঝাতে (গুজব) শুরু করলেন যে- “যেহেতু দেশভাগ হয়েছে হিন্দু-মুসলিম জাতিভেদের ভিত্তিতে তাই অখন্ড পাকিস্থানই হলো ইসলামের প্রকৃত ধারক ও বাহক। আর পাকিস্তানের সাথে ভাগ হয়ে এই স্বাধীনতা যুদ্ধ হচ্ছে ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। ভাইয়ের সাথে ভাইয়ের যুদ্ধ। এটা ইসলামকে খন্ডিত করে ফেলার একটা চক্রান্ত; একজন মুসলিম কখনই ভাইয়ের সাথে ভাইয়ের এ যুদ্ধ সমর্থন করে না। এটা হিন্দু রাষ্ট্র ভারতের একটা চক্রান্ত……..” এবং অদ্ভুদভাবে এদেশের একটা অংশের মানুষ সেই গুজবকে নিজের মস্তিস্কে ধারন করেই রইলেন। কিন্তু যেহেতু বিষয়টা ছিলো দেশের স্বাধীনতার-সার্বভৈমত্বের প্রশ্ন, লড়াইটা ছিলো অধিকার ছিনিয়ে আনার লড়াই; তাই দেশের একটা বিরাট অংশের মানুষ তাদের সেই গুজবকে উপেক্ষা করেও যুদ্ধে নেমে দেশকে স্বাধীন করেছিলো।
এবার স্বাধীনতাত্তর বাংলাদেশ যখন নুতন করে নিজের পায়ে দাড়াবে- সেই সময়ে একদল হত্যা করলো শেখ মুজিবকে। হত্যা করা হলো এদেশের বুদ্ধিজীবি আর প্রগতিশীল মানুষগুলোকে। সেখানেও তাদের গুজবই ভরসা। এলো সামরিক শাসন- এলো স্বৈরাচারী শাষন কিন্তু মানুষ চুপ করে আছে কেন? কারন, দেশকে পরানো হলো ধর্মের টুপি; এখানেও ভরসা গুজব। এই ৪৮ বছরে দেশের মানুষকে অন্ধের মতো হিংসাত্মক, কদর্য, বিদ্বেষমূলক মানসিকতায় অনেক গুজব বিশ্বাস করতে দেখা গেছে, যার ইতিহাস অসীম।
ভারতে রামমন্দির নির্মানের গুজবে এদেশের সংখ্যাগুরু মানুষদের একটা বিরাট অংশ পুড়িয়ে দিয়েছে নিজেদেরই প্রতিবেশী সংখ্যালঘু হিন্দুদের বাড়ি; ধর্ষন করেছে প্রতিবেশীর স্ত্রী-কন্যাকে। গুজব ছড়িয়ে রামুতে বৌদ্ধ মন্দিরে হামলা হয়েছে; নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হয়েছে সে অঞ্চলের বৌদ্ধ সংখ্যালঘুদের। গুজবে বিশ্বাসী জনতা অন্ধ বিশ্বাসে নিরক্ষর রসরাজ দাসের নামে মিথ্যা ধর্ম অবমাননার অভিযোগ এনে, দল বেঁধে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে ব্রাহ্মনবাড়িয়ার নাসিরনগরের হিন্দু সংখ্যালঘুদের। গুজবে বিশ্বাসী বাবা-মা অন্ধ বিশ্বাসে ও প্রাপ্তির মোহে নিজের সন্তানকেও হত্যা করতে এতটুকু পিছপা হননি। গুজবে বিশ্বাসী আমরা চাঁদে দেখি সাইদী হুজুরকে। পিতলের গোপাল দুধ খায়, তন্ত্র-মন্ত্র-তাবিজ-কবচে বিশ্বাস এমনসব গুজবে বিশ্বাস করে ভারতীয় উপমহাদেশের একটা বিরাট অংশের মানুষ। সেসব ইতিহাসের পান্ডুলিপি অনেক বড়; এক জীবনে এটা পড়ে শেষ করা যাবে না।

২০১৩ সালের ৫ মে’র কথা মনে আছে আপনাদের। মাদ্রাসার কোমলমতি ছাত্ররা জানতোই না নাস্তিকরা কি করেছে? কি বলেছে? কিন্তু ঢাকার শাপলা চত্ত্বরে হেফাজতের গুজবে তারা তান্ডব চালিয়ে পুরো দেশ যখন অচল করে দিয়েছে; তখন তাদের উচ্ছেদের ঘটনাকেও গুজব হিসেবে ছড়ানো হয়েছে- “মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষদের হত্যা করা হচ্ছে”। যে হেফাজত বায়তুল মোকাররমের বারান্দায় কোরআন পুড়িয়ে গুজব ছড়িয়েছে “সরকার কোরান পুড়িয়েছে”। এরকম আর কত গুজবের ঘটনা শুনবেন আপনারা? কারন, অন্ধ আর বধিরের সমাজে বদমায়েশদের গুজবই শেষ ভরসা। বদমায়েশরা জানে কি করে সাধারন আর সহজসরল মানুষের মগজে গুজব ঢুকিয়ে দেয়া যায়!
আমাদের দেশে এখন গুজবের মহামারি চলছে। গুজবে ছড়ানো হচ্ছে- ব্রিজ তৈরিতে মানুষের মাথা চাই। গুজব ছড়িয়ে মূল হত্যাকারী ফাসিয়ে দিচ্ছে অসহায় মিন্নিদের। ছেলেধরা গুজব রটিয়ে প্রকাশ্যে মানুষ পিটিয়ে মারছে অসহায় আর নিরপরাধ মানুষকে। সাধারন মানুষ আজ আর নিরাপদ নয় এই সমাজে; বাবা-মা ঘরে ফিরতে পারবে কিনা তাঁর কোন নিশ্চয়তা নেই। প্রকাশ্য দিবালোকে মানুষ পিটিয়ে মারছে মানুষকেই। আর সে একজন-দুজন নয় সবাই যেন সংঘবদ্ধ। কোন মানবিকতা নেই! কিন্তু আচ্ছা আপনি কি কখনো ভেবে দেখেছেন একটা জাতি এভাবে “গুজবে জাতিতে” কিভাবে পরিনত হলো? সমাজবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে কখনো প্রশ্ন তুলেছেন- আমাদের কেন অন্ধকার থেকে আর ফেরা হলো না? 

কারন, আপনারা বিজ্ঞানহীন শিক্ষা তুলেফেলে সেখানে এনেছেন ধর্মীয় মাদ্রাসা শিক্ষা। যখন দেশের প্রতিটি অঞ্চলে প্রয়োজন ছিলো উন্মুক্ত পাঠাগার, বিজ্ঞানাগার তখন আপনার করেছেন মাদ্রাসা। যে বয়সে একজন মানুষের মধ্যে সৃষ্টি করা প্রয়োজন মানবিক মূল্যবোধ, তখন আপনার তাদের করেছেন ধর্মীয় মতান্ধ। যখন প্রয়োজন ছিলো বিজ্ঞান বিতর্কের তখন আপনারা খোলা মাঠে, রাস্তায় হাজারো মাইক দিয়ে করেছেন মাহফিল। যখন প্রয়োজন ছিলো কো-এডুকেশনের ব্যবস্থাকরা তখন আপনাদের মগজে জেঁকে বসেছে “নারী মানে তেতুল”। অভিজিৎ রায়ের মত মানুষকে হত্যা করার জন্য মৌলবাদীরা তখন প্রকাশ্যে হুংকার দিয়েছে “নাস্তিকদের কতল করা ওয়জিব হয়ে গেছে”। মানুষের মধ্যে জাতীভেদ, সাম্প্রদায়ীকতা, অস্থিরতা, অসহিষ্ণুতা, ক্রোধ, হিংসা ও বিদ্বেষের এ বৈষম্যমূলক সমাজ একদিনে সৃষ্টি হয়নি। আপনাদের প্রচ্ছন্ন মদদে আর ধর্মভিত্তিক ভূখন্ড গড়ার সুপ্ত বাসনাই আজকের এ অস্থির সমাজের জন্ম দিয়েছে। আপনারা চেয়েছিলেন শুধু একটা ধর্মীয় রাষ্ট্র; সেটাতো করেছে! কিন্তু সেই রাষ্ট্রের মানুষগুলোকে মানবিকতা আর মূল্যবোধ শেখানোর প্রয়োজন কখনোই অনুভব করেননি তাই সভ্য আর বিজ্ঞানমনস্ক নাগরিকও সৃষ্টি হয়নি। হেফাজতের নির্দেশে আপনারা পাঠ্যপুস্তক থেকে বিজ্ঞান, বিবর্তনবাদ আর সংস্কৃতিকে তুলে দিয়ে আপনার কি আশা করেন; এদেশে আইনস্টাইন আর ব্রুনো জন্মাবে?

দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে আজ আর কান্না করে কোনই লাভ নেই; বরংচ সত্যিই যদি এর থেকে বেড়িয়ে আসতে চান তবে সন্তানকে ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে না পাঠিয়ে বিজ্ঞান আর বিবর্তনের শিক্ষা দিন। তাকে মানবিক করে গড়ে তুলতে আপনাকেও অনেক অবদান রাখতে হবে। আপনাকে দেখে এতদিন যা-যা শিখেছে আপনার সন্তান; আজ থেকে-এখন থেকেই অসাম্প্রদায়িকতা, বিজ্ঞানমনস্কতা, মানবিকতা এসব আপনার কাছ থেকেই শিখুক আগামী প্রজন্ম।

ব্রুনোর কথা মনে আছে তো আপনাদের?

১৬০০ সালের ২০ জানুয়ারি পোপ ৮ম ক্লেমেন্ট ব্রুনোকে একজন ধর্মদ্রোহী বলে রায় দিয়ে তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেন। ১৭ ফেব্রুয়ারি তাঁকে রোমের কেন্দ্রীয় বাজার Campo de’ Fioriএ নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাঁকে সবার সামনে খুঁটির সাথে বেঁধে পুড়িয়ে মারা হয়। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল- “এই মহাবিশ্বের মতো আরো মহাবিশ্ব আছে, পৃথিবী গোল, সূর্য এই মহাবিশ্বের কেন্দ্র নয় এবং এটি একটি নক্ষত্র ছাড়া আর কিছু নয়”- এই ধারণা পোষণ করা। এভাবেই ‍গুজবে বিশ্বাস করে হত্যা করা হয়েছে কত মহামানবদের, তার হিসেব নেই। যে দেশ আর সমাজ একদিন ব্রনোকে হত্যা করেছিল তারাই জ্ঞানের আলোতে এসে স্বীকার করেছিলো ব্রুনোই ঠিক; সেদিন তারা ভুল ছিলো! 

ব্রুনোকে যারা হত্যা করেছিল তারা তো একদিন সভ্য হয়ে স্বীকার করেছে ব্রুনোকে হত্যা ছিলো তাদের ভুল! আপনারা কবে স্বীকার করছেন, “গুজব” ছড়িয়ে এভাবে সাধারন মানুষ, হুমায়ুন আজাদ, অভিজিৎ, অনন্ত, দীপনদের… হত্যা ছিলো আপনাদের ভুল?

লিখেছেন: কাজল ‍কুমার দাস, ব্লগার ও প্রাবন্ধিক
(প্রথম প্রকাশ ২৪ জুলাই ২০১৯- মুক্তমনা ব্লগ)