Thursday, July 25, 2019

গুজব আর অন্ধবিশ্বাসে বেড়ে ওঠা এক জাতি

আমাদের একটা পুরনো ঐতিহ্য আছে; বলতে পারেন এটা আমাদের একটা অর্জনও। “হুজুগে বাঙ্গালী”- শব্দটার সাথে আপনারা অনেকেই কম-বেশী পরিচিত। আমাদের পূর্বপুরষরাও সে ঐতিহ্যকে সযত্নে লালন করে রেখেছিলেন- তাদের কর্মের মাধ্যমে। বাংলায় আমাদের একটি অতি পরিচিত শব্দ আছে- “গুজব” যার ইংরেজীতে অর্থ অনেক- Rumor, Idle Gossip, Bruit এরকম। এসব শব্দকে বিভিন্ন দেশের ভাষাভাষিরা বিভিন্ন অর্থে ব্যবহার করলেও এর মূলকথা- “গুজব”। গুজবের ইতিহাস অনেক পুরনো- সেই অন্ধকারের সময় থেকেই গুজবের জন্ম। কিন্তু সেসব ইতিহাসে আমার অত বেশী আগ্রহ নেই। আমরা বরংচ আমাদের গুজবের সভ্যতা আর ইতিহাসকেই একটু তুলে ধরার চেষ্টা করছি।

আসুন, তাহলে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস দিয়েই শুরুটা করা যাক্। ৭১’এ এদেশে দুটো পক্ষ ছিলো; একদল বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে এবং অন্যদল স্বাধীনতার বিপক্ষে। যারা স্বাধীনতার পক্ষে ছিলো তারা মূলত এদেশের মানুষের উপর পাকিস্থানের বর্বরতা-অত্যাচার আর স্বৈরতন্ত্রকে মেনে নিতে পারেননি। আর অন্যদল চাচ্ছিলেননা যে- পাকিস্থান ভেঙ্গে যাক। কিন্তু যেহেতু তারা এ বিষয়টিকে এভাবে এদেশের সাধারন মানুষকে বোঝাতে অক্ষম ছিলেন; কারন তাতে সাধারন মানুষের মনে তাদের বিরুদ্ধে একটা বিরুপ প্রভাব সৃষ্টি হতে পারে- তাই তারা বেছে নিলেন ভিন্নপথ। কি সেই পথ? তারা বিভিন্ন মসজিদে-মাদ্রাসায়-আলোচনায় এদেশের সহজ-সরল মানুষকে বোঝাতে (গুজব) শুরু করলেন যে- “যেহেতু দেশভাগ হয়েছে হিন্দু-মুসলিম জাতিভেদের ভিত্তিতে তাই অখন্ড পাকিস্থানই হলো ইসলামের প্রকৃত ধারক ও বাহক। আর পাকিস্তানের সাথে ভাগ হয়ে এই স্বাধীনতা যুদ্ধ হচ্ছে ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। ভাইয়ের সাথে ভাইয়ের যুদ্ধ। এটা ইসলামকে খন্ডিত করে ফেলার একটা চক্রান্ত; একজন মুসলিম কখনই ভাইয়ের সাথে ভাইয়ের এ যুদ্ধ সমর্থন করে না। এটা হিন্দু রাষ্ট্র ভারতের একটা চক্রান্ত……..” এবং অদ্ভুদভাবে এদেশের একটা অংশের মানুষ সেই গুজবকে নিজের মস্তিস্কে ধারন করেই রইলেন। কিন্তু যেহেতু বিষয়টা ছিলো দেশের স্বাধীনতার-সার্বভৈমত্বের প্রশ্ন, লড়াইটা ছিলো অধিকার ছিনিয়ে আনার লড়াই; তাই দেশের একটা বিরাট অংশের মানুষ তাদের সেই গুজবকে উপেক্ষা করেও যুদ্ধে নেমে দেশকে স্বাধীন করেছিলো।
এবার স্বাধীনতাত্তর বাংলাদেশ যখন নুতন করে নিজের পায়ে দাড়াবে- সেই সময়ে একদল হত্যা করলো শেখ মুজিবকে। হত্যা করা হলো এদেশের বুদ্ধিজীবি আর প্রগতিশীল মানুষগুলোকে। সেখানেও তাদের গুজবই ভরসা। এলো সামরিক শাসন- এলো স্বৈরাচারী শাষন কিন্তু মানুষ চুপ করে আছে কেন? কারন, দেশকে পরানো হলো ধর্মের টুপি; এখানেও ভরসা গুজব। এই ৪৮ বছরে দেশের মানুষকে অন্ধের মতো হিংসাত্মক, কদর্য, বিদ্বেষমূলক মানসিকতায় অনেক গুজব বিশ্বাস করতে দেখা গেছে, যার ইতিহাস অসীম।
ভারতে রামমন্দির নির্মানের গুজবে এদেশের সংখ্যাগুরু মানুষদের একটা বিরাট অংশ পুড়িয়ে দিয়েছে নিজেদেরই প্রতিবেশী সংখ্যালঘু হিন্দুদের বাড়ি; ধর্ষন করেছে প্রতিবেশীর স্ত্রী-কন্যাকে। গুজব ছড়িয়ে রামুতে বৌদ্ধ মন্দিরে হামলা হয়েছে; নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হয়েছে সে অঞ্চলের বৌদ্ধ সংখ্যালঘুদের। গুজবে বিশ্বাসী জনতা অন্ধ বিশ্বাসে নিরক্ষর রসরাজ দাসের নামে মিথ্যা ধর্ম অবমাননার অভিযোগ এনে, দল বেঁধে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে ব্রাহ্মনবাড়িয়ার নাসিরনগরের হিন্দু সংখ্যালঘুদের। গুজবে বিশ্বাসী বাবা-মা অন্ধ বিশ্বাসে ও প্রাপ্তির মোহে নিজের সন্তানকেও হত্যা করতে এতটুকু পিছপা হননি। গুজবে বিশ্বাসী আমরা চাঁদে দেখি সাইদী হুজুরকে। পিতলের গোপাল দুধ খায়, তন্ত্র-মন্ত্র-তাবিজ-কবচে বিশ্বাস এমনসব গুজবে বিশ্বাস করে ভারতীয় উপমহাদেশের একটা বিরাট অংশের মানুষ। সেসব ইতিহাসের পান্ডুলিপি অনেক বড়; এক জীবনে এটা পড়ে শেষ করা যাবে না।

২০১৩ সালের ৫ মে’র কথা মনে আছে আপনাদের। মাদ্রাসার কোমলমতি ছাত্ররা জানতোই না নাস্তিকরা কি করেছে? কি বলেছে? কিন্তু ঢাকার শাপলা চত্ত্বরে হেফাজতের গুজবে তারা তান্ডব চালিয়ে পুরো দেশ যখন অচল করে দিয়েছে; তখন তাদের উচ্ছেদের ঘটনাকেও গুজব হিসেবে ছড়ানো হয়েছে- “মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষদের হত্যা করা হচ্ছে”। যে হেফাজত বায়তুল মোকাররমের বারান্দায় কোরআন পুড়িয়ে গুজব ছড়িয়েছে “সরকার কোরান পুড়িয়েছে”। এরকম আর কত গুজবের ঘটনা শুনবেন আপনারা? কারন, অন্ধ আর বধিরের সমাজে বদমায়েশদের গুজবই শেষ ভরসা। বদমায়েশরা জানে কি করে সাধারন আর সহজসরল মানুষের মগজে গুজব ঢুকিয়ে দেয়া যায়!
আমাদের দেশে এখন গুজবের মহামারি চলছে। গুজবে ছড়ানো হচ্ছে- ব্রিজ তৈরিতে মানুষের মাথা চাই। গুজব ছড়িয়ে মূল হত্যাকারী ফাসিয়ে দিচ্ছে অসহায় মিন্নিদের। ছেলেধরা গুজব রটিয়ে প্রকাশ্যে মানুষ পিটিয়ে মারছে অসহায় আর নিরপরাধ মানুষকে। সাধারন মানুষ আজ আর নিরাপদ নয় এই সমাজে; বাবা-মা ঘরে ফিরতে পারবে কিনা তাঁর কোন নিশ্চয়তা নেই। প্রকাশ্য দিবালোকে মানুষ পিটিয়ে মারছে মানুষকেই। আর সে একজন-দুজন নয় সবাই যেন সংঘবদ্ধ। কোন মানবিকতা নেই! কিন্তু আচ্ছা আপনি কি কখনো ভেবে দেখেছেন একটা জাতি এভাবে “গুজবে জাতিতে” কিভাবে পরিনত হলো? সমাজবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে কখনো প্রশ্ন তুলেছেন- আমাদের কেন অন্ধকার থেকে আর ফেরা হলো না? 

কারন, আপনারা বিজ্ঞানহীন শিক্ষা তুলেফেলে সেখানে এনেছেন ধর্মীয় মাদ্রাসা শিক্ষা। যখন দেশের প্রতিটি অঞ্চলে প্রয়োজন ছিলো উন্মুক্ত পাঠাগার, বিজ্ঞানাগার তখন আপনার করেছেন মাদ্রাসা। যে বয়সে একজন মানুষের মধ্যে সৃষ্টি করা প্রয়োজন মানবিক মূল্যবোধ, তখন আপনার তাদের করেছেন ধর্মীয় মতান্ধ। যখন প্রয়োজন ছিলো বিজ্ঞান বিতর্কের তখন আপনারা খোলা মাঠে, রাস্তায় হাজারো মাইক দিয়ে করেছেন মাহফিল। যখন প্রয়োজন ছিলো কো-এডুকেশনের ব্যবস্থাকরা তখন আপনাদের মগজে জেঁকে বসেছে “নারী মানে তেতুল”। অভিজিৎ রায়ের মত মানুষকে হত্যা করার জন্য মৌলবাদীরা তখন প্রকাশ্যে হুংকার দিয়েছে “নাস্তিকদের কতল করা ওয়জিব হয়ে গেছে”। মানুষের মধ্যে জাতীভেদ, সাম্প্রদায়ীকতা, অস্থিরতা, অসহিষ্ণুতা, ক্রোধ, হিংসা ও বিদ্বেষের এ বৈষম্যমূলক সমাজ একদিনে সৃষ্টি হয়নি। আপনাদের প্রচ্ছন্ন মদদে আর ধর্মভিত্তিক ভূখন্ড গড়ার সুপ্ত বাসনাই আজকের এ অস্থির সমাজের জন্ম দিয়েছে। আপনারা চেয়েছিলেন শুধু একটা ধর্মীয় রাষ্ট্র; সেটাতো করেছে! কিন্তু সেই রাষ্ট্রের মানুষগুলোকে মানবিকতা আর মূল্যবোধ শেখানোর প্রয়োজন কখনোই অনুভব করেননি তাই সভ্য আর বিজ্ঞানমনস্ক নাগরিকও সৃষ্টি হয়নি। হেফাজতের নির্দেশে আপনারা পাঠ্যপুস্তক থেকে বিজ্ঞান, বিবর্তনবাদ আর সংস্কৃতিকে তুলে দিয়ে আপনার কি আশা করেন; এদেশে আইনস্টাইন আর ব্রুনো জন্মাবে?

দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে আজ আর কান্না করে কোনই লাভ নেই; বরংচ সত্যিই যদি এর থেকে বেড়িয়ে আসতে চান তবে সন্তানকে ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে না পাঠিয়ে বিজ্ঞান আর বিবর্তনের শিক্ষা দিন। তাকে মানবিক করে গড়ে তুলতে আপনাকেও অনেক অবদান রাখতে হবে। আপনাকে দেখে এতদিন যা-যা শিখেছে আপনার সন্তান; আজ থেকে-এখন থেকেই অসাম্প্রদায়িকতা, বিজ্ঞানমনস্কতা, মানবিকতা এসব আপনার কাছ থেকেই শিখুক আগামী প্রজন্ম।

ব্রুনোর কথা মনে আছে তো আপনাদের?

১৬০০ সালের ২০ জানুয়ারি পোপ ৮ম ক্লেমেন্ট ব্রুনোকে একজন ধর্মদ্রোহী বলে রায় দিয়ে তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেন। ১৭ ফেব্রুয়ারি তাঁকে রোমের কেন্দ্রীয় বাজার Campo de’ Fioriএ নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাঁকে সবার সামনে খুঁটির সাথে বেঁধে পুড়িয়ে মারা হয়। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল- “এই মহাবিশ্বের মতো আরো মহাবিশ্ব আছে, পৃথিবী গোল, সূর্য এই মহাবিশ্বের কেন্দ্র নয় এবং এটি একটি নক্ষত্র ছাড়া আর কিছু নয়”- এই ধারণা পোষণ করা। এভাবেই ‍গুজবে বিশ্বাস করে হত্যা করা হয়েছে কত মহামানবদের, তার হিসেব নেই। যে দেশ আর সমাজ একদিন ব্রনোকে হত্যা করেছিল তারাই জ্ঞানের আলোতে এসে স্বীকার করেছিলো ব্রুনোই ঠিক; সেদিন তারা ভুল ছিলো! 

ব্রুনোকে যারা হত্যা করেছিল তারা তো একদিন সভ্য হয়ে স্বীকার করেছে ব্রুনোকে হত্যা ছিলো তাদের ভুল! আপনারা কবে স্বীকার করছেন, “গুজব” ছড়িয়ে এভাবে সাধারন মানুষ, হুমায়ুন আজাদ, অভিজিৎ, অনন্ত, দীপনদের… হত্যা ছিলো আপনাদের ভুল?

লিখেছেন: কাজল ‍কুমার দাস, ব্লগার ও প্রাবন্ধিক
(প্রথম প্রকাশ ২৪ জুলাই ২০১৯- মুক্তমনা ব্লগ)


নারী-শিশু নির্যাতন; ধর্মান্ধতা আর বিচারহীনতার সংস্কৃতি

সমাজ নামক এই কূপমুন্ডক সামাজিক সংস্কারে বাস করা নির্যাতিত মানুষ সামাজিক মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হবে ভেবে ধর্ষণের শিকার হলেও মুখ খোলেন না। বেশির ভাগ মানুষেরই এই দশা। এছাড়া ধর্ষণের বিচার প্রক্রিয়ার দুর্নীতি, দীর্ঘসূত্রিতা ও পুরুষতান্ত্রিক হয়রানির কারণে ধর্ষণের শিকার অনেক নারীই শেষব্দি আর কোন অভিযোগ করতে ভরসা পান না।
পূর্নিমা শীলকে চেনেন তো আপনারা? ভোলার পূর্নিমা শীল! এদেশের সংখ্যাগুরুদের বিকৃত মানসিকতার শিকার হয়েছিলো এই মেয়েটি। দলবেঁধে পালাক্রমে যাকে ধর্ষন করা হয়েছিলো। যার মা সেদিন অনুনয় করে ধর্ষকদের বলেছিলো “বাবারা তোমরা একজন একজন করে করে যাও, ও ছোটতো পারবে না…”। শুধু পুর্নিমাই নয় সেবার এরকম হাজারো পূর্নিমা ধর্ষিত হয়ে দেশত্যাগ করেছিলো।

তনুকে মনে তনুকে মনে আছে আপনাদের? কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী ও নাট্যকর্মী সোহাগী জাহান তনু। ২০১৬ সালের ২০ মার্চ রাতে কুমিল্লার ময়নামতি সেনানিবাস এলাকার পাওয়ার হাউসের অদূরে ঝোপ থেকে এই কলেজছাত্রীর লাশ উদ্ধার করা হয়। সেনানিবাস চেনেন তো আপনি, কখনো গেছেন? যেখানে ব্যানেট আর বুটজুতার দাপট চলে! ওইসব জায়গাতে! পুরো এলাকাটায়ই কেমন একটা গা ছমছমে অবস্থা। একটি পর্দাশীল মেয়েকে সেখানে হত্যা করা হলো কি করে? তনু কিন্তু উশৃঙ্খল ছিলো না বরংচ হিজাব পরা, নাটক-থিয়েটার করা ভদ্র মেয়ে। আজ প্রায় তিন বছর কেটে গেল তবুও হত্যা মামলার তদন্ত শেষ হয়নি। এমনকি এ মামলার আসামিও শনাক্ত হয়নি। আর হবেইবা কি করে, কার সে সাধ্যি আছে?

একইভাবে ফেনীর মাদ্রাসা ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকেও শেষ পর্যন্ত বাঁচানো যায়নি৷ ২০১৯ এর ৬ এপ্রিল সকালে আলিম পরীক্ষা দিতে সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসায় যান নুসরাত। নুসরাত এর ভাষ্য মতে সেখানে হাত মোজা, পা মোজাসহ বোরকা পরিহিত ৪-৫ জন তাকে অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির মামলা ও অভিযোগ তুলে নিতে চাপ দেয়। সে অস্বীকৃতি জানালে গায়ে কেরোসিন জাতীয় পদার্থ ঢেলে আগুন দিয়ে পালিয়ে যায় তারই সহপাঠি আর মাদ্রাসার লোকজন। ১০ এপ্রিল ২০১৯ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন নুসরাতের মৃত্যু ঘটে। ফেনীর নুসরাতের পর রাজধানীর মুগদার হাসি। একজন মাদ্রাসাছাত্রী, অপরজন গৃহবধূ। দুজনই কেরোসিনের আগুনের নির্মম বলি। মাত্র ১২ দিনের ব্যবধানে ঘটে আলোচিত এই দুই ঘটনা। 

ছোট্ট শিশু। বয়স কত? সাত বছর। গত ৭ জুলাই ২০১৯ ঢাকার ওয়ারীতে শিশুটিকে ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা ঘটে। ছাদ দেখানোর কথা বলে সে শিশুটিকে লিফট থেকে সবচেয়ে ওপর তলায় অবিক্রীত একটি শূন্য ফ্লাটের ভেতর নিয়ে যায়। সেখানে শিশুটিকে প্রথমে ধর্ষণ করার চেষ্টা করে। তাতে ব্যর্থ হয়ে শিশুটির মাথায় আঘাত করে অচেতন করে। এরপরে সে শিশুটিকে ধর্ষণ করে। কিন্তু তার পরিচয় প্রকাশ পেয়ে যেতে পারে, এই ভয়ে শিশুটিকে হত্যা করে গলায় রশি বেধে ঝুলিয়ে রেখে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়।

১৮ জুলাই ২০১৯ নওগাঁর মান্দায় কলা ও কাঁঠাল বিচি খাওয়ানোর লোভ দেখিয়ে ৩ বছরের এক শিশুকে ধর্ষণ করে তিন সন্তানের জনক আছির উদ্দিন। গুরুতর অবস্থায় ওই শিশুকে উদ্ধার করে নওগাঁ সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

ব্লেড দিয়ে যৌনাঙ্গের প্রবেশ পথ কেটে বড় করে রাতভর ধর্ষন করে দিনাজপুরের ৫ বছরের শিশু পূজাকে। সারারাত ধরে ২টা জানোয়ার টানা ধর্ষন করে সকালে বাড়ির কাছে ফেলে রেখে গিয়েছিলো তাকে। বিচার হয়নিতো তাঁর, ওসব এখন ইতিহাস! আপনাদের চরিত্র আর সভ্যতার ইতিহাস।

ধর্ষণের বিচার চাইতে গিয়েও ধর্ষণের শিকার হতে হয়েছে এমন খবরও পত্রিকার পাতায় স্থান পেয়েছে। ধর্ষণের এমন লাগামহীন চিত্র এদেশের আইন ও বিচার ব্যবস্থাসহ পুরো সিস্টেমের ভিত নাড়িয়ে দিয়েছে। প্রহসনের এসব বিচার সম্পন্ন করে ধর্ষণের কলঙ্ক থেকে বাংলাদেশ রেহাই পাবে কিনা! সে ভাবনাটা অনেকটাই অপরিষ্কার। অসুস্থ সংস্কৃতির ঘুণে ধরা এই সমাজের মগজ পরিষ্কার না করলে ধর্ষণ নির্মূল কোনো ভাবেই সম্ভব না, আশা করি সেটা নিয়ে আজ আর কারো দ্বিমত নেই।

কত ঘটনার বিবরন শুনবেন আর! প্রতিদিন এদেশে ধর্ষনের এই তালিকা দীর্ঘ্য থেকে দীর্ঘ্যতর হচ্ছে। এরকম কতইনা ঘটনা কালের গহ্বরে হারিয়ে গেছে তা আমাদের জানা নেই, ভয়ে-লজ্জায় যা প্রকাশ পায়নি। সম্প্রতি শুধুমাত্র সাংবাদ-মাধ্যমে প্রকাশিত অগনিত ঘটনাপ্রবাহের তথ্যানুসারে এ বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ৬ মাসে সারাদেশে ৩ শ ৯৯ জন শিশু ধর্ষণ ও ধর্ষণ চেষ্টার শিকার হয়েছে । এর মধ্যে ৮ জন ছেলে শিশু । ধর্ষণের পরে ১ জন ছেলে শিশুসহ মারা গেছে ১৬ টি শিশু। বাংলাদেশে এখন একমাত্র আলোচ্য বিষয়- ধর্ষন, যে শব্দটি আজ আড্ডা-আলোচনা-অফিস টেবিলে কিংবা পথে স্থান করে নিয়েছে। আজ এমন একটি দিনও যাচ্ছে না, যেদিন ধর্ষণ নামক যৌন আক্রমণের শিকার হচ্ছে না শিশু থেকে পঞ্চাশোর্ধ্ব নারীরা। ঘরে-বাইরে, স্কুল কলেজ মাদ্রাসা, কর্মক্ষেত্র কিংবা গণ-পরিবহন কোথাও যেন শিশু বা নারীর নিরাপত্তা নেই। এ দেশটা যেন শ্বাপদের গভীর অরন্যের পরিণত হয়েছে।

কিন্তু দেশে এই যে ধর্ষনের মহামারি এর কারন কি ভেবে দেখেছেন কখনো? ধর্ষনের জন্য যারা পোষাককে দায়ী করেন; তারা বলবেন কি? তনুর পোষাক কি ছিলো? নুসরাতেই বা কি ছিলো? দুই থেকে ৭ বছরের শিশুর পোষাকইবা কতটা অশ্লীল হতে পারে! যা দেথে আপনাদের হিংস্ত্র দানবগুলো জেগে ওঠে? আসলে সমস্যাটা আপনাদের মগজে- সেই মগজে, যে মগজে আপনি আপনার ধর্ম নামের নোংরা অন্ধত্ব পুষে রেখেছেন। আর প্রায় প্রতিটি প্রথাগত ধর্মই নারীকে কৃতদাস-যৌনদাস-সন্তানোৎপাদনের শষ্যক্ষেত্র-সঙ্গী করে রেখেছে। এবং এরই প্রতিফিলন আপনারা জন্মের পর থেকেই আপনাদের পরিবারগুলোতে দেখে এসেছেন; পুরুষত্বের সীমাহীন বর্বরতায়। আর তার বাকী শিক্ষাটুকু সম্পন্ন হয়েছে আপনার জন্মগত সমাজ থেকে। ধম্ম আপনাকে মানুষ করতে না পারলেও বর্বর পুরুষ তৈরি করেছে ঠিকভাবেই। নইলে সীমাহীন ধর্ষন দেখে আপনার মাথায় আসে কি করে; এসব বন্ধ করতে পতিতালয় চাই! পতিতালয়, যার খদ্দের হবেন আপনি। সেই আপনি, যে নারীর সতীত্ব পরীক্ষায় বিশ্বাসী একজন পুরুষ- আপনার পতিতালয় চাই! কতটা নোংরা আপনার ভেতরের পুরুষত্ব যে, নিজের কন্যাও আজ আপনার কাছে নিরাপদ নয়। পিতৃত্বকে বিসর্জন দিয়ে পুরুষত্বকে আপনি লালন করছেন। তাহলে কে নিরাপদ আপনার কাছে? আপনার কন্যা-ভগ্নি-প্রতিবেশী…… কেউ নয়। কারন আপনি প্রচন্ডভাবে ধর্মবিশ্বাসী, সেই পুরুষ।

কেন বাংলাদেশে এত ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে, সমাজবজ্ঞিানের দৃষ্টিতে তার ব্যাখ্যা খুঁজুন। গ্রামের সহজ সরল নারী-শিশু থেকে সমাজের উঁচু দালানের নারী-শিশু কারোরই ছাড় নেই। মাদ্রাসায়-স্কুলে-কলেজে-গনপরিবহনে-অফিসে-পুলিশ স্টেশনে-বাড়িতে কোথাও যৌন আক্রমণ থেকেও রেহাই নেই নারী-শিশুদের। গণ-পরিবহণেতো আজকাল ধর্ষকদের সম্মিলিতভাবে ধর্ষনের কিংবা অন্যান্য যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন নারী যাত্রীরা। সবচেয়ে আশ্চর্যজনক এবং ভয়াবহ দিকটি হচ্ছে শিশু ধর্ষণ। মাদ্রাসায় হুজুর-মোল্লাদের বিকৃত রুচির বিকৃতি থেকে রেহাই নেই কোমলমতি শিশুদের। এদের পাশবিক প্রবৃত্তি ক্রমেই নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ছে। একের পর এক ধর্ষণ, যৌন সহিংসতা ও হত্যার ঘটনা ঘটলেও কোনোভাবেই এর লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না। কেউ যেন কোন কথাও বলতে চাইছে না এসব মাদ্রাসা শিক্ষার বিরুদ্ধে; এটা কি দোজখের ভয় নাকি বেহেস্তের মোহ। নইলে যে নুসরাতকে মাদ্রাসায় বসে মাদ্রাসারই অধ্যক্ষ ধর্ষন করে তাঁকে হত্যা করলো সেই নুসরাতের মা শিরিনা আক্তার বলেন, “আমার মেয়ে আখেরাতের পরীক্ষায় পাস করবে।” খুব বেশী আশ্চর্য্য লাগার কোন কারন নেই! কারন এটাই ধ্রুব সত্য যে, এদেশের বাবা-মা- অভিভাবকেরা এই বিশ্বাসেই তাদের সন্তানকে মাদ্রাসায় দেন যে, তাদের সন্তান আখেরাতের জন্য কাজ করছে। আর সেই আখেরাত শুধু সন্তানদের জন্যই নয়- তাদের পথকেও করবে নিশ্চিত। তাতে যদি তাদের সেই সন্তানরা (ছেলে হোক বা মেয়ে) মাদ্রাসায় বসে যৌন নির্যাতনের শিকার বা শারিরিক অত্যাচারেরও শিকার হয় বা তাদের হত্যাও করা হয় তাতে তাদের আফসোস নেই। কারন, মূলকথা “আখেরাত”!

ঘরে-বাইরে সর্বত্রই নারী ও শিশুর জন্য অনিরাপদ হয়ে উঠছে। বিরূপ প্রভাব পড়ছে সামাজিক জীবনে। সম্মিলিতভাবে মানুষ যেন অসভ্যতার দিকেই হাঁটতে শুরু করেছে। কিন্তু এর পেছনে কারনও রয়েছে অনেক- শিল্প, সংস্কৃতি থেকে মানুষের সরে যাওয়া আর বিজ্ঞান বিমুখতাও এর একটা অন্যতম কারন। ছেলেবেলা থেকেই পারিবারিকভাবে ছেলে এবং মেয়ে শিশুদের খেলাধুলা-চালচলন-শিক্ষা-পোষাক সহ সকলক্ষেত্রেই শুরু হয় চরম বৈষম্য। ছেলেশিশুটিকে খেলার জন্য বল-ব্যাট-প্লেন-কার দিলেও মেয়েটির জন্য সেই পরীমার্কা পুতুলই, এবং তাকে বুঝিয়ে দেয়া হয় “তুমি মেয়ে এবং এই সীমানাটা তোমার জন্য নির্ধারিত”। ছেলেটির সাথে সমান তালে সে ছুটতে পারে না। শিক্ষার আধুনিকায়ন করে যখন কো-এডুকেশন চালু করার কথা ছিলো তখন আমরা করেছি মাদ্রাসা। ধর্মভিত্তিক অন্ধকারাচ্ছন্ন এসকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছড়িয়েছে কেবলই নারীদ্বেষ আর হিংসার মত ভয়ংকর ভাইরাস। রাষ্ট্রের প্রচ্ছনান মদদে আর পৃষ্ঠপোষকতায় যা আজ দানবের আকার ধারন করেছে, সেই দানবের করাল গ্রাস থেকে এ দেশটাকে বাঁচানো কষ্টকর। তার সাথে রাষ্ট্রীয় বিচারহীনতার সাংস্কৃতি তো আছেই; সব মিলিয়ে একটা হিংস্ত্র শ্বাপদের অরন্যে আমরা কেবল বেঁচেই আছি। যেখানে বিচার চাওয়া যায় না, তবে আসামীরা জামিন পেয়ে যায় ঠিকই। এসব আপনারাও জানেন আমরাও জানি! ক্ষমতাধর আসামীকে বাঁচাতে ফাঁসানো হয় অসহায় মিন্নিদের। কেন হয় এসব? কেন ঠিকপথে শেষ হয় না এসব বিচার? কেন ধরা যাবে না অপরাধীদের? রাষ্ট্র নির্বাক হলেও এসব প্রশ্নের উত্তর আমাদের অজানা নয়।

পূর্নিমা-তনু-নুসরাতরাতো মরে গিয়ে বাঁচলো, এ অভিষপ্ত ভূমিতে আমরা বেঁচে আছি কেন?
মানুষ বেঁচে আছে কেন? এভাবে থাকাকে কি বেঁচে থাকা বলে?
মানুষ কি বেঁচে থাকে, এভাবে!


লিখেছেন: কাজল ‍কুমার দাস, ব্লগার ও প্রাবন্ধিক

(প্রথম প্রকাশ ২২ জুলাই ২০১৯- মুক্তমনা ব্লগ)

Wednesday, July 17, 2019

ধর্মান্ধ হলে ধর্ষন বন্ধ হবে না


আজ ঠিক এই মুহুর্তে যাকে খুব বেশী প্রয়োজন ছিলো তিনি . অভিজিৎ রায় বহু আগেই যিনি তাঁরবিশ্বাসের ভাইরাসবইয়ে লিখে গেছেন মানুষ ধর্মে কেন অন্ধ হয়; অন্ধ হলেই বা কি হয়.... এসবের বৈজ্ঞানীক ব্যাখ্যা।মানুষটা আজ নেই মৌলবাদীরা তাকে হত্যা করেছে- কিন্তু তাঁর দর্শনতো রয়ে গেছে, যা আজ সত্য হলো
 
যে নুসরাতকে মাদ্রাসায় বসে মাদ্রাসারই অধ্যক্ষ ধর্ষন করে তাঁকে হত্যা করা হলো সেই নুসরাতের মা শিরিনা আক্তার বলছেন, “আমার মেয়ে আখেরাতের পরীক্ষায় পাস করবে।কি খুব বেশী আশ্চর্য্য লাগছে? এটাই ধ্রুব সত্য যে এদেশের বাবা-মা-অভিভাবকেরা এই বিশ্বাসেই তাদের সন্তানকে মাদ্রাসায় দেন যে, তাদের সন্তান আখেরাতের জন্য কাজ করছে। আর সেই আখেরাত শুধু সন্তানদের জন্যই নয়- তাদের পথকেও করবে নিশ্চিত। তাতে যদি তাদের সেই সন্তানরা (ছেলে হোক বা মেয়ে) মাদ্রাসায় বসে যৌন নির্যাতনের শিকার বা শারিরিক অত্যাচারেরও শিকার হয় বা তাদের হত্যাও করা হয় তাতে তাদের কিচ্ছু আসে যায় না। কারন, মূলকথা আখেরাত!

আপনারা যারা ধর্ষনের শাস্তি হিসেবে ধর্ষকের মৃত্যুদন্ড, প্রকাশ্যে ফাঁসি, যৌনাঙ্গ থেতলে দেয়া..... এরকম অনেক প্রস্তাব করছেন তারা একবার ভাবুনতো, একজন সভ্য আর মানবিক বোধসম্পন্ন মানুষ হিসেবে আপনি কি মৃত্যুদন্ডের মত অমানবিক প্রথার পক্ষেই আছেন নাকি ধর্ষনের মত অপরাধের বিলুপ্তি চান? যদি সত্যিই চান সমাজ থেকে ধর্ষন লুপ্ত হোক- ধর্ষকের জন্মই না হোক! তবে ভাবুন, ধর্ষকের জন্ম হচ্ছে কোথায়? ধর্ষণ সংক্রান্ত বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞান তত্ত্বগুলোকে ঘেঁটে সেই আতুরঘরগুলো খুঁজে বের করুন; আর মহামারীর আকার নেয়া সেই ধর্ষকের আতুরঘরে সর্বশক্তি দিয়ে আঘাত করুন।

আমাদের শিক্ষায়-ধর্মে-সংস্কৃতিতে যৌনতার প্রতি যে দৃষ্টীভঙ্গী শেখানো হয় ছোটবেলা থেকেই,  নারীর প্রতি এক ধরনের বিকৃত দৃষ্টীভঙ্গী গড়ে উঠে ওখান থেকেইএ দেশের মসজিদে-মাদ্রাসায় মাহফিলের মোল্লাদের নারীদ্বেষী বিকৃত বক্তব্য নুতন কিছু নয়। আপনি হয়ত ভাবছেন এসব নোংড়া বক্তব্য শুধু ওইসব ময়দানেই সীমাবদ্ধ! তবে আপনি নিশ্চিৎ থাকুন আপনার ভাবনার আর জানার দৈন্যতা এটাই। এবার আপনি যদি আপনার পাশের মতান্ধ প্রগতিশীল বন্ধুটির ভাবনার জগতে একটু উঁকি দিন বা তার আচরণ লক্ষ্য করুন। তবে আপনিই বুঝবেন ওসব মোল্লা আর আপনার এই প্রগতিশীলদের মধ্যে পার্থক্য কতটুকু। এবার কিন্তু নিজের দায়িত্বেই বুঝে নিতে হবে বাকী “আম জনতার মনস্তাত্বিক অবস্থা”। এ দেশের একটা বিরাট অংশের মানুষ এখনো মনে করেন নারী ধর্ষনের জন্য পোষাক দায়ী, যারা মত দেন ধর্ষন বন্ধে পতিতালয় চাই তাদের সাথে এসব অসভ্য বর্বরদের সাথে পার্থক্য শুধুই পোষাকে; চিন্তায় আর দর্শনগত অবস্থানে এরা সমান। এরা নিজেদের বর্বর মানসিকতাকে সভ্য করতে মোটেও রাজী নন। তাইতো, এ দেশের মাহফিলগুলোতে যখন লক্ষ-লক্ষ মাইকে দেশব্যাপী চিৎকার করে বলা হয়-

“তেঁতুল দেখলে মানুষের যেমন জিভে জল আসে তেমনি নারীদের দেখলেদিলের মইধ্যে লালা বাইর হয়
“শোনো নারীরা, চার দেয়ালের ভেতরই তোমাদের থাকতে হবে স্বামীর বাড়িতে বসে তোমরা আসবাবপত্র দেখভাল করবা, শিশু লালন-পালন, পুরুষ শিশুদের যত্ন করবা এই হলো তোমাদের কাজ তোমাদের কেন বাইরে যেতে হবে?”
দিনেরাত্রে মহিলাদের সাথে পড়ালেখা করতেছেন, আপনার দিল ঠিক রাখতে পারবেন না রাস্তাঘাটে হাঁটাহুটা করতেছেন, হ্যান্ডশেক কইরা কইরা, আপনার দিল ঠিক রাখতে পারবেন না যতোই বুজুর্গ হোক না কেন, এই মহিলাকে দেখলে, মহিলার সাথে হ্যান্ডশেক করলে আপনার দিলের মধ্যে কুখেয়াল আইসা যাবে, খারাপ খেয়াল এইটা মনের জেনা, দিলের জেনা হইতে হইতে আসল জেনায় পরিণত হবে এটা সত্য না মিথ্যা?”
গার্মেন্টসে কেন দিছেন আপনার মেয়েকে? ফজরে / টা বাজে চলে যায়, রাত ৮টা, ১০টা, ১২টায়ও আসে না কোন পুরুষের সাথে ঘোরাফেরা করতেসে তুমি তো জানো না কতোজনের মধ্যে মত্তলা হচ্ছে আপনার মেয়ে, আপনে তো জানেন না জেনা কইরা কইরা টাকা রোজগার করতেছে, কী বরকত হবে?” 

তখন আপনাকে বুঝে নিতে হবে এসব কথাই এদেশের শিক্ষাহীন, অজ্ঞ, মতান্ধ মানুষের মনের কথা। এই বদমায়েশগুলো ভালো করেই জানে যে, ৬ বছরের মেয়ে, বোরখাবৃতা মেয়ে কিংবা ৬০ বছরের বৃদ্ধা স্বাভাবিকভাবে যৌনানুভুতি সৃষ্টি করে না; তবে তাদের দৃষ্টিতে নারী যখন পন্য-খাদ্যদ্রব্য-শষ্যক্ষেত্র তখন কিন্তু তাদের ধর্ষকীয় ব্রেইনে নারী বিষয়টি মারাত্মক উদ্দীপক হিসেবে কাজ করেকীভাবে এই কন্ডিশানিং হচ্ছে? যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ হেলথের ডিরেক্টর ডঃ আলিয়াস বলেছেন, মানুষের পার্সোনালাটি লার্নিং হয় তিনটা প্রধান ফ্যাক্টর দ্বারা শিক্ষা, সঙ্গ এবং পরিবেশএখন ধর্ম আর তাঁর শিক্ষার কারনে এই শিক্ষা, সঙ্গ এবং পরিবেশ তিনটেই হচ্ছে বিপরীতমুখী। কারন, ধর্ষণের জন্য আমাদের সমাজ নামের এই ব্যবস্থাই মূলত দায়ী; যাকে রক্ষণশীল আখ্যা দিয়ে শিশু-কিশোর বয়স থেকেই মেয়েকে ছেলের সাথে মিশতে দেয়া হয় না এবং ছেলেকেও মেয়ের থেকে দূরে রাখা হয়।এভাবে মেয়ের শরীরকে গোপন এবং নিষিদ্ধ করে রাখার যে অবৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া সেটা যে কতটা মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে তা আমাদের সমাজ আজও বুঝে উঠতে পারেনি এবং আদৌ তা পারবে কিনা সেটা নিয়ে আমি সন্দিহান।

প্রথম বিশ্বের মানুষ যখন চাঁদে যাচ্ছে, মঙ্গল গ্রহে নুতন আবাসনের সন্ধান খুঁজছে তখন আমাদের খুঁজতে হচ্ছে ধর্ষন কেন হয়? আর এর থেকেও আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, ধর্ষনের বৈজ্ঞানিক কারন না খুঁজে আমরা মৃত্যুদন্ড’র মত অমানবিক কাজকে ধর্ষন বন্ধের হাতিয়ার হিসেবে বেঁছে নিয়েছি; এটাই হয়ত আমাদের আরব্য শিক্ষার ফল! জন্মথেকে ধর্মের অন্ধকারে বেড়েওঠা আমাদের প্রেম, যৌনতা আর নারীদেহ নিয়ে আমাদের ট্যাবু ভাঙার এটাই সবথেকে ভালো সময়
শুরু হোক এখনই; এখান থেকেই।

লেখক: কাজল কুমার দাস
(প্রথম প্রকাশ ইষ্টিশন)

Tuesday, June 25, 2019

নির্মল কুমার সেনঃ ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম ফরেনসিক সায়েন্টিষ্ট

ফরেনসিক সায়েন্স হল বিজ্ঞানের এমন একটি ফলিত শাখা যেখানে পদার্থবিদ্যা, রসায়নবিদ্যা, জীববিদ্যা কিংবা বিজ্ঞানের অন্যান্য বিশুদ্ধ শাখার জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে কোন অপরাধের সূত্র খোঁজা বা বিশদ তদন্ত চালানো হয়। বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখার তুলনায় এই শাখাটির বিকাশ হয়েছে বেশ ধীরলয়ে। আর তাই আধুনিক ফরেনসিক সায়েন্স বলতে আমরা যা বুঝি তার মূল গোড়াপত্তন শুরু হয় গত শতাব্দী থেকে। ভারতীয় উপমহাদেশে এই ফরেনসিক সায়েন্স সম্পর্কিত গবেষণায় যাকে পথিকৃৎ বলা যায় তিনি একজন বাঙালি বিজ্ঞানী। তার নাম নির্মলকুমার সেন।


অবিভক্ত বাংলার যশোর জেলার হরিনগর গ্রামে নির্মলকুমারের জন্ম। তার জন্মের কিছুদিন পরেই তার পিতা প্যারীমোহন সেন এবং মাতা সরোজিনী সপরিবারে পাবনায় চলে আসেন। পাবনাতেই নির্মলকুমারের প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয়। পাবনা ইন্সটিটিউশন থেকে থেকে ১৯১৫ সালে মাধ্যমিক পাশ করবার পর তিনি ভর্তি হন পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে। এই কলেজ থেকে তিনি প্রথম শ্রেণী পেয়ে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর তিনি ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি কৃতিত্বের সাথে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। সেসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন বিভাগে অধ্যাপনা করতেন প্রখ্যাত রসায়ন বিজ্ঞানী জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ। 

জ্ঞানচন্দ্র ঘোষের উৎসাহ এবং অনুপ্রেরণা নির্মল কুমার সেনকে অনেকখানি প্রভাবিত করে। আর তাই জ্ঞানচন্দ্র ঘোষের অধীনেই তিনি তাঁর ডক্টরেট গবেষণা শুরু করেন। বাংলার তৎকালীন অর্থনৈতিক অবস্থা বিচারে পাট শিল্পের গুরুত্ব ছিল ছিল অপরিসীম। আর তাই তিনি তাঁর গবেষণার বিষয়বস্তু হিসেবে পাট বীজের রাসায়নিক গঠন সম্পর্কে আরও বিশদরূপে জানবেন বলে সিদ্ধান্ত নিলেন। তাঁর অভিসন্দর্ভের শিরোনাম ছিল “কেমিক্যাল কম্পোজিশন অফ জুট সীডস”। এই গবেষণা চলাকালীন সময়েই তিনি তৎকালীন ঢাকা গভর্নমেন্টাল কলেজে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৩৩ সালে তিনি ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন এবং একই বছর পাটবীজের রাসায়নিক গঠনের উপর তার এই গবেষণার জন্য তিনি রয়্যাল এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে এলিয়ট প্রাইজ পান। 

১৯৪২ সালে নির্মল কুমার সেনকে হুগলী মহসিন কলেজে বদলি করা হয়। এরপরের বছর তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজের রসায়ন বিভাগে প্রফেসর হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৪৮ সালে তিনি রসায়ন বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। তাঁর মূল লেখাপড়া রসায়নের উপর হলেও অধ্যাপনা কাজের ফাঁকে তিনি বিভিন্ন বিষয়ের উপর নানা সময়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হন। ১৯৪২ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলার সময়ে তিনি সরকারের অধীনে সিভিল ডিফেন্স বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। পরবর্তীতে তিনি বাংলা ও সিকিমের সিভিল ডিফেন্স এর গুরুত্বপূর্ণ বিভাগে অধিষ্ঠিত হন। অধ্যাপনার পাশাপাশি এই দায়িত্বও তিনি সুষ্ঠুরূপে পালন করেন। পাশাপাশি তিনি ডেভিড হেয়ার কলেজে পাঠদান ও স্নাতক , স্নাতকোত্তর পর্যায়ের বিভিন্ন শিক্ষার্থীদের অভিসন্দর্ভ তদারক করতেন। কর্মজীবনের এই সকল ব্যস্ততার মধ্যেও তিনি গবেষণাকে আঁকড়ে রেখেছিলেন সবসময়। নির্মল কুমার সেন পোস্ট ডক্টরেট পর্যায়ে গবেষণা করার জন্য বিভিন্ন দেশের গুরুত্বপূর্ণ গবেষণাগারে উল্লেখযোগ্য কিছু গবেষণাকার্য সম্পন্ন করেন। লিভারপুল বিশ্ববিদ্যালয়ে বিখ্যাত বিজ্ঞানী থমাস পার্সি হিলডিচের গবেষণাগারে তিনি তাঁর পোস্টডক্টরেট গবেষণা সম্পন্ন করেন। এখানে থাকার সময় তিনি প্রাকৃতিক চর্বি সংশ্লেষণ এবং এর রাসায়নিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বিস্তারিত গবেষণা করেন। পরবর্তীতে সুইজারল্যান্ডের জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয়ে নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী পল ক্যারের – এর গবেষণাগারেও তিনি পোস্ট ডক্টরাল গবেষক হিসেবে যোগদান করেনরসায়নের মানুষ হওয়ায় প্রথম দিকে তিনি বিভিন্ন প্রাকৃতিক উপাদানের সংশ্লেশণ, উৎপাদন প্রক্রিয়া নিয়ে বেশি আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু ধীরে ধীরে তাঁর গবেষণার বিষয় আরও বিস্তৃত ও বৈচিত্র্যময় হওয়া শুরু করে । 

১৯৪৯ সালে তখনকার রাজ্য সরকার তাঁকে ফরেনসিক সায়েন্স সম্পর্কে উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য যুক্তরাজ্যে প্রেরণ করে। সেই সময় বাংলার মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়। তিনি অপরাধ বিজ্ঞান সম্পর্কে বিস্তারিত গবেষণা ও পাশাপাশি ফরেনসিক সায়েন্স বিষয়ক ল্যাবরেটরি প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা বোধ করেছিলেন। যুক্তরাজ্যে যাওয়ার পর প্রফেসর সেন লণ্ডনের মেট্রোপলিটন পুলিশ ল্যাবরেটরি, স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ গবেষণাগার ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন এবং ফরেনসিক সায়েন্স সম্পর্কিত বিশেষ প্রশিক্ষণ লাভ করেন। দেশে ফেরার পর ১৯৫২ সাল অব্দি তিনি ছিলেন কলকাতা পুলিশ বিভাগের ফরেনসিক সায়েন্স বিভাগের খণ্ডকালীন শিক্ষক। পাশাপাশি রাজ্য সরকারের অনুরোধে তিনি একটি ফরেনসিক সায়েন্স ল্যাবরেটরি গঠন ও গবেষণাকাজের জন্য একটি পরিকল্পনার খসড়া তৈরি শুরু করেন। তাঁর পরিকল্পনা অনুসারেই ১৯৫৩ সালের জুন মাসে প্রতিষ্ঠিত হয় রাজ্য ফরেনসিক সায়েন্স ল্যাবরেটরি। এই ল্যাবরেটরিটি পরিচালনার ভারও ন্যস্ত হয় তাঁর উপর। 

নির্মল কুমার সেন কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ফরেনসিক সায়েন্সের এই গবেষণাগারটি শুধু পশ্চিমবঙ্গে নয় , সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশে প্রথম হিসেবে বিবেচিত আর তাই এই উপমহাদেশে ফরেনসিক সায়েন্স সম্পর্কিত গবেষণায় অধ্যাপক সেন কেবলমাত্র উল্লেখযোগ্যই নন, পথিকৃৎ ও বটে। সেই সময় তাঁর এই ল্যাবে পশ্চিমবঙ্গ তো বটেই , দিল্লী, সিকিম, ওড়িশা থেকেও নানা ধরণের জটিল কেস আসত সমাধানের সূত্র উদ্ধার করবার জন্যে। 

শুধুমাত্র ফরেনসিক সায়েন্স ল্যাব প্রতিষ্ঠা করেই অধ্যাপক সেন বসে থাকেননি। যেহেতু অপরাধীদের কৃত অপরাধ বিভিন্ন প্যাটার্নে পরিবর্তিত হয় সেহেতু তিনিও গবেষণার মাধ্যমে অপরাধের সূত্র উদঘাটনের বিভিন্ন পন্থা আবিষ্কারে নিজেকে আত্মনিয়োগ করেন। ফরেনসিক সায়েন্স সম্পর্কিত গবেষণায় নির্মলকুমার সেনের অবদান অনস্বীকার্য। তাঁর মধ্যে প্রথমেই উল্লেখ করা যায় নরকঙ্কাল থেকে হারিয়ে যাওয়া মানুষকে শনাক্ত করবার কৌশল আবিষ্কারের ব্যাপারটি। অজ্ঞাতপরিচয় কোন মানুষের কঙ্কালের চেহারা খুলির আকৃতি, চক্ষুকোটরের বিস্তৃত বিশ্লেষণ প্রভৃতিকে কাজে লাগিয়ে ধীরে ধীরে ওই ব্যক্তির প্রকৃত চেহারাকে খুঁজে পাওয়া ই ছিল তাঁর এই অভিনব গবেষণার উদ্দেশ্য। তাঁর এই গবেষণাপত্র ” Identification by superimposed photographs” শিরোনামে ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে International Criminal Police Review জার্নালে প্রকাশিত হয়। পাশাপাশি ফরেনসিক সায়েন্স গবেষণা সম্পর্কিত তাঁর অন্যান্য গবেষণা ও ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন একের পর এক প্রকাশিত হয় কলকাতা পুলিশ জার্নালে ও “জ্ঞান-বিজ্ঞান” পত্রিকার বিভিন্ন সংখ্যায়। তিনি ফরেনসিক সায়েন্স সম্পর্কে তাঁর মৌলিক গবেষণার জন্য পুয়ের্তো রিকোতে লিগাল মেডিসিন ও ফরেনসিক সায়েন্স সম্পর্কিত প্রথম আমেরিকান কনফারেন্সেও বক্তা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। 

তাঁর নেতৃত্বে সেই সময়ের বেশ কিছু চাঞ্চল্যকর অপরাধের সমাধান করা সম্ভব হয়েছিল। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বেলারানি মৃত্যু রহস্য (১৯৫৪)- এর কথা। এই অপরাধের জট খুলে সমাধানে উপনীত হওয়ার ক্ষেত্রে নির্মল কুমার সেনের সন্ধানী ও বিশ্লেষণী দৃষ্টি ও মৌলিক গবেষণা প্রক্রিয়া উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছিল। তাঁর দ্বারা ই ফ্লোরোসেন্ট বা প্রতিপ্রভ বিকিরণ ব্যবহারের মাধ্যমে ব্যাংকের চেক জালিয়াতির মত অপরাধের সূত্র উদ্ঘাটন করা সম্ভব হয়েছিল। তাছাড়া দীনদয়াল মৃত্যু রহস্য ( ১৯৬৭ ), এটর্নি জেনারেল হেম সান্যাল মার্ডার কেস সহ বিভিন্ন চাঞ্চল্যকর অপরাধের সমাধান প্রক্রিয়ায় অধ্যাপক সেনের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ফরেনসিক সায়েন্স সম্পর্কিত গবেষণাকালীন বিভিন্ন সময়ে তিনি বেশ কিছু মৌলিক বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া আবিষ্কার করেন। তাঁর আরেকটি উল্লেখযোগ্য কাজ হচ্ছে কালিতে লেখা কাগজের কোন ডকুমেন্ট থেকে অপরাধের সূত্র খুঁজে বের করা। কালি দিয়ে লেখা কাগজের ডকুমেন্ট কত দিনের পুরনো , ক্রোমাটোগ্রাফি ব্যবহার করে তা উদ্ভাবনের অভিনব উপায় আবিষ্কার করেছিলেন তিনি। তাঁর এই গবেষণা প্রকাশিত হয়েছিল জার্নাল অফ ফরেনসিক সায়েন্সে ১৯৭১ সালে। সেই সময়ে ফরেনসিক সায়েন্সের প্রেক্ষাপটে তাঁর এই কাজটি মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হয়। এছাড়াও দেশ বিদেশের বহু গবেষণা পত্রিকায় অধ্যাপক সেন এর গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর গবেষণা জীবনের দিকে তাকালে বোঝা যায় তাঁর প্রথম দিককার গবেষণাগুলি জৈব ও প্রাকৃতিক রসায়নের উপর হলেও শেষ ভাগের অধিকাংশ গবেষণাপত্রই ফরেনসিক সায়েন্স সম্পর্কীয়। কিন্তু এ কথা বলতেই হয় ফরেনসিক সায়েন্স সম্পর্কিত তাঁর গবেষণাকর্মগুলি অন্য মাত্রা পেয়েছে কারণ তাঁর এই গবেষণাতে যুগপৎ মেলবন্ধন ঘটেছে রসায়নবিজ্ঞান সম্পর্কিত গবেষণা প্রক্রিয়ার। 

চাকরি জীবন থেকে অবসর গ্রহণের পর অধ্যাপক সেন প্রায় তিন বছর এমিরেটাস সায়েন্টিস্ট হিসেবে কাজ করেছেন
” কাউন্সিল অফ সায়েন্টিফিক এন্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ, ইণ্ডিয়া” তে । রসায়নবিজ্ঞান এবং ফরেনসিক সায়েন্সে উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্য তিনি রয়্যাল ইনস্টিটিউট অফ কেমিস্ট্রির ফেলো হিসেবে নির্বাচিত হন ১৯৫০ সালে। এর পরের বছর ই তিনি ইন্ডিয়ান সায়েন্স আকাদেমির ফেলো হিসেবে নির্বাচিত হন। ১৯৭৬ সালে ইন্ডিয়ান আকাদেমি অফ ফরেনসিক সায়েন্স তাঁকে ফেলো হিসেবে নির্বাচিত করে। 

তবে উজ্জ্বল গবেষণা জীবন, সাফল্যমণ্ডিত কর্মজীবন ছাড়াও অধ্যাপক সেনের খেলাধুলায় ও সঙ্গীতে ছিল অসামান্য দক্ষতা। ছাত্রজীবনে তাঁর ডক্টরেট ডিগ্রি লাভের খবর সেই সময়ের বহুল প্রচারিত অমৃত বাজার পত্রিকা প্রকাশ করেছিল এভাবেঃ
” The degree of Doctor of Science has recently been conferred on Mr. Nirmal Kumar Sen, Lecturer of Dacca Intermediate College in Chemistry, by the Dacca University. Dr. Sen is well known in Dacca as a good cricketer and a musician. By his achievement Dr. Sen has shown that play and study can really go side by side in the Bengalees.”
(A New D.Sc., Our Own Correspondent, Dacca, Nov.30)

এই খবরটি যখন প্রকাশিত হয়েছিল তখন বাঙলায় তথা ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশেরা রাজত্ব করছিল । পরাধীন বাঙলায় একজন বাঙালির এই অসামান্য সাফল্যের গুরুত্ব ছিল যথেষ্ট। একই ব্যক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশুনায় কৃতী, অপরদিকে খেলার জগতে ও সংগীত জগতে সমান দক্ষ- এ ধরণের সব্যসাচীর ভূমিকায় থাকতে পারেন, তারই অসংখ্য প্রমাণে পূর্ণ হয়ে আছে নির্মলকুমার সেনের সমগ্র জীবন। 

জীবন সায়াহ্নে এসেও অধ্যাপক সেন নানা ভাবে ফরেনসিক গবেষণায় মূল্যবান উপদেশ কিংবা বিবিধ সহযোগিতার মাধ্যমে যুক্ত ছিলেন। ১৯৮৩ সালের ১৬ অক্টোবর তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ফরেনসিক সায়েন্স ও রসায়নবিজ্ঞানে যুগপৎ দক্ষ এই বাঙালি বিজ্ঞানী আমাদের বিস্মৃতির মেঘে অনেকখানি ঢেকে গেলেও বিজ্ঞানের স্মৃতির আকাশে আজও তিনি এতটুকু ম্লান হন নি । 

রেফারেন্সঃ
1. Biographical Memoir of Nirmal Kumar Sen, written by Asima Chatterjee (www.insaindia.res.in)
2. Sen, N.K. and Ghosh, P.C., 1971. Dating iron-base ink writings on documents. Journal of forensic sciences, 16(4), pp.511-520.

পরিশিষ্ট
নির্মল কুমার সেন রচিত উল্লেখযোগ্য গবেষণাপত্র “Dating iron-base ink writings on documents”

Abstract:
A new method for thin-layer chromatography evaluation of progressive oxidative changes of the blue dye and Fe content in the ink strokes on documents of known ages written with iron-base inks is described. The method is a photodensitometric evaluation of the size and intensity of the spots of blue dye and red ferric thiocyanate directly on the chromatograms. Ink samples were obtained from a number of personal diaries of known ages ranging from Jan. 1942 to Dec. 1969. They were written with the same type of ink on almost the same kind of paper and were stored under similar conditions. This method may prove to be of forensic importance in determination of the age of documents bearing such ink.
(Sen, N.K. and Ghosh, P.C., 1971. Dating iron-base ink writings on documents. Journal of forensic sciences, 16(4), pp.511-520.)

লেখক: অতনু চক্রবর্তী

Saturday, June 22, 2019

আরজ আলী মাতুব্বর: যেমন করে ছড়িয়ে গেল

 প্রথম পর্ব

বাংলা একাডেমীর বর্ধমান হাউসের পেছনের ভবনের সিঁড়িতে একজন কৃষক দর্শনের অপরিচিত মানুষকে দেখে একদিন থমকে দাঁড়ালাম। লম্বা, কৃশকায়, একহারা গড়ন তাঁর। পাঞ্জাবি-পাজামা পরনে। পায়ে রাবারের জুতো। একেবারে সাদামাটা। তামাটে গায়ের রং, পোড় খাওয়া মানুষ, দেখে আঁচ করা যায়। আপাদমস্তক সাধারণ, সাদাসিধে। তবে অসাধারণ তাঁর চোখ দুটো। তীক্ষ্ম, ধারালো, ভয়ানক বুদ্ধিদীপ্ত।

"বিদ্যাশিক্ষার ডিগ্রী আছে,
জ্ঞানের কোনো ডিগ্রী নেই.
জ্ঞান ডিগ্রীবিহীন ও সীমাহীন"
                                               -আরজ আলী মাতুব্বর

মনোযোগ দিয়ে চাইলে যে কেউ চোখ জোড়া দেখে আকর্ষণ বোধ করবেন। হঠাৎ করে আমি মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পড়লে তিনিও অনেকটা অপ্রস্তুত হয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন। জিজ্ঞাসু চোখে চাইলেন আমার দিকে। চোখের ভাষায় তাঁর পথ আটকাবার কারণ জানতে চাইলেন। আমি কিছুটা জড়তা নিয়ে শুধোলাম আপনাকে তো চিনলাম না! সেই মুহূর্তে মনে হয়েছিল, তিনি বুঝি কোনো গ্রামের চারণ কবি। পথ চলেন, আর স্বভাবসুলভ কবিতা বানান। উৎসুক শ্রোতা পেলে ধরে প্রবল উৎসাহে শুনিয়ে দেন। সেই কথাটি পেশ করে তিনি হয়তো পকেট হাতড়ে দুচারখান কবিতা বের করে পড়তে দেবেন। অথবা পাঠ করে শোনাবেন।


 আরজ আলী মাতুব্বরের বসতবাড়ী (আরজ মঞ্জিল) লামচরি

না, কোনোটাই করলেন না তিনি। আমার অনুমানের মতো করে বললেনও না কিছু। একটু রয়ে সয়ে বললেন তিনি, আমি একজন সামান্য কৃষক, থাকি গাঁও-গেরামে। আমাকে চিনবেন কেমন করে! তবে জগৎ ও জীবনের নানা বিষয় নিয়ে একটু আধটু ভাবনা ভাবি। মনের খেয়ালে সেই ভাবনাগুলো নিয়ে গুছিয়ে একটু লেখার চেষ্টা করি। অল্প কয়েকখানা বই বের করেছি নিজের কষ্টের পয়সায়। আমাদের এলাকায় কেউ কেউ হয়তো বইগুলো পড়েছেন। তাও সংখ্যায় খুব বেশি হবে না। বই এতদূর এই ঢাকা শহরে আসেনি। কখনো আসলেও কেউ তা পড়বে না।


  দ্বিতীয় পর্ব

এদেশের একজন অপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষিত অথচ প্রাজ্ঞ, শ্রমজীবী অথচ মুক্তবুদ্ধি চর্চায় প্রাগ্রসর, লোকায়ত অথচ বিজ্ঞানসম্মত চেতনায় পরিপূর্ণ ছিলেন। এমন একজন অনন্য মানুষ সম্পর্কে এদেশের অগ্রসর ও মনস্বী বুদ্ধিজীবী ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ওপরোক্ত মন্তব্য করেছেন আজ থেকে তিন যুগ আগে। তখনো তাঁকে চেনেন নি তেমন কেউ। নিভৃত পল্লী প্রান্তর থেকে শহুরে লেখক-পাঠকদের নজর কাড়তে পারেন নি। অনেক পরে, অনেক দেরিতে চিনেছি আমরা তাঁকে। তাঁর জীবন সায়াহ্নকালে, বেশ বিলম্বে আমরা এই প্রগ্রসর লৌকিক দার্শনিকের সাথে পরিচিত হতে আরম্ভ করেছিলাম। কিন্তু এই পরিচয়পর্বটি বিস্তৃত হবার আগেই, সকলে বুঝে ওঠার আগেই গত হয়েছেন তিনি।

আরজ আলী মাতুব্বর। নাগরিক পরিসর থেকে অনেক দূরে জন্ম তাঁর। জীবনভর একটানা সংগ্রাম-সংঘাতের মধ্য একই স্থানে সারাটি জীবন বসবাস করেছেন। ভীষণ একাকীত্বে, নিরিবিলিতে নিজ গ্রামে থেকে আপন যেটুকু জমি-জিরেত তাতে ফসল ফলিয়েছেন। আর তার ফাঁকে ফাঁকে জীবন ও জগতের সত্যানুসন্ধান করে ফিরেছেন।


ইংরেজিতে ‘সেল্ফ টট’ বলে প্রচলিত যে কথাটি তা খাঁটি অর্থেই প্রযোজ্য আরজ আলী মাতুব্বরের ক্ষেত্রে। সাধারণ অর্থে কোনো বিদ্যাপীঠে তার শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ হয়নি। বছর দেড়েক একটি মক্তবে ভর্তি হয়ে, অক্ষর জ্ঞানটুকু নেয়া হয়েছিল। ব্যস, অইটুকুই। এই সামান্য অক্ষরজ্ঞান পুঁজি করে জ্ঞানরাজ্যের বিশাল অঙ্গনে বিস্ময়কর পদাচারণা ঘটেছিল তাঁর। সুপুরী, নারকোল আর নদনদীর জন্য অধিক পরিচিত বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের বর্তমান বিভাগীয় শহর বরিশাল। বরিশাল শহরের কোল ঘেঁষে কীর্তনখোলা নদী। কীর্তনখোলার এক পাড়ে বরিশাল শহর। নদীর বিপরীত দিকে চরমোনাই গ্রাম। এই দুয়ের মাঝ বরাবর বয়ে গেছে কীর্তনখোলা।




শহর থেকে কীর্তনখোলা নদী বেয়ে ১০/১২ কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রম করলে পড়বে এক শান্তসমাহিত গ্রাম। গ্রামটির নাম লামচরি। নদীর ঘাট থেকে প্রায় এক কিলোমিটার পথের দূরত্বে লামচরি গ্রামের কেন্দ্রস্থ লে একটি দরিদ্র কৃষিজীবী পরিবারের বাস। ‘মাতুব্বর বাড়ি’ বলে পরিচিত। লামচরি গ্রামের এ বাড়িতেই বাংলা ১৩০৭ সালের ৩ পৌষ আরজ আলী মাতুব্বরের জন্ম। পূর্বপুরুষের বাড়ি ছিল একই জেলার কালিকাপুর ও ঝর্ণাভাঙা গ্রামে। লামচরি গ্রাম একসময় জলাভূমি ছিল। পরে চর জেগে উঠলে আরজ আলীর পিতামহ আমান উল্লা মাতুব্বর শেষ জীবনে লামচরি গ্রামে ঘরবাড়ি বানিয়ে বসত গড়ে তোলেন।


পূর্বপুরুষের সকলেই ছিলেন কৃষিজীবী। চরে তখনো মানুষের বসবাস শুরু হয়নি। ক্ষেত-খামারও হয়নি। কম মানুষজন, ঘরবাড়ি, হালচাষ হতে থাকে। বাড়ির আশেপাশের চরের জমিতে ফসল ফলানো শুরু করলেন আরজের বাবা এন্তাজ আলী মাতুব্বর। লামচরি চর পরিণত হয় লামচরি গ্রামে। ধনধান্যে ভরে ওঠে লামচরির মানুষের ঘর-গোলা। ধীরে ধীরে একসময় সম্পন্ন গ্রাম হয়ে ওঠে লামচরি। আরজ আলী মাতুব্বরের জন্মের চার বছর পর ১৩১১ সালে মারা যান তার বাবা। মৃত্যুর সময় তার উত্তরাধিকারীদের জন্য রেখে যান সামান্য আবাদি জমি এবং বসত বাড়িটি। জমির পরিমাণ ৫ বিঘা। আর টিনে ছাওয়া বসতের দুটো ঘর। এসময় উপর্যপুরি কয়েক বছর প্রাকৃতিক প্রতিকূলতার জন্য ফসল মারা যায়। আরজ আলীরা ৫ ভাইবোন। ৩ ভাই ২ বোন। জন্মের কিছুদিন পর এক ভাই কাছেম আলী মারা যায় ১৩০১ সালে। একই বছরে আরেক ভাই ছোমেদ আলী ৩ বছর বয়সে মারা যায়। এন্তাজ আলী মাতুব্বর তার বড় মেয়ে জিগীর জান বিবিকে বিয়ে দিয়ে যান। তার মৃত্যুর সময় থাকে দুই ভাই বোন, কুলসুম বিবি ও আরজ আলী। আরজ আলীর মা লালমন্নেছা বিবি স্বামী এবং ক্ষেতের ফসল হারিয়ে ছেলেমেয়েকে নিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েন। অনাহারে অর্ধাহারে দিন কাটে তাদের।


  তৃতীয় পর্ব
বরিশাল এলাকার দাপুটে জমিদার তখন লাকুটিয়ার রায় বাবুরা। জমিদারের খাজনা বাকি পড়ে। দু মুঠো খাবারের সংস্থানই যখন হয়না তখন খাজনা পরিশোধের প্রশ্নই আসে না। অত্যাচারী জমিদার তা বুঝবেন কেন! জমিদারি প্রথাই এমন-প্রজার সুখ-সুবিধার বিষয়টা সেখানে গৌণ। পাইক-বরকন্দাজ দিয়ে, অত্যাচার-নির্যাতন করে নিজেদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ নিশ্চিত করার জন্য প্রজাদের খাজনা আদায় করাটাই মুখ্য ব্যাপার। দরিদ্র প্রজা খাজনা প্রদানে অসমর্থ হলে তারা প্রথমে পীড়ন এবং শেষে ক্রোক বা নিলামের আয়োজন করতো।

১৩১৭ সালে আরজের মা জমির খাজনা দিতে না পারলে যে সামান্য জমিটুকু ছিল তা জমিদাররা নিলামে চড়িয়ে নিজেরা দখল করে। বেঁচে থাকার জন্য, টিকে থাকার জন্য লালমন্নেছাকে অন্যের নিকট হাত পাততে হলো। করতে হলো ধারকর্জ। বরিশাল শহরের সে সময়ের কুখ্যাত কুসীদজীবী জনার্দন সেনের নিকট থেকে চড়া সুদে টাকা কর্জ করলেন। এই দেনার দায়ে পরের বছরই অর্থাৎ ১৩১৮ সালে জনার্দন সেন আরজ আলীদের টিনের বসত বাড়িখানা নিলাম করে নেয়ার এক বছরের মধ্যে আরজের মা পুত্র-কন্যা নিয়ে বিত্ত-বেসাত ও গৃহহীন হয়ে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের নিñিদ্র অন্ধকারের অতলে নিমজ্জিত হন। 




রক্ষা এই, নিষ্ঠুর জমিদার বা কুসীদজীবী জমিছাড়া, ঘরহারা করলেও ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করে নি। একান্ত অনুগ্রহবশত ভিটেটুকুর মালিকানা বিধবার নিকট থেকে ছিনিয়ে নিতে পারেনি। পুরানো ভিটিতে তিনি কয়েকদিন কাঁদাকাটা করে অবশেষে সহানুভূতিশীল প্রতিবেশীদের সহায়তায় নতুন একখানা ঘর ওঠালেন। এক চিলতে একটি ঘর। ঘরখানি দৈর্ঘ্যে ছিল পাঁচ হাত। আর প্রস্থে চার হাত। ঘরের চাল ধৈঞ্চর, ছাউনি গুয়াপাতায়, মাদারের গাছের থাম আর ঢেকি লতা দিয়ে বাধা খেজুর পাতার বেড়া। ঘরের চারিদিকে রান্নার হাঁড়িপাতিল, পানির কলসি, চুলা, কাঁথা, বালিশ ইত্যাদি। এর মাঝে কোনোভাবে গুটিশুটি মেরে দু ভাইবোন ও মা বসবাস করতে শুরু করে নতুনভাবে। আর তাতে শুয়ে শুয়ে বালক আরজ আলী স্বপ্ন দেখতে থাকে। নানা এলোমেলো স্বপ্ন। এলোমেলো ভাবনা। তাদের দুর্দশার কথা। অত্যাচারী জমিদারের কথা। অফুরন্ত জিজ্ঞাসা তার মনে আকুলি-বিকুলি করে। বালক আরজ খেই হারিয়ে ফেলে। উত্তর মেলে না।


রাতে ঘুমের ঘোরে পা লেগে ঘরের একপাশে রাখা পানি ভরা কলসি ভেঙে পানি ঘরময় ছড়িয়ে কাঁথা বালিশ বিছানা ভিজে জবজবে একাকার কোনোদিন। আবার কোনোদিন পাতিলের পান্তাভাত ঘরময় ছিঁটিয়ে গেছে। এসময় তাদের দু’বেলার খাবার ছিল এঁটে কলার সাথে পান্তা ভাত। আরজের মা মানুষের বাড়ি বাড়ি কাজ করে, ঢেঁকিতে ধান কুটে কষ্টে সৃষ্টে কোনোভাবে দিনযাপন করেছেন। চোখের জল ফেলে মুখ বুঁজে কষ্ট সয়ে গেছেন তিনি। ভবিষ্যতের আশায় বুক বেঁধে উদয়াস্ত পরিশ্রম করেছেন। ছেলেমেয়ে দুটোকে আগলে রেখে সান্ত্বনা খুঁজেছেন। মানুষ করে গড়ে তুলতে সযত্ন চেষ্টা করেছেন। কিন্তু মানুষ করতে তো ছেলেকে লেখাপড়া করাতে হবে। তার সে সামর্থ্য কই? বেঁচেবর্তে থাকার জন্য খাবার চাই আগে। তারপর না লেখাপড়া। তাদের মুখের দু মুঠো খাবার জোটাতেই প্রাণান্ত। তায় আবার লেখাপড়া!


এসব প্রশ্নের তাড়নায় দীর্ঘদিন বিমোহিত মনে আচ্ছন্ন থেকেছি। হৃষ্টচিত্তে তাঁর বইগুলো সার্বক্ষণিকভাবে বহন করেছি। আর যখন যাকে পেয়েছি পড়ে পড়ে শুনিয়েছি। প্রথমত এটুকুই কর্তব্য বলে মনে হয়েছে। পরে মনে হয়েছে এটুকুতে সন্তুষ্ট হলে চলবে কেন? আমার আজীবন লালিত ধ্যানধারণা ও দর্শনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ এই রচনাগুলো আরো বৃহত্তর পরিসরে নিয়ে যাওয়ার আয়োজন করতে হবে। বহু পাঠককে আলোকিত করার, চিন্তার দাসত্ব থেকে মুক্ত করার অপরিমেয় গুণের অধিকারী কৃষক দার্শনিক আরজ আলী মাতুব্বরের রচনাগুলোকে একত্রিত করে পরিবেশন তো করা যায়। তবে আরো আগে এই লেখককে তো প্রকাশ করা দরকার। তার জীবনী প্রকাশের মাধ্যমে ব্যাপক মানুষের গোচরে নেয়া দরকার এই মহজ্জনকে। অনেকটা অন্ধ আবেগের আতিশয্যে নেমে গেলাম। পরে অবশ্য জেনেছিলাম দেশের প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বেশ আগে দৈনিক ইত্তেফাক-এর এক ঈদ সংখ্যায় তাঁকে নিয়ে লিখেছেন। মফিদুল হক সচিত্র সন্ধানীতে লিখেছেন। লিখেছেন এদেশের বিশিষ্ট স্পষ্টবাদী প্রবাদ পুরুষ অধ্যাপক আহমদ শরীফ, অগ্রসর লেখক-রাজনীতিক বদরুদ্দীন উমরও বুঝি লিখেছিলেন। বরিশালের দু’জন সংবাদকর্মী ও লেখক অরূপ তালুকদার এবং মিন্টু বসু লিখেছিলেন অথবা আরজ আলীর সাক্ষাৎকার প্রকাশ করেছিলেন। এগুলো সবকটি লেখাই পরে হাতে পেয়েছি। নাট্যকর্মী খায়রুল আলম সবুজের তৎপরতার কবি আসাদ চৌধুরী বাংলাদেশ টেলিভিশনে তার এক অনুষ্ঠানে আরজ আলীকে উপস্থাপন করেছিলেন। এগুলো জেনেছি পরে এবং ক্রমান্বয়ে। যাহোক এর পর টানা প্রায় ছয় বছর বরিশাল যাতায়াত। বরিশাল শহর থেকে লামচরি, নদীপথে। অনেকের সঙ্গে কথা, আলাপ, পরিচয়। পরিচয় হলো বরিশাল বিএম কলেজের দর্শনের অধ্যাপক কাজী আব্দুল কাদিরের সঙ্গে। একজন শুভ্র, øিগ্ধ, সাদাসিধে মানুষ। অতিশয় অমায়িক ও পাণ্ডিত্যের ভারে উন্নত এই মানুষটি আরজ আলী মাতুব্বরকে উদার ও অকৃপণ ভাবে সর্বতো সহায়তা করেছেন। হয়তো আরজ আলীর নিজেকে নির্মাণ করতে পারার পেছনে এই ভদ্রলোকের অবদান গরিষ্ঠভাগ।


জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে শুধু আপন বিশ্বাসই নয়, সকল মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া উচিত। সকল ধ্যান-ধারণা সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান লাভ করা দরকার প্রতিটি জ্ঞান পিপাসু মানুষের। শুধু সীমাবদ্ধ পরিমন্ডলে আবদ্ধ হলে চলেনা। সীমানাকে অতিক্রম করে যেতে হবে ক্রমান্বয়ে। এর মধ্যেই ক্রমশ অতিক্রম করা যাবে নিজেকে।

                                               -আরজ আলী মাতুব্বর

 


 চতুর্থ পর্ব
 সাহিত্য, সংস্কৃতি ও প্রশাসনের অনেক ব্যক্তির নিকট তাঁর সম্পর্কে খোঁজ-খবর। অতঃপর সিদ্ধান্ত নেয়া হলো আরজ আলীর জীবনী লেখার। কথা হলো বাংলা একাডেমীর তৎকালীন মহাপরিচালক ড, মাহমুদ শাহ কোরেশীর সঙ্গে। তিনি খুব স্বল্পকালের জন্য নিয়োগ পেয়েছিলেন বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক হিসেবে। এক ফেব্র“য়ারি থেকে আরেক ফেব্র“য়ারি এই এক বছর মাত্র তিনি এই দায়িত্বে নিয়োজিত হয়েছিলেন। নিযুক্তি পাবার পর তিনি দুটো বিষয় সামনে রেখে কাজ করে যাচ্ছিলেন। গতিশীলতা এবং বয়সে অপেক্ষাকৃত তরুণ লেখকদের বই প্রকাশ। ঘনিষ্ঠতার সুবাদে দ্বিতীয়োক্ত বিষয়টি আমার নিকট ব্যক্ত করে তিনি দ্রুত পাণ্ডুলিপি দিতে বললেন। আমি আরজ আলীর ব্যাপারটি বিবৃত করে মহাপরিচালক বরাবরে একখানি চিঠিও দিলাম। সম্মতি মিললো, তারা প্রকাশ করবেন জীবনী পুস্তক। এক সময় জীবনী পুস্তকের পাণ্ডুলিপি লেখা সমাপ্ত হলো। প্রকাশও হলো স্বল্পকালের মধ্যে। মহাপরিচালক জনাব মাহমুদ শাহ কোরেশীর ব্যক্তিগত উৎসাহে বইটি দ্রুত অনুমোদন ও সম্পাদনা লাভ করে ছাপাখানা থেকে বেরিয়ে এলো। ঠিক সে সময়ই বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক হাসনাত আবদুল হাই আরজ আলী মাতুব্বরের জীবনী লেখার উপকরণ সংগ্রহের জন্য আমাকে খোঁজাখুঁজি করছিলেন। তিনি আরজ আলী সম্পর্কে জেনেছিলেন সাহিত্য ও সঙ্গীত অন্তপ্রাণ অ্যাডভোকেট আলী নূর সাহেবের নিকট। প্রায় সমবয়সী এই বন্ধুযুগল পরস্পরকে মামা বলে সম্বোধন করেন। নিকটাত্মীয় কেউ না হলেও দূরাত্মীয় হলেও হতে পারে। আবার নাও হতে পারে। তবে দু’জনার বাড়ী একই জেলায়। দু’জনের মধ্যে সখ্য ভাব বেশ গভীর। একদিন দু’জনে ধানমন্ডির দু’নম্বরে গে্যঁটে ইনস্টিটিউটে মঞ্চায়িত সক্রেটিস নাটক দেখে ফেরার পথে নূর ভাই সক্রেটিস-তুল্য আরজ আলী মাতুব্বরের কথা হাসনাত ভাইয়ের নিকট উত্থাপন করেন। হাসনাত ভাই হতবাক!

বাংলাদেশে এমন একজন ব্যক্তি আমাদের অগোচরে থাকতে পারে, এতো ভাবনারও অতীত। নূর ভাইয়ের বয়ানের সঙ্গে হাসনাত ভাইয়ের বিস্ময় একাকার হবার এক পর্যায়ে হাসনাত ভাইয়ের উত্তেজিত ঘোষণাÑ এবার ঈদ সংখ্যায় তাঁর উপন্যাসের প্রধান চরিত্র আরজ আলী মাতুব্বর। এরপরই আমাকে খোঁজাখুঁজি।




আরজ আলীর জীবনী লিখেছি আমি, এটা নূর ভাই জানতেন। তিনিই হাসনাত ভাইকে আমার কথা বলেন এবং একদিন আমাদের দু’জনকে মুখোমুখিও করে দিলেন তার বাসায়। তারপর অসংখ্য দিন নূর ভাইয়ের লালমাটিয়ার বাসার বৈঠকখানায় আমরা বসেছি। এর অদূরে লালমাটিয়াস্থ আমার অপরিসর ডেরায়ও কয়েকদিন বসেছি। আবার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় অবধি অধ্যাপক মুহম্মদ শামসুল হকের নিকটও আমরা সদলবলে গিয়েছি। যথার্থ একজন গ্রন্থকীট এবং অতিশয় সজ্জন ও প্রগতি চিন্তার এই মানুষটি আরজ আলীকে উদার সহায়তায় সর্বতোভাবে ঋদ্ধ করেছেন। নিয়ামানুগভাবে বিষয়ওয়ারি পুস্তক নির্বাচন, সংগ্রহ ও আলোচনা এগুলো করেছেন তিনি পরম ঐকান্তিকতায়। আরজ আলীর উচ্চতা ও অসামান্যতা উপলব্ধি করে তিনি সহায়তায় মুক্তহাত প্রসারিত করেছিলেন। বস্তুত আরজের জ্ঞানচর্চার শৃঙ্খলা স্থাপনে শামসুল হকের অবদান অসামান্য। সৎ, জ্ঞানভুক ও নির্মল এই মানুষটি দীর্ঘদিন রোগে ভুগে প্রায় এক দশক আগে প্রয়াত হয়েছেন। ক্রমাগত আড্ডায় ও তথ্যাধারে তাঁর জুড়ি সত্যিই বিরল। আশঙ্কাজনকভাবে আমাদের সমাজে এমন মানুষের সংখ্যা ইদানীং কমে যাচ্ছে।


 পঞ্চম ও শেষ পর্ব
উপন্যাসখানি লেখা হলো। আরজের জীবনচর্যা ও দার্শনিক অবস্থান পর্যবেক্ষণ করে বিমুগ্ধ লেখক হাসনাত আবদুল হাই সীমাহীন দ্রুততায় জীবনীভিত্তিক উপন্যাস লিখে ফেললেন। এই ধারার উপন্যাসের তিনি সূচনা করেছেন শিল্পী এস এম সুলতানের জীবনচরিত অবলম্বনে রচিত উপন্যাস ‘সুলতান’-এর মাধ্যমে। ‘একজন আরজ আলী’ নামের একখনি উপন্যাস অতি দ্রুততায় নামিয়ে ফেললেন হাসনাত ভাই এবং শাহাদত চৌধুরী সম্পাদিত তৎকালীন সাপ্তাহিক বিচিত্রার ঈদ সংখ্যায় তা ছাপাও হয়ে গেল। অত্যন্ত সুলিখিত এবং আরজ-জীবনের খুব প্রাসঙ্গিক অংশগুলো উপন্যাসের মেজাজে অতিশয় মুনশিয়ানায় উপস্থাপন করে উপন্যাসটি রচিত।

প্রায় কাছাকাছি সময়ে বাংলা একাডেমী প্রকাশিত আমার রচিত জীবনী ও একজন আরজ আলী উপন্যাস প্রকাশিত হলো। দুটো পুস্তক খুব দ্রুত পাঠকনন্দিতও হলো এবং আরজ আলী মাতুব্বরের প্রতি মানুষের গভীর মনোযোগ আকর্ষণ করলো। নূর ভাই সবিশেষ আগ্রহ নিয়ে বইখানির প্রকাশনা অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রস্তাব করলে আমরা তাৎক্ষণিক উৎসাহী হয়ে উঠি। জাতীয় জাদুঘরের শিশু মিলনায়তনে কেবল প্রকাশনা অনুষ্ঠানের আয়োজন নয়, আরজ আলী মাতুব্বরের পরিবারের সদস্য ও আরজ আলী সান্নিধ্যধন্য বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সম্মিলনী হয়ে গেল। এতে শিল্পী আবুল কাসেম, সরদার ফজলুল করিম, অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, অধ্যাপক মুহম্মদ শামসুল হক প্রমুখসহ বেশ কয়েকজন স্মৃতিচারণের পাশাপাশি দার্শনিক তত্ত্বের আলোচনা করেছিলেন। হলভর্তি উপচে পড়া নিবিষ্ট শ্রোতা। সকলে তন্ময় হয়ে শুনেছেন, আরজ আলীকে শ্রদ্ধার সঙ্গে উপলব্ধিতে মনোযোগি হয়েছেন।
অনুষ্ঠানটির সংবাদ প্রকাশে দৈনিক জনকণ্ঠ সে সময় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। এখানে বিশেষত জনকণ্ঠ সম্পাদক বর্ষীয়ান সাংবাদিক তোয়াব খানের কথা উল্লেখ করতেই হয়। তাঁর ব্যক্তিগত আগ্রহে খুব গুরুত্বের সঙ্গে খবর এবং উপর্যুপরি কয়েকটি ফিচার ও পুস্তক আলোচনা প্রকাশিত হয়। তিনি শিল্পী শামসুদ্দীনকে দিয়ে আরজ আলীর একটি মনোজ্ঞ স্কেচ করান। তিনি পরে আমাকে মূল ডিজাইনটি দিয়েছেন ব্যবহারের জন্য এবং স্কেচটি রচনাবলী ও বিভিন্ন স্থানে বহুল ব্যবহৃত ও পরিচিত। এমনকি স্কেচটি অনুসরণে পোস্টারও ছাপা হয়েছে।




এ সকল উদ্যোগে ও তৎপরতায় এতো দ্রুতলয়ে আরজ আলীর নাম, তাঁর দর্শন তত্ত্ব তরুণ বয়সী লেখক ও পাঠকের মধ্যে তাঁর প্রভাব ছড়িয়ে গেল যে তা একরকম অবিশ্বাস্য। দুদশক আগের কথার বয়ান এটুকুই থাক।
আরজ আলী মাতুব্বরের সঙ্গে কিয়ৎকালীন ব্যক্তিগত পরিচয় ও তাঁর সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে ওঠার বিবরণ পাঠক সমীপে তুলে ধরার তাগিদ থেকে এই বিবরণের অবতারণা করা হলো। বর্তমান প্রজন্ম আরজ আলীকে জানার প্রাথমিক তৃষ্ণা মিটবে এ পুস্তকখানির মাধ্যমে। বর্তমান জীবনী গ্রন্থের সংক্ষিপ্ত সংস্করণ প্রথম বাংলা একাডেমী প্রকাশ করেছিল ১৯৯৩ সালে। দ্রুত নিঃশেষিত হওয়ায় ২০০১ সালে দ্বিতীয় সংস্করণ হয়েছে। তাও অনেক আগে ফুরিয়ে গেছে। অথচ নতুন প্রজন্মের পাঠকদের মধ্যে আরজ আলী সম্পর্কে রয়েছে অপার কৌতূহল। তাঁর জীবন এবং দর্শনের সঙ্গে পরিচিত হবার তাগিদ অনুভব করেন তারা। প্রজন্মের তাগিদ ও চাহিদা বিবেচনা করে বর্তমান সংস্করণ বর্ধিত কলেবরে প্রকাশ করা হলো। এই সম্প্রসারণকৃত সংস্করণ পাঠককে আরজ আলী অনুধাবনে আরো সহায়ক হবে বলে আমরা ধারণা করি। আরজ আলীর প্রতি যতোটা মনোযোগ ফেরানো যাবে ততটাই আমাদের সমাজ যুক্তিসিদ্ধ ও বিজ্ঞানমুখী হয়ে উঠতে পারবে। সেটাই তো আমাদের কাম্য।


লেখক:  আইয়ুব হোসেন, গবেষক ও সাংবাদিক

জয়দেব মুখোপাধ্যায় : চৈতন্য মৃত্যুরহস্যের কিনারা করতে গিয়ে প্রাণ দিয়েছিলেন যে গবেষক

জয়দেব মুখোপাধ্যায়ের যেন এক কিংবদন্তির নাম যার কথা অনেকেই শুনেছে , বহু মানুষই তাকে খুঁজে ফেরে কিন্ত তার ব্যাপারে বিশদে কেউ কিছু বলতে পারেনা...