Tuesday, July 7, 2020

জয়দেব মুখোপাধ্যায় : চৈতন্য মৃত্যুরহস্যের কিনারা করতে গিয়ে প্রাণ দিয়েছিলেন যে গবেষক



জয়দেব মুখোপাধ্যায়ের যেন এক কিংবদন্তির নাম যার কথা অনেকেই শুনেছে , বহু মানুষই তাকে খুঁজে ফেরে কিন্ত তার ব্যাপারে বিশদে কেউ কিছু বলতে পারেনা। শ্রী চৈতন্যের অন্তর্ধান রহস্য প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গেলে ঘুরে ফিরে বারবার উঠে আসে এই গবেষকের রহস্যময় মৃত্যুর কথা। মানুষটা গোটা জীবনটাই উৎসর্গ করেছিলেন এই রহস্য সমাধানের জন্য। তারপর দেখতে দেখতে তার মৃত্যুর পর ২৫ টা বছর পেরিয়ে গেল অথচ খুব অদ্ভুত ভাবেই ইন্টারনেট এই অসাধারণ মানুষটাকে নিয়ে আজও নীরব ! সমসাময়িক লেখাতে ‘আজকাল পত্রিকায়’ প্রকাশিত কুড়ি বছরের পুরনো এক প্রবন্ধ ছাড়া আর বিশেষ কোন সোর্সের উল্লেখ পাওয়া যায়না । খুব যত্ন করে কেউ বা কারা যেন এই মানুষটাকে বাঙালি জনমানস থেকে মুছে ফেলতে চেয়েছে । আজকালের মূল প্রবন্ধটা দুর্লভ এবং বিস্ফোরক তথ্যে ঠাঁসা । তাই স্থাপত্যের পক্ষ থেকে আজ মূল প্রবন্ধটাই টাইপ করে তুলে দেওয়া হল জনসমক্ষে ।


‘চৈতন্য খুনের’ কিনারা করতে গিয়ে খুন ?

লেখক – অরুপ বসু , শারদীয় আজকাল (বিশেষ সংখ্যা) ১৪০৭ , পৃষ্ঠা ৩৯২ 

আজকাল পত্রিকায় অরুপ বসুর লেখা আর্টিকেলের কভার (পুরনো সংবাদপত্রের প্রতিবেদনগুলো তারিখসহ উল্লেখ করা আছে)

এক
‘বিশ্ব যখন নিদ্রা মগন গগন অন্ধকার / কে দেয় আমার বীণার তারে এমন ঝঙ্কার’ । এ গান যখন লিখেছিলেন তখন রবীন্দ্রনাথের বয়স ঊনপঞ্চাশ । আর আটচল্লিশ বছর বয়সে চৈতন্য যখন বলছেন ‘গোবিন্দ বিরহে আমার কাছে মুহূর্ত হয় যুগের মতন সুদীর্ঘ । চোখে নেমে আসে ঘন বরষা । সমস্ত সংসার আমার কাছে হয়ে যায় শূন্য’। তখন তার মৃত্যু হয় । ১৫৩৩ খ্রিষ্টাব্দের ২৯ জুন । এখনও পর্যন্ত রহস্যাবৃত সেই মৃত্যু । খুন বা আত্মহত্যা যাই হোক, দেহটা গেল কোথায় ?
৪৬২ বছর বাদে এই সত্যের অনুসন্ধানে নেমে যখন প্রায় প্রমান করতে চলেছেন চৈতন্যকে কিভাবে কারা খুন করেছিল এবং দেহ কোথায় পুঁতে দিয়েছে , ঠিক তখনই মৃত্যু হল সত্যান্বেষী ডঃ জয়দেব মুখোপাধ্যায়ের, ১৯৯৫ সালের ১৭ এপ্রিল । ৫ বছর বাদেও জয়দেববাবুর মৃত্যু রহস্যাবৃত । স্থানীয় লোকেরা যাকে সরাসরি খুন বলে সন্দেহজনক ব্যক্তির শাস্তি চায়, সরকারি খাতায় তাকেই আত্মহত্যা বলে দেখানো হয়েছে ।
জয়দেববাবু ও তার মা বিমলা মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যুর যদি সঠিক কিনারা হয়, তাহলে বহু মূল্যবান নথি উদ্ধার হবে, এমনকি চৈতন্য মৃত্যুর রহস্যজালও উন্মোচিত হবে । তাই আমরা একটু খননকাজ চালিয়ে দেখি, জয়দেববাবু কে ? কীভাবে তার মৃত্যু হয়েছিল , তা নিয়ে সরকারি তদন্তই বা কতটুকু এগিয়েছিল ।
দুই
১৯৯৬ সালে কলকাতায় জয়েদেববাবুকে নিয়ে একটি তদন্তমূলক নাটক দেখি । তার আগে একটি গল্প পড়ি । কোথাও স্পষ্ট করে কিছু বলা ছিল না । কিন্ত ইঙ্গিত ছিল ।
১৯৯৫ সালের কাগজগুলো উল্টেপাল্টে দেখি । দু-চার লাইনের একটা খবর বেরিয়েছিল বটে – ‘পুরীতে বাঙালি গবেষকের রহস্যময় মৃত্যু । পুরীর আনন্দময়ী মার আশ্রমে এক বাঙালি গবেষক ডঃ জয়দেব মুখোপাধ্যায় ও তার মা বিমলা মুখোপাধ্যায়কে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে । স্থানীয় মানুষের ধারনা এটা খুন । পুলিস তদন্তের কাজ শুরু করেছে’ ।
অতঃপর সংবাদমাধ্যম নীরব । কোনও ফলোআপ স্টোরি নেই । অথচ এক বছরেরও বেশি সময় পার হয়ে গেছে । সন্দেহ গভীর হল । এটা যে কোন চক্রের কাজ তাতে আর কোন কিন্ত নেই ।
প্রথমেই চৈতন্যের মৃত্যুরহস্য নিয়ে পড়া শুরু করলাম । সাম্প্রতিককালের সব গবেষকের লেখাতেই উঠে এল একটি নাম । জয়দেব মুখোপাধ্যায় । তিনিই নাকি পারেন মুশকিল আসান করতে ।
হাতে এল একটি বই । জয়দেববাবুর লেখা ‘কাঁহা গেলে তোমা পাই’ । উপন্যাসের আঙ্গিকে লেখা চৈতন্যের সমাধির খোঁজে একটি তদন্তমূলক গ্রন্থের প্রথম খণ্ড । চৈতন্যের সমাধি কোথায় হয়েছিল এখনও পর্যন্ত তা অজ্ঞাত । গ্রন্থের শুরুতে জয়দেববাবু লিখেছেন , পুরীর ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের কর্মসচিব স্বামী অভিনবানন্দজি এক পত্র লিখে তাকে জানিয়েছেন যে, তার সুনিশ্চিত ধারনা, মহাপ্রভুর দেহটিকে মনিকোঠার রত্নবেদীর নিম্নেই সমাহিত করা হয়েছিল । একই কথা বলেছেন ডঃ দীনেশচন্দ্র সেন, যিনি প্রথম স্পষ্ট করে বলেছিলেন পুরীর মন্দিরের ভেতর চৈতন্যকে খুন করে পুঁতে ফেলা হয়েছে । ‘Chaitanya and His Age’ গ্রন্থে লিখেছেন,
‘This they did to make time for burying him within the temple. If he left the world at 4 pm, the doors, windows were kept closed till 11 pm.  This was taken for burying him and repairing the floor after burial. The priest at 11 pm opened the gate and gave out that Chaitanya was incorporated with the image of Jagannath.’
একই কথা জানা যায় হালে আবিষ্কৃত প্রত্যক্ষদর্শী বৈষ্ণব দাসের পুঁথি ‘চৈতন্য চকড়া’ থেকে । ‘রাত্রি দশ দণ্ডে চন্দন বিজয় যখন হল, তখন পড়িলা প্রভুর অঙ্গ স্তম্ভ পছ আড়ে’ । দশ দন্ড মানে রাত এগারোটায় তিনি গড়ুর স্তম্ভের কাছে চৈতন্যের মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখেছিলেন।
কাঁহা গেলে তোমা পাই এর প্রধান চরিত্র আনন্দ (জয়দেববাবু) । উপন্যাসের মাঝামাঝি জায়গায় আনন্দকে প্রভুজি বলেছেন, চৈতন্য মৃত্যু রহস্যের কিনারা, তার সমাধির খোঁজ করতে গেলে এই পুরীতেই খুঁজতে হবে । যেখানে চৈতন্য জীবনের শেষ এবং মূল্যবান ১৮ বছর কাটিয়েছেন । ১৫১০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি পুরীতে আসেন । ১৫৩৩ খ্রিস্টাব্দে মারা যান । মাঝে কয়েকটা বছর দাক্ষিণাত্যে কাটিয়েছেন মাত্র ।
সমসাময়িক চরিতকারদের সাহায্য নিয়ে সুকুমার সেন ‘চৈতন্যাবদান’ গ্রন্থের শেষে লিখলেন, ‘দিব্যোন্মাদের সময় তার চিত্তকে সুস্থতায় ফিরিয়ে আনতেন , শেষ বয়সে তার দুই প্রধান সহচর – রামানন্দ রায় ও স্বরুপ দামোদর । দিব্যোন্মাদের চরম অবস্থায় কোনরকম বাহ্যজ্ঞান থাকত না । তাকে রাত্রিকালে রক্ষা করতে সঙ্গীদের প্রায়ই সারা রাত্রি জেগে থাকতে হত ।
১৫৩৩ খ্রিষ্টাব্দের ২৯ জুন চৈতন্য গান গাইতে গাইতে পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে ঢুকেছিলেন । সেই প্রথম আর শেষ মাত্র কয়েক ঘণ্টার জন্য পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের দরজা বন্ধ ছিল । তারপর চৈতন্যকে আর পাওয়া যায় না । এই ব্যাপারে বেশিরভাগ চরিতকার একমত ।
সেই সময় স্বরুপ দামোদর ভেতরে ছিলেন । তাকেও মৃত অবস্থায় পাওয়া যায় এবং উধাও হয়ে যায় তার লেখা পুঁথি চকড়া বা কড়চা ।
জয়দেববাবু বলতেন স্বরুপ দামদরের সেই নিখোঁজ পুথিটি তিনি আবিষ্কার করেছেন। শুধু তাই নয় তার সময়ের আরও বহু খ্যাত অখ্যাত বাঙালি ও ওড়িয়া লেখকের পুঁথি তিনি পেয়েছেন । তার জোরালো দাবী ছিল, আর কিছুদিনের মধ্যে তিনি প্রমান করে দেবেন চৈতন্য খুন হয়েছিল কোথায়, কখন , কীভাবে । এই সবই পাওয়া যাবে “কঁহা গেলে তোমা পাই” এর দ্বিতীয় খণ্ডে । প্রথম খণ্ডের শেষ দিকে প্রভুজির ভ্রাতুষ্পুত্রী বিদুষী মাধবী আনন্দকে বলেছেন, ‘সে জায়গাটা আমিই দেখিয়ে দিতে পারি তোমাকে, যদি অবশ্য একটি শর্ত রক্ষা করতে রাজী হও তুমি’ ।
কথা হচ্ছে টোটো গোপীনাথ মন্দিরের সামনে কাঁঠাল গাছের মত দেখতে পলাং গাছের ছায়ায় । তার মানে কি টোটো গোপীনাথের মন্দিরেই চৈতন্য সমাধিস্থ ? শোনা যায় টোটো গোপীনাথের দেওয়ালে এক সময় মানুষ মাথা খুঁটত । বিশ্বাস ছিল চৈতন্যের কঙ্কাল সেখানে পোঁতা আছে । বছর পঞ্চাশ আগে প্রবাসীতেও এরকম একটা খবর বেরিয়েছিল । তাছাড়া বিশিষ্ট ওড়িয়া পণ্ডিত সদাশিব রঘুশর্মার স্থির বিশ্বাস, টোটো গোপীনাথ মন্দিরের উঠোনে যে দুটি তুলসী মন্দির আছে, তার অপেক্ষাকৃত প্রাচীন মন্দিরের নিচে চৈতন্যকে সমাধিস্থ করা হয়েছিল । ‘কঁহা গেলে তোমা পাই’ এর শেষে দেখেছি, প্রভুজি আনন্দকে চিঠি দিয়েছেন, ‘আর মাত্র দশদিন’ । রাজমহেশ্বরী থেকে ফিরলেই সব প্রশ্নের জবাব পাওয়া যাবে। রাজমহেশ্বরী পুরীর কাছেই তৎকালীন একটি প্রদেশ, যার শাসক ছিলেন চৈতন্যভক্ত রায় রামানন্দ ।
এই দশদিন আর শেষ হয়নি । দ্বিতীয় খণ্ডের পাণ্ডুলিপি প্রকাশকের ঘরে পৌঁছানর আগেই জয়দেববাবুর মৃত্যু হয় ।
তিন
পুরীর স্বর্গদ্বার , চৈতন্য চক বা চৈতন্য মোড় । পাঁচশো বছর বাদে পুরীতে প্রথম চৈতন্যমূর্তি স্থাপিত হয় জয়দেববাবুর উদ্যোগেই । উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এসেছিলেন রাষ্ট্রপতি জৈল সিং এবং কেন্দ্রীয় মানবাধিক কমিশনের চেয়ারম্যান  রঙ্গনাথ মিশ্র । উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে জয়দেববাবু বলেছিলেন, ‘যে কারণে মহাপ্রভু অন্তর্ধানের পর পঞ্চাশটি বছর উৎকল এবং বঙ্গের বৈষ্ণবমণ্ডলী নিদারুন আতঙ্কে স্তব্ধ করে রেখেছিল নিজেদের পরমপ্রিয় নাম সংকীর্তনকে, ঠিক সেই কারনেই চৈতন্যদেবের উপর লেখা প্রায় সমস্ত গ্রন্থেই ইচ্ছে করেই এড়িয়ে গেছে চৈতন্য তিরোধানের শেষ মুহূর্তের দৃশ্য বর্ণনাকে’।
স্বর্গদ্বারের ডানদিকে শ্মাশান ছাড়িয়ে আরো কিছুদূর গেলে, মীনাক্ষী হোটেল, তার পাশে ট্রাভেলিং এজেন্ট কার্তিক দাসের দপ্তর । পাশে একটা সরু গলি সমুদ্রের দিকে নেমে গেছে । গলির শেষে আনন্দময়ীর আশ্রম বাড়ি। কিন্ত গলির মাঝামাঝি গেলেই ডান হাতে ছোট দরজা । দরজা দিয়ে ঢুকলেই উঠোন । বাঁদিকে বিশাল আশ্রমবাড়ি । ডানদিকে দুটো ঘর , বারান্দা , চাতাল । চাতালের একদিকে দুটো অগভীর চৌবাচ্চা ।

‘… ঐ চৌবাচ্চার মধ্যেই দাদুর দেহটা পড়েছিল । ভেতরে মাথা , বাইরে পা । ভেতরে আধ চৌবাচ্চা জল । মাথাটা পুরো জলে ডোবা ছিল’ । অনন্দময়ী আশ্রমের দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে কথাগুলো বলছিলেন কার্তিক দাস। ‘এখানে সবাই জয়দেববাবুকে দাদু বলে ডাকত’ । যার যা বিপদ , যার যা সমস্যা – সব ব্যাপারেই দাদুর কাছে আসত । কত বেকার ছেলেকে দাদু চাকরি জুটিয়ে দিত , ব্যবসার জন্য ব্যাঙ্ক লোনের ব্যবস্থা করে দিত, গরিব মেয়ের বিয়েতে সাহায্য করত ।  দাদু রাস্তা দিয়ে হাঁটলে ভিড় জমে যেত । কত নামীদামী লোক দেখা করতে আসত’।

‘কি যেন একটা বই লিখছিলেন দাদু। চিঠিতে টেলিগ্রামে হুমকি দিত । পুলিসকেও জানিয়েছিল দাদু । ভয় পেত না দাদু । বলত এত মানুষ ভালোবাসে, গুণ্ডারা মেরে গেলেই হল’ !
‘সেদিন, কালুর মাকে চেনেন তো, নীলমণি প্রধান, ওর মেয়ে দাদুর ঘরদোর পরিষ্কার করে দিত । রান্না করে দিত। সকালে এসে দেখছে , দরজা বন্ধ । ধাক্কালেও খুলছে না । দাদু তো অনেক সকালে ওঠে’।
‘মেয়েটি কালুর মাকে , আমাকে ডেকে আনে’ ।
‘পাঁচিলে উঠে দেখি ঐ দৃশ্য । মাথা চৌবাচ্চায় , পা বাইরে , হাত দুটো পিছন দিকে দড়ি দিয়ে বাঁধা। ঘরের দরজা খোলা। খাটের তলায় মেঝেতে দাদুর মা উপুড় হয়ে পড়ে আছে । মুখ দিয়ে গাঁজলা বেরোচ্ছে’।
‘লাফিয়ে নামলাম । আরও অনেকে এল । তখনও জ্ঞান আছে দাদুর মার । ঘরের মধ্যে ঘুমের ওষুধের ছেঁড়া রাংতা । ইংরেজিতে লেখা দুটো সুইসাইড নোট । আর প্রচুর বই , প্রাচীন পুঁথি – সব লন্ডভণ্ড করা’ ।
কার্তিকবাবুর সাথে আনন্দময়ী আশ্রমে দাঁড়িয়ে এসব কথা হচ্ছিল । জয়দেববাবুর মৃত্যুর দেড় বছর বাদে। ১৯৯৬ সালের ২৮ অক্টোবর ।
গলির মুখে একটা পানের দোকান । নীলমনির স্বামীপরিত্যক্তা কন্যার দোকান । নীলমণির সাথে কথা হচ্ছিল , জয়দেববাবুই দোকান করতে সাহায্য করেছেন । বেঁচে থাকতে রোজ কত মানুষ আসত । রাজীব গান্ধীকেও দেখেছি আসত ! সেই মানুষটিকে যখন দাহ করতে আনল , ভয়ে কেউ শ্মশানে গেল না ! পুলিশ দাহ করে দিয়ে চলে গেল । আর ঘরের সব বইপত্র নিয়ে কোথায় গেল, কে জানে ! বলতেন মহাপ্রভুর শেষটা বড় কষ্টের । কারা কষ্ট দিয়েছিল , তাদের নাম ফাঁস করে দেব । সব পুঁথি পেয়েছি । পুজোর সময় গরীবদের কাপড় দিতেন । প্রসাদ খাওয়াতেন । কোত্থেকে টাকা পেতেন , কে জানে’ !
১৭ এপ্রিল মারা যান জয়দেববাবু । তার মা বিমলাদেবী মারা যান তিনদিন পর ২০ এপ্রিল । এই তিনদিনে কি তাকে বাঁচানোর চেষ্টা হয়েছিল ? তার কাছ থেকে তো অনেক কিছু জানা যেত !
‘বাঁচানো ? দাদুর মাকে মেরে ফেলা হয়’।
বললেন কার্তিকবাবু । পুরী হাসপাতালে বিনা চিকিৎসায় ফেলে রেখেছিল । এখানকার লোকেরা চেঁচামেচি করায় তাকে কটক মেডিকেল কলেজে সরিয়ে দেওয়া হয় , কী না, সেখানে ভাল চিকিৎসা হবে’ ।
চার

‘আনন্দময়ী আশ্রমের তপন মহারাজ বললেন, জয়দেব মুখোপাধ্যায় খুন হয়েছিলেন । খুন হওয়ার দিনই আগরতলা , হরিদ্বার , উত্তর কাশী , কংখল – সব আশ্রমেই খবর গেছিল । আশ্চর্য , কেউ আর যোগাযোগ করেনি ।’

তপন মহারাজ অরফে গোপালানন্দ ওরফে তপন ব্যানার্জি । কলকাতার বরানগরের ছেলে । অনাথ । সাধুসঙ্গে পড়ে আনন্দময়ী মার শিষ্য । উত্তর কাশীর আশ্রম তিনিই দাঁড় করিয়েছেন । ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে পুরীর আশ্রমের দায়িত্বে তিনি । সংস্কারের কাজ চলছে । জয়দেববাবুর ঘর দুটো বন্ধ ।
তপন মহারাজ বললেন, আমাকে এখানে আসার আগে বলা হয়েছে, ওসব নিয়ে মাথা ঘামাবে না । অথচ ১৯৭৫ সাল থেকে জয়দেববাবু এই আশ্রমের দায়িত্বে । আমাকে বলা হয়েছে তিনি শিষ্য ছিলেন না । অথচ এই আশ্রমের দায়িত্বে তিনিই ছিলেন । এবং সেটা মার নির্দেশে ।
১৯৯৬ সালের ২৯ অক্টোবর । তখন দুপুর । কথা বলতে বলতে তপন মহারাজ দরজা বন্ধ করে দিয়ে এলেন । বললেন ১৯৮২ সালে মা এখানে আসেন । মা ওনাকে স্নেহ করতেন । জানতেন উনি পণ্ডিত , ভাষাবিদ । ওনার গবেষণার বিষয় চৈতন্যের অন্তর্ধান । মা কিন্ত নিষেধ করেছিলেন । বলেছিলেন, ‘যা বলছ, তা হয়তো ঠিক । কিন্ত মনে হচ্ছে বিপদে পড়বে । এতদিন যখন কেউ কিছু করেনি , তুমি একা কেন বিপদের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ছ ?’
এসব শোনার পর কংখলে ফোন করি । স্পষ্ট করে বলে দেওয়া হয় যে জয়দেববাবু আশ্রমের কেউ ছিলেন না।
আশ্রমের কেউ নন অথচ ২০ বছর ধরে আশ্রমের সেক্রেটারি ! সাগর তীরে আশ্রমের জমি পাণ্ডারা দখল করবে বলে লড়াই করছেন ?
বালানন্দ তীর্থাশ্রম । ভারপ্রাপ্ত কর্তার নাম গোকুলানন্দ । দেওঘরে ছিলেন । কংখলে আনন্দময়ী মাকে দেখেছেন । ইংরেজি , হিন্দি , বাংলা , ওড়িয়া ভালো বলেন । পুরীতে এর আগে বছর কয়েক থেকে গেছেন । ফের এসেছেন ১৯৯৫ সালের এপ্রিলেই । জয়দেববাবুর প্রসঙ্গ তুলতেই – ‘ও সেই ভদ্রলোক ! শুনেছি বটে চৈতন্য নিয়ে কি সব কাজ করছিলেন । ছেলেবেলায় শুনেছি, সমুদ্রের জলে মিলিয়ে গেছেন । আত্মহত্যা । বড় হয়ে নতুন করে জানলাম পাণ্ডারা খুন করেছিল । আমরা ধর্মকর্ম নিয়ে থাকি । এসব নিয়ে মাথা ঘামাই না । জয়দেববাবু তো গৃহী ছিলেন । দুর্ঘটনায় মারা গেছেন’ ।
দুটো আশ্রমের মধ্যে দূরত্ব দশ মিনিটের হাঁটা পথ । যা নিয়ে সে সময়ে পুরী তোলপাড়, তা নিয়ে গোকুলানন্দের নিরাসক্ত এবং ‘গৃহী’ মন্তব্যটির মধ্যে যে খোঁচা, তা গভীর চক্রান্ত এবং পরিকল্পিত খুনের ইঙ্গিত দেয় নাকি ?
পাঁচ












































জয়দেববাবু কলকাতার ভোলানাথ প্রকাশনীর সুরেশ দাস’কে লেখা শেষ চিঠিতে কিছুদিন ধৈর্য ধরার জন্য
 অনুরোধ করেছিলেন । তথ্যসূত্র – ক্ষ্যাপা খুঁজে ফেরে (দ্বিতীয় খণ্ড) ।

ঝাড়গ্রামে গিয়ে দেখা করি ঝাড়গ্রাম বার্তার সম্পাদক সুরেশচন্দ্র ভকতের সাথে । মায়ের শিষ্য । আনন্দময়ী মায়ের কথাতেই ‘কঁহা গেলে তোমা পাই’ ছেপেছেন । বললেন ‘জয়দেববাবু একবার এখানে অজ্ঞাতবাসে ছিলেন। সঙ্গে মা বিমলা । বেনারসের পাথু মহারাজ বলেছেন, ওনাকে খুন করা হয়েছে চৈতন্য গবেষণার জন্যই । সুরেশ তুমি আর পুরীতে যেও না’ । ছেলে চিত্তরঞ্জনের টাটা কলেজে পড়ে । গেছিল পুরীতে । তখন জয়দেববাবু মারা গেছেন । ভারত সেবাশ্রমের মহারাজ চিত্তকে বলেছিল বাবা যেন এদিকে না আসে ।
সুরেশবাবু বললেন, অনেক প্রাচীন পুঁথি আর দ্বিতীয় খণ্ড বইয়ের পাণ্ডুলিপি মে মাসেই আমাকে দেবেন বলেছিলেন । বলতেন গৌরস্তম্ভের তলায় চৈতন্যকে পুঁতে ফেলেছিল । অনেকেই ওনাকে উৎসাহ দিতেন । বেনারসে , কংখলে , ত্রিগুনা সেন , হরেকৃষ্ণ মহতাব আর রামকৃষ্ণ মিশনের মহারাজেরা তাকে উৎসাহ দিতেন।
শুনেছি জয়দেববাবুরা ঢাকার লোক । বাবা সি আই এস ছিলেন । নিজে কেন্দ্রীয় তথ্য দপ্তরে ছিলেন । বলতেন, দ্বিতীয় খণ্ড প্রকাশের পর সব পরিচয় জানিয়ে দেব।
অজ্ঞাতবাসের সময় ঝাড়গ্রামে সরস্বতী বৈজনাথ কেডিয়া স্কুলে থাকতেন । লালজলের কাছে জঙ্গলের কাছে একটি আশ্রমেও যেতেন ।
‘লালজল, জঙ্গলের মধ্যে এক দুর্গম আশ্রম । আদিবাসীরা আমাকে বলেছিল, এক সাধুবাবা বাগালদের প্রশ্ন করতেন, এইরকম কোন পাথর দেখেছ ?  কোন পাথরের কোনও চিহ্ন দেখেছ’?
শোনা যায় চৈতন্য এদিকে এসেছিলেন এবং পাথরের গায়ে নানারকম খোদিত চিহ্নও দেখা যায়। জয়দেববাবু ঝাড়গ্রামে কতটা কি পেয়েছিলেন জানা যায়নি । তবে সুরেশবাবুর কথায় এটা স্পষ্ট জয়দেববাবু যে খুন হয়েছেন, ভারত সেবাশ্রমের মহারাজ সেটা টের পেয়েছেন। আর পুরীতে গেলে গুরুত্বপূর্ণ নথি ও পাণ্ডুলিপির জন্য সুরেশবাবুকেও খুন করতে পারে তারা !
ছয়
সার্কিট হাউসে উঠেছিলাম । সেখান থেকে কোনওদিন কটকে যাই ডিআইজি ক্রাইমের সাথে কথা বলতে , কোনওদিন পুরীর এসপি । একদিন সার্কিট হাউসে ফিরে দেখি একজন পুলিস অফিসার আমার জন্যই অপেক্ষা করছেন। বললেন একটা বড় ভালো কাজে হাত দিয়েছেন । ঠিক পথেই এগোচ্ছেন । কলকাতার সিবিআই এর এসপি (স্পেশাল ক্রাইম ব্রাঞ্চ) লোকনাথ বেহরার সাথে কথা বলুন । ওর মা ক্ষুব্ধ । জয়দেববাবুর ভক্ত ছিলেন । এখানকার পুলিস আত্মহত্যা বলে চালাচ্ছে । আর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফিরে যান । পরে সঙ্গে লোক নিয়ে আসবেন । একা ঘুরবেন না ।
পরদিন কটকে গিয়েই বুঝলাম , অজ্ঞাত পরিচয় পুলিস অফিসারটি ঠিক বলেছেন । আই জি ক্রাইম যিনি ঘটনার সময় পুলিসের এসপি ছিলেন, একজন ইন্সপেক্টরকে ডাকলেন । তিনি আমার প্রশ্ন না শুনেই বললেন, ওটা তো আত্মহত্যা । ডিসেম্বরে ফাইল ক্লোজ করে দেওয়া হয়েছে ।
– আত্মহত্যা কেন করবে ?
-টাকার অভাব । পাস বইয়ে দেখলাম, টাকা তেমন ছিল না । তাছাড়া ঐ ভদ্রমহিলার সঙ্গে তো অবৈধ …
-আত্মহত্যা যিনি করেছেন তার হাত পিছন থেকে বাঁধা !
১৯৯৬ সালের অক্টোবরে যিনি আই জি ক্রাইম ছিলেন তিনি এবার বেশ ক্ষুব্ধ ! ‘আপনার এ নিয়ে এত মাথাব্যাথা কেন ? ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞ প্রফেসর রত্নাকর দাস বডি দেখে এটাকে আত্মহত্যা বলেছেন । কয়েক বস্তা বই , পুঁথি , রঙ্গনাথ মিশ্রকে লেখা চিঠি পেয়েছি ; দেখি কি করা যায়’।
কটক মেডিকেল কলেজের ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞ ডঃ রত্নাকর দাস বললেন, ‘দেহ আমি দেখিনি’। কয়েকটা ছবি আমাকে দেখানো হয়েছিল । আত্মহত্যা আমি বলিনি । আমি এখানে থাকি । চাকরি করি । যা বলার তাই বলেছি’ । 
সাত
ধরে নিলাম, বিমলাদেবী জয়দেববাবুর মা নন । ধরে নিলাম, পিছন দিকে হাত বেঁধে, ঘুমের ওষুধ খেয়ে মুণ্ডিতমস্তক সন্ন্যাসী জয়দেববাবু চৌবাচ্চার জলে মাথা ডুবিয়ে আত্মহত্যা করেছেন । কিন্ত সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি এবং কেন্দ্রীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান রঙ্গনাথ মিশ্র এবং রাষ্ট্রপতিকে লেখা চিঠি, ২৫ বছরের পরিশ্রমে আবিষ্কৃত দুর্লভ পুঁথি , জয়দেববাবুর পাণ্ডুলিপি হজম করার অধিকার পুলিসকে কে দিল ?
১৯৭৬ সালের ৫ ই আগস্ট জয়দেববাবুকে লেখা ডঃ নীহাররঞ্জন রায়ের চিঠিতে আছে,
‘চৈতন্যদেবকে গুম খুন করা হয়েছিল পুরীতেই এবং চৈতন্যদেবের দেহের কোন অবশেষের চিহ্নও রাখা হয়নি কোথাও। এবং তা হয়নি বলেই তিনটে কিংবদন্তী প্রচারের প্রয়োজন হয়েছিল । …এই বয়সে শহীদ হবার ইচ্ছে নেই বলেই বলতে পারবো না ঠিক কোথায় চৈতন্যকে খুন করা হয়েছিল’ ।
আর তা বলতে গিয়েই শেষ পর্যন্ত জয়দেববাবু জীবন দিলেন । ১৫৩৩ সালে চৈতন্য , ১৯৯৫ সালে জয়দেব । এর কোনও প্রতিকার নেই ? পৃথিবী কি একবিন্দু এগোয়নি ?

উপরের আর্টিকেলটার সমস্ত স্বত্বাধীকারি হল আজকাল পত্রিকা এবং লেখক তথা অবসরপ্রাপ্ত সাংবাদিক অরুপ বসু। কালের ধ্বনি কোনভাবেই এই লেখার কোনরকম স্বত্ব দাবী করেনা । জয়দেব মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যু সম্পর্কিত একমাত্র প্রামাণ্য লেখা এবং মূল সোর্স হিসেবে , কুড়ি বছর আগে প্রকাশিত শারদীয় আজকাল পত্রিকায় প্রকাশিত এই লেখাটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক দলিল। অরুপ বসুই একমাত্র সাংবাদিক যিনি সেসময় প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে খোদ পুরীতে গিয়ে ঘটনাটা কভার করেছিলেন ; যার জন্য তাকে অশেষ কৃতজ্ঞতা জানাই ।  

সত্যি বলতে কি , প্রবন্ধটা পড়ে কিছুক্ষন স্তব্ধ হয়ে বসে থাকতে হয় । গোটা ঘটনাটাকে অন্তঃকরণ করতে বেশ কিছুটা সময় লাগে ।
জয়দেব মুখোপাধ্যায়ের জন্ম হয়েছিল ১৯৩০ এর দশকের শেষের দিকে বোলপুরে । সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান ছিলেন ; বাবা এবং দাদামশাই , দুজনেই ছিলেন বিচারপতি। দুর্গাপদ চট্টোপাধ্যায় তার বইয়ের ভূমিকায় লিখেছিলেন যে জয়দেববাবু ছিলেন আই.সি.এস পিতার একমাত্র সন্তান । তিনি প্রাচ্য দর্শনের উপর ডক্টরেট করেন এবং ভারতীয় সভ্যতার শেকড় খুঁজতে একসময় এশিয়ার বহু দেশে ঘুরেছিলেন । শিবের ঐতিহাসিকতা বিষয়ে গবেষণা করার জন্য বহুবার প্রাণ বিপন্ন করে কৈলাসের মানস সরোবর এবং সংলগ্ন বরফে ঢাকা পাহাড়ের আনাচে কানাচে খুঁজে বেড়িয়েছেন । একাধিক ভাষা জানতেন এবং প্রাচীন সাহিত্য , সংস্কৃত এবং শাস্ত্রজ্ঞানের জন্য তিনি একাডেমিক সার্কেলে অত্যন্ত পরিচিত ছিলেন সেসময় । জগন্নাথদেবকে নিয়ে তার লিখিত বইগুলো এখনো বেস্টসেলার । কিছু বই অবশ্য এখন আর খুঁজে পাওয়া যায়না , কিছু তিনি সম্পূর্ণ করে যেতে পারেন নি । ভদ্রলোক সমস্ত সুখ ঐশ্বর্য ত্যাগ করে একদমই সাধারন দীনহীনের মত জীবন যাপন করতেন । দুঃখের বিষয় হল , গোটা মানুষটার অস্তিত্বটাকেই আজ এমন ভাবে ‘ভ্যানিশ’ করে দেওয়া হয়েছে যে তার একটা ছবিও আর খুঁজে পাওয়া যায়না ইন্টারনেটে ! ক্ষ্যাপা খুঁজে ফেরে গ্রন্থের দ্বিতীয় সংস্করণের ভূমিকায় প্রকাশক সুরেশ দাস ১৯৮৯ সালে কলকাতা থেকে লিখেছেন যে ১৯৭৮ সালে প্রথম পর্ব প্রকাশিত হবার পর কথাসাহিত্যিক সমরেশ বসু এবং পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী ডঃ শান্তি কুমার দাশগুপ্তের সাথে তার ঘনিষ্ঠতা হয় । জয়দেববাবুর সাথে পরিচয় হবার পরই এনারা এই বিষয়ে বই লিখেছিলেন। আশ্চর্যের ব্যাপার হল , সুরেশ দাস সেই ১৯৮৯ সালে লিখেছিলেন যে ‘কাঁহা গেলে তোমা পাই’ এর দ্বিতীয় খণ্ড রচনা প্রায় সম্পূর্ণ করে ফেলেছেন জয়দেববাবু এবং এর জন্য তিনি বাংলা ও উড়িষ্যার প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে চৈতন্যের সমসাময়িক বহু প্রাচীন পুঁথিও আবিষ্কার করেছিলেন। এর বছর ছয়েক বাদে তার রহস্যমৃত্যু ঘটে । 

জয়দেব মুখোপাধ্যায়ের লেখা তিনটি বিখ্যাত গ্রন্থ (কাঁহা গেলে তোমা পাই , দারুব্রহ্ম রহস্য এবং ক্ষ্যাপা খুঁজে ফেরে )

তার মৃত্যুর পর বেশ কিছু গুজব রটানো হয়েছিল । পুলিস বলেছিল আত্মহত্যা আবার কেউ কেউ দাবী করেছিলেন যে মন্দিরের জমি সংক্রান্ত বিবাদের কারণেই তাকে খুন করা হয় । একটা ব্যাপার খুব আশ্চর্যজনক যে এরকম একটা অসাধারণ মানুষ, বহুবার হুমকি পেয়েও কেন তার বইয়ের দ্বিতীয় পর্বের একাধিক পাণ্ডুলিপি বানিয়ে যান নি ?
এই নিয়েও কিছু গল্প প্রচলিত আছে । দু-একজন দাবী করেছিলেন যে জয়দেববাবু নাকি একাধিক পাণ্ডুলিপি আলাদা আলাদা ভাবে কপি করে রেখেছিলেন এবং মৃত্যুর আগে তার ঘনিষ্ঠ কিছু মানুষকে পাঠিয়ে যান । আবার কেউ বলে যে পাণ্ডুলিপি সহ সমস্ত প্রাচীন পুঁথি এখনো সিবিআই কিম্বা উড়িষ্যা পুলিসের গোপন লকারে জমা করা আছে । কেউ বলে সেই পাণ্ডুলিপির ছেঁড়া কয়েকটা পাতা বহুদিন বাদে পুরীর সমুদ্রসৈকতে পাওয়া গিয়েছিল । আবার একজন সাংবাদিককে ফেসবুকে দাবী করতে দেখলাম যে এই বইটা আজও ক্লাসিফায়েড ডকুমেন্ট হিসেবে ভুবনেশ্বর মিউজিয়ামের ভল্টে রাখা আছে। জয়দেববাবু সাবধানতা অবলম্বন করার জন্য অন্য শিরনাম ব্যবহার করে বইটা লিখেছিলেন । তবে এই নিয়ে বিশদে কিছু বলা সম্ভব নয় কারণ পুরোটাই কিংবদন্তী বা মিথের মত ভেসে বেড়ায় ! জয়দেববাবুর মৃত্যুর খবর – যুগান্তর পত্রিকা ( আনন্দময়ী আশ্রমে রহস্যজনক মৃত্যু – ১৯.৮.১৯৯৫) , The Telegraph (Diary entry hints at dispute over property : New Twist to Puri Death – 30.4.1995) এবং The Statesman (Death of two ashram-dwellers baffle Police in Puri – 28.4.1995) পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল । আগ্রহীরা খুঁজে দেখতে পারেন । আমি এত পুরনো পেপার জোগাড় করতে পারিনি ।
জয়দেববাবুর মৃত্যুর বছর পাঁচেক বাদে ২০০০ সালের ১৫ই জুন (তারিখটা দুচারদিন আগে পরে হতে পারে । জোর দিয়ে কেউ বলতে পারেনি)  , আনন্দবাজার পত্রিকার পাঁচ নম্বর পাতায় একটা খবর প্রকাশিত হয়েছিল । সেখানে লেখা ছিল যে ASI জগন্নাথ মন্দিরের সংরক্ষণ করার সময় মন্দির গাত্রের এক প্রাচীরের মধ্যে থেকে একটা/দুটো কঙ্কাল উদ্ধার করেছে । এরপর কঙ্কালটাকে/ কঙ্কালগুলোকে ফরেন্সিক পরীক্ষার জন্য ল্যাবেও পাঠানো হয়েছিল । কিন্ত খুব আশ্চর্যের কথা হল , এরপর কোন প্রভাবশালী মহল থেকে পুরো ঘটনাটাকে চেপে দেওয়া হয় । এরপর আর সেই কঙ্কালের কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি ! আমি ASI এর Annual Report পড়ে দেখেছি যে ১৯৯৯ সালে জগন্নাথ মন্দির কর্তৃপক্ষ ASI’এর কর্মীদের সত্যিই মন্দিরের ভেতর প্রবেশ করে Measure Drawing করার অনুমতি দেয় এবং ২০০০ সালে জগন্নাথ মন্দিরের বেশ কিছু অংশ সংরক্ষণও করা হয়েছিল । ২০০০ সালের জুন মাসের আনন্দবাজার পত্রিকাগুলো কারোর কাছে থাকলে খুঁজে দেখতে পারেন , আমি জোগাড় করতে পারিনি । গোপালকৃষ্ণ রায়ের লেখা -জ্ঞাননৌকা ও অন্যান্য প্রবন্ধ, বইতেও ঘটনাটার উল্লেখ আছে । এই প্রসঙ্গে গবেষক এবং অধ্যাপক তমাল দাশগুপ্তের সাথে আমার দিন কয়েক আগেই কথা হয়েছিল । তমালদাই প্রথম দীর্ঘ গবেষণা করে ‘চৈতন্য হত্যার অনুসন্ধানে‘ নামে একটা অসাধারণ প্রবন্ধ লেখেন , যার পর বাঙালি নেটিজেনদের মধ্যে এই বিষয়ে আবার নতুন করে আগ্রহ জন্মায় । তমালদা বলছিলেন, সেসময় কঙ্কালের খবরটা বেশ কয়েকটা সংবাদপত্রে ছাপা হয় এবং আজ থেকে সাত-আট বছর আগেও নেটে এই নিয়ে সার্চ করলে একটা আর্টিকেল পাওয়া যেত । উনি নিজেই দেখেছেন ! কিন্ত আশ্চর্যের ব্যাপার মাঝে কোন একটা সময়ে ইন্টারনেট থেকে সেটা সরিয়ে নেওয়া হয় । ঘটনাটার পর আর্কিওলজিক্যাল সার্ভের যিনি স্থানীয় অধিকর্তা তাকেও সেদিনই বদলি করে দেওয়া হয় কেরালায় । দুটো কঙ্কালের মধ্যে একটার আকার ছিল দীর্ঘ ; প্রায় সাড়ে ছয় ফুটের মত এবং অপর কঙ্কালটার আকার ছিল ছোট । তবে কি ছোট কঙ্কালটা স্বরুপ দামোদরের ? উত্তর দেওয়ার কেউ নেই । হয়তো এতদিন বাদে আর উত্তর খুঁজে পাওয়া সম্ভবও নয় ।
এই প্রসঙ্গে আরেকটা ভীষণ আশ্চর্যজনক তথ্য দিয়ে লেখাটা শেষ করি । সাংবাদিক অরুপ বসু লিখেছেন যে জয়দেববাবু ঝাড়গ্রামের লালজল জঙ্গলে পাথরের উপর চিহ্নের খোঁজে বনে বাদাড়ে ঘুরে বেড়াতেন দিনের পর দিন । সাম্প্রতিককালের চৈতন্য গবেষক তুহিন মুখোপাধ্যায়ও কিন্ত তার বই ‘ চৈতন্যের শেষ প্রহর’ বইতে উড়িষ্যার চুরঙ্গগড় /সারঙ্গগড় দুর্গের পার্শ্ববর্তী জঙ্গলে এমনই এক পাথুরে সাঙ্কেতিক লিপির উল্লেখ করেছেন । সিদ্ধেশ্বর মন্দিরের পিছনের দুর্গম অরণ্যের মধ্যে এক পাথরের উপর কিছু সাঙ্কেতিক লিপি এবং প্রাচীন এক অজ্ঞাতপরিচয় সাধকের সমাধির উল্লেখ আছে । তুহিন বাবু তার লেখায় তৎকালীন সময়ের সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিচার করে যুক্তি দিয়েছেন সে সময়ের ধর্মভিরু হিন্দুদের পক্ষে খোদ মন্দির প্রাঙ্গনেই সচল জগন্নাথকে হত্যা করাটা বেশ অস্বাভাবিক শোনায় । তাছাড়া মন্দিরের মাদলপঞ্জিতেও সে সময় মন্দির শুদ্ধিকরণেরও কোন উল্লেখ পাওয়া যায়না । তাই হয়তো শ্রী চৈতন্য নিজেই কোন গুপ্তপথে মন্দির থেকে বেরিয়ে আসেন কিম্বা বিগ্রহ দর্শনের পর তার প্রবল উত্তেজনায় যে ভাবসমাধি হয়েছিল তার সুযোগ নিয়ে গোবিন্দ বিদ্যাধর ও তার দলবল নদীপথ বেয়ে পার্শ্ববর্তী দুর্গম চুরঙ্গগড় (Chudanga Gada) দুর্গে এনে তাকে বন্দী করে রাখে । মনে রাখতে হবে যে এই গোবিন্দ বিদ্যাধরই কিন্ত কয়েকবছর বাদে ঘৃণ্য চক্রান্ত করে রাজা প্রতাপরুদ্রের সমস্ত বংশধরদের হত্যা করে উড়িষ্যার সিংহাসনে বসেছিল। তবে কোন আশ্চর্য কারণে তুহিনবাবু , মন্দির চত্বর থেকে পাওয়া কঙ্কালের খবরটা নিয়ে বিশেষ আলোচনা করেন নি তার বইতে।

নন্দনকাননের (প্রাচীন চন্দকা অরণ্য) উত্তরে গহন জঙ্গলের মধ্যে স্থিত অত্যন্ত সুরক্ষিত সেই চুরঙ্গগড় /সারঙ্গগড় দুর্গ যার কথা তুহিনবাবু তার লেখায় উল্লেখ করেছেন। চৈতন্যের সময় এই দুর্গ ছিল গোবিন্দ বিদ্যাধরের অধীনে এবং প্রাচী নদীর মোহনা থেকে কাকতপুর হয়ে জলপথে মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই এখানে পৌঁছানো সম্ভব ছিল  ।

এছাড়া সাম্প্রতিক কালের চৈতন্য গবেষক স্নেহাশিস মুখার্জিও তার লেখায় (তারেই খুঁজে বেড়াই) এমনই ইঙ্গিত দিয়েছেন । তিনি নিজে পুরীতে গিয়ে গবেষণা করে বলেন  যে জগন্নাথ মন্দিরের দক্ষিণ দ্বারের দিক থেকে একটা গুপ্তপথ এসে শেষ হয়েছে বাসুদেব সার্বভৌমের বাড়ি বা বর্তমান গঙ্গামাতা মঠ । এখনো এই সুরঙ্গ পথের অস্তিত্ব আছে । তিনি এর ছবি দিয়েছিলেন তার ফেসবুক পোস্টে । ভদ্রলোক এই বিষয়ে অনুসন্ধান করে এখন অব্দি ঊনিশটা পর্ব লিখেছেন ।
তবে রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় , ডঃ নীহাররঞ্জন রায় , নির্মল নাগ , ডঃ জয়দেব মুখোপাধ্যায় ,  যুধিষ্ঠির জানা (মালীবুড়ো) , ডঃ দীপক চন্দ্র , দুর্গাদাস চট্টোপাধ্যায়ের মত অসংখ্য গবেষক সরাসরি দাবী করেছিলেন যে নীলাচলেই চৈতন্যকে নির্মমভাবে হত্যা করে তার মৃতদেহ খুব গোপনে সমাধিস্থ করা হয়েছিল যা এখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি । সত্যি বলতে কি , প্রত্যক্ষ প্রমানের অভাবে আজকে এই সমস্ত দাবীগুলোর সত্যতা নিরূপণ করা প্রায় অসম্ভব । তাই Circumstantial Evidence এবং Inductive Reasoning এর ভিত্তিতে সত্যান্বেষণ করা ছাড়া উপায় নেই । জোরালো প্রমান হয়তো পাওয়া সম্ভব ছিল যদি সেই কঙ্কালের ডিএনএ টেস্ট করা যেত কিম্বা মুরারি গুপ্ত , বৈষ্ণবদাস , স্বরুপ দামদর বা বৃন্দাবন দাসের লেখার হারানো অংশগুলো খুঁজে পাওয়া যেত যেগুলো জয়দেববাবু উদ্ধার করেছিলেন । কে বলতে পারে , হয়তো ‘কাঁহা গেলে তোমা পাই’ এর দ্বিতীয় পর্বটা এখনো অন্ধকার ঘরের কোন ধুলোমাখা আলমারির কোনায় অবহেলায় অনাদরে পড়ে রয়েছে ! শুনেছি জয়দেববাবুর জন্ম বোলপুরে । ঐ অঞ্চলের কেউ খোঁজ নিয়ে দেখতে পারেন ওনাদের বাড়িটা এখনো রয়েছে কিনা ।
আসলে একটা বিষয় ভেবে আমার খুব অবাক লাগে যে বাংলার ইতিহাসের দুই যুগনায়ক , যারা বাংলার সমাজজীবনে বিপ্লব নিয়ে এসেছিলেন সেই – শ্রী চৈতন্য এবং সুভাষচন্দ্র বসু , দুজনের মৃত্যুই কি অদ্ভুত রহস্যের মোড়কে জড়ানো । ইতিহাসের কি আশ্চর্য সমাপতন না ! হয়তো এই জন্যই একজন বাঙালি হিসেবে এক অদ্ভুত আকর্ষণ অনুভব করি এই বিষয়ে ।
মাস খানেক আগে ঠিক এই কথাগুলোই হচ্ছিল নিজের বন্ধু সার্কেলে । এমবিএ’র সহপাঠী অরিজিতের সাথে আমার বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হয় । অরিজিতের পদবী পাত্র । শেকড় উৎকলে হলেও গত কয়েক প্রজন্ম ধরেই বাংলার বাসিন্দা এবং একজন খাঁটি বাঙালি তথা যদুবংশীয় (JU) । অরিজিতকে এই রহস্যমৃত্যুর কথা বলতেই ও প্রথমে কিছুক্ষণ থমকে গেল । তারপর দ্বিধা কাটিয়ে বলল যে পুরীতে আমাদের পরিবারের পাণ্ডারা অন্তত ১৫-২০ প্রজন্ম ধরে ওখানেই বাস করছে । বর্তমানে যিনি পাণ্ডা , তিনি ছোটবেলায় ওকে এরকমই এক ঘটনার কথা বলেছিল । সেই পাণ্ডাও নিজে বংশপরম্পরায় এই হত্যার ঘটনাটা শুনে আসছে । ছোটবেলায় ও ঘটনাটার গুরুত্বটা বুঝতে পারেনি , কিন্ত আজকে বহুবছর বাদে আবার শোনার পর পুরো ঘটনাটা কানেক্ট করতে পারল । ওর মুখ থেকে শোনার পর আমার শরীরে একটা মৃদু শিহরন খেলে গেছিল সেদিন !
সেদিনই ঠিক করেছিলাম এই ঘটনাটা নিয়ে লিখব । জয়দেববাবুকে স্তব্ধ করে দেওয়া হয়েছিল ।  সে সময় ইন্টারনেট ছিলনা ,  সোশ্যাল মিডিয়া ছিল না । কিন্ত আজকের পৃথিবীতে মুহূর্তের মধ্যে দাবানলের মত ইনফরমেশন আমাদের আঙুলের ছোঁয়ায় হাজার হাজার কিলোমিটার দূরে পৌঁছে যায় । যে বা যারা সত্যিটাকে লুকিয়ে রাখতে চেয়েছিলেন তারা হয়তো সেদিন বোঝে নি যে একজন জয়দেব মুখোপাধ্যায়কে চুপ করিয়ে দিলেও ভবিষ্যতে তার জায়গায় আরো দশজন বাঙালি আগ্রহী হয়ে এগিয়ে আসবে একদিন । সত্যিটাকে বেশিদিন চেপে রাখা যায়না । একদিন না একদিন সে প্রকাশ পাবেই ।
আজকের মত এটুকুই । ভালো থাকবেন ।

পুনশ্চ – ১। জয়দেব বাবুর কোন ছবি বা পুরনো পেপার কাটিংগুলো থাকলে, ফেসবুকে পোস্ট করে স্থাপত্যকে ট্যাগ করে দিতে পারেন । এই নির্ভীক জ্ঞানতাপসকে এভাবে ভুলে গেলে জাতি হিসেবে আমরা এক ক্ষমাহীন ভুল করব ।
২। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ঐতিহাসিক ডঃ নীহাররঞ্জন রায়ের ৫/৮/১৯৭৬ তারিখে জয়দেববাবুকে লেখা চিঠির মূল বয়ানটা ছিল এরকম-
” শ্রী মহাপ্রভু চৈতন্যদেবকে গুমখুন করা হয়েছিল পুরীতেই এবং সন্ন্যাসী চৈতন্যদেবের দেহের কোন অবশেষের চিহ্নও রাখা হয়নি কোথাও। এবং তা হয়নি বলেই তিনটে কিংবদন্তী প্রচারের প্রয়োজন হয়েছিল । ঐ গুমখুনের সমস্ত ব্যাপারটাই একটা বহুদিনের চিন্তিত , বহুজন সমর্থিত চক্রান্তের ফল । কে বা কারা ঐ চক্রান্ত করেছিল সে সম্পর্কে আমার অনুমান একটা আছে কিন্ত তা বলতে পারব না । কারণ এখনও আর কিছুদিন বেঁচে থাকতে চাই । চৈতন্যদেব , গান্ধী martyr হতে পারেন, আমার martyr হবার বিন্দুমাত্র বাসনা নেই ।”
– তথ্যসূত্র –  শ্রীচৈতন্য অনন্ত জীবনের সত্যান্বেষণ (দুর্গাপদ চট্টোপাধ্যায়) , পৃষ্ঠা – ৩১৫
৩। দীর্ঘ ৫০০ বছর ধরে ধামাচাপা দিয়ে রাখা এই সত্যিটা সমস্ত বাঙ্গালির জানা উচিত ।

চৈতন্যের রহস্যমৃত্যু বিষয়ে জানতে যে লেখাগুলো পড়তে পারেন :
২। বই – কাঁহা গেলে তোমা পাই (ডঃ জয়দেব মুখোপাধ্যায়) ,চৈতন্যের শেষ প্রহর (তুহিন মুখোপাধ্যায়) , ক্ষমা কর হে প্রভু (রুপক সাহা) , শ্রীচৈতন্যের অন্তর্ধান রহস্য – যুধিষ্ঠির জানা (মালীবুড়ো) , সচল জগন্নাথ শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য (ডঃ দীপক চন্দ্র) , জ্যেতির্ময় শ্রীচৈতন্য (কালকূট – সমরেশ বসু) , চৈতন্য শেষ কোথায় ? (রজত পাল) , শ্রী চৈতন্যের দিব্যজীবন এবং অজ্ঞাত তিরোধান পর্ব (বিষ্ণুপদ পাণ্ডা) , গোরা (শৈবাল মিত্র) , শ্রী চৈতন্য অন্তর্ধান রহস্য (দেবাশিস পাঠক) , শ্রীচৈতন্য অনন্ত জীবনের সত্যান্বেষণ (দুর্গাপদ চট্টোপাধ্যায়)
এছাড়া কিছু বই আছে যেগুলো নিষিদ্ধ কিম্বা আউট অফ প্রিন্ট যেমন – ইতিহাসে শ্রীচৈতন্য (অমূল্য চরণ সেন)

Featured Image এর ছবিটা এঁকেছেন – অনিকেত মিত্র

Thursday, July 25, 2019

গুজব আর অন্ধবিশ্বাসে বেড়ে ওঠা এক জাতি

আমাদের একটা পুরনো ঐতিহ্য আছে; বলতে পারেন এটা আমাদের একটা অর্জনও। “হুজুগে বাঙ্গালী”- শব্দটার সাথে আপনারা অনেকেই কম-বেশী পরিচিত। আমাদের পূর্বপুরষরাও সে ঐতিহ্যকে সযত্নে লালন করে রেখেছিলেন- তাদের কর্মের মাধ্যমে। বাংলায় আমাদের একটি অতি পরিচিত শব্দ আছে- “গুজব” যার ইংরেজীতে অর্থ অনেক- Rumor, Idle Gossip, Bruit এরকম। এসব শব্দকে বিভিন্ন দেশের ভাষাভাষিরা বিভিন্ন অর্থে ব্যবহার করলেও এর মূলকথা- “গুজব”। গুজবের ইতিহাস অনেক পুরনো- সেই অন্ধকারের সময় থেকেই গুজবের জন্ম। কিন্তু সেসব ইতিহাসে আমার অত বেশী আগ্রহ নেই। আমরা বরংচ আমাদের গুজবের সভ্যতা আর ইতিহাসকেই একটু তুলে ধরার চেষ্টা করছি।

আসুন, তাহলে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস দিয়েই শুরুটা করা যাক্। ৭১’এ এদেশে দুটো পক্ষ ছিলো; একদল বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে এবং অন্যদল স্বাধীনতার বিপক্ষে। যারা স্বাধীনতার পক্ষে ছিলো তারা মূলত এদেশের মানুষের উপর পাকিস্থানের বর্বরতা-অত্যাচার আর স্বৈরতন্ত্রকে মেনে নিতে পারেননি। আর অন্যদল চাচ্ছিলেননা যে- পাকিস্থান ভেঙ্গে যাক। কিন্তু যেহেতু তারা এ বিষয়টিকে এভাবে এদেশের সাধারন মানুষকে বোঝাতে অক্ষম ছিলেন; কারন তাতে সাধারন মানুষের মনে তাদের বিরুদ্ধে একটা বিরুপ প্রভাব সৃষ্টি হতে পারে- তাই তারা বেছে নিলেন ভিন্নপথ। কি সেই পথ? তারা বিভিন্ন মসজিদে-মাদ্রাসায়-আলোচনায় এদেশের সহজ-সরল মানুষকে বোঝাতে (গুজব) শুরু করলেন যে- “যেহেতু দেশভাগ হয়েছে হিন্দু-মুসলিম জাতিভেদের ভিত্তিতে তাই অখন্ড পাকিস্থানই হলো ইসলামের প্রকৃত ধারক ও বাহক। আর পাকিস্তানের সাথে ভাগ হয়ে এই স্বাধীনতা যুদ্ধ হচ্ছে ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। ভাইয়ের সাথে ভাইয়ের যুদ্ধ। এটা ইসলামকে খন্ডিত করে ফেলার একটা চক্রান্ত; একজন মুসলিম কখনই ভাইয়ের সাথে ভাইয়ের এ যুদ্ধ সমর্থন করে না। এটা হিন্দু রাষ্ট্র ভারতের একটা চক্রান্ত……..” এবং অদ্ভুদভাবে এদেশের একটা অংশের মানুষ সেই গুজবকে নিজের মস্তিস্কে ধারন করেই রইলেন। কিন্তু যেহেতু বিষয়টা ছিলো দেশের স্বাধীনতার-সার্বভৈমত্বের প্রশ্ন, লড়াইটা ছিলো অধিকার ছিনিয়ে আনার লড়াই; তাই দেশের একটা বিরাট অংশের মানুষ তাদের সেই গুজবকে উপেক্ষা করেও যুদ্ধে নেমে দেশকে স্বাধীন করেছিলো।
এবার স্বাধীনতাত্তর বাংলাদেশ যখন নুতন করে নিজের পায়ে দাড়াবে- সেই সময়ে একদল হত্যা করলো শেখ মুজিবকে। হত্যা করা হলো এদেশের বুদ্ধিজীবি আর প্রগতিশীল মানুষগুলোকে। সেখানেও তাদের গুজবই ভরসা। এলো সামরিক শাসন- এলো স্বৈরাচারী শাষন কিন্তু মানুষ চুপ করে আছে কেন? কারন, দেশকে পরানো হলো ধর্মের টুপি; এখানেও ভরসা গুজব। এই ৪৮ বছরে দেশের মানুষকে অন্ধের মতো হিংসাত্মক, কদর্য, বিদ্বেষমূলক মানসিকতায় অনেক গুজব বিশ্বাস করতে দেখা গেছে, যার ইতিহাস অসীম।
ভারতে রামমন্দির নির্মানের গুজবে এদেশের সংখ্যাগুরু মানুষদের একটা বিরাট অংশ পুড়িয়ে দিয়েছে নিজেদেরই প্রতিবেশী সংখ্যালঘু হিন্দুদের বাড়ি; ধর্ষন করেছে প্রতিবেশীর স্ত্রী-কন্যাকে। গুজব ছড়িয়ে রামুতে বৌদ্ধ মন্দিরে হামলা হয়েছে; নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হয়েছে সে অঞ্চলের বৌদ্ধ সংখ্যালঘুদের। গুজবে বিশ্বাসী জনতা অন্ধ বিশ্বাসে নিরক্ষর রসরাজ দাসের নামে মিথ্যা ধর্ম অবমাননার অভিযোগ এনে, দল বেঁধে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে ব্রাহ্মনবাড়িয়ার নাসিরনগরের হিন্দু সংখ্যালঘুদের। গুজবে বিশ্বাসী বাবা-মা অন্ধ বিশ্বাসে ও প্রাপ্তির মোহে নিজের সন্তানকেও হত্যা করতে এতটুকু পিছপা হননি। গুজবে বিশ্বাসী আমরা চাঁদে দেখি সাইদী হুজুরকে। পিতলের গোপাল দুধ খায়, তন্ত্র-মন্ত্র-তাবিজ-কবচে বিশ্বাস এমনসব গুজবে বিশ্বাস করে ভারতীয় উপমহাদেশের একটা বিরাট অংশের মানুষ। সেসব ইতিহাসের পান্ডুলিপি অনেক বড়; এক জীবনে এটা পড়ে শেষ করা যাবে না।

২০১৩ সালের ৫ মে’র কথা মনে আছে আপনাদের। মাদ্রাসার কোমলমতি ছাত্ররা জানতোই না নাস্তিকরা কি করেছে? কি বলেছে? কিন্তু ঢাকার শাপলা চত্ত্বরে হেফাজতের গুজবে তারা তান্ডব চালিয়ে পুরো দেশ যখন অচল করে দিয়েছে; তখন তাদের উচ্ছেদের ঘটনাকেও গুজব হিসেবে ছড়ানো হয়েছে- “মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষদের হত্যা করা হচ্ছে”। যে হেফাজত বায়তুল মোকাররমের বারান্দায় কোরআন পুড়িয়ে গুজব ছড়িয়েছে “সরকার কোরান পুড়িয়েছে”। এরকম আর কত গুজবের ঘটনা শুনবেন আপনারা? কারন, অন্ধ আর বধিরের সমাজে বদমায়েশদের গুজবই শেষ ভরসা। বদমায়েশরা জানে কি করে সাধারন আর সহজসরল মানুষের মগজে গুজব ঢুকিয়ে দেয়া যায়!
আমাদের দেশে এখন গুজবের মহামারি চলছে। গুজবে ছড়ানো হচ্ছে- ব্রিজ তৈরিতে মানুষের মাথা চাই। গুজব ছড়িয়ে মূল হত্যাকারী ফাসিয়ে দিচ্ছে অসহায় মিন্নিদের। ছেলেধরা গুজব রটিয়ে প্রকাশ্যে মানুষ পিটিয়ে মারছে অসহায় আর নিরপরাধ মানুষকে। সাধারন মানুষ আজ আর নিরাপদ নয় এই সমাজে; বাবা-মা ঘরে ফিরতে পারবে কিনা তাঁর কোন নিশ্চয়তা নেই। প্রকাশ্য দিবালোকে মানুষ পিটিয়ে মারছে মানুষকেই। আর সে একজন-দুজন নয় সবাই যেন সংঘবদ্ধ। কোন মানবিকতা নেই! কিন্তু আচ্ছা আপনি কি কখনো ভেবে দেখেছেন একটা জাতি এভাবে “গুজবে জাতিতে” কিভাবে পরিনত হলো? সমাজবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে কখনো প্রশ্ন তুলেছেন- আমাদের কেন অন্ধকার থেকে আর ফেরা হলো না? 

কারন, আপনারা বিজ্ঞানহীন শিক্ষা তুলেফেলে সেখানে এনেছেন ধর্মীয় মাদ্রাসা শিক্ষা। যখন দেশের প্রতিটি অঞ্চলে প্রয়োজন ছিলো উন্মুক্ত পাঠাগার, বিজ্ঞানাগার তখন আপনার করেছেন মাদ্রাসা। যে বয়সে একজন মানুষের মধ্যে সৃষ্টি করা প্রয়োজন মানবিক মূল্যবোধ, তখন আপনার তাদের করেছেন ধর্মীয় মতান্ধ। যখন প্রয়োজন ছিলো বিজ্ঞান বিতর্কের তখন আপনারা খোলা মাঠে, রাস্তায় হাজারো মাইক দিয়ে করেছেন মাহফিল। যখন প্রয়োজন ছিলো কো-এডুকেশনের ব্যবস্থাকরা তখন আপনাদের মগজে জেঁকে বসেছে “নারী মানে তেতুল”। অভিজিৎ রায়ের মত মানুষকে হত্যা করার জন্য মৌলবাদীরা তখন প্রকাশ্যে হুংকার দিয়েছে “নাস্তিকদের কতল করা ওয়জিব হয়ে গেছে”। মানুষের মধ্যে জাতীভেদ, সাম্প্রদায়ীকতা, অস্থিরতা, অসহিষ্ণুতা, ক্রোধ, হিংসা ও বিদ্বেষের এ বৈষম্যমূলক সমাজ একদিনে সৃষ্টি হয়নি। আপনাদের প্রচ্ছন্ন মদদে আর ধর্মভিত্তিক ভূখন্ড গড়ার সুপ্ত বাসনাই আজকের এ অস্থির সমাজের জন্ম দিয়েছে। আপনারা চেয়েছিলেন শুধু একটা ধর্মীয় রাষ্ট্র; সেটাতো করেছে! কিন্তু সেই রাষ্ট্রের মানুষগুলোকে মানবিকতা আর মূল্যবোধ শেখানোর প্রয়োজন কখনোই অনুভব করেননি তাই সভ্য আর বিজ্ঞানমনস্ক নাগরিকও সৃষ্টি হয়নি। হেফাজতের নির্দেশে আপনারা পাঠ্যপুস্তক থেকে বিজ্ঞান, বিবর্তনবাদ আর সংস্কৃতিকে তুলে দিয়ে আপনার কি আশা করেন; এদেশে আইনস্টাইন আর ব্রুনো জন্মাবে?

দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে আজ আর কান্না করে কোনই লাভ নেই; বরংচ সত্যিই যদি এর থেকে বেড়িয়ে আসতে চান তবে সন্তানকে ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে না পাঠিয়ে বিজ্ঞান আর বিবর্তনের শিক্ষা দিন। তাকে মানবিক করে গড়ে তুলতে আপনাকেও অনেক অবদান রাখতে হবে। আপনাকে দেখে এতদিন যা-যা শিখেছে আপনার সন্তান; আজ থেকে-এখন থেকেই অসাম্প্রদায়িকতা, বিজ্ঞানমনস্কতা, মানবিকতা এসব আপনার কাছ থেকেই শিখুক আগামী প্রজন্ম।

ব্রুনোর কথা মনে আছে তো আপনাদের?

১৬০০ সালের ২০ জানুয়ারি পোপ ৮ম ক্লেমেন্ট ব্রুনোকে একজন ধর্মদ্রোহী বলে রায় দিয়ে তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেন। ১৭ ফেব্রুয়ারি তাঁকে রোমের কেন্দ্রীয় বাজার Campo de’ Fioriএ নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাঁকে সবার সামনে খুঁটির সাথে বেঁধে পুড়িয়ে মারা হয়। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল- “এই মহাবিশ্বের মতো আরো মহাবিশ্ব আছে, পৃথিবী গোল, সূর্য এই মহাবিশ্বের কেন্দ্র নয় এবং এটি একটি নক্ষত্র ছাড়া আর কিছু নয়”- এই ধারণা পোষণ করা। এভাবেই ‍গুজবে বিশ্বাস করে হত্যা করা হয়েছে কত মহামানবদের, তার হিসেব নেই। যে দেশ আর সমাজ একদিন ব্রনোকে হত্যা করেছিল তারাই জ্ঞানের আলোতে এসে স্বীকার করেছিলো ব্রুনোই ঠিক; সেদিন তারা ভুল ছিলো! 

ব্রুনোকে যারা হত্যা করেছিল তারা তো একদিন সভ্য হয়ে স্বীকার করেছে ব্রুনোকে হত্যা ছিলো তাদের ভুল! আপনারা কবে স্বীকার করছেন, “গুজব” ছড়িয়ে এভাবে সাধারন মানুষ, হুমায়ুন আজাদ, অভিজিৎ, অনন্ত, দীপনদের… হত্যা ছিলো আপনাদের ভুল?

লিখেছেন: কাজল ‍কুমার দাস, ব্লগার ও প্রাবন্ধিক
(প্রথম প্রকাশ ২৪ জুলাই ২০১৯- মুক্তমনা ব্লগ)


নারী-শিশু নির্যাতন; ধর্মান্ধতা আর বিচারহীনতার সংস্কৃতি

সমাজ নামক এই কূপমুন্ডক সামাজিক সংস্কারে বাস করা নির্যাতিত মানুষ সামাজিক মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হবে ভেবে ধর্ষণের শিকার হলেও মুখ খোলেন না। বেশির ভাগ মানুষেরই এই দশা। এছাড়া ধর্ষণের বিচার প্রক্রিয়ার দুর্নীতি, দীর্ঘসূত্রিতা ও পুরুষতান্ত্রিক হয়রানির কারণে ধর্ষণের শিকার অনেক নারীই শেষব্দি আর কোন অভিযোগ করতে ভরসা পান না।
পূর্নিমা শীলকে চেনেন তো আপনারা? ভোলার পূর্নিমা শীল! এদেশের সংখ্যাগুরুদের বিকৃত মানসিকতার শিকার হয়েছিলো এই মেয়েটি। দলবেঁধে পালাক্রমে যাকে ধর্ষন করা হয়েছিলো। যার মা সেদিন অনুনয় করে ধর্ষকদের বলেছিলো “বাবারা তোমরা একজন একজন করে করে যাও, ও ছোটতো পারবে না…”। শুধু পুর্নিমাই নয় সেবার এরকম হাজারো পূর্নিমা ধর্ষিত হয়ে দেশত্যাগ করেছিলো।

তনুকে মনে তনুকে মনে আছে আপনাদের? কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী ও নাট্যকর্মী সোহাগী জাহান তনু। ২০১৬ সালের ২০ মার্চ রাতে কুমিল্লার ময়নামতি সেনানিবাস এলাকার পাওয়ার হাউসের অদূরে ঝোপ থেকে এই কলেজছাত্রীর লাশ উদ্ধার করা হয়। সেনানিবাস চেনেন তো আপনি, কখনো গেছেন? যেখানে ব্যানেট আর বুটজুতার দাপট চলে! ওইসব জায়গাতে! পুরো এলাকাটায়ই কেমন একটা গা ছমছমে অবস্থা। একটি পর্দাশীল মেয়েকে সেখানে হত্যা করা হলো কি করে? তনু কিন্তু উশৃঙ্খল ছিলো না বরংচ হিজাব পরা, নাটক-থিয়েটার করা ভদ্র মেয়ে। আজ প্রায় তিন বছর কেটে গেল তবুও হত্যা মামলার তদন্ত শেষ হয়নি। এমনকি এ মামলার আসামিও শনাক্ত হয়নি। আর হবেইবা কি করে, কার সে সাধ্যি আছে?

একইভাবে ফেনীর মাদ্রাসা ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকেও শেষ পর্যন্ত বাঁচানো যায়নি৷ ২০১৯ এর ৬ এপ্রিল সকালে আলিম পরীক্ষা দিতে সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসায় যান নুসরাত। নুসরাত এর ভাষ্য মতে সেখানে হাত মোজা, পা মোজাসহ বোরকা পরিহিত ৪-৫ জন তাকে অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির মামলা ও অভিযোগ তুলে নিতে চাপ দেয়। সে অস্বীকৃতি জানালে গায়ে কেরোসিন জাতীয় পদার্থ ঢেলে আগুন দিয়ে পালিয়ে যায় তারই সহপাঠি আর মাদ্রাসার লোকজন। ১০ এপ্রিল ২০১৯ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন নুসরাতের মৃত্যু ঘটে। ফেনীর নুসরাতের পর রাজধানীর মুগদার হাসি। একজন মাদ্রাসাছাত্রী, অপরজন গৃহবধূ। দুজনই কেরোসিনের আগুনের নির্মম বলি। মাত্র ১২ দিনের ব্যবধানে ঘটে আলোচিত এই দুই ঘটনা। 

ছোট্ট শিশু। বয়স কত? সাত বছর। গত ৭ জুলাই ২০১৯ ঢাকার ওয়ারীতে শিশুটিকে ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা ঘটে। ছাদ দেখানোর কথা বলে সে শিশুটিকে লিফট থেকে সবচেয়ে ওপর তলায় অবিক্রীত একটি শূন্য ফ্লাটের ভেতর নিয়ে যায়। সেখানে শিশুটিকে প্রথমে ধর্ষণ করার চেষ্টা করে। তাতে ব্যর্থ হয়ে শিশুটির মাথায় আঘাত করে অচেতন করে। এরপরে সে শিশুটিকে ধর্ষণ করে। কিন্তু তার পরিচয় প্রকাশ পেয়ে যেতে পারে, এই ভয়ে শিশুটিকে হত্যা করে গলায় রশি বেধে ঝুলিয়ে রেখে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়।

১৮ জুলাই ২০১৯ নওগাঁর মান্দায় কলা ও কাঁঠাল বিচি খাওয়ানোর লোভ দেখিয়ে ৩ বছরের এক শিশুকে ধর্ষণ করে তিন সন্তানের জনক আছির উদ্দিন। গুরুতর অবস্থায় ওই শিশুকে উদ্ধার করে নওগাঁ সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

ব্লেড দিয়ে যৌনাঙ্গের প্রবেশ পথ কেটে বড় করে রাতভর ধর্ষন করে দিনাজপুরের ৫ বছরের শিশু পূজাকে। সারারাত ধরে ২টা জানোয়ার টানা ধর্ষন করে সকালে বাড়ির কাছে ফেলে রেখে গিয়েছিলো তাকে। বিচার হয়নিতো তাঁর, ওসব এখন ইতিহাস! আপনাদের চরিত্র আর সভ্যতার ইতিহাস।

ধর্ষণের বিচার চাইতে গিয়েও ধর্ষণের শিকার হতে হয়েছে এমন খবরও পত্রিকার পাতায় স্থান পেয়েছে। ধর্ষণের এমন লাগামহীন চিত্র এদেশের আইন ও বিচার ব্যবস্থাসহ পুরো সিস্টেমের ভিত নাড়িয়ে দিয়েছে। প্রহসনের এসব বিচার সম্পন্ন করে ধর্ষণের কলঙ্ক থেকে বাংলাদেশ রেহাই পাবে কিনা! সে ভাবনাটা অনেকটাই অপরিষ্কার। অসুস্থ সংস্কৃতির ঘুণে ধরা এই সমাজের মগজ পরিষ্কার না করলে ধর্ষণ নির্মূল কোনো ভাবেই সম্ভব না, আশা করি সেটা নিয়ে আজ আর কারো দ্বিমত নেই।

কত ঘটনার বিবরন শুনবেন আর! প্রতিদিন এদেশে ধর্ষনের এই তালিকা দীর্ঘ্য থেকে দীর্ঘ্যতর হচ্ছে। এরকম কতইনা ঘটনা কালের গহ্বরে হারিয়ে গেছে তা আমাদের জানা নেই, ভয়ে-লজ্জায় যা প্রকাশ পায়নি। সম্প্রতি শুধুমাত্র সাংবাদ-মাধ্যমে প্রকাশিত অগনিত ঘটনাপ্রবাহের তথ্যানুসারে এ বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ৬ মাসে সারাদেশে ৩ শ ৯৯ জন শিশু ধর্ষণ ও ধর্ষণ চেষ্টার শিকার হয়েছে । এর মধ্যে ৮ জন ছেলে শিশু । ধর্ষণের পরে ১ জন ছেলে শিশুসহ মারা গেছে ১৬ টি শিশু। বাংলাদেশে এখন একমাত্র আলোচ্য বিষয়- ধর্ষন, যে শব্দটি আজ আড্ডা-আলোচনা-অফিস টেবিলে কিংবা পথে স্থান করে নিয়েছে। আজ এমন একটি দিনও যাচ্ছে না, যেদিন ধর্ষণ নামক যৌন আক্রমণের শিকার হচ্ছে না শিশু থেকে পঞ্চাশোর্ধ্ব নারীরা। ঘরে-বাইরে, স্কুল কলেজ মাদ্রাসা, কর্মক্ষেত্র কিংবা গণ-পরিবহন কোথাও যেন শিশু বা নারীর নিরাপত্তা নেই। এ দেশটা যেন শ্বাপদের গভীর অরন্যের পরিণত হয়েছে।

কিন্তু দেশে এই যে ধর্ষনের মহামারি এর কারন কি ভেবে দেখেছেন কখনো? ধর্ষনের জন্য যারা পোষাককে দায়ী করেন; তারা বলবেন কি? তনুর পোষাক কি ছিলো? নুসরাতেই বা কি ছিলো? দুই থেকে ৭ বছরের শিশুর পোষাকইবা কতটা অশ্লীল হতে পারে! যা দেথে আপনাদের হিংস্ত্র দানবগুলো জেগে ওঠে? আসলে সমস্যাটা আপনাদের মগজে- সেই মগজে, যে মগজে আপনি আপনার ধর্ম নামের নোংরা অন্ধত্ব পুষে রেখেছেন। আর প্রায় প্রতিটি প্রথাগত ধর্মই নারীকে কৃতদাস-যৌনদাস-সন্তানোৎপাদনের শষ্যক্ষেত্র-সঙ্গী করে রেখেছে। এবং এরই প্রতিফিলন আপনারা জন্মের পর থেকেই আপনাদের পরিবারগুলোতে দেখে এসেছেন; পুরুষত্বের সীমাহীন বর্বরতায়। আর তার বাকী শিক্ষাটুকু সম্পন্ন হয়েছে আপনার জন্মগত সমাজ থেকে। ধম্ম আপনাকে মানুষ করতে না পারলেও বর্বর পুরুষ তৈরি করেছে ঠিকভাবেই। নইলে সীমাহীন ধর্ষন দেখে আপনার মাথায় আসে কি করে; এসব বন্ধ করতে পতিতালয় চাই! পতিতালয়, যার খদ্দের হবেন আপনি। সেই আপনি, যে নারীর সতীত্ব পরীক্ষায় বিশ্বাসী একজন পুরুষ- আপনার পতিতালয় চাই! কতটা নোংরা আপনার ভেতরের পুরুষত্ব যে, নিজের কন্যাও আজ আপনার কাছে নিরাপদ নয়। পিতৃত্বকে বিসর্জন দিয়ে পুরুষত্বকে আপনি লালন করছেন। তাহলে কে নিরাপদ আপনার কাছে? আপনার কন্যা-ভগ্নি-প্রতিবেশী…… কেউ নয়। কারন আপনি প্রচন্ডভাবে ধর্মবিশ্বাসী, সেই পুরুষ।

কেন বাংলাদেশে এত ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে, সমাজবজ্ঞিানের দৃষ্টিতে তার ব্যাখ্যা খুঁজুন। গ্রামের সহজ সরল নারী-শিশু থেকে সমাজের উঁচু দালানের নারী-শিশু কারোরই ছাড় নেই। মাদ্রাসায়-স্কুলে-কলেজে-গনপরিবহনে-অফিসে-পুলিশ স্টেশনে-বাড়িতে কোথাও যৌন আক্রমণ থেকেও রেহাই নেই নারী-শিশুদের। গণ-পরিবহণেতো আজকাল ধর্ষকদের সম্মিলিতভাবে ধর্ষনের কিংবা অন্যান্য যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন নারী যাত্রীরা। সবচেয়ে আশ্চর্যজনক এবং ভয়াবহ দিকটি হচ্ছে শিশু ধর্ষণ। মাদ্রাসায় হুজুর-মোল্লাদের বিকৃত রুচির বিকৃতি থেকে রেহাই নেই কোমলমতি শিশুদের। এদের পাশবিক প্রবৃত্তি ক্রমেই নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ছে। একের পর এক ধর্ষণ, যৌন সহিংসতা ও হত্যার ঘটনা ঘটলেও কোনোভাবেই এর লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না। কেউ যেন কোন কথাও বলতে চাইছে না এসব মাদ্রাসা শিক্ষার বিরুদ্ধে; এটা কি দোজখের ভয় নাকি বেহেস্তের মোহ। নইলে যে নুসরাতকে মাদ্রাসায় বসে মাদ্রাসারই অধ্যক্ষ ধর্ষন করে তাঁকে হত্যা করলো সেই নুসরাতের মা শিরিনা আক্তার বলেন, “আমার মেয়ে আখেরাতের পরীক্ষায় পাস করবে।” খুব বেশী আশ্চর্য্য লাগার কোন কারন নেই! কারন এটাই ধ্রুব সত্য যে, এদেশের বাবা-মা- অভিভাবকেরা এই বিশ্বাসেই তাদের সন্তানকে মাদ্রাসায় দেন যে, তাদের সন্তান আখেরাতের জন্য কাজ করছে। আর সেই আখেরাত শুধু সন্তানদের জন্যই নয়- তাদের পথকেও করবে নিশ্চিত। তাতে যদি তাদের সেই সন্তানরা (ছেলে হোক বা মেয়ে) মাদ্রাসায় বসে যৌন নির্যাতনের শিকার বা শারিরিক অত্যাচারেরও শিকার হয় বা তাদের হত্যাও করা হয় তাতে তাদের আফসোস নেই। কারন, মূলকথা “আখেরাত”!

ঘরে-বাইরে সর্বত্রই নারী ও শিশুর জন্য অনিরাপদ হয়ে উঠছে। বিরূপ প্রভাব পড়ছে সামাজিক জীবনে। সম্মিলিতভাবে মানুষ যেন অসভ্যতার দিকেই হাঁটতে শুরু করেছে। কিন্তু এর পেছনে কারনও রয়েছে অনেক- শিল্প, সংস্কৃতি থেকে মানুষের সরে যাওয়া আর বিজ্ঞান বিমুখতাও এর একটা অন্যতম কারন। ছেলেবেলা থেকেই পারিবারিকভাবে ছেলে এবং মেয়ে শিশুদের খেলাধুলা-চালচলন-শিক্ষা-পোষাক সহ সকলক্ষেত্রেই শুরু হয় চরম বৈষম্য। ছেলেশিশুটিকে খেলার জন্য বল-ব্যাট-প্লেন-কার দিলেও মেয়েটির জন্য সেই পরীমার্কা পুতুলই, এবং তাকে বুঝিয়ে দেয়া হয় “তুমি মেয়ে এবং এই সীমানাটা তোমার জন্য নির্ধারিত”। ছেলেটির সাথে সমান তালে সে ছুটতে পারে না। শিক্ষার আধুনিকায়ন করে যখন কো-এডুকেশন চালু করার কথা ছিলো তখন আমরা করেছি মাদ্রাসা। ধর্মভিত্তিক অন্ধকারাচ্ছন্ন এসকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছড়িয়েছে কেবলই নারীদ্বেষ আর হিংসার মত ভয়ংকর ভাইরাস। রাষ্ট্রের প্রচ্ছনান মদদে আর পৃষ্ঠপোষকতায় যা আজ দানবের আকার ধারন করেছে, সেই দানবের করাল গ্রাস থেকে এ দেশটাকে বাঁচানো কষ্টকর। তার সাথে রাষ্ট্রীয় বিচারহীনতার সাংস্কৃতি তো আছেই; সব মিলিয়ে একটা হিংস্ত্র শ্বাপদের অরন্যে আমরা কেবল বেঁচেই আছি। যেখানে বিচার চাওয়া যায় না, তবে আসামীরা জামিন পেয়ে যায় ঠিকই। এসব আপনারাও জানেন আমরাও জানি! ক্ষমতাধর আসামীকে বাঁচাতে ফাঁসানো হয় অসহায় মিন্নিদের। কেন হয় এসব? কেন ঠিকপথে শেষ হয় না এসব বিচার? কেন ধরা যাবে না অপরাধীদের? রাষ্ট্র নির্বাক হলেও এসব প্রশ্নের উত্তর আমাদের অজানা নয়।

পূর্নিমা-তনু-নুসরাতরাতো মরে গিয়ে বাঁচলো, এ অভিষপ্ত ভূমিতে আমরা বেঁচে আছি কেন?
মানুষ বেঁচে আছে কেন? এভাবে থাকাকে কি বেঁচে থাকা বলে?
মানুষ কি বেঁচে থাকে, এভাবে!


লিখেছেন: কাজল ‍কুমার দাস, ব্লগার ও প্রাবন্ধিক

(প্রথম প্রকাশ ২২ জুলাই ২০১৯- মুক্তমনা ব্লগ)

Wednesday, July 17, 2019

ধর্মান্ধ হলে ধর্ষন বন্ধ হবে না


আজ ঠিক এই মুহুর্তে যাকে খুব বেশী প্রয়োজন ছিলো তিনি . অভিজিৎ রায় বহু আগেই যিনি তাঁরবিশ্বাসের ভাইরাসবইয়ে লিখে গেছেন মানুষ ধর্মে কেন অন্ধ হয়; অন্ধ হলেই বা কি হয়.... এসবের বৈজ্ঞানীক ব্যাখ্যা।মানুষটা আজ নেই মৌলবাদীরা তাকে হত্যা করেছে- কিন্তু তাঁর দর্শনতো রয়ে গেছে, যা আজ সত্য হলো
 
যে নুসরাতকে মাদ্রাসায় বসে মাদ্রাসারই অধ্যক্ষ ধর্ষন করে তাঁকে হত্যা করা হলো সেই নুসরাতের মা শিরিনা আক্তার বলছেন, “আমার মেয়ে আখেরাতের পরীক্ষায় পাস করবে।কি খুব বেশী আশ্চর্য্য লাগছে? এটাই ধ্রুব সত্য যে এদেশের বাবা-মা-অভিভাবকেরা এই বিশ্বাসেই তাদের সন্তানকে মাদ্রাসায় দেন যে, তাদের সন্তান আখেরাতের জন্য কাজ করছে। আর সেই আখেরাত শুধু সন্তানদের জন্যই নয়- তাদের পথকেও করবে নিশ্চিত। তাতে যদি তাদের সেই সন্তানরা (ছেলে হোক বা মেয়ে) মাদ্রাসায় বসে যৌন নির্যাতনের শিকার বা শারিরিক অত্যাচারেরও শিকার হয় বা তাদের হত্যাও করা হয় তাতে তাদের কিচ্ছু আসে যায় না। কারন, মূলকথা আখেরাত!

আপনারা যারা ধর্ষনের শাস্তি হিসেবে ধর্ষকের মৃত্যুদন্ড, প্রকাশ্যে ফাঁসি, যৌনাঙ্গ থেতলে দেয়া..... এরকম অনেক প্রস্তাব করছেন তারা একবার ভাবুনতো, একজন সভ্য আর মানবিক বোধসম্পন্ন মানুষ হিসেবে আপনি কি মৃত্যুদন্ডের মত অমানবিক প্রথার পক্ষেই আছেন নাকি ধর্ষনের মত অপরাধের বিলুপ্তি চান? যদি সত্যিই চান সমাজ থেকে ধর্ষন লুপ্ত হোক- ধর্ষকের জন্মই না হোক! তবে ভাবুন, ধর্ষকের জন্ম হচ্ছে কোথায়? ধর্ষণ সংক্রান্ত বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞান তত্ত্বগুলোকে ঘেঁটে সেই আতুরঘরগুলো খুঁজে বের করুন; আর মহামারীর আকার নেয়া সেই ধর্ষকের আতুরঘরে সর্বশক্তি দিয়ে আঘাত করুন।

আমাদের শিক্ষায়-ধর্মে-সংস্কৃতিতে যৌনতার প্রতি যে দৃষ্টীভঙ্গী শেখানো হয় ছোটবেলা থেকেই,  নারীর প্রতি এক ধরনের বিকৃত দৃষ্টীভঙ্গী গড়ে উঠে ওখান থেকেইএ দেশের মসজিদে-মাদ্রাসায় মাহফিলের মোল্লাদের নারীদ্বেষী বিকৃত বক্তব্য নুতন কিছু নয়। আপনি হয়ত ভাবছেন এসব নোংড়া বক্তব্য শুধু ওইসব ময়দানেই সীমাবদ্ধ! তবে আপনি নিশ্চিৎ থাকুন আপনার ভাবনার আর জানার দৈন্যতা এটাই। এবার আপনি যদি আপনার পাশের মতান্ধ প্রগতিশীল বন্ধুটির ভাবনার জগতে একটু উঁকি দিন বা তার আচরণ লক্ষ্য করুন। তবে আপনিই বুঝবেন ওসব মোল্লা আর আপনার এই প্রগতিশীলদের মধ্যে পার্থক্য কতটুকু। এবার কিন্তু নিজের দায়িত্বেই বুঝে নিতে হবে বাকী “আম জনতার মনস্তাত্বিক অবস্থা”। এ দেশের একটা বিরাট অংশের মানুষ এখনো মনে করেন নারী ধর্ষনের জন্য পোষাক দায়ী, যারা মত দেন ধর্ষন বন্ধে পতিতালয় চাই তাদের সাথে এসব অসভ্য বর্বরদের সাথে পার্থক্য শুধুই পোষাকে; চিন্তায় আর দর্শনগত অবস্থানে এরা সমান। এরা নিজেদের বর্বর মানসিকতাকে সভ্য করতে মোটেও রাজী নন। তাইতো, এ দেশের মাহফিলগুলোতে যখন লক্ষ-লক্ষ মাইকে দেশব্যাপী চিৎকার করে বলা হয়-

“তেঁতুল দেখলে মানুষের যেমন জিভে জল আসে তেমনি নারীদের দেখলেদিলের মইধ্যে লালা বাইর হয়
“শোনো নারীরা, চার দেয়ালের ভেতরই তোমাদের থাকতে হবে স্বামীর বাড়িতে বসে তোমরা আসবাবপত্র দেখভাল করবা, শিশু লালন-পালন, পুরুষ শিশুদের যত্ন করবা এই হলো তোমাদের কাজ তোমাদের কেন বাইরে যেতে হবে?”
দিনেরাত্রে মহিলাদের সাথে পড়ালেখা করতেছেন, আপনার দিল ঠিক রাখতে পারবেন না রাস্তাঘাটে হাঁটাহুটা করতেছেন, হ্যান্ডশেক কইরা কইরা, আপনার দিল ঠিক রাখতে পারবেন না যতোই বুজুর্গ হোক না কেন, এই মহিলাকে দেখলে, মহিলার সাথে হ্যান্ডশেক করলে আপনার দিলের মধ্যে কুখেয়াল আইসা যাবে, খারাপ খেয়াল এইটা মনের জেনা, দিলের জেনা হইতে হইতে আসল জেনায় পরিণত হবে এটা সত্য না মিথ্যা?”
গার্মেন্টসে কেন দিছেন আপনার মেয়েকে? ফজরে / টা বাজে চলে যায়, রাত ৮টা, ১০টা, ১২টায়ও আসে না কোন পুরুষের সাথে ঘোরাফেরা করতেসে তুমি তো জানো না কতোজনের মধ্যে মত্তলা হচ্ছে আপনার মেয়ে, আপনে তো জানেন না জেনা কইরা কইরা টাকা রোজগার করতেছে, কী বরকত হবে?” 

তখন আপনাকে বুঝে নিতে হবে এসব কথাই এদেশের শিক্ষাহীন, অজ্ঞ, মতান্ধ মানুষের মনের কথা। এই বদমায়েশগুলো ভালো করেই জানে যে, ৬ বছরের মেয়ে, বোরখাবৃতা মেয়ে কিংবা ৬০ বছরের বৃদ্ধা স্বাভাবিকভাবে যৌনানুভুতি সৃষ্টি করে না; তবে তাদের দৃষ্টিতে নারী যখন পন্য-খাদ্যদ্রব্য-শষ্যক্ষেত্র তখন কিন্তু তাদের ধর্ষকীয় ব্রেইনে নারী বিষয়টি মারাত্মক উদ্দীপক হিসেবে কাজ করেকীভাবে এই কন্ডিশানিং হচ্ছে? যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ হেলথের ডিরেক্টর ডঃ আলিয়াস বলেছেন, মানুষের পার্সোনালাটি লার্নিং হয় তিনটা প্রধান ফ্যাক্টর দ্বারা শিক্ষা, সঙ্গ এবং পরিবেশএখন ধর্ম আর তাঁর শিক্ষার কারনে এই শিক্ষা, সঙ্গ এবং পরিবেশ তিনটেই হচ্ছে বিপরীতমুখী। কারন, ধর্ষণের জন্য আমাদের সমাজ নামের এই ব্যবস্থাই মূলত দায়ী; যাকে রক্ষণশীল আখ্যা দিয়ে শিশু-কিশোর বয়স থেকেই মেয়েকে ছেলের সাথে মিশতে দেয়া হয় না এবং ছেলেকেও মেয়ের থেকে দূরে রাখা হয়।এভাবে মেয়ের শরীরকে গোপন এবং নিষিদ্ধ করে রাখার যে অবৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া সেটা যে কতটা মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে তা আমাদের সমাজ আজও বুঝে উঠতে পারেনি এবং আদৌ তা পারবে কিনা সেটা নিয়ে আমি সন্দিহান।

প্রথম বিশ্বের মানুষ যখন চাঁদে যাচ্ছে, মঙ্গল গ্রহে নুতন আবাসনের সন্ধান খুঁজছে তখন আমাদের খুঁজতে হচ্ছে ধর্ষন কেন হয়? আর এর থেকেও আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, ধর্ষনের বৈজ্ঞানিক কারন না খুঁজে আমরা মৃত্যুদন্ড’র মত অমানবিক কাজকে ধর্ষন বন্ধের হাতিয়ার হিসেবে বেঁছে নিয়েছি; এটাই হয়ত আমাদের আরব্য শিক্ষার ফল! জন্মথেকে ধর্মের অন্ধকারে বেড়েওঠা আমাদের প্রেম, যৌনতা আর নারীদেহ নিয়ে আমাদের ট্যাবু ভাঙার এটাই সবথেকে ভালো সময়
শুরু হোক এখনই; এখান থেকেই।

লেখক: কাজল কুমার দাস
(প্রথম প্রকাশ ইষ্টিশন)

জয়দেব মুখোপাধ্যায় : চৈতন্য মৃত্যুরহস্যের কিনারা করতে গিয়ে প্রাণ দিয়েছিলেন যে গবেষক

জয়দেব মুখোপাধ্যায়ের যেন এক কিংবদন্তির নাম যার কথা অনেকেই শুনেছে , বহু মানুষই তাকে খুঁজে ফেরে কিন্ত তার ব্যাপারে বিশদে কেউ কিছু বলতে পারেনা...