আজ ঠিক এই মুহুর্তে যাকে খুব বেশী প্রয়োজন ছিলো তিনি ড. অভিজিৎ রায়। বহু আগেই যিনি তাঁর “বিশ্বাসের ভাইরাস” বইয়ে লিখে গেছেন মানুষ ধর্মে কেন অন্ধ হয়; অন্ধ হলেই বা কি হয়.... এসবের বৈজ্ঞানীক ব্যাখ্যা।মানুষটা আজ নেই মৌলবাদীরা তাকে হত্যা করেছে- কিন্তু তাঁর দর্শনতো রয়ে গেছে, যা আজ সত্য হলো।
যে নুসরাতকে মাদ্রাসায় বসে মাদ্রাসারই অধ্যক্ষ ধর্ষন করে তাঁকে হত্যা করা হলো সেই নুসরাতের মা শিরিনা আক্তার বলছেন, “আমার মেয়ে আখেরাতের পরীক্ষায় পাস করবে।” কি খুব বেশী আশ্চর্য্য লাগছে? এটাই ধ্রুব সত্য যে এদেশের বাবা-মা-অভিভাবকেরা এই বিশ্বাসেই তাদের সন্তানকে মাদ্রাসায় দেন যে, তাদের সন্তান আখেরাতের জন্য কাজ করছে। আর সেই আখেরাত শুধু সন্তানদের জন্যই নয়- তাদের পথকেও করবে নিশ্চিত। তাতে যদি তাদের সেই সন্তানরা (ছেলে হোক বা মেয়ে) মাদ্রাসায় বসে যৌন নির্যাতনের শিকার বা শারিরিক অত্যাচারেরও শিকার হয় বা তাদের হত্যাও করা হয় তাতে তাদের কিচ্ছু আসে যায় না। কারন, মূলকথা আখেরাত!
আপনারা যারা ধর্ষনের শাস্তি হিসেবে ধর্ষকের মৃত্যুদন্ড, প্রকাশ্যে ফাঁসি, যৌনাঙ্গ থেতলে দেয়া..... এরকম অনেক প্রস্তাব করছেন তারা একবার ভাবুনতো, একজন সভ্য আর মানবিক বোধসম্পন্ন মানুষ হিসেবে আপনি কি মৃত্যুদন্ডের মত অমানবিক প্রথার পক্ষেই আছেন নাকি ধর্ষনের মত অপরাধের বিলুপ্তি চান? যদি সত্যিই চান সমাজ থেকে ধর্ষন লুপ্ত হোক- ধর্ষকের জন্মই না হোক! তবে ভাবুন, ধর্ষকের জন্ম হচ্ছে কোথায়? ধর্ষণ সংক্রান্ত বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞান তত্ত্বগুলোকে ঘেঁটে সেই আতুরঘরগুলো খুঁজে বের করুন; আর মহামারীর আকার নেয়া সেই ধর্ষকের আতুরঘরে সর্বশক্তি দিয়ে আঘাত করুন।
আমাদের শিক্ষায়-ধর্মে-সংস্কৃতিতে যৌনতার প্রতি যে দৃষ্টীভঙ্গী শেখানো হয় ছোটবেলা থেকেই, নারীর প্রতি এক ধরনের বিকৃত দৃষ্টীভঙ্গী গড়ে উঠে ওখান থেকেই। এ দেশের মসজিদে-মাদ্রাসায় মাহফিলের মোল্লাদের নারীদ্বেষী বিকৃত বক্তব্য নুতন কিছু নয়। আপনি হয়ত ভাবছেন এসব নোংড়া বক্তব্য শুধু ওইসব ময়দানেই সীমাবদ্ধ! তবে আপনি নিশ্চিৎ থাকুন আপনার ভাবনার আর জানার দৈন্যতা এটাই। এবার আপনি যদি আপনার পাশের মতান্ধ প্রগতিশীল বন্ধুটির ভাবনার জগতে একটু উঁকি দিন বা তার আচরণ লক্ষ্য করুন। তবে আপনিই বুঝবেন ওসব মোল্লা আর আপনার এই প্রগতিশীলদের মধ্যে পার্থক্য কতটুকু। এবার কিন্তু নিজের দায়িত্বেই বুঝে নিতে হবে বাকী “আম জনতার মনস্তাত্বিক অবস্থা”। এ দেশের একটা বিরাট অংশের মানুষ এখনো মনে করেন নারী ধর্ষনের জন্য পোষাক দায়ী, যারা মত দেন ধর্ষন বন্ধে পতিতালয় চাই তাদের সাথে এসব অসভ্য বর্বরদের সাথে পার্থক্য শুধুই পোষাকে; চিন্তায় আর দর্শনগত অবস্থানে এরা সমান। এরা নিজেদের বর্বর মানসিকতাকে সভ্য করতে মোটেও রাজী নন। তাইতো, এ দেশের মাহফিলগুলোতে যখন লক্ষ-লক্ষ মাইকে দেশব্যাপী চিৎকার করে বলা হয়-
“তেঁতুল দেখলে মানুষের যেমন জিভে জল আসে তেমনি নারীদের দেখলে ‘দিলের মইধ্যে লালা বাইর হয়”
“শোনো নারীরা, চার দেয়ালের ভেতরই তোমাদের থাকতে হবে। স্বামীর বাড়িতে বসে তোমরা আসবাবপত্র দেখভাল করবা, শিশু লালন-পালন, পুরুষ শিশুদের যত্ন করবা। এই হলো তোমাদের কাজ। তোমাদের কেন বাইরে যেতে হবে?”
“দিনেরাত্রে মহিলাদের সাথে পড়ালেখা করতেছেন, আপনার দিল ঠিক রাখতে পারবেন না। রাস্তাঘাটে হাঁটাহুটা করতেছেন, হ্যান্ডশেক কইরা কইরা, আপনার দিল ঠিক রাখতে পারবেন না। যতোই বুজুর্গ হোক না কেন, এই মহিলাকে দেখলে, মহিলার সাথে হ্যান্ডশেক করলে আপনার দিলের মধ্যে কুখেয়াল আইসা যাবে, খারাপ খেয়াল। এইটা মনের জেনা, দিলের জেনা হইতে হইতে আসল জেনায় পরিণত হবে। এটা সত্য না মিথ্যা?”
“গার্মেন্টসে কেন দিছেন আপনার মেয়েকে? ফজরে ৭/৮ টা বাজে চলে যায়, রাত ৮টা, ১০টা, ১২টায়ও আসে না। কোন পুরুষের সাথে ঘোরাফেরা করতেসে তুমি তো জানো না। কতোজনের মধ্যে মত্তলা হচ্ছে আপনার মেয়ে, আপনে তো জানেন না। জেনা কইরা কইরা টাকা রোজগার করতেছে, কী বরকত হবে?”
তখন আপনাকে বুঝে নিতে হবে এসব কথাই এদেশের শিক্ষাহীন, অজ্ঞ, মতান্ধ মানুষের মনের কথা। এই বদমায়েশগুলো ভালো করেই জানে যে, ৬ বছরের মেয়ে, বোরখাবৃতা মেয়ে কিংবা ৬০ বছরের বৃদ্ধা স্বাভাবিকভাবে যৌনানুভুতি সৃষ্টি করে না; তবে তাদের দৃষ্টিতে নারী যখন পন্য-খাদ্যদ্রব্য-শষ্যক্ষেত্র তখন কিন্তু তাদের ধর্ষকীয় ব্রেইনে নারী বিষয়টি মারাত্মক উদ্দীপক হিসেবে কাজ করে। কীভাবে এই কন্ডিশানিং হচ্ছে? যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ হেলথের ডিরেক্টর ডঃ আলিয়াস বলেছেন, মানুষের পার্সোনালাটি লার্নিং হয় তিনটা প্রধান ফ্যাক্টর দ্বারা শিক্ষা, সঙ্গ এবং পরিবেশ। এখন ধর্ম আর তাঁর শিক্ষার কারনে এই শিক্ষা, সঙ্গ এবং পরিবেশ তিনটেই হচ্ছে বিপরীতমুখী। কারন, ধর্ষণের জন্য আমাদের সমাজ নামের এই ব্যবস্থাই মূলত দায়ী; যাকে রক্ষণশীল আখ্যা দিয়ে শিশু-কিশোর বয়স থেকেই মেয়েকে ছেলের সাথে মিশতে দেয়া হয় না এবং ছেলেকেও মেয়ের থেকে দূরে রাখা হয়।এভাবে মেয়ের শরীরকে গোপন এবং নিষিদ্ধ করে রাখার যে অবৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া সেটা যে কতটা মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে তা আমাদের সমাজ আজও বুঝে উঠতে পারেনি এবং আদৌ তা পারবে কিনা সেটা নিয়ে আমি সন্দিহান।
প্রথম বিশ্বের মানুষ যখন চাঁদে যাচ্ছে, মঙ্গল গ্রহে নুতন আবাসনের সন্ধান খুঁজছে তখন আমাদের খুঁজতে হচ্ছে ধর্ষন কেন হয়? আর এর থেকেও আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, ধর্ষনের বৈজ্ঞানিক কারন না খুঁজে আমরা মৃত্যুদন্ড’র মত অমানবিক কাজকে ধর্ষন বন্ধের হাতিয়ার হিসেবে বেঁছে নিয়েছি; এটাই হয়ত আমাদের আরব্য শিক্ষার ফল! জন্মথেকে ধর্মের অন্ধকারে বেড়েওঠা আমাদের প্রেম, যৌনতা আর নারীদেহ নিয়ে আমাদের ট্যাবু ভাঙার এটাই সবথেকে ভালো সময়।
শুরু হোক এখনই; এখান থেকেই।
লেখক: কাজল
কুমার দাস
(প্রথম প্রকাশ ইষ্টিশন)
(প্রথম প্রকাশ ইষ্টিশন)
No comments:
Post a Comment