Monday, February 19, 2018

আখতারুজ্জামান ইলিয়াস: বাংলা কথাসাহিত্যের অকালপ্রয়াত প্রবাদপুরুষ

মাত্র দুটি উপন্যাস আর হাতেগোনা কয়েকটি ছোটগল্প লিখে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম সেরা লেখকের আসনে বসে যাওয়ার কাজটি মোটেই সহজ নয়। কিন্তু উপন্যাস দুটির একটি যদি হয় ‘চিলেকোঠার সেপাই’, আর অন্যটি যদি হয় ‘খোয়াবনামা’, তাহলে হয়তো সম্ভব। কারণ, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসকে যে তার লেখা শব্দ কিংবা বাক্যের কলেবরে পরিমাপ করা দুঃসাধ্য ব্যপার, তা তিনি তার লেখার গুণগত ব্যাপ্তি দিয়েই প্রমাণ করে গেছেন।
এই দুই উপন্যাসের মধ্য দিয়ে খুব সচেতনভাবেই আখতারুজ্জামান ইলিয়াস বাংলা সাহিত্যে উপন্যাসের গতিপথে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এনেছেন। মহাকাব্যিক ব্যাপ্তিতে লেখা এই উপন্যাস দুটোকে একটু গভীর থেকে দেখলেই বোঝা যায়, এগুলোতে কোনো ব্যক্তি কিংবা ইতিহাস নয়, বরং একেকটি জনপদই যেন নায়কের ভূমিকায়। সমকালীন উপন্যাস রচনায় এমন মুন্সিয়ানাই তাকে পরিণত করেছে ধরাবাঁধা কাঠামোর বাইরের উপন্যাসিকদের ধ্রুবতারা হিসেবে। তার দেখানো পথ ধরেই বাংলা সাহিত্য বহুদূর হেঁটে যাবে, তা বুঝতে আর কারো বাকি ছিলো না। পশ্চিম বাংলার জনপ্রিয় সাহিত্যিক মহাশ্বেতা দেবী, ইলিয়াসের শব্দচয়নে যে নতুন করে বাংলা উপন্যাসের পুর্নজন্ম হচ্ছে তা নিয়ে লিখেছিলেন,
“এ এক নতুন বাংলা ভাষা, শহরের ধুলো-কাদা-মবিল-আবর্জনা-হঠাৎ ধনীর বর্বর অসভ্যতা আস্তাকুঁড়ের মানুষদের বারুদ হয়ে ওঠার ভাষা। শহরের নিচুতলার সমাজের মানুষের বাংলা ভাষা এমন ইজ্জত পায়নি সাহিত্যে। যেমন দেখার চোখ, তেমনি স্বচ্ছ ও কঠিন রাজনীতিক বিশ্বাস, তেমনি ধারালো হিউমার।”
তবে শুধু উপন্যাসেই যে তিনি নতুন ধারার সৃষ্টি করেছেন তা নয়, বাংলা সাহিত্যের মুমূর্ষু ছোটগল্পকে বাঁচিয়ে তোলার দায়িত্বও যেন তার কাঁধেই পড়েছিল।
আখতারুজ্জামান ইলিয়াস; Source: arts.bdnews24.com
আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের জন্ম ১৯৪৩ সালে, বাবা বদিউজ্জামান মোহাম্মদ ইলিয়াস মুসলিম লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। বগুড়া মুসলিম লীগের সেক্রেটারির দায়িত্বও পালন করেছেন তিনি। তাই ইলিয়াস তার রাজনীতির প্রথম পাঠ নিঃসন্দেহে তার বাবার কাছেই পেয়েছিলেন। দেশভাগের সেই উত্তপ্ত সময়টাতে তিনি বড় হয়েছেন, বুঝতে শিখেছেন। দেশভাগের ফলে সৃষ্ট লক্ষ-কোটি মানুষের কান্নার রোল তার অন্তরেও বাসা বেঁধেছিল। পরবর্তীকালে তার রচনায় নানাভাবে চিত্রায়িত হয়েছে এই দৃশ্যপট।
NewsletterSubscribe to our newsletter
and stay updated.
বাবা-মায়ের কাছে প্রাথমিক শিক্ষা আর বগুড়া জিলা স্কুলে পড়া ইলিয়াস ইন্টারমিডিয়েট পড়ার জন্য ভর্তি হলেন ঢাকা কলেজে। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স, মাস্টার্স। জোরেশোরে লেখালেখি না করলেও ইলিয়াস বসে ছিলেন না। আশপাশের যা কিছুই তাকে নাড়া দিতো, তা নিয়েই লেখার চেষ্টা করেতেন। দশম শ্রেণির ছাত্র থাকাকালেই সওগাত পত্রিকায় তার ছোটগল্প প্রকাশিত হয়।
ষাটের দশকে যখন সাহিত্যজগতে ইলিয়াসের পদচারণা শুরু হয়, ততদিনে পূর্ব বাংলার বাংলা সাহিত্য নিজের খুঁটিতে দাঁড়িয়ে গেছে। ১৯৪৩ এর দুর্ভিক্ষ থেকে শুরু করে বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক মন্দা আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যখন ভারতবাসী ক্লান্ত, ঠিক তখনই দেশভাগের করাল গ্রাসে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয় পুরো উপমহাদেশ।
আর এই উপাদানগুলো থেকে শক্তিশালী বাংলা সাহিত্য গড়ে ওঠার যে প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছিল, তা অনেকটাই অনাদরে থেকে গেল। পঞ্চাশ আর ষাটের দশকের খ্যাতিমান বাংলা কথাসাহিত্যিকদের প্রায় সবার গল্প আর উপন্যাসে গ্রামের চেহারা অনেকটাই শোচনীয়। রাজনৈতিক পটভূমিতে বাংলাদেশের গ্রামের কিংবা সমাজের প্রান্তিক মানুষের অংশগ্রহণ যে উপেক্ষিত ছিল, তা বলাই বাহুল্য। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ অবশ্য স্রোতের বিপরীতে হেঁটে জেগে উঠা গ্রামের কথা, সমাজ আর সভ্যতার ঘূর্ণাবর্তে প্রান্তিক মানুষের আখ্যানকে তুলে ধরেছিলেন।
বাংলা সাহিত্যের দুই দিকপাল, আহমদ ছফা এবং আখতারুজ্জামান ইলিয়াস; Source: সুশীল চন্দ্র সিংহ, বাংলামোটর, ঢাকা।
১৯৬০ সালে সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত ‘স্বগত মৃত্যুর পটভূমি’ গল্পের মধ্য দিয়েই ইলিয়াস জানান দিয়েছিলেন, বাংলা সাহিত্যে নতুন যুগ আসছে। যে যুগে মানুষের অনুভূতি, দুঃখ-যন্ত্রণা কিংবা মনোজাগতিক ঘটনাগুলোর বর্ণনা দিয়েই চরিত্রকে চিত্রায়ন করা হবে। এই ধরনের বর্ণনা পাঠককে যেমন চিন্তার খোরাক দেবে, ঠিক তেমনি শব্দের বুননে সমকালকেও অবধারিতভাবেই সামনে নিয়ে আসবে।
তবে এই ব্যাপারটি যে ইলিয়াস একাই বাংলা সাহিত্যে চর্চা করছিলেন, ব্যাপারটি কিন্তু মোটেও সেরকম নয়। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাহিত্যকর্মে এই অনুসূক্ষ্ম মনোজাগতিক বিশ্লেষণের ধারা শুরু হয়েছিল। কিন্তু তারপরে আবারও তা ঝিমিয়ে পড়ে। জেমস জয়েস আর গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের মতো খ্যাতিমান সাহিত্যিকেরাও তাদের গল্প আর উপন্যাসে সূক্ষ্ম বিশ্লেষণের পরিচয় দিয়েছিলেন। ইলিয়াসও এদের সবার কাছ থেকেই অনুপ্রাণিত হয়েছেন। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তার সহকর্মী এবং বন্ধু শওকত আলী বলেছিলেন, “জয়েস ছিলেন ইলিয়াসের একজন প্রিয় লেখক, তেমনি ছিলেন মার্কেজও।” তাই অনেকেই জেমস জয়েসের ইউলিসিসের ছাপ খুঁজে পেয়েছেন চিলেকোঠার সেপাইয়ের চিত্রপট উপস্থাপনা আর চরিত্রগুলোর মনোজাগতিক রসায়ন বিশ্লেষণের গভীরতায়।
চিলেকোঠার সেপাই এর প্রচ্ছদ; Source: ebanglalibrary.com
ইলিয়াসের লেখালেখির শুরুর সময় থেকেই পূর্ব বাংলায় চলছিল অস্থির সময়। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান থেকে শুরু করে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ তার লেখনীতে বেশ ছাপ ফেলেছে। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তার বেশ কয়েকটি আলোচিত ছোটগল্পও আছে। আর এই তালিকায় সবার আগে চলে আসে ‘রেইনকোট’ গল্পটির নাম। মুক্তিযুদ্ধের সময়কালে রসায়নের প্রভাষক নূরুল হুদার দ্বিধাদ্বন্দ্বের মনস্তত্ত্ব নিয়েই গড়ে উঠেছে এই গল্পের দৃশ্যপট। লড়াই না করে বরং সাধারণভাবে গোলমালকে পাশ কাটিয়ে বেঁচে থাকার আকুতি নিয়ে দিনাতিপাত করা নুরুল হুদা কি গল্পের নায়ক? নাকি মুক্তিযুদ্ধে চলে যাওয়া শ্যালক মিন্টুর রেইনকোটটিই নায়ক? তবে পাঠকদের মতে সবাইকে ছাপিয়ে মুক্তিযুদ্ধের অসাধারণ মনস্তাত্ত্বিক দর্শনই হয়ে উঠেছে গল্পের প্রধান চারিত্রিক নায়ক।
মুক্তিযুদ্ধের পরে বাংলাদেশের অস্থির সময়ে সমাজের প্রান্তিক মানুষের চিন্তা, হতাশাকেও পরম মমতায় বন্দী করেছেন ইলিয়াস। অপ্রাপ্তির নৈরাশ্য, যুব সমাজের অস্থিরতা, স্বার্থপরতা আর সামগ্রিক ফলাফল হিসেবে সৃষ্ট মনস্তাত্ত্বিক সংকট নিয়ে তিনি রচনা করেন ‘অন্য ঘরে অন্য স্বর’।
‘অন্য ঘরে অন্য স্বর’ এর প্রচ্ছদ; Source: somewhereinblog.net
বাংলা কথাসাহিত্যের পাঠকের একটি বড় অংশ যেহেতু মধ্যবিত্ত, তাই বাংলা ছোটগল্পই হোক কিংবা উপন্যাসই হোক, সেখানে মধ্যবিত্তের প্রাধান্য ছিল। নিম্নবিত্তের চিন্তা-চেতনা, চাওয়া-পাওয়া কিংবা ভাষা সবই ছিল যেন অনাকাঙ্ক্ষিত। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস উপন্যাসের মতো ছোটগল্পেও সেই মধ্যবিত্তের গণ্ডি ভেঙে দিলেন। ভাষারীতিতে নিয়ে এলেন অভিনব পরিবর্তন। অভূতপূর্ব এই পরিবর্তনকে সম্বল করে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের কথাসাহিত্যেও এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। তাই ‘সংস্কৃতির ভাঙ্গা সেতু’ প্রবন্ধে ইলিয়াস জোর দিয়ে বলেছিলেন,
“আজ মধ্যবিত্তের সংস্কৃতি সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সংস্কৃতি থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। কিন্তু যে মধ্যবিত্ত আজ তাদের ‘মুক্তির জন্য স্থিরসংকল্প’, তাদের ‘শ্রমজীবী নিম্নবিত্তের সঙ্গে যোগাযোগ’ রাখতে হবে।”
আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের যার মধ্য দিয়ে বাংলা সাহিত্যে কিংবদন্তী বলে বিবেচিত হবেন, সেটি হলো ‘খোয়াবনামা’। বগুড়ার কাছাকাছি কোনো এক কালাৎহার বিল আর এর পার্শ্ববর্তী কয়েকটি গ্রামকে কেন্দ্র করে সাধারণ কিছু কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষের ঘটনাগুলো এই উপন্যাসে আবর্তিত হতে থাকলেও, ইলিয়াস সেখানে তেভাগা আন্দোলন থেকে শুরু করে ভারতভাগের ঐতিহাসিক ঘটনাকে যোগ করেছেন সুনিপুণভাবে। অতীতের পলাশীর যুদ্ধ, সিপাহী বিদ্রোহ আর ফকির বিদ্রোহের ফলে মানুষের জীবন আর চিন্তায় পরিবর্তনকে বিশ্লেষণ করেছেন। ভারত বিভাগের ফলে সৃষ্ট সমস্যা প্রান্তিক মানুষকে কীভাবে জর্জরিত করেছে, সেই ব্যাপারটিকেও তুলে এনেছেন তিনি খোয়াবনামায়।
‘খোয়াবনামা’র  প্রচ্ছদ; Source: gobanglabooks.com

যে পা নিয়ে পুরান ঢাকার অলিগলি থেকে শুরু করে সারাদেশে চষে বেড়িয়ে সাধারণ মানুষের স্বপ্ন আর মনস্ততত্ত্বের গল্প লিখেছেন ইলিয়াস, শেষ জীবনে সেই পা দু’টির একটি তার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছিলো ক্যান্সার। অসুস্থ হয়েও লেখালেখি চালিয়ে গেছেন। মনের জোর দিয়েই বাংলা সাহিত্যকে আরেকটু সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন।
চিরচেনা আখতারুজ্জামান ইলিয়াস; Source: wikimedia commons

কিন্তু মাত্র ৫৪ বছর বয়সেই থামতে হয় বাংলা সাহিত্যে নিচুস্তরের মানুষের কথা তুলে আনা অনন্য এই কলমযোদ্ধাকে। ১৯৯৭ সালে যাওয়ার আগে বাংলা সাহিত্যে অসামান্য অবদানের জন্য তাকে ভূষিত করা হয়েছে ‘বাংলা একাডেমি পুরস্কার’, ‘সাদত আলী আখন্দ পুরস্কার’, ‘আনন্দ পুরস্কার’ সহ অসংখ্য পুরস্কার আর সম্মাননায়। নিজের সাহিত্যসৃষ্টির ব্যপারে তার অভিমত ছিলো অনেকটা এরকম,
“আমার সময়ের দেওয়ালের ভেতর আমি শুধু হাঁসফাঁস করি। এভাবে বাঁচা মুশকিল। তাই কোনো বড় কিছু করার জন্যে নয়, এমনি বাঁচার তাগিদে, নিশ্বাস নেওয়ার জন্যে পায়ের পাতায় ভর দিয়ে দেওয়ালের ওপারটা দেখার চেষ্টা করি।”

লেখক: শাহ্ মো: মিনহাজুল আবেদীন
 
তথ্যসূত্র:
সাহা, করুণা রাণী (২০১৫)। ‘আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের সাহিত্যে জীবন ও সমকাল’; পৃষ্ঠা: ৮-১৩
ফিচার ইমেজ: Daily Sun

Sunday, June 25, 2017

নজরুল যা পেরেছিলেন


একাধারে বামুন-মোল্লাকে বিদ্রূপ করতে পেরেছেন, ঈশ্বরের কাছে যাবার জন্য কোনো মধ্যবর্তীর প্রয়োজন নেই বলতে পেরেছিলেন সোচ্চারে। ধর্ম যেখানে ধর্মধ্বজীদের হাতে মানবতার শত্রু হয়, তাকে কলমের আগায় বিঁধতে ভয় পাননি।
"পূজিছে গ্রন্থ ভণ্ডের দল মূর্খরা সব শোন
মানুষ এনেছে গ্রন্থ, গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোন।"

আবার শ্যামা হিন্দুর মা বলে গান লিখতে আটকায়নি তাঁর। ইসলামী সঙ্গীতে ঢেলে দিয়েছেন নিজের সুর-সাধনা। ধর্মের যে ভাব মানবিক তাকে আপন করতে দ্বিধা বোধ করেননি। আশ্চর্য যৌবনে মেতে ছিলেন নজরুল। আশ্চর্য ভাবে মেতেছিলেন।
শ্যামাসঙ্গীত লিখছেন বলে শুধু আত্ম-উদ্ধারের বাসনা ব্যক্ত করেননি।
"আর কতকাল রইবি বেটি, মাটির ঢেলার মূর্তি-আড়াল?
স্বর্গকে আজ জয় করেছে অত্যাচারী শক্তি চাঁড়াল।
দেব-শিশুদের মারছে চাবুক, বীর যুবাদের দিচ্ছে ফাঁসি-
ভূ-ভারত আজ কসাইখানা, আসবি কখন সর্বনাশী?”

বুকের পাটা অনেক বড়। মন বলেছে মা-কে ডাকবেন। দুঃসময়ে সেই অপরূপা শক্তি যদি ভক্তির কথা শুনে প্রলয় নাচনে না আসে, তবে তার কোলের সন্তানের কি হবে? সে শক্তি বাহুতে বাহুতে প্রলয়ের হাওয়া লাগালে তবে সাগরপার করা যাবে অত্যাচারীকে। এবং তিনি আল্লাকেও দাঁড় করিয়েছেন আল্লার নাম নেওয়া জাত-জালেমদের বিরুদ্ধে।
"সিঁড়ি-ওয়ালাদের দুয়ারে এসেছে আজ
চাষা মজুর ও বিড়িওয়ালা;
মোদের হিস্‌সা আদায় করিতে ঈদে
দিল হুকুম আল্লাতালা!
দ্বার খোলো সাততলা-বাড়িওয়ালা, দেখো কারা দান চাহে,
মোদের প্রাপ্য নাহি দিলে যেতে নাহি দেব ঈদ্গাহে!
আনিয়াছে নবযুগের বারতা নতুন ঈদের চাঁদ,
শুনেছি খোদার হুকুম, ভাঙিয়া গিয়াছে ভয়ের বাঁধ।
মৃত্যু মোদের ইমাম সারথি, নাই মরণের ভয়;
মৃত্যুর সাথে দোস্তি হয়েছে – অভিনব পরিচয়।
যে ইসরাফিল প্রলয়-শিঙ্গা বাজাবেন কেয়ামতে–
তাঁরই ললাটের চাঁদ আসিয়াছে, আলো দেখাইতে পথে।
মৃত্যু মোদের অগ্রনায়ক, এসেছে নতুন ঈদ,
ফিরদৌসের দরজা খুলিব আমরা হয়ে শহিদ।
আমাদের ঘিরে চলে বাংলার সেনারা নৌজোয়ান,
জানি না, তাহারা হিন্দু কি ক্রিশ্চান কি মুসলমান।
নির্যাতিতের জাতি নাই, জানি মোরা মজলুম ভাই –
জুলুমের জিন্দানে জনগণে আজাদ করিতে চাই!
এক আল্লার সৃষ্ট সবাই, এক সেই বিচারক,
তাঁর সে লীলার বিচার করিবে কোন ধার্মিক বক?
বকিতে দিব না বকাসুরে আর, ঠাসিয়া ধরিব টুঁটি
এই ভেদ-জ্ঞানে হারায়েছি মোরা ক্ষুধার অন্ন রুটি।"

ইসলামী সঙ্গীত-এর পংক্তি এগুলি। নজরুল কিন্তু নজরুল-ই। খোদার সামনেই বসুন আর শ্যামা মায়ের কোলের কাছে, তিনি বলেন সেই মানুষের কথা, যার কেউ নেই।
নজরুল পেরেছিলেন। আমরা পারিনি।

লেখক:শুদ্ধসত্ত্ব সহজিয়া ঘোষ, নাট্যকার

Sunday, January 22, 2017

“আরজ আলী মাতুব্বর দার্শনিক নন”,আপনি কি দার্শনিক? – ২

১।
আরজ আলী মাতুব্বর কিম্বা সরদার ফজলুল করিম কে “অ-দার্শনিক” প্রমান করবার জঙ্গে যারা হাজির তাদের যুক্তি গুলো কি? দেখুন তাদের যুক্তিগুলো কিরকমের “অকাট্য” !

  • আরজ আলী মাতুব্বর সাহেব কেবল ইসলাম ধর্মের সমালোচনা করেছেন, তিনি কোনও মৌলিক প্রশ্ন তোলেন নি।
  • আর সরদার ফজলুল করিম দর্শন পড়েছেন বটে, দর্শন পড়িয়েছেন বটে এমন কি কিছু দর্শনের বই অনুবাদও করেছেন, কিন্তু তিনি দর্শন চর্চা করেন নি।
তাই এরা দুজনের কেউই দার্শনিক নন। এরা আরো বলেন – আরজ আলী মাতুব্বর একজন ইসলামী বিদ্বেষী আর সরদার ফজলুল করিম কেবলই একজন অনুবাদক। আরজ আলী আর অধ্যাপক সরদারের পেছনের লাগা অনলাইন গোষ্ঠীটির এইই হচ্ছে মোদ্দা কথা। এই লাইনে যেমন আহমেদ – আলম – কুদ্দুসেরা আছেন তেমনি পাল – সাহা – গোমেজ – ভট্টাচার্যরাও আছেন। আমাদের বোঝা দরকার আলম – কুদ্দুস – গোমেজ – ভট্টাচার্যদের ঐক্যের যায়গাটি কোথায়। এদের এই ঐক্যের যায়গাটি এই লেখার এক পর্যায়ে ব্যাখ্যা করবো।
২।
যে সকল অনলাইন পুরোহিত আরজ আলী মাতুব্বর সাহেবের কাজ কে গৌন প্রমানের জঙ্গে লিপ্ত তাদের মতামত কে আমি গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। আমি মনে করি, পৃথিবীর যেকোনো মানুষ মনে করতেই পারেন – অমুক গৌন লেখক, তমুক গৌন শিল্পী কিম্বা অমুক তো দার্শনিক নন, তমুক তো কবি নন ইত্যাদি। কিন্তু যে সকল অনলাইন পুরোহিতেরা আরজ আলী বা সরদার ফজলুল করিমের পেছনে লেগে আছেন কয়েক বছর ধরে, আমরা তাদের এজেন্ডার কথা জানি। এবং আমি মনে করি আমাদের তরুন পাঠকদের এই সকল অনলাইন পুরোহিতদের এজেন্ডাগুলোর কথা জানানোটা জরুরী।


৩।
বাংলাদেশ যেভাবে রকেটের গতিতে ইসলামী মোল্লাতন্ত্রের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, তাতে – সেকুলার, ধর্ম-নিরপেক্ষ, প্রগতিবাদী চিন্তকদের উপরে ব্যক্তি আক্রমন, তাঁদের কাজ কে গৌন বলে প্রচার করা, তাঁদের ভুমিকা, তাঁদের প্রতিষ্ঠান, তাঁদের অর্জন সকল কিছুকে গৌন বলে প্রচার করাটা খুব স্বাভাবিক একটি কাজ, খুবই প্রত্যাশিত প্রবনতা। এই ধরনের প্রচারনার পেছনে রাজনীতিটা আসলে মোল্লাতন্ত্রের রাজনীতি। ঐতিহাসিক ভাবেই মোল্লাতন্ত্র এই সকল কাজ করে এসেছে, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে। একাজ করার জন্যে “মালপানি”র সরবরাহও কম নয়। সেকুলার প্রগতিশীল চিন্তার সাথে মোল্লাতন্ত্রের এই বৈরীতা ঐতিহাসিক। তা সে কখনও ইউরোপে খ্রিস্টিয় মোল্লাতন্ত্রের রুপ ধরে এসেছে আবার কখনও বা এশিয়ার দেশ গুলোতে ইসলামী মোল্লাতন্ত্র কিম্বা ভারতে হিন্দু মোল্লাতন্ত্রের স্বরূপে এসেছে। তাই ভারতে যেমন প্রগতিশীল চিন্তক ইরফান হবিব কে হিন্দু বিদ্বেষী হিসাবে চিহ্নিত করা হয় ঠিক একই কায়দায় ইতিহাসের অধ্যাপক ও গবেষক রোমিলা থাপারকেও হিন্দু বিদ্বেষী বলা হয়। অরুন্ধতী রায় কে বলা হচ্ছে পশ্চিমের দালাল – ভারতের শত্রু। এদের সবারই “দোষ” হচ্ছে এরা নিরন্তর ভাবে ভারতের ভয়াবহ মোল্লাতন্ত্র – হিন্দুত্তবাদের বিরুদ্ধে তাঁদের সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন। ভারতের কর্পোরেট পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে নিরন্তর সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন। মোল্লাতন্ত্র আর কর্পোরেট পুঁজির ঐক্য তো ঐতিহাসিক। পৃথিবীর ইতিহাস আমাদের বলে দেয়, পুঁজি কখনই মোল্লাতন্ত্র কে উৎখাত করতে চায়নি, বরং পুঁজি – পুজিবাদ সবসময়েই মোল্লাতন্ত্রের সাথে হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করেছে। যেখানে যেখানে দরকার সেখানে সেখানে পুঁজির সবচাইতে কাছের বন্ধু হচ্ছে – ধর্ম বা মোল্লাতন্ত্র। ভারতে যারা ইরফান হবিব – রোমিলা থাপার বা অরুন্ধতী রায়ের গুষ্ঠি উদ্ধার করছেন দিন রাত, তাঁদের ঠিকুজি নিয়ে দেখুন … পেয়ে যাবেন হিন্দুত্ববাদের এলিট প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিগুলোকে। একই ভাবে, বাংলাদেশে যারা আরজ আলী মাতুব্বর, আহমদ শরীফ, সরদার ফজলুল করিম, হুমায়ুন আজাদ বা সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী সহ আরো অনেকের পেছনে লেগে আছেন দলবল নিয়ে, তাঁদের ঠিকানা – সাকিন – পরিচয় নিয়ে দেখুন, দেখবেন, গোড়াটা একই যায়গায় বাঁধা – ওপারে হিন্দুত্ববাদ আর এপারে ইসলাম আর দুপারেই রয়েছে মোল্লাতন্ত্র আর ব্যবসায়ী – বেনিয়াদের জোট । ইরফান হবিব-রোমিলা থাপার – অরুন্ধতী রায় – আরজ আলো মাতুব্বর – সরদার ফজলুল করিম – আহমদ শরীফ – হুমায়ুন আজাদ – সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী এদের সকলকে গৌন প্রতিপন্ন করাটা মোল্লাতন্ত্রের বড় এজেন্ডার অংশ। শুধু প্রেক্ষিত ভেদে তা কখনও হিন্দু মোল্লাতন্ত্র কিম্বা ইসলামী মোল্লাতন্ত্রের অংশ মাত্র। আসুন এবার, বাংলাদেশের মোল্লাতন্ত্রের প্রতিনিধিদের “কে দার্শনিক” বিষয়ক প্রশ্নটি নিয়ে আলোচনা করি।

৪।
কে দার্শনিক আর কে নয়? প্রশ্নটা প্রায় একই রকমের যখন আমরা জিজ্ঞাসা করি কে কবি আর কে নয়। অর্থাৎ কোনটা কবিতা তা যত সহজে বোঝা যায় কবিকে ততটা সহজে বোঝা যায়না। তাই – আধুনিক কালে দর্শন কি, দর্শনের আওতা কতদূর, দর্শনের আলোচনার প্রধান প্রশ্ন গুলো কি কি, আর দর্শনের পদ্ধতিই বা কি রকমের? এই সকল প্রশ্ন নিয়ে হাজার হাজার লেখা পাওয়া যাবে। দর্শনের একাডেমিক বই গুলোতে এই শিরোনামের অধ্যায় গুলো পাওয়া যাবে। কিন্তু কে দার্শনিক আর কে নয়, এ বিষয়ে আলোচনার – লেখালেখির নজির খুব বেশী নয়। এমন কি কে দার্শনিক নন, এটা পেশাদার দার্শনিকদের আলোচনার বিষয়ের মধ্যে পড়েই না। বরং দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি কি, একজন মানুষ কখন দার্শনিক হয়ে ওঠেন সেই সকল বিষয়ে কিছু আলোচনা আছে।

৫।
প্রথম পর্বে উল্লেখ করেছি, আরজ আলী মাতুব্বর আর সরদার ফজলুল করিমের বিরুদ্ধে এই জঙ্গের নেতৃত্ব দিচ্ছেন যে অনলাইন পুরোহিত, তিনি অনুবাদ করেছিলেন (অথবা করিয়ে নিয়েছিলো)ফরাসী দার্শনিক রেনে দেকারতের পুস্তক, সেই অতি নীচু মানের অনুবাদের ভুমিকা লিখে দিতে রাজী হননি অধ্যাপক সরদার ফজলুল করিম। সেই থেকেই সরদার ফজলুল করিমের নাম দার্শনিকের খাতা থেকে কাটা যায়। আমার বিশ্বাস, অধ্যাপক সরদার বা মাতুব্বর সাবের কেউই খুন মাইন্ড করবেন না – যদি বাংলাদেশের মোল্লাতন্ত্র তাঁদেরকে দার্শনিকের খাতা থেকে বাদ দিয়ে দেন। বরং আসুন মূল আলোচনাটা শুরু করি – কে দার্শনিক, কখন ও কিভাবে দার্শনিক?

রেনে দেকারতেরই একটা বিখ্যাত কথা দিয়ে শুরু করি। পড়ে দেখুন –
“It is now some years since I detected how many were the false beliefs that I had believed to be true since my earliest youth. And since that time, I have been convinced that I must once and for all seriously try to rid myself of all the opinions which I had formerly accepted, and begin to build a new, if I wanted to establish any firm and permanent structure for my beliefs.”
— René Descartes, Meditations

“অনেক বছর হলো, আমি এখন বুঝতে পারি, আমার যৌবন থেকে এখন পর্যন্ত কতগুলো ভুল ও মিথ্যা বিশ্বাস আমি সত্যি বলে জেনেছিলাম। যেদিন থেকে বুঝেছি, সেদিন থেকেই মনে করেছি, আমি অন্তত একবার, সকল শক্তি দিয়ে চেষ্টা করবো আমার বয়ে বেড়ানো সেই সকল মিথ্যা বিশ্বাস – সংস্কার থেকে বেরিয়ে এসে আমার নিজের চিন্তা গড়ে তুলতে, যা হবে দীর্ঘস্থায়ী এবং আমার নিজস্ব চিন্তা”।
— মেডিটেশন, রেনে দেকারতে
(অনুবাদ আমার নিজের, ভুল হলে দেখিয়ে দিন, শুধরে নেবো)
রেনে দেকারতে হচ্ছেন আধুনিক দর্শনের জনক। ফরাসী এই নাক উচু ভদ্রলোক দর্শনে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্যে স্মরনীয়। তাঁর কথা বলার আগে, খেয়াল করে দেখুন, তিনি কি বলছেন – জীবনের একটা পর্যায়ে এখন তিনি বুঝতে পারেন, কত ভুল ধারণা বিশ্বাস তিনি পুষে রেখেছিলেন, বহন করেছিলেন তাঁর যৌবন কালে, সে সকল ভুল ধারণা, বিশ্বাস থেকে তিনি এখন বেরিয়ে আসতে চান। এবং আশা প্রকাশ করছেন – একদিন তিনি তাঁর নিজের রচিত – গড়ে তোলা চিন্তার মাঝে বসবাস করবেন। দেকারতের মন্তব্যটিতে কোনও সুনির্দিষ্ট বিশ্বাসের কথা বলা নেই, এটা কি ধর্ম বিশ্বাস নাকি অন্য কোনও প্রসঙ্গে? তাতে আসলে কিছু যায় আসেনা, যদি আমরা তাঁর “বোধ” টিকে বোঝার চেষ্টা করি।
(রেনে দেকারতে, আধুনিক দর্শনের অন্যতম ব্যক্তি, পুরনো বিশ্বাসকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে গড়ে তুলেছিলেন, নিজের চিন্তা – বিশ্বাস।)
সকল মানুষের এই বোধদয় হয়না। বরং বাস্তব জীবন থেকে বললে – বলা যাবে, পৃথিবীর বেশীর ভাগ মানুষেরই তাঁর জীবদ্দশায় এই বোধদয় হয়না। খুব কম মানুষই ভেবে উঠতে পারেন … যে সে তাঁর সমগ্র শৈশব – কৈশোর – যৌবন ধরে অসংখ্য ভ্রান্তির মাঝে অতিবাহিত করেছে, এখন সময়, সেই সকল ভ্রান্তি কে দূর করার, নতুন চিন্তা গড়ে তোলার। রেনে দেকারতের এই বোধদয় ছিলো এবং তিনি তা দূর করার চেষ্টা করেছেন তাঁর নিজের চিন্তা গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে।
এটা দর্শনের একটি প্রধান ধাপ – বর্তমান – অস্তিত্তমান বিষয়ের প্রসঙ্গে প্রশ্ন তোলা, পুরনো চিন্তার মাঝ থেকে বেরিয়ে এসে নিজের চিন্তা গড়ে তোলা, অন্তত গড়ে তোলার চেষ্টা করা।
প্রশ্ন হচ্ছে – মানুষ কিভাবে পুরনো চিন্তা থেকে বেরিয়ে এসে নিজের মতো করে নতুন চিন্তা গড়ে তোলে বা তোলার চেষ্টা করতে পারে? এর কোনও সোজা সাপটা উত্তর নেই। অথবা এর হয়তো অসংখ্য উত্তর আছে। তবে সবচাইতে সহজ উত্তর টা হচ্ছে – “জিজ্ঞাসা” ! মানুষ জিজ্ঞাসার মাধ্যমেই তাঁর নিজের পুরনো জ্ঞান – জানাশোনা – বোধ কে চ্যালেঞ্জ করে এবং নতুন জ্ঞান – জানাশোনা – বোধ তৈরী করার চেষ্টা করে। এই পথপরিক্রমায় হয়তো নানান পদ্ধতিগত ধাপ আছে – নানান টুল আছে ব্যবহারের। পদ্ধতিগত বিষয়ে নানান তফাত থাকলেও – মৌলিক বিষয়টি হচ্ছে – “জিজ্ঞাসা” বা প্রশ্ন তোলা। এই জিজ্ঞাসা কখনও নিজের সম্পর্কে কখনও বা বহিরঙ্গন সম্পর্কে, কখনও সৃষ্টি বা স্রষ্টা সম্পর্কে কিম্বা প্রকৃতি সম্পর্কে।
৬।
সাম্প্রতিক সময়ের এক দর্শনের অধ্যাপক বিষয়টিকে এভাবে লিখেছেন – “ফিলসফি বা দর্শনের শুরুটা প্রায়ই হয় কিছু ঘ্যান ঘ্যান করা ব্যক্তিগত প্রশ্ন দিয়ে। প্রায়শই আমাদের দার্শনিক চিন্তার শুরু হয় কোনও বিশাল হতাশা বা বিষাদের মধ্যে দিয়ে। কখনও কখনও বড় সড় ট্র্যাজেডি থেকেই আমাদের দার্শনিক চিন্তার উদ্ভব ঘটে। আমাদের দার্শনিক চিন্তার শুরু হয় যখন সত্যিই আমরা অনেক কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে অতিবাহিত করি, যখন আমারা সত্যিই অনেক কঠিন প্রশ্নের মুখোমুখি হই ও সেসবের সমাধানের চেষ্টা করি। সোজা করে বললে দর্শন হচ্ছে জীবনের সেই বড় প্রশ্ন গুলো উত্থাপন করা। দর্শন হচ্ছে জীবনের প্রাথমিক প্রশ্নগুলো তোলা, আমাদের চিন্তা ও জ্ঞানের জগতের খুব ছোট কিম্বা বড় কিম্বা প্রাথমিক প্রশ্নগুলো তোলা, সেইসকল প্রশ্ন যা প্রায়শই আমরা ধরাধার্য বলে মেনে নেই, প্রশ্ন করিনা। ধরা যাক আমরা জানি মানুষ হত্যা খুব মন্দ একটি কাজ। এটা আমরা বিশ্বাস করি এবং ধরেই নেই সঠিক বলে কিন্তু কেউ যদি প্রশ্ন তোলে কেনও মানুষ হত্যা ভালো কাজ নয়? কখন মানুষ হত্যা ভালো কাজ নয়? এই নৈতিক অবস্থানটি কি সকল সময়েই সঠিক? এই প্রশ্নগুলো বিব্রতকর, কঠিন প্রশ্ন এবং আমরা সকলেই হয়তো এই ধরনের বিব্রতকর-কঠিন প্রশ্নগুলো করিনা, অথচ এসকল প্রশ্ন জীবনেরই অংশ। সাধারণ মানুষের প্রাত্যহিক মধ্যবিত্ত যাপিত জীবনে এই প্রশ্নগুলো করা হয়ে ওঠেনা, তাঁরা এই সকল প্রশ্নের একধরনের উত্তর বা নৈতিক অবস্থান কে ধরাধার্য হিসাবে মেনে নেন। কিন্তু কেউ কেউ এধরনের বিব্রতকর প্রশ্নগুলো তোলেন, সেসবের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেন, এই সকল প্রশ্নের প্রেক্ষিতে নিজের চিন্তাগুলোকে আরটিকুলেইট বা সংঘবদ্ধ করেন বা গুছিয়ে তোলেন, সেই সকল গোছানো চিন্তার পেছনে যুক্তি দাঁড়া করেন এবং সব শেষে… সেই সকল চিন্তার প্রকাশ, অন্যদের কে জানানো – কখনও লিখে,কখনও বা বলে। হয়তোবা এই নতুন চিন্তার সাথে বেশীরভাগ মানুষ একমত হবেন না, কিম্বা মানুষ হয়তো প্রতিক্রিয়ায় আক্রান্ত হবেন এই নতুন চিন্তায়, কিন্তু এইই হচ্ছে দর্শনের পদ্ধতি। বলা যেতে পারে, প্রায়শই দর্শনের শুরুই হয় দ্বিমত দিয়ে, ভিন্নমত পোষণের মধ্যে দিয়ে।” (The Big Question – Robert C Solomon, Kathleen Higgins)

৭।
আমি জানি, কুট তার্কিক বন্ধুরা বলবেন, প্রশ্ন তোলাই যদি দর্শন হয়, তাহলে পৃথিবীর সকল মানুষই দার্শনিক, তাহলে তো পৃথিবীতে কোটি কোটি দার্শনিক ! প্রশ্ন তোলাই যদি দার্শনিক হওয়ার প্রাথমিক শর্ত হয়, তাহলে তো শিশুরা সবচেয়ে বড় দার্শনিক ! আপাত যুক্তিতে হয়তো তাইই। অর্থাৎ যেকোনো মানুষই দার্শনিক হতে পারেন। শিশুরাও দর্শনের প্রশ্ন তুলতে পারে। কিন্তু বিষয় হিসাবে দর্শন তা বলেনা। সকল প্রশ্নই দার্শনিক প্রশ্ন নয়। কেনো নয়, সে বিষয়ে দ্বিমত – ভিন্নমত – বহুমত থাকতে পারে, কিন্তু সকল প্রশ্নই দার্শনিক প্রশ্ন হিসাবে উত্তীর্ণ হয়না। এই বিষয়ে বহু লেখালেখি আছে। দর্শনের একাডেমিক পুস্তকগুলোতে তাই ইদানিং সুনির্দিষ্ট অধ্যায়ই থাকে – দার্শনিক প্রশ্ন কি সে বিষয়ে আলোচনা নিয়ে। হাতের কাছে একটা বহুল পঠিত ও স্বীকৃত দর্শনের প্রবন্ধ আছে – দার্শনিক প্রশ্ন কি এ বিষয়ের উপরে, প্রখ্যাত দার্শনিক ও দর্শনের অধ্যাপক Nermi Uygur ১৯৬৪ সালে, দার্শনিক প্রশ্ন কি? এ বিষয়ে একটি দারুন প্রবন্ধ লেখেন। প্রবন্ধটিতে তিনি বিষয়টির তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা দেন, কেনও আমাদের দৈনন্দিন প্রশ্নগুলো দার্শনিক প্রশ্ন নাও হতে পারে। দুটি খুব সহজ উদাহরন ব্যবহার করেছেন তিনি – আমি শুধু প্রেক্ষিত বদল করে তাঁর ব্যাখ্যাটি তুলে ধরছি। ধরুন, ঢাকা শহরে এখন এপার্টমেন্ট ব্যবসায়ের রমরমা অবস্থা (না হলেও ধরে নিন)। আপনি একটি এপার্টমেন্ট কিনবেন, তাই আপনি প্রশ্ন করছেন – “এখানকার এপার্টমেন্ট গুলোতে কয়টা করে বেডরুম আছে?” – এই প্রশ্নটি কি একটি দার্শনিক প্রশ্ন? কিম্বা হতে পারে? এই প্রশ্নটি একটি দার্শনিক প্রশ্ন হয়ে ওঠার সম্ভাবনা প্রায় শুন্যের কাছাকাছি। কেননা, কেবলমাত্র একটি সংখ্যা প্রশ্নকারীর সকল উত্তর দিতে পারে, কেবলমাত্র একটি সংখ্যার উল্লেখ এই বিষয়ের সকল জানার আগ্রহকে নিবৃত্ত করতে পারে। ধরুন উত্তরটি হচ্ছে – “চারটি বেডরুম আছে”। মাত্র একটি শব্দ – “চারটি”, উল্লেখিত প্রশ্নটি সম্পর্কে সকলের আগ্রহের অবসান ঘটায় এখানে। ধরুন, আপনি সেই ফ্ল্যাটটি কিনেছেন এবং একদিন আপনার সন্তান কে জিজ্ঞাসা করছেন – “রান্নাঘরের দরোজাটি কি বন্ধ নাকি খোলা?” এই প্রশ্নটি কি দার্শনিক প্রশ্ন হতে পারে? এটাও দার্শনিক প্রশ্ন হয়ে ওঠার সম্ভাবনা প্রায় শুন্যের কাছাকাছি। কেনন – মাত্র দুটি অপশনের যেকোনো একটি দিয়ে এই প্রশ্নটি সম্পর্কে সকল মিমাংসা করে দেয়া সম্ভব। “খোলা” অথবা “বন্ধ” এই দুটি শব্দের যেকোনো একটি হচ্ছে পার্থিব উত্তর। কিম্বা প্রশ্নটি শুধুমাত্র একটি অপশন দিয়েও করা যেতে পারে – “রান্না ঘরের দরোজাটি কি খোলা”? এই প্রশ্নেরও পরিনতি একই। কিন্তু ধরুন তো – “জীবনের মানে কি?” এই প্রশ্নটির কতগুলো উত্তর হতে পারে? একটি? দুইটি কিম্বা চৌদ্দটি? কিম্বা দুই হাজার? কিম্বা দুই লক্ষ উত্তর? এমন কি দুই লক্ষ উত্তর হলেও – দু’লক্ষতম উত্তরটিও হয়তো এই প্রশ্নটিতে পৃথিবীর সকলের আগ্রহ নিবৃত্ত করতে পারবেনা, অর্থাৎ কোনও উত্তরই শ্রোতার পরবর্তী প্রশ্ন করাকে বন্ধ করতে পারেনা। এটাই হচ্ছে প্রাত্যহিক প্রশ্ন ও দার্শনিক প্রশ্নের মাঝে একটা উল্লেখযোগ্য পার্থক্য। প্রাত্যহিক প্রশ্নের ঠিক কিম্বা বেঠিক উত্তর তৈরী থাকে, দর্শনের প্রশ্নের কোনও ঠিক বেঠিক উত্তর নেই, শুধু উত্তর খোঁজার প্রয়াস আছে।

৮।
আরজ আলী মাতুব্বর এর লেখালেখিগুলোকে তিনখন্ডে প্রকাশ করেছে ঢাকার একটি প্রকাশনা (অন্তত আমার কাছে এগুলোই আছে)। প্রথম খন্ডের প্রথম অংশের নাম “সত্যর সন্ধান” … এই পুস্তকে তিনি শুরু করেছিলেন মানুষের জিজ্ঞাসা দিয়ে… এবং কয়েকটি অধ্যায়ে তিনি বিন্যস্ত করেছেন তাঁর প্রশ্ন গুলো এবং তাঁর পেছনে দাড়া করিয়েছেন তাঁর যুক্তির দেয়াল। যারা আরজ আলী মাতুব্বর এর লেখা সত্যিই পড়েছেন – তাঁরা জানেন, আরজ আলী মাতুব্বর এর তোলা প্রশ্ন গুলো কি প্রাত্যহিক জীবনের প্রশ্ন নাকি সেই প্রশ্নগুলো মাতুব্বর সাহেবের নিজের পুরনো বিশ্বাস থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা। মাতুব্বর শুধু নিজেই তাঁর পুরনো বিশ্বাস কে প্রশ্নবিদ্ধ করেন নি, তিনি তাঁর সাথের ও তাঁর পরবর্তী মানুষদেরও সেই সকল প্রশ্নের সহযাত্রী করেছেন। মাতুব্বর সাহেব লিখেছেনঃ

“জগতে এমন অনেক বিষয় আছে, সেসব বিষয়ে দর্শন, বিজ্ঞান ও ধর্ম এক কথা বলেনা। আবার ধর্ম জগতেও মতানৈক্যর অন্ত নেই। যেখানে একই কালে দুইটি মত সত্য হইতে পারেনা সেখানে শতাধিক ধর্মে প্রচলিত শতাধিক মত সত্য হইবে কিরুপে? যদি বলা হয় সত্য হইবে একটি তখন প্রশ্ন হইবে কোনটি এবং কেনো? অর্থাৎ সত্য বিচারের মাপকাঠি কি? সত্যতা প্রমানের উপায় কি এবং সত্যর রুপ কি?”
— আরজ আলী মাতুব্বর রচনা সমগ্র, খন্ড – ১, পৃষ্ঠাঃ ৫০ / ৫১
প্রথম অধ্যায়ের শেষে তিনি প্রশ্ন রেখেছেন –
  1. আমি কে?
  2. প্রান কি অরুপ না স্বরূপ?
  3. মন ও প্রান কি এক?
  4. প্রানের সহিত দেহ ও মনের সম্পর্ক কি?
  5. প্রান চেনা যায় কি?
  6. আমি কি স্বাধীন?
  7. অশরীরী আত্মার কি জ্ঞান থাকিবে?
— আরজ আলী মাতুব্বর রচনা সমগ্র, খন্ড – ১, পৃষ্ঠাঃ ৫৯ / ৬১
পাঠকের কাছে প্রশ্ন – বলুন তো এই প্রশ্নগুলো কি প্রাত্যহিক প্রশ্ন? নাকি দার্শনিক প্রশ্ন? প্রশ্নগুলো কি কোনও বিশেষ ধর্মের সমালোচনা? নাকি জীবন অনুসন্ধিৎসা? এই প্রশ্নগুলো থেকে আরজ মাতুব্বর সাহেব চেষ্টা করেছেন নিজের মতো করে অনুসন্ধান করতে, নিজের যুক্তি গুলোকে সাজাতে এবং নিজের চিন্তা – উপসংহার গুলোকে লিখে প্রকাশ করতে – একজন দার্শনিক এভাবেই তাঁর চিন্তাকে গড়ে তোলেন। তাঁর প্রকাশের ধরন হয়তো আমাদের আধুনিক নাগরিক মস্তিস্ক কে খুব স্বস্তি দেয়না, আমরা হয়তো ঠিক এভাবে বিষয়গুলিকে দেখিনা, দেখতে চাইনা, হয়তো আরজ মাতুব্বর সাহেবের লেখায় শহুরে মেকী “ক্ল্যাসিক” ভাবটি নেই, কিন্তু প্রশ্নগুলো দার্শনিক প্রশ্ন নাকি প্রাত্যহিক প্রশ্ন এ বিষয়ে কি ভেবে দেখবেন? আরজ মাতুব্বর এর পুস্তকগুলো অনলাইনে খুবই সহজলভ্য – পড়ে দেখুন, প্রেজুডিস বা সংস্কার মুক্ত থেকে পড়ে দেখুন, তারপর নিজেকে প্রশ্ন করুন – আরজ মাতুব্বর যে সকল প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন, সেগুলো কি দার্শনিক প্রশ্ন?
৯।
আরজ আলী মাতুব্বর রচনাসমগ্র ডাউনলোড করতে পারেন এখান থেকে আরজ আলী মাতুব্বর রচনাসমগ্র

আমি বলছিনা যে আরজ আলী মাতুব্বর সাহেবকে আপনার দার্শনিক হিসাবে স্বীকার করতেই হবে। এই স্বীকার করা না করা দিয়ে মাতুব্বর সাব তো বটেই তাঁর পাঠকদেরও কিছু যায় আসেনা। আমি চেষ্টা করলাম, দর্শনের চর্চা কিভাবে কিভাবে শুরু হয়, দার্শনিক প্রশ্ন কি? তাঁর একটা সহজ প্রাথমিক ধারণা দেবার, বলাই বাহুল্য দর্শনের একাডেমিক পুস্তক/প্রবন্ধ থেকেই আলোচনাটি করার চেষ্টা করেছি। যারা আরজ আলী মাতুব্বর এর লেখার নিবিড় পাঠক, তাঁরা সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন, আশা করি।
আগামী পর্বে দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে আলোচনা করবো।
(চলবে)

 লেখক:, লেখক ও প্রাবন্ধিক

রেফারেন্সঃ
Nermi Uygur (1964) What is a Philosophical Question? Mind, New Series, Vol. 73, No. 289 (Jan., 1964), pp. 64-83
Robert C Solomon, Kathleen Higgins, (2010), The big questions: A short introduction to philosophy, 8th ed. 2010, 2006 Wadsworth, Cengage Learning –

Wednesday, August 19, 2015

প্রজন্মের জন্য যুদ্ধ শুরু করেছি

অভিজিৎ রায় আর অনন্ত বিজয়ের খুনীরা গ্রেফতার হয়েছে, দেশে আর ব্লগার খুন হবে না।- এতটা নিশ্চিন্ত না হবার জন্য লেখক ও ব্লগার বন্ধুদেরকে অনুরোধ করছি।আগের হত্যাকান্ডগুলোর ধরা পড়া খুনীরা জামিনে বাইরে। সরকার আর পুলিশ এখনো আমাদের সম্পূর্ণ আস্থা অর্জন করতে পারেনি, বরং প্রতিটি হত্যাকান্ডেই আমাদেরকে বিভ্রান্ত করেছে এবং আমাদের মনে অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। দেশের অনেক ডাক্তার, ইন্জিনিয়ার, শিক্ষক, ঈমাম, এমনকি সর্বোচ্চ আদালতের আইনজীবিরাও জঙ্গিবাদ, হত্যা ও সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে পৃষ্টপোষকতায় লিপ্ত। ৯৫% মুসলমান, এক কোটি মাদ্রাসা শিক্ষার্থী, প্রবল ধর্মানুভূতিশীল ইসলামী রাষ্ট্র আর সমাজ ব্যাবস্থায় প্রতিদিনই অসংখ্য নতুন নতুন মৌলবাদীর জন্ম হবার কথা। তাই, দেশে ধর্মনিরপেক্ষতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সুশাসন আর মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার সম্পূর্ণ প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত বিজ্ঞানমনস্ক ও যুক্তিবাদী লেখক আর ব্লগার, এবং সবাক নাস্তিকদেরকে সব সময়ই অতিরিক্ত সাবধানতায় দিন যাপন করতে হবে।
এটা আমাদের দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ। দেশের বীর যোদ্ধারা মাত্র নয় মাসে দেশের স্বাধীনতা অর্জন করলেও মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার আর ব্যক্তিস্বাধীনতা অর্জনে অনেক সময় নব্বই বছরও যথেষ্ঠ নয়। আমরা আমাদের পরের প্রজন্মের জন্য যুদ্ধ শুরু করেছি মাত্র।

লেখক: ওমর ফারুক লুক্স, লেখক ও শিল্পী

Monday, March 12, 2012

হিন্দুশাস্ত্রে পাপ ও নাস্তিকতা

‘পাপ’ শব্দটি মানুষের একটি কন্সেপ্ট মাত্র। তবে অভিধানে এ ‘পাপ’ শব্দের অর্থান্তর দেখলে রীতিমতো অবাক হতে হয়। কতরকম নামকরণ! অন্যায়, অধর্ম, অপুণ্য, দুষ্কৃতি, পাতক, অঘ, অংহ, শাবর, কল্মাষ, কিল্বিষ, কলুষ, কর্বুর, কিন্ব, কল্ব, প্রত্যবায়, দুরিত, অপরাধ, গুনাহ, গুনাহখাতা, বদি, ময়লা ইত্যাদি কত নামে ডাকা হয় পাপকে। অথচ এর বিপরীত শব্দ ‘পুণ্য’-এর ক্ষেত্রে অর্থান্তর অর্ধেকও নেই। হিন্দুশাস্ত্রে এ পাপকে ভাগ করা হয়েছে আবার তিন ভাগে। এগুলোকে একত্রে বলে ত্রিপাপ : ১. অনুপাতক; ২. উপপাতক; ৩. মহাপাতক বা মহাপাপ বা ঘোরপাপ। আলোচনা করা যাক এ তিন পাপ নিয়ে। ‘অনুপাতক’ শব্দটি বিশ্লেষণ করলে পাওয়া যায় অনু (সাদৃশ্য)+পাতক (পাপ) অর্থাৎ সাদৃশ্য পাপ। কথা হচ্ছে সাদৃশ্যটি কার সঙ্গে? মহাপাতকের সাদৃশ পাপই বিবেচিত হয় অনুপাপ হিসেবে। এ পাপের মধ্যে পড়ে : মিথ্যা কথা, মিথ্যা সাক্ষ্য, প্রতারণা, গচ্ছিত দ্রব্য দখল, ভূমি দখল, পরের স্ত্রী সঙ্গে সহবাস, বেদ ভুলে যাওয়া, বন্ধুর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা, মদপান ইত্যাদি। এমনই পঁয়ত্রিশ প্রকার অনুপাপ রয়েছে। অন্যদিকে ব্রাহ্মণ হত্যা, ব্রাহ্মণের স্বর্ণচুরি, মদপান, গুরুপতœীহরণ ইত্যাদি মহাপাতকের পর্যায়ে পড়ে। আর আছে ঊনষাটটি উপপাতক, অর্থাৎ অপেক্ষাকৃত লঘু পাপ। এর মধ্যে অন্যতম হলো : পরস্ত্রীগমন, নিজেকে বিক্রি, স্ত্রীকে বিক্রি, সন্তান বিক্রি, মাতৃত্যাগ, পিতৃত্যাগ, পুত্রসন্তানকে ত্যাগ, আত্মীয়-স্বজন বা বন্ধুত্যাগ, কন্যাদূষণ, অনিষ্ট করার ইচ্ছায় মন্ত্রতন্ত্র পাঠ ও নানা ক্রিয়া, ঋণ পরিশোধ না-করা, নাস্তিকতা, গোহত্যা ইত্যাদি। এ থেকে দেখা যাচ্ছে নাস্তিকতা একটি পাপকর্ম। আর এমনই পাপ যে, তা মা-বাবা-সন্তানত্যাগের মতো অনৈতিক এবং পরের স্ত্রীর সাথে সহবাস বা নিজের স্ত্রীকে অন্যের কাছে বিক্রি করার মতো সমাজগর্হিত কাজের সঙ্গে তুলনীয়। শাস্ত্র নাস্তিকদের এভাবেই বিচার-বিশ্লেষণ করেছে।
অপরদিকে ইসলাম ধর্মে কবিরা গুনাহ অর্থাৎ মহাপাপ হলো ৫০টি। গভীরভাবে না ভাবলেও চলবে, একটু খোলা চোখে দেখলেও এই ৫০টি পাপকর্ম একই তালিকাভুক্ত হওয়াকে অনেকক্ষেত্রে রীতিমতো হাস্যকার ব্যাপার মনে হবে। যেমন : দাড়ি কামানো আর নিরপরাধ ব্যক্তিকে হত্যা করা কীভাবে একই অপরাধে দুষ্ট হতে পারে তা আমার জানা নেই। একপলক না হয় দেখে নেওয়া যাক গুনাহের তালিকাটি : ১. তাচ্ছিল্যের সাথে কারও প্রতি বিদ্রুপ করে হাসা; ২. কাউকে খোটা দেওয়া; ৩. কাউকে মন্দ আখ্যা দিয়ে ডাকা; ৪. কুধারণা করা; ৫. কারও দোষ খোঁজ করা; ৬. কারও কুৎসা রটানো; ৭. অকারণে কাউকে দোষারোপ করা; ৮. আড়ালে কারও নিন্দা করা; ৯. অপবাদ দেওয়া; ১০. প্রতারণা করা; ১১. কাউকে তার পূর্বের গুনাহর জন্য লজ্জা দেওয়া; ১২. কারও ক্ষতিতে খুশি হওয়া; ১৩. অহংকার করা; ১৪. গৌরবান্বিত হওয়া; ১৫. সামর্থ থাকা সত্ত্বেও অসহায় লোকদের সাহায্য না করা; ১৬. কারও সম্পদের ক্ষতি করা; ১৮. কারও চরিত্রে আঘাত করা; ১৯. ছোটদের ¯েœহ না করা; ২০. অনাহারী ও বস্ত্রহীনদের উপযুক্ত সাহায্য না করা; ২১. পার্থিব মনোমালিন্যের কারণে পরস্পর তিন দিনের বেশি কথা বন্ধ রাখা; ২২. কোনো প্রাণীর ছবি তোলা; ২৩. অন্যের জমির ওপর মালিকানা দাবি করা; ২৪. সুস্থ-সবল শরীরে ভিক্ষা করা; ২৫. দাঁড়ি কামানো বা এক মুঠোর কম ছেটে ফেলা; ২৬. কাফের ও ফাসেকদের পোশাক ও ভেশভূষা পরিধান করা; ২৭. পুরুষেরা মহিলাদের পোশাক ও ভেশভূষা পরিধান করা; ২৮. মহিলারা পুরুষদের পোশাক ও ভেশভূষা পরিধান করা; ২৯. অপকর্ম করা; ৩০. চুরি করা; ৩১. ডাকাতি করা; ৩২. মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া; ৩৩. এতিমদের জিনিস আত্মসাৎ করা; ৩৪. মা-বাবার কথা অমান্য করা ও তাদের কষ্ট দেওয়া; ৩৫. নিরপরাধ লোককে হত্যা করা; ৩৬. মিথ্যা প্রতিজ্ঞা করা; ৩৭. ঘুষ গ্রহণ করা; ৩৮. ঘুষ দেওয়া; ৩৯. ঘুষ লেনদেনে সহায়তা করা; ৪০. মদপান করা; ৪১. জুয়া খেলা; ৪২. জুলুম করা; ৪৩. কারও কোনো জিনিস বিনা অনুমতিতে নিয়ে যাওয়া; ৪৪. সুদ গ্রহণ করা; ৪৫. সুদ দেওয়া; ৪৬. সুদের চুক্তিপত্র লেখা; ৪৭. সুদের সাক্ষী হওয়া; ৪৮. মিথ্যা কথা বলা; ৪৯. গচ্ছিত দ্রব্য আত্মসাৎ করা এবং ৫০. প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করা । সূত্র : মাজালিসে আবরার (২ খ-, পৃষ্ঠা : ১৭)। সচেতন পাঠকের কাছে নিশ্চয়ই এর পর আর বিস্তৃত আলোচনা দাবি করে না। তাদের কাছে এ তালিকা উপস্থাপনই যথেষ্ট। ‘কীসের সঙ্গে কী পান্তা ভাতে ঘি’ প্রবাদটি মনে হয় এ ক্ষেত্রে যথাযথ হবে।
পাপ ও নাস্তিকতা নিয়ে যেহেতু এ লেখা সেহেতু এবার আসা যাক আস্তিক ও নাস্তিক প্রসঙ্গে। আস্তিক বা নাস্তিক শব্দের সাধারণ যে অর্থ সকলের কাছে পরিচিত তা দিয়ে আলোচনা শুরু করছি। লেখাটি শেষ হবে এর বুৎপত্তিগত অর্থ দিয়ে। প্রথমে করা যাক ‘নাস্তিক’ শব্দটির বিশ্লেষণ। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর বঙ্গীয় শব্দকোষ-এ ‘নাস্তিক’ শব্দটি পাণিনির ব্যাকরণ অনুসারে বিশ্লেষণ করেছে এভাবেÑ নাস্তিক [নাস্তি+ইক (ঠক্্)]। সংস্কৃত ‘নাস্তি’ শব্দটি ব্যাখ্যা করে পাওয়া যায় ন (না)+অস্তি=নাস্তি। অব্যয়বাচক এ শব্দটির অর্থ ক্রিয়ারূপে দেখানো হয়েছেÑ ‘না আছে’, ‘নাই’, ‘নহে’ এবং অব্যয়রূপেÑ ‘অবিদ্যমান’, ‘সত্তাহীন’ ইত্যাদি। হরিচরণ ‘নাস্তিক’ শব্দের যে অর্থ করেছেন তা হলো : ‘পরলোক নাই’Ñ ইহা যাহার মতি; পরলোক অবিশ্বাসী; পরলোকাভাববুদ্ধিশালী; নাস্তি পরলোক, পরলোকসাধনাদৃষ্টাভাববাদী, বেদনিন্দুক ইত্যাদি। মনুসংহিতার অর্থানুসারে করা হয়েছে ‘নাস্তিক’ শব্দের এ সকল অর্থ। এ ছাড়াও নাস্তিকের আরও অর্থ বিদ্যমান আছে : যাহাতে তর্ক বলীয়ান, সর্ব বস্তু স্বভাবসিদ্ধ, ঈশ্বর কারও কর্তা নয়, বেদ অকিঞ্চিৎকর, তাদৃশ শাস্ত্র। এমনকি মাধ্যমিক, যোগাচার, সৌত্রাস্তিক, বৈভাষিক, চার্বাক, দিগম্বরÑ এই ছয় ভাগে ভাগ করা হয়েছে নাস্তিকদের। নাস্তিক বা নাস্তিকতা নিয়ে শাস্ত্রাবেত্তাদের ভাবনার অন্ত ছিল না দেখা যাচ্ছে। কত নামকরণ, কত ভাগে বিচারকরণÑ অবাক হতে হয়।
সাধারণ অর্থে একজন মানুষ আস্তিক হয় জন্মের পর থেকে নানা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে, আর নাস্তিক হয় নানা আত্মগত প্রতিকূল প্রচেষ্টার আলোকে। আস্তিক হতে কোনো জ্ঞান লাগে না। জন্মের পর থেকে যা শেখানো হয়, সেই শিক্ষা নিয়েই জীবন পার করে দিতে পারে একজন তথাকথিত আস্তিক মানুষ। তাতে করে সেই ব্যক্তির কোনোরকম কষ্ট তো হয়ই না, বরং এর ব্যত্যয় ঘটলেই যত সমস্যা দেখা দেয়। আস্তিকরা তাদের সকল কষ্টকেই ভাগ্য নামক অস্পৃশ্য বস্তুটির ওপর ছেড়ে দিয়ে অকারণ সান্ত¦না খোঁজে যায়; চুনকে দুধ ভাবতে বড় আনন্দ পায়। মজার বিষয় হলো, ওটা যে চুন, দুধ নয়Ñ তা তাদের বিশ্বাস করানোও বড় অসম্ভব ব্যাপার। তার ওপর তাদের বিশ্বাসের দুধকে চুন বলতে তো কথাই নেই, তেড়ে আসবে মারতে। এর জন্য কিন্তু সেই কূপম-ূক ব্যক্তিটি সম্পূর্ণ দায়ী নয়। দায়ী আছে তার সঙ্গে আরও অনেক কিছুই। একটি শিশু যে পরিবেশে বেড়ে ওঠে সেই পরিবেশের পারিপার্শ্বিক নানা উপাদান সে গ্রহণ করে চেতন ও অবচেতন মনে। তা ছাড়া প্রতিটি শিশুর অভিভাবক কোমলমতি শিশুটির মনে সচেতনভাবে তাদের নিজস্ব চিন্তা-চেতনা, বিশ্বাস-অবিশ্বাস, সংস্কার-কুসংস্কার প্রবেশ করে যায়। এক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মে বিশ্বাসী হওয়াকে পূণ্যজ্ঞান মনে করেই অধিকাংশ পিতামাতা তার শিশু সন্তানকে নিজের ধর্মে-বিশ্বাসী করে তোলে। এ ব্যাপারে তাদের কোনোরকম সংশয় নেই। সংশয় থাকা মানেই পাপ। তাই জন্মের পর থেকে একটি শিশু যেমন তার পরিবার ও আশপাশ থেকে ভাষা রপ্ত করে, তেমনই আত্মস্থ করে ধর্ম নামক আমৃত্যু পালনীয় আচার। ফলে অন্যান্য গুণাগুণের মতো সে সাধারণ অর্থে আস্তিক হয়েই বেড়ে ওঠে। এক্ষেত্রে শিশুটির পিতামাতা ধর্মে বা ঈশ্বরে অবিশ্বাসী হলে ভিন্ন বিষয়। ধরা যাক, হিন্দু ঘরে জন্ম নেওয়া কোনো একটি বাঙালি শিশুকে ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর আফ্রিকান কোনো আদিবাসীদের কাছে তুলে দেওয়া হলো। শিশুটি বড় হয়ে কোন সংস্কৃতি গ্রহণ করবে? হিন্দু ঘরে জন্ম নিয়েছে বলেই কি সে হিন্দু দেবদেবীকে পূজা করবে? না, তা সে করবে না। সে তার বেড়ে ওঠা ঐ জাতিগোষ্ঠীর নিজস্ব সংস্কৃতিই আপন জ্ঞান করবে। সেটাই সবার দেখাদেখি পালন করবে, পূজা করবে তাদের নিজস্ব দেবদেবী বা অশুভ আত্মাকে। এখানে বাঙালি রক্ত বা জিন কোনো কাজে আসবে না। বাঙালিদের ঈশ্বরকে সে পূজা দেবে না। বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধা সে পোষণ করবে না দুর্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতী নামক কোনো দেবদেবীর প্রতি। তাকে শত চেষ্টা করেও পালন করানো যাবে না বাঙালির সংস্কৃতি। যদি বাঙালির কোনো সংস্কৃতির অংশ সে পালন করেই-বা তা এক হয় সে ভালোবাসার তাগিদে করবে, নয়ত তাকে বাধ্য হয়ে করানো হবে। এ দুটি রাস্তাই তার সামনে খোলা থাকে। আমরা কোনো শিশুকেই বেড়ে ওঠার সময় কেউ জিজ্ঞাসা করে না, সে ধর্মপালন করবে কি করবে না। এমন প্রশ্ন মাথায়ই আসে না পিতামাতার কাছে। ধর্মপালন করবে এমন ভাবনাই যেন স্বাভাবিক। এর অন্যথা যেন হতে নেই; হলেই সর্বনাশ। তা ছাড়া মানুষমাত্রই ‘ভয়’ ও ‘লোভ’ নামের দুটি রিপুর দ্বারা কোনো না কোনোভাবে কমবেশি আক্রান্ত। প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম এ দুই শক্তিশালী রিপুকে মানুষের মনের ভেতর উশকে দেয়। ধর্মপ্রবর্তকেরা এ দুটি রিপুকে চমৎকারভাবে প্রবেশ করিয়েছে তাদের নিজ নিজ ধর্মগ্রন্থগুলোতে। ধর্মের আজ্ঞা পালন করলে এই পাবে, সেই পাবে, আর না পালন করলে এই শাস্তি, সেই শাস্তি অমুক তমুক কত কী! মনের মাধুরী মিশিয়ে কল্পনা করে সৃষ্টি করা হয় স্বর্গ ও নরক নামের দুটি আলাদা স্থানও। ধর্মগ্রন্থগুলোতে শাস্তির যে বিধান দেওয়া আছে তা রীতিমতো রোমহর্ষক। নরকে বিচিত্র সব শাস্তির বর্ণনা শুনলে পরে ঈশ্বর যে দয়ালু, ক্ষমাশীল ইত্যাদি গুণবাচক শব্দগুলো ভুলে যেতে হয়। আর স্বর্গে তো ভোগের শেষ নেই। ওখানে ভোগের যে ব্যবস্থা আছে তা দেখে মনে হয় ঈশ্বর কতটা ভোগবাদে বিশ্বাসী। যেন ভোগেই প্রকৃত সুখ। যে ঈশ্বরের কাছে সকল কিছুর নিয়ন্ত্রণ থাকে, কেন তাকে মানুষকে লোভ বা ভয় দেখিয়ে কাজ করাতে হবে তা-ই মাথায় আসে না। যার নির্দেশ ছাড়া যেখানে গাছের একটা পাতাও নড়ে না, সেখানে পৃথিবীব্যাপী এই যে বোমাবাজি চলছে তাতে করে কাকে দোষ দিতে হয়, ঈশ্বরকে নাকি মানুষকে? যে ঈশ্বর পৃথিবীর ¯্রষ্টা, যিনি সর্বত্র বিরাজমান বলে খ্যাত আছেন, আমার কথা হলো দক্ষিণ আমেরিকার অ্যামাজন জঙ্গলে বসবাসকারী উলঙ্গ নারী-পুরুষেরা কেন তাঁকে বা তাঁর প্রেরিত ধর্মগ্রন্থের নাম পর্যন্ত শোনেনি? তাহলে কি ঐ মানুষগুলো তার সৃষ্ট নয়? যাই হোক, আমার মনে হয়, আজ যারা নাস্তিক হয়েছেন তারা সবাই নিজের চেষ্টায় হয়েছেন। নাস্তিক হতে হলে কেবল তথ্য বা তত্ত্বগত জ্ঞানই থাকলেই হয় না, সেইসাথে প্রয়োজন হয় আধুনিক বিজ্ঞানচেতনা, যুক্তিবাদিতা, সততা, আদর্শগত মূল্যবোধ, আত্মবিশ্বাস, নির্ভীকতার মতো নানা গুণ। কেননা তাদেরকে আশেপাশের মানুষের নানা অকারণ প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়, শুনতে হয় নানা ভর্ৎসনা। আস্তিকদের এ ব্যাপারে দারুণ সুবিধা। তাদের এমন কোনো বিব্রত অবস্থার সম্মুখীন হতে হয় না। বিশ্বাস করলে যেন সব ঝামেলা মুক্ত। ব্রিটিশ প্রাবন্ধিক, অভিধান রচয়িতা স্যামুয়েল জনসন (১৮ সেপ্টেম্বর ১৭০৯ – ১৩ ডিসেম্বর ১৭৮৪)-এর একটি কথা মনে পড়ছে, “প্রতিটি যুগেই নতুন নতুন ভুল দেখা যায়, আর দেখা যায় নতুন নতুন সংস্কার।” আর আমরা তো সবাই জানি, ধর্ম ও সংস্কার একে অপরের সাথে আষ্টেপৃষ্টে বাস করে। ফলে উল্লিখিত উদ্ধৃতিটির আলোকে বলা যায়, ধর্ম হচ্ছে এক প্রকা- ভুল, আর সেই ভুলের অগণিত সন্তান হচ্ছে তথাকথিত সংস্কার। আইরিশ নাট্যকার ও কবি অস্কার ওয়াইল্ড (১৬ অক্টোবর ১৮৫৪ – ৩০ নভেম্বর ১৯০০) অলৌকিকতা সম্পর্কে একবার বলেছিলেনÑ “জগতের অলৌকিকতা হলো যা দৃশ্যমান তার মধ্যে, কোনো অদৃশ্যের মাঝে নয়।” কথাটির একটু গভীরে প্রবেশ করলে পাওয়া যায় অমোঘ সত্য। অর্থাৎ যা কিছু দৃশ্যমান, তাই সত্য। অদৃশ্যের মধ্যে মিথ্যা বলা অনেক সহজ ব্যাপার। ঈশ্বর অদৃশ্য। তাই মিথ্যা ঈশ্বর মিথ্যার জন্ম দিয়ে যাচ্ছে ক্রমাগত। একবিংশ শতাব্দীতে এসে এখন যেহেতু নতুন কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের অবতরণা সম্ভব নয়, নতুনভাবে স্বর্গপ্রেরিত দূত নেমেও আসবে, আসলেও তাকে থাকতে হবে পাগলাগারদে সেহেতু ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ক্রমবর্ধমান মিথ্যার হাত থেকে বেঁচে গেল। যেসকল মিথ্যা এখনও বেঁচেবর্ত্তে আছে তা যুগের সাথে সাথে বিলীন হতে বাধ্য। একটি মিথ্যাকে দশবার সত্যের মতো করে বললে সত্যের মতো শোনায় সত্যি, কিন্তু মিথ্যা তো সত্য হয়ে যায় না। মিথ্যা মিথ্যাই থাকে। কেবল সাময়িক দেখতে অন্যরকম লাগে।

রচনার বিষয়টি যেহেতু নাস্তিকতা, তাই ফিরে আসি আবার নাস্তিক ও আস্তিক প্রসঙ্গে। কলিম খান ও রবি চক্রবর্তী রচিত ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক শব্দার্থের অভিধান বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ (প্রথম খ-) আস্তিক ও নাস্তিক ভুক্তিটিতে বলা হয়েছে : “‘আছে’ এই বিশ্বাস যার, তাঁকে আস্তিক বলা হয়ে থাকে। কী ‘আছে’? এর উত্তর হলো ‘কোনো একটা কিছু আছে’। তথাকথিক ধর্মনিষ্ঠ ধর্মভীরু মানুষেরা বলতে পারেন, ‘ঈশ্বর’। যুক্তিবাদীরা এসব কথাকে বাজে কথা বলে মনে করেন। কিন্তু আমরা দেখেছি ‘আছে’ এই ‘বিশ্বাস’ না থাকলে মানুষ তো বটেই, কোনো জীবই বেঁচে থাকতে পারে কি না সন্দেহ। গাছের তলা দিয়ে যাওয়ার সময় গাছটি ঘাড়ের ওপর ভেঙে পড়বে না কিংবা রাস্তাটি যে হঠাৎ দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে আমাকে গিলে ফেলবে না, আগন্তুক গাড়িটি যে হঠাৎ ফুটপাথে উঠে আমাকে চিঁড়ে চ্যাপটা করে দেবে না, পাশের গুমটিতে বসে থাকা ছোকরাগুলো যে হঠাৎ দৌড়ে এসে আমার জামাকাপড় কেড়ে নিয়ে আমাকে রাস্তায় ফেলে দিয়ে চলে যাবে নাÑ যথাক্রমে এই প্রাকৃতিক, যান্ত্রিক, সামাজিক নিয়ম আমাদের ঘিরে বলবৎ ‘আছে’। এই ‘আছে’তে ‘বিশ্বাস’ না থাকলে আমরা কি একদিনও বাঁচতাম! তাই ভেবে দেখলে জীবমাত্রেই আস্তিক। এমন একটি মানুষও নেই যে আস্তিক নয়। ধারণা করা হয় খুব সম্ভব গ্রিক ধরংঃযবঃরশড়ং (যার থেকে ইংরেজি ধবংঃযবঃরপ শব্দটি তৈরি হয়েছে) শব্দটি ‘আস্তিক’-এরই জ্ঞাতিভাই। অন্যদিকে ‘নাই’তে বিশ্বাস করে যে, সে হলো নাস্তিক। এখন প্রশ্ন হলো, কার থাকা বা না-থাকার কথা হচ্ছে? শেষ বিচারে তিনি হলেন জগৎ¯্রষ্টা জগন্নাথ বা জগৎকারণ। আস্তিক শব্দের আলোচনায় আমরা দেখেছি যে, প্রকৃতপক্ষে নাস্তিক হওয়া অবাস্তব, অসম্ভব। অন্ততপক্ষে ‘সর্ব্ব বস্তু স্বভাবসিদ্ধ’Ñ এই জগৎকারণে বিশ্বাস না থাকলে কোনো জীবই বেঁচে থাকতে পারে না, নাস্তিকেরাও পারেনি।” বুৎপত্তিগত অর্থ বিচারে আস্তিক ও নাস্তিক শব্দের অর্থই গেল বদলে। অর্থাৎ ‘আছে’ তে বিশ্বাস করতে হবে। ধর্মগুরুরা এই ‘আছে’র সঙ্গে ঈশ্বরের অস্তিত্বকে জড়িয়েছে। নিরীহ শব্দের সঙ্গে অযথা ধর্মের গন্ধ মেশানো আর কি! সবশেষে একটি নিরীহ প্রশ্ন রেখে লেখাটি শেষ করতে চাইÑ “স্বয়ং বুদ্ধ যেখানে বলে গেলেনÑঈশ্বর বলে কিছু নেই; সেই তাঁকেই কেন ঈশ্বর বানিয়ে পূজা করা হচ্ছে আজ?”

লেখক: অঞ্জন আচার্য
(প্রথম প্রকাশ মুক্তমনা, ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১২)

Sunday, February 21, 2010

কিভাবে একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হয়ে গেল

বাঙালি বড় বিস্মৃতিপরায়ণ জাতি। নিজেদের ইতিহাস ভুলে বসে থাকে। কখনো বিকৃতও করে অহর্নিশি। বাঙালি বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের সংখ্যা নিয়ে, স্বাধীনতার ঘোষক নিয়ে, শেখ মুজিবের অবদান নিয়ে… এমন কোন বিষয় নেই যা নিয়ে বাঙালি বিতর্ক করে না। সেই বিস্মৃতিপরায়ণ জাতি হিসেবে আমরা একুশে ফেব্রুয়ারি পালন করি, উল্লাসে একে অভিহিত করি ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে, কিন্তু আমরা সত্যই কি জানি একুশে ফেব্রুয়ারি দিনটির আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হবার ইতিহাসটুকু?
ইন্টারনেটে সার্চ করুন। এ নিয়ে কোন তথ্যই আপনি পাবেন না। এমনকি আন্তজার্তিক ভাবে পালিত ইউনেস্কোর পোষ্টার লিফলেট কিংবা নিউজ লেটারে কোথাও বাংলাদেশের ১৯৫২ সনের এই আত্মত্যাগের সংবাদটি আপনার চোখে পড়বে না। আপনি জানবেন না কিভাবে ২১শে ফেব্রুয়ারির এই দিনটি কোন যাদুবলে হঠাৎ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হয়ে গেল ২০০০ সাল থেকে। জানার কোন উপায় নেই – কারা ছিলো এর পেছনে। ব্যতিক্রম বোধ হয় শুধু মুক্তমনার এই লেখাটি। হাসান মাহমুদের (ফতেমোল্লার) The Makers of History: International Mother Language Day নামের এই লেখায় ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরা হয়েছে কি অক্লান্ত পরিশ্রম করে দু’জন পরবাসী বাঙালি একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে পরিণত করেছিলেন। ছোট্ট একটা লেখা ইংরেজীতে। কিন্তু অসামান্য দলিল। দলিলটি হারিয়ে যাবার আগেই আমার মনে হল একুশে ফেব্রুয়ারির এই দিনে সেই গৌরবময় উপাখ্যানটুকু বাংলায় বয়ান করা যাক।
বিগত নব্বই শতকের শেষ দিক। সবকিছুর পুরোধা ছিলেন রফিক (রফিকুল ইসলাম) নামের এক ক্যানাডা নিবাসী বাঙালি। চেহারা ছবিতে অসাধারাণ কিছু মনে হবে না দেখলে। চিরায়ত বাঙালি চেহারা, আলাদা কোন বিশেষত্ব চোখে মুখে নেই। কিন্তু যে কেউ একটু কথা বললেই বুঝবেন যে সাধারণ এই লোকটির মধ্যে লুকিয়ে আছে এক অমিত শক্তির স্ফুরণ। একসময় মুক্তিযুদ্ধ করেছেন, দেশ-মাতৃকাকে মুক্ত করেছেন না-পাক বাহিনীর হাত থেকে। তো এই লোকটি একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে পরিণত করার সম্মুখ যোদ্ধা হবেন না তো কে হবেন?
১৯৫২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৪৪ ধারা ভেঙ্গে এক রফিক পুলিশের গুলিতে প্রাণ দিয়ে একুশে ফেব্রুয়া্রিকে অমর করেছিলেন। তার ৪৬ বছর পরে আরেকজন রফিক সুদূর কানাডায় বসে আরেক দুঃসাহসী কাজ করে ফেললেন ।
১) ১৯৯৮ সালের ৯ই জানুয়ারী রফিক জাতিসংঘের তৎকালীন জেনারেল সেক্রেটারী কফি আনানকে একটি চিঠি লেখেন। সেই চিঠিতে রফিক ১৯৫২ সালে ভাষা শহীদদের অবদানের কথা উল্লেখ করে কফি আনানকে প্রস্তাব করেন ২১শে ফেব্রুয়ারিকে ‘মাতৃভাষা দিবস’হিসেবে যেন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি দেয়া হয়।
২) সে সময় সেক্রেটারী জেনারেলের প্রধান তথ্য কর্মচারী হিসেবে কর্মরত হাসান ফেরদৌসের (যিনি একজন সাহিত্যিক হিসেবেও পরিচিত) নজরে এ চিঠিটি আসে। তিনি ১৯৯৮ সালের ২০ শে জানুয়ারী রফিককে অনুরোধ করেন তিনি যেন জাতিসংঘের অন্য কোন সদস্য রাষ্ট্রের কারো কাছ থেকে একই ধরনের প্রস্তাব আনার ব্যবস্থা করেন।
৩) সেই উপদেশ মোতাবেক রফিক তার সহযোদ্ধা আব্দুস সালামকে সাথে নিয়ে “এ গ্রুপ অব মাদার ল্যাংগুয়েজ অফ দ্যা ওর্য়াল্ড” নামে একটি সংগঠন দাঁড় করান। এতে একজন ইংরেজীভাষী, একজন জার্মানভাষী, একজন ক্যান্টোনিজভাষী, একজন কাচ্চিভাষী সদস্য ছিলেন। তারা আবারো কফি আনানকে “এ গ্রুপ অব মাদার ল্যাংগুয়েজ অফ দ্যা ওর্য়াল্ড”-এর পক্ষ থেকে একটি চিঠি লেখেন, এবং চিঠির একটি কপি ইউএনওর ক্যানাডিয়ান এম্বাসেডর ডেভিড ফাওলারের কাছেও প্রেরণ করেন।
৪) এর মধ্যে একটি বছর পার হয়ে গেলো। ১৯৯৯ সালের মাঝামাঝি সময়ে হাসান ফেরদৌস সাহেব রফিক এবং সালামকে উপদেশ দেন ইউনেস্কোর ভাষা বিভাগের জোশেফ পডের সাথে দেখা করতে। তারা জোশেফের সাথে দেখা করার পর জোশেফ তাদের উপদেশ দেন ইউনেস্কোর আনা মারিয়ার সাথে দেখা করতে। এই আনা মারিয়া নামের এই ভদ্রমহিলাকে আমরা কৃতজ্ঞতাভরে স্মরণ করবো, কারণ এই ভদ্রমহিলাই রফিক-সালামের কাজকে অনেক সহজ করে দেন। আনা মারিয়া রফিক-সালামের কথা মন দিয়ে শোনেন এবং তারপর পরামর্শ দেন তাদের প্রস্তাব ৫ টি সদস্য দেশ – ক্যানাডা, ভারত, হাঙ্গেরি, ফিনল্যান্ড এবং বাংলাদেশ দ্বারা আনীত হতে হবে।
৫) সে সময় বাংলাদেশের শিক্ষামন্ত্রী এম এ সাদেক এবং শিক্ষা সচিব কাজী রকিবুদ্দিন, অধ্যাপক কফিলউদ্দিন আহমেদ, মশিউর রহমান (প্রধানমন্ত্রীর সেক্রেটারিয়েটের তৎকালীন ডিরেক্টর), সৈয়দ মোজাম্মেল আলি (ফ্রান্সে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত), ইকতিয়ার চৌধুরী (কাউন্সিলর), তোজাম্মেল হক (ইউনেস্কোর সেক্রেটারি জেনেরালের শীর্ষ উপদেষ্টা) সহ অন্য অনেকেই জড়িত হয়ে পড়েন।তারা দিন রাত ধরে পরিশ্রম করেন আরো ২৯ টি দেশকে প্রস্তাবটির স্বপক্ষে সমর্থন আদায়ে। অন্যান্য বাংলাদেশী এবং প্রবাসীদের কাছে ব্যাপারটা অগোচরেই ছিল- পর্দার অন্তরালে কি দুঃসাহসিক নাটক চলছিলো সে সময়। এই উচ্চাভিলাসী প্রজেক্টের সাথে জড়িত ব্যক্তিরা এবং ক্যানাডার ভ্যাঙ্কুভার শহরের জনা কয়েক লোক কেবল ব্যাপারটা জানেন, এবং বুকে আশা নিয়ে তারা সেসময় স্বপ্নের জাল বুনে চলেছেন প্রতিদিন।
৬) ১৯৯৯ সালের ৯ ই সেপ্টেম্বর। ইউনেস্কোর প্রস্তাব উত্থাপনের শেষ দিন। এখনো প্রস্তাব এসে পৌঁছায়নি। ওদিকে রফিক সালামেরা ব্যাপারটি নিয়ে বিনিদ্র রজনী অতিক্রম করে চলেছেন। টেলিফোনের সামনে বসে আছেন, কখনো চোখ রাখছেন ইমেইলে। আসলে প্রস্তাবটির পেছনে প্রধাণমন্ত্রীর একটি সই বাকি ছিলো। আর প্রধানমন্ত্রী তখন পার্লামেন্টে। পার্লামেন্টের সময়সূচীর পরে সই করতে করতে প্রস্তাব উত্থাপনের সময়সীমা পার হয়ে যাবে। সেটা আর সময় মত ইউনেস্কো পৌঁছুবে না। সব পরিশ্রম জলেই যাবে বোধ হয়।
৭) প্রধানমন্ত্রীকে ফোন করে অনুরোধ করা হলো তিনি যেন প্রস্তাবটি সই করে ফ্যাক্স করে দেন ইউনেস্কোর দপ্তরে। অফিসের সময়সীমা শেষ হবার মাত্র একঘণ্টা আগে ফ্যাক্সবার্তা ইউনেস্কোর অফিসে এসে পৌঁছুলো।
৮) ১৬ই নভেম্বর কোন এক অজ্ঞাত কারণে (সময়াভাবে ?) বহুল প্রতাশিত প্রস্তাবটি ইউনেস্কোর সভায় উত্থাপন করা হলো না। রফিক সালামেরা আরো একটি হতাশ দিন পার করলেন।
৯) পর দিন – ১৭ই নভেম্বর, ১৯৯৯। এক ঐতিহাসিক দিন। প্রস্তাব উত্থাপন করা হলো সভার প্রথমেই। ১৮৮ টি দেশ এতে সাথে সাথেই সমর্থন জানালো। কোন দেশই এর বিরোধিতা করলোনা, এমনকি খোদ পাকিস্তানও নয়।  সর্বসম্মতিক্রমে একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে গৃহীত হলো ইউনেস্কোর সভায়।
এভাবেই একুশে ফেব্রুয়ারি একটি আন্তর্জাতিক দিনে পরিণত হলো। কিন্তু এতো কিছুর পরেও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মূল উদ্যোক্তা রফিক এবং সালাম সবার কাছে অচেনাই রয়ে গেলেন। তাদের ত্যাগ তিতিক্ষা আর পরিশ্রম অজ্ঞাতই থেকে গেল। কেউ জানলো না কি নিঃসীম উৎকন্ঠা আর আশায় পার করেছিলেন তারা ১৯৯৯ সালের নভেম্বর মাসের শেষ ক’টি বিনিদ্র রজনী। কেউ জানলো না, কিভাবে সমর্থন যুগে চলেছিলেন তাদের স্ত্রী, পরিবার, এবং কাছের বন্ধু বান্ধবেরা। কত অজ্ঞাতকূলশীলেরাই বাংলা একাডেমি পদক, একুশে পদক পেয়ে যান এই অভাগার দেশে আর রফিক সালামেরা উপেক্ষিতই থেকে যান।
আমি এই লেখার মাধ্যমে মুক্তমনার পক্ষ থেকে রফিক সালাম নামে কানাডা নিবাসী দুই ভাষা সৈনিকের একুশে পদক প্রস্তাব করছি।

লেখক: অভিজিৎ রায়, লেখক এবং প্রকৌশলী, মুক্তমনার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক।

Sunday, July 26, 2009

আমাদের জাতীয়তা , দ্বিজাতিতত্ত্বের প্রেতাত্মা এবং একটি প্রস্তাবনা


বিগত প্রায় সাড়ে তিন দশক যাবত একটি নষ্ট বিতর্ক বাংলাদেশের রাজনীতি গ্রাস করে রেখেছেকোন কোন মানুষের ব্যক্তি জীবনে যেমন শনির দশা সহজে কাটতে চায় না ঠিক তেমনি আমাদের জাতীয় জীবনেও এ বিতর্ক প্রসূত সংকটের সুরাহা এখনো হয় নিবিতর্কটির নেপথ্যে রয়েছে ছোট্ট এক প্রশ্ন, কি হবে আমাদের জাতীয় পরিচিতি? বাঙালী অথবা বাংলাদেশী? এই বিতর্কটি এখনো জীইয়ে রাখা হয়েছে এক বিশেষ ¯^v_©‡š^lx গোষ্ঠীর রাজনৈতিক প্রাণ কাঠি হিসাবে

বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর এবং পচাঁত্তরের পটপরিবর্তন পূর্ব রাজনীতিতে আমাদের জাতীয় পরিচিতি নিয়ে কোন প্রশ্ন ওঠেনিবরং সে সময়ে বাংলাদেশের জনগণের ইচ্ছের প্রতিফলনে রচিত সংবিধানে স্পষ্টত:ই ঘোষিত হয়েছিলো বাংলাদেশ সীমানা অর্ন্তভূক্ত জনগোষ্ঠীর পরিচিতি হবে বাঙালী হিসাবে এবং বাঙলী জাতীয়তাবাদই হবে সদ্য ¯^vaxbZv প্রাপ্ত বাংলাদেশের সংবিধানে অন্যতম স্তম্ভবস্তুতঃ পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসন এবং শোষণ বাঙলী জাতীয়তাবাদ জাগরণে প্রেরণা যুগিয়েছে এবং একাত্তরের আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে এই বাঙলী জাতীয়তাবাদই ছিল সবচেয়ে শক্তিশালী সমরাস্ত্রনৃতাত্বিক দৃষ্টিকোণে পাক-ভারত উপমহাদেশে বাঙালী এক পৃথক জাতিসত্ত্বাবাঙলির রয়েছে নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং একটি পূর্ণাঙ্গ জাতি হিসাবে চিহ্নিত হওয়ার অপরাপর উপাদান সমূহবং থেকে বাংলা নামক যে জনপদের উদ্ভব ( সূত্র: রিজিয়া রহমান, বং,থেকে বাংলা, ১৯৮৩ মুক্তধারা প্রকাশনী ঢাকা) সে জনপদে আবহমানকাল থেকে যে প্রধান জনগোষ্ঠী বাস করে আসছে, যাদের রয়েছে সাধারণ শারীরিক, চারিত্রিক, সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যাবলী তারাই বাঙলী জাতীয়তাবাদের ধারক এবং বাহকঐতিহাসিক গবেষণায় জানা যায় খ্রীষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকের পূর্ব থেকেই বঙ্গদেশ এবং বাঙলী জাতির অস্তিত্ব ছিলএই বাঙলীর চিন্তা-চেতনা মনন ক্রমশঃ বিকশিত হয়ে বিশ্বদরবারে বাঙলী আজ এক উল্লেখযোগ্য জাতিতবুও আমরা যারা সন্দেহাতীতভাবে বাঙলী, তাদের মধ্যেও কেন জাতীয় পরিচিতি নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব? কেউ কেউ, বিশেষতঃ বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিশেষ এক গোষ্ঠীর অনুসারীরা নিজেদেরকে বাঙালী হিসেবে পরিচয় প্রদানে গর্বিত না হয়ে কৃত্রিম জাতীয়তা বাঙলাদেশী হিসাবে পরিচয় প্রদানে আশ্বস্ত হয়এই বিশেষ গোষ্ঠীর এ মনো:স্তাত্বিক আচরণের কার্যকারণ পুরোটাই রাজনৈতিক এবং বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ নামক ষঢ়যন্ত্রমূলক রাজনৈতিক মতবাদটি হচ্ছে বাংলাদেশের জনসাধারণকে বিভ্রান্ত করার বড় এক হাতিয়ার

বাঙলীর আত্মপরিচিতিতে এই উদ্দেশ্যপূর্ণ বিভ্রান্তি সৃষ্ট করার মূল কৃতিত্বের দাবীদার প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়াসামরিক লেবাসে রাজনীতি অঙ্গনে পর্দাপণের প্রথমভাগেই তিনি সদম্ভে বলেছিলেন, I shall make politics difficult for politicians. ধূর্ত জিয়া সুচতুর ভাবেই তা করতে পেরেছিলেন বাঙলী জাতির মধ্যে বিভাজনের সৃষ্টি করেজিন্নাহ্‌ যেমন তার রাজনৈতিক ক্ষমতা নিশ্চিত করার দূরভীসন্ধীতে সর্ব ভারতীয় রাজনীতিতে প্রবর্তন করেছিলেন দ্বিজাতিতত্ত্বের ঠিক তেমনি জেনারেল জিয়া বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রবর্তন করেন বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদজিন্নাহ সাহেবের দ্বিজাতিতত্ত্ব এবং জিয়ার বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ দুটোরই মূল লক্ষ্য রাষ্ট্রিয় তথা রাজনৈতিক ক্ষমতা নিশ্চিত করে ব্যক্তিগত রাজনৈতিক উচ্চভিলাসের পূর্ণতা অর্জন করাসবচেয়ে ধবংসাত্মক বিষয় হচ্ছে জিয়া প্রবর্তিত বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের নেপথ্যে ক্রিয়াশীল দ্বিজাতিতত্বের ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতামূলতঃ হিন্দু প্রধান পশ্চিমবঙ্গের বাঙলীদের সাথে মুসলিম প্রধান পূর্ববঙ্গ তথা বাংলাদেশের বাঙলীদের পৃথকীকরণ করার লক্ষ্যেই তথাকথিত বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের উন্মেষ

জিন্নাহ সাহেবের ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদ দ্বিজাতিতত্ত্বের মূলে তার রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ ছাড়া যে অন্য কোন দর্শন ছিল না তা তার রাজনৈতিক জীবন পর্যালোচনা করলে স্পষ্টত:ই প্রতীয়মান হয়পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত জিন্নাহ সাহেব তার রাজনৈতিক জীবনের শুরুতে ছিলেন ধর্ম নিরপেক্ষ রাজনীতির কট্টর সমর্থকজিন্নাহ্‌ সাহেবের ব্যক্তিজীবনে ইসলামের কোন প্রতিফলন ছিল নানামাজ, রোজা, হজ্ব, ইসলামের ইত্যাদি মৌলিক অনুশাসনের প্রতি জিন্নাহ্‌ সাহেবের অনুরক্তি পরিলক্ষিত হয়নি কখনো। (সূত্র: কার্ল পোজে, টাইম ম্যাগাজিন. ১৬ই wW‡m¤^i, ১৯৯৬) কার্ল পোজে কর্তৃক গবেষনাপত্রে জানা যায় ১৯৩২ সাল পর্যন্ত জিন্নাহ্‌ সাহেব ছিলেন ভারত বিভক্তির ঘোর বিরোধীতবুও কেন পরবর্তীতে তিনি সর্বভারতীয় রাজনীতিতে ভারত বিভাজনের বড় অস্ত্র দ্বিজাতিতত্ত্বের আমদানী করলেন? এর বড় কারণ তকালীন অবিভক্ত ভারতের রাজনীতিতে গান্ধী, নেহেরু , মৌলানা আজাদ, সুভাষ বসু-প্রমূখ শক্তিশালী ও মেধাবী নেতাদের পাশে জিন্নাহ্‌ সাহেবের অবস্থান ছিল ম্লান এবং চতুর জিন্নাহ্‌ অনুভব করতে পেরেছিলেন প্রাগুক্ত মেধাবী নেতাদের সাথে রাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় তিনি সর্বভারতীয় রাজনীতিতে মূল নেতা হতে পারবেন না কোনদিনতাই জিন্নাহর্‌ রাজনীতিতে প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল দ্বিজাতিতত্ত্ব নামক অবৈজ্ঞানিক এক মতবাদ, যেখানে জাতীয়তার সংজ্ঞা বর্হিভূতভাবে ভারতবর্ষের হিন্দু ও মুসলমানকে দুটি পৃথক জাতিসত্তা হিসাবে বিধৃত করা হয়েছেদ্বিজাতিতত্ত্বের ব্রীটিশদের আর্শীবাদ থাকায় জিন্নাহ্‌র পক্ষে রাতারাতি মুসলমানদের নেতা বনে যাওয়া সম্ভব হয়েছিল এবং সবচেয়ে বড় বিষয়ে ব্যক্তি জিন্নাহ্‌র উচ্চাভিলাষ একটি রাষ্টের নেতা হওয়া সম্ভব হয়েছিল এই দ্বিজাতিতত্ত্বের মাধ্যমেই

অবশ্য দ্বিজাতিতত্ত্ব যে এক ভিত্তিহীন দর্শন সে বিষয়ে এর উদ্ভাবক জিন্নাহ্‌ সাহেবের পাকিস্তান সৃষ্টির অব্যাহতি পরই এর কবর রচনা করে গেছেনএই প্রস্তাবনা সমর্থিত হয় পাকিস্তান গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনে জিন্নাহ্‌ সাহেবের উদ্বোধনী ভাষণেএ ভাষনে তিনি স্পষ্টতঃই বলেছিলেন পাকিস্তান রাষ্ট্রিয় কাঠামোয় হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রীষ্টানের কোন ব্যবধান নেই, সবারই জাতীয়তা হবে পাকিস্তান তাঁর এ বক্তেব্যেই দ্বিজাতিতত্ত্বের কবর রচিত হয়ে সমর্থিত হয় ধর্মনিরপেক্ষতার মূলবাণীশুধু এতোটুকুই নয়, বরং পরবর্র্তী জীবনে তিনি তার প্রচারিত দ্বিজাতিতত্ত্বে সংশয় প্রকাশ করেন এবং জানা যায় মৃত্যুশয্যায় জিন্নাহ্‌রএক উচ্চারণ ছিল “পাকিস্তান দি বিগেষ্ট ব্লান্ডার অব মাই লাইফ” (সূত্র: কার্ল পোজে, টাইম ম্যাহাজিন, ১৬ই wW‡m¤^i, ১৯৯৬ইং)

¯^vaxb বাংলাদেশের রাজনীতিতে জিন্নাহ্‌ কর্তৃক আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত দ্বিজাতিতত্ত্বের প্রেতাত্মাকে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ মোড়কে আমদানী করলেন জেনারেল জিয়াজিয়া নিজে একজন বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যে বাঙলী জাতীয়তাবাদকে ভিত্তি করেই সংঘটিত হয়েছিল সে বিষয়ে নিশ্চিত তিনি সচেতন ছিলেনকিন্তু তা সত্ত্বেও জিন্নাহর্‌ মতই জেনারেল জিয়া তার রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ পূরণে ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদের আশ্রয় নেনপঁচাত্তরের পটপরিবর্তন যে মূলত: পাকিস্তানপন্থীদের ষড়যন্ত্র ছিল তা আজ ক্রমশ: প্রকাশিতমুজীব হত্যার অন্যতম নায়ক ফাঁসীর আসামী কর্নেল ফারুকের প্রদত্ত জবানবন্দীতে জানা যায় মুজীব হত্যার বিষয়ে জিয়া পূর্বাহ্নেই অবহিত ছিলেন এবং মুজীব হত্যার সংশ্লিষ্ট, সামরিক অফিসারদের প্রতি তার যে আর্শীবাদ ছিল সে বিষয়ে সন্দেহের কোন অবকাশ নেইপরবর্তীতে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে অধিষ্ঠিত হওয়ার পরপরই জিয়া পাকিস্তানপন্থী সামরিক বেসামরিক ব্যক্তিবর্গের প্ররোচনায় এবং নিজের রাজনৈতিক শক্তি সুসংহত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রবর্তন করলেন বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের শ্লোগানচতুর জিয়া জানতেন ধর্মপ্রাণ বাঙলী মুসলমানদেরকে ধর্র্মীয় সুড়সুড়ি এবং ভারতবিরোধী শ্লোগান দিয়ে নেতৃত্বশূণ্য বাংলাদেশের রাজনীতিতে সহজেই সস্তা জনপ্রিয়তা অর্জন করা যাবেজিয়ার ধর্মভিত্তিক এ জাতীয়তাবাদে মদদ যোগায় একাত্তরের পরাজিত শক্তিবর্গ এবং পাকিস্তানপন্থী কতিপয় বুদ্ধিজীবি

অনেকে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের অপরিহার্যতার সপক্ষে বিভিন্ন যুক্তি প্রদর্শন করে থাকেনতাদের প্রধানতম যুক্তি হল ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বাঙলী হতে বাংলাদেশের বাঙলীকে পৃথকীকরণের জন্যই বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের আবশ্যিকতা রয়েছেকিন্তু এ যুক্তি ধোপে টিকে নাকারণ নৃতাত্বিক সংজ্ঞানুযায়ী কোন ব্যক্তি জন্মসূত্রে প্রাপ্ত জাতীয়তা পরিত্যাগ করতে পারে নাতাই ¯^fveZtB প্রশ্ন জাগে, একজন বাঙলী কিভাবে তার জন্মসূত্রে প্রাপ্ত বাঙলিত্ব পরিত্যাগ করে বাংলাদেশী জাতিতে পরিণত হবে? বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ সম্পূর্ণ কাল্পনিক কারণ বাংলাদেশী জাতি বলে কোন জাতির অস্তিত্ব নেইএ ছাড়া পূর্ববঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গের বাঙলীরা জাতি হিসাবে বাঙলী পরিচয় প্রদানে বাঁধা কোথায়? উত্তর কোরিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়া দুদেশের অধিবাসীদেরই জাতীয়তা কোরীয়-তাতে তো কোন রূপ সমস্যার সৃষ্টি হয় বলে জানা যায়নিবাংলাদেশের জাতীয়তাবাদের সপক্ষে আরো একটি যুক্তি হচ্ছে বাঙালী হিসাবে বাংলাদেশের সকলকে নাগরিকের পরিচিতি হলে অপরাপর অবাঙলী ( যেমন চাকমা, গারো, সাঁওতাল, বিহারী, ইত্যাদি)দের প্রতি অবিচার করা হবেহ্যাঁ এ যুক্তিটি অবশ্যই সমর্থনযোগ্যযদিও সংখ্যা বিবেচনায় বাংলাদেশের অবাঙলীরা নগন্য ( ০.৬%, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো) তবুও তাদের জাতীয়তা, সাহিত্য, সংস্কৃতির প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শনের দায়িত্ব বর্তায় সংখ্যাগুরু বাঙলীদের উপরতাই সংখ্যালঘুদের জাতিসত্ত্বার প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে নিম্নোক্ত প্রস্তাবনা গ্রহণ করা যেতে পারে

বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জনগোষ্ঠীর রাষ্ট্রীয় পরিচিতি বা নাগরিকত্ব হবে বাংলাদেশীউল্লেখ্য বাংলাদেশী প্রতিবাচ্য দ্বারা জাতীয়তা বা ন্যাশনালিটি বুঝাবে না বরং তা বুঝাবে নাগরিকত্ব বা সিটিজেনশীপ

একজন মানুষের জাতীয়তা জন্মগত এবং তা বর্জন কিংবা অর্জন করা সম্ভব নয়একজন বাঙলী কখনো বাঙলীত্ব পরিহার করে বিহারী বা পাঞ্জাবী জাতিতে পরিবর্তিত হতে পারবে নাতবে নাগরিকত্ব বা সিটিজেনশীপ গ্রহণ কিংবা বর্জন করা সম্ভবএকজন বাঙলী বৃটেনের কিংবা অন্য কোন দেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করতে পারেকিন্তু তার পক্ষে মূল জাতীয়তা বাঙলীত্ব বর্জন করা কখনো সম্ভবপর নয়এই দর্শনের আলোকে বাংলাদেশের সকল নাগরিক যে যার নিজস্ব জাতিসত্ত্বার ভিত্তিতে জাতীয়তার পরিচয় প্রদান করতে পারবেউল্লেখ্য বাংলাদেশের সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠীর জাতীয়তা বাঙলীঅপরাপর যে সব সংখ্যালঘু জাতি বা উপজাতি বাংলাদেশের ভৌগলিক সীমানার অধিবাসী তাদেরও নিজস্ব জাতীয়তায় পরিচিতি পেতে কোনরূপ বিধি নিষেধের সম্মুখীন হবে না

যেহেতু আমাদের মুক্তি সংগ্রামে বাঙলী জাতীয়তাবাদ ছিল মূল চালিকা শক্তি এবং বাংলাদেশের জনসংখ্যা ৯৯% ভাগের বেশী সংখ্যক অধিবাসী বাঙলী সেহেতু বাংলাদেশের সংবিধানের মূল স্তম্ভ হবে বাঙলী জাতীয়তাবাদ

জাতীয়তাবাদ সংশ্লিষ্ট বর্তমান সংকট নিরসনের লক্ষ্যে বুদ্ধিজীবিসহ রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের ঐক্যমত্যে আসা আবশ্যকবিশেষতঃ এই অহেতুক বির্তকটি নিয়ে বর্তমানে দেশে যে বিভ্রান্তি রয়েছে তা মোটেই কাঙ্খিত নয়আশা করা যায় উপরোক্ত প্রস্তাবনা কার্য্যকরী করলে “বাঙলী বনাম বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ” নামক নষ্ট বিতর্কের অবসান হয়ে আমাদের জাতীয় পরিচিতির সংকট কেটে ওঠবে

লেখক: মোহাম্মদ আন্‌ওয়ারুল কবীর

পেশা:অধ্যাপনা, কম্পিউটার বিঞ্জান

জয়দেব মুখোপাধ্যায় : চৈতন্য মৃত্যুরহস্যের কিনারা করতে গিয়ে প্রাণ দিয়েছিলেন যে গবেষক

জয়দেব মুখোপাধ্যায়ের যেন এক কিংবদন্তির নাম যার কথা অনেকেই শুনেছে , বহু মানুষই তাকে খুঁজে ফেরে কিন্ত তার ব্যাপারে বিশদে কেউ কিছু বলতে পারেনা...