১।
আরজ আলী মাতুব্বর কিম্বা সরদার ফজলুল করিম কে “অ-দার্শনিক” প্রমান করবার জঙ্গে যারা হাজির তাদের যুক্তি গুলো কি? দেখুন তাদের যুক্তিগুলো কিরকমের “অকাট্য” !
২।
যে সকল অনলাইন পুরোহিত আরজ আলী মাতুব্বর সাহেবের কাজ কে গৌন প্রমানের জঙ্গে লিপ্ত তাদের মতামত কে আমি গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। আমি মনে করি, পৃথিবীর যেকোনো মানুষ মনে করতেই পারেন – অমুক গৌন লেখক, তমুক গৌন শিল্পী কিম্বা অমুক তো দার্শনিক নন, তমুক তো কবি নন ইত্যাদি। কিন্তু যে সকল অনলাইন পুরোহিতেরা আরজ আলী বা সরদার ফজলুল করিমের পেছনে লেগে আছেন কয়েক বছর ধরে, আমরা তাদের এজেন্ডার কথা জানি। এবং আমি মনে করি আমাদের তরুন পাঠকদের এই সকল অনলাইন পুরোহিতদের এজেন্ডাগুলোর কথা জানানোটা জরুরী।
৩।
বাংলাদেশ যেভাবে রকেটের গতিতে ইসলামী মোল্লাতন্ত্রের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, তাতে – সেকুলার, ধর্ম-নিরপেক্ষ, প্রগতিবাদী চিন্তকদের উপরে ব্যক্তি আক্রমন, তাঁদের কাজ কে গৌন বলে প্রচার করা, তাঁদের ভুমিকা, তাঁদের প্রতিষ্ঠান, তাঁদের অর্জন সকল কিছুকে গৌন বলে প্রচার করাটা খুব স্বাভাবিক একটি কাজ, খুবই প্রত্যাশিত প্রবনতা। এই ধরনের প্রচারনার পেছনে রাজনীতিটা আসলে মোল্লাতন্ত্রের রাজনীতি। ঐতিহাসিক ভাবেই মোল্লাতন্ত্র এই সকল কাজ করে এসেছে, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে। একাজ করার জন্যে “মালপানি”র সরবরাহও কম নয়। সেকুলার প্রগতিশীল চিন্তার সাথে মোল্লাতন্ত্রের এই বৈরীতা ঐতিহাসিক। তা সে কখনও ইউরোপে খ্রিস্টিয় মোল্লাতন্ত্রের রুপ ধরে এসেছে আবার কখনও বা এশিয়ার দেশ গুলোতে ইসলামী মোল্লাতন্ত্র কিম্বা ভারতে হিন্দু মোল্লাতন্ত্রের স্বরূপে এসেছে। তাই ভারতে যেমন প্রগতিশীল চিন্তক ইরফান হবিব কে হিন্দু বিদ্বেষী হিসাবে চিহ্নিত করা হয় ঠিক একই কায়দায় ইতিহাসের অধ্যাপক ও গবেষক রোমিলা থাপারকেও হিন্দু বিদ্বেষী বলা হয়। অরুন্ধতী রায় কে বলা হচ্ছে পশ্চিমের দালাল – ভারতের শত্রু। এদের সবারই “দোষ” হচ্ছে এরা নিরন্তর ভাবে ভারতের ভয়াবহ মোল্লাতন্ত্র – হিন্দুত্তবাদের বিরুদ্ধে তাঁদের সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন। ভারতের কর্পোরেট পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে নিরন্তর সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন। মোল্লাতন্ত্র আর কর্পোরেট পুঁজির ঐক্য তো ঐতিহাসিক। পৃথিবীর ইতিহাস আমাদের বলে দেয়, পুঁজি কখনই মোল্লাতন্ত্র কে উৎখাত করতে চায়নি, বরং পুঁজি – পুজিবাদ সবসময়েই মোল্লাতন্ত্রের সাথে হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করেছে। যেখানে যেখানে দরকার সেখানে সেখানে পুঁজির সবচাইতে কাছের বন্ধু হচ্ছে – ধর্ম বা মোল্লাতন্ত্র। ভারতে যারা ইরফান হবিব – রোমিলা থাপার বা অরুন্ধতী রায়ের গুষ্ঠি উদ্ধার করছেন দিন রাত, তাঁদের ঠিকুজি নিয়ে দেখুন … পেয়ে যাবেন হিন্দুত্ববাদের এলিট প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিগুলোকে। একই ভাবে, বাংলাদেশে যারা আরজ আলী মাতুব্বর, আহমদ শরীফ, সরদার ফজলুল করিম, হুমায়ুন আজাদ বা সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী সহ আরো অনেকের পেছনে লেগে আছেন দলবল নিয়ে, তাঁদের ঠিকানা – সাকিন – পরিচয় নিয়ে দেখুন, দেখবেন, গোড়াটা একই যায়গায় বাঁধা – ওপারে হিন্দুত্ববাদ আর এপারে ইসলাম আর দুপারেই রয়েছে মোল্লাতন্ত্র আর ব্যবসায়ী – বেনিয়াদের জোট । ইরফান হবিব-রোমিলা থাপার – অরুন্ধতী রায় – আরজ আলো মাতুব্বর – সরদার ফজলুল করিম – আহমদ শরীফ – হুমায়ুন আজাদ – সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী এদের সকলকে গৌন প্রতিপন্ন করাটা মোল্লাতন্ত্রের বড় এজেন্ডার অংশ। শুধু প্রেক্ষিত ভেদে তা কখনও হিন্দু মোল্লাতন্ত্র কিম্বা ইসলামী মোল্লাতন্ত্রের অংশ মাত্র। আসুন এবার, বাংলাদেশের মোল্লাতন্ত্রের প্রতিনিধিদের “কে দার্শনিক” বিষয়ক প্রশ্নটি নিয়ে আলোচনা করি।
৪।
কে দার্শনিক আর কে নয়? প্রশ্নটা প্রায় একই রকমের যখন আমরা জিজ্ঞাসা করি কে কবি আর কে নয়। অর্থাৎ কোনটা কবিতা তা যত সহজে বোঝা যায় কবিকে ততটা সহজে বোঝা যায়না। তাই – আধুনিক কালে দর্শন কি, দর্শনের আওতা কতদূর, দর্শনের আলোচনার প্রধান প্রশ্ন গুলো কি কি, আর দর্শনের পদ্ধতিই বা কি রকমের? এই সকল প্রশ্ন নিয়ে হাজার হাজার লেখা পাওয়া যাবে। দর্শনের একাডেমিক বই গুলোতে এই শিরোনামের অধ্যায় গুলো পাওয়া যাবে। কিন্তু কে দার্শনিক আর কে নয়, এ বিষয়ে আলোচনার – লেখালেখির নজির খুব বেশী নয়। এমন কি কে দার্শনিক নন, এটা পেশাদার দার্শনিকদের আলোচনার বিষয়ের মধ্যে পড়েই না। বরং দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি কি, একজন মানুষ কখন দার্শনিক হয়ে ওঠেন সেই সকল বিষয়ে কিছু আলোচনা আছে।
৫।
প্রথম পর্বে উল্লেখ করেছি, আরজ আলী মাতুব্বর আর সরদার ফজলুল করিমের বিরুদ্ধে এই জঙ্গের নেতৃত্ব দিচ্ছেন যে অনলাইন পুরোহিত, তিনি অনুবাদ করেছিলেন (অথবা করিয়ে নিয়েছিলো)ফরাসী দার্শনিক রেনে দেকারতের পুস্তক, সেই অতি নীচু মানের অনুবাদের ভুমিকা লিখে দিতে রাজী হননি অধ্যাপক সরদার ফজলুল করিম। সেই থেকেই সরদার ফজলুল করিমের নাম দার্শনিকের খাতা থেকে কাটা যায়। আমার বিশ্বাস, অধ্যাপক সরদার বা মাতুব্বর সাবের কেউই খুন মাইন্ড করবেন না – যদি বাংলাদেশের মোল্লাতন্ত্র তাঁদেরকে দার্শনিকের খাতা থেকে বাদ দিয়ে দেন। বরং আসুন মূল আলোচনাটা শুরু করি – কে দার্শনিক, কখন ও কিভাবে দার্শনিক?
রেনে দেকারতেরই একটা বিখ্যাত কথা দিয়ে শুরু করি। পড়ে দেখুন –
“It is now some years since I detected how many were the false beliefs that I had believed to be true since my earliest youth. And since that time, I have been convinced that I must once and for all seriously try to rid myself of all the opinions which I had formerly accepted, and begin to build a new, if I wanted to establish any firm and permanent structure for my beliefs.”
— René Descartes, Meditations
রেনে দেকারতে হচ্ছেন আধুনিক দর্শনের জনক। ফরাসী এই নাক উচু ভদ্রলোক দর্শনে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্যে স্মরনীয়। তাঁর কথা বলার আগে, খেয়াল করে দেখুন, তিনি কি বলছেন – জীবনের একটা পর্যায়ে এখন তিনি বুঝতে পারেন, কত ভুল ধারণা বিশ্বাস তিনি পুষে রেখেছিলেন, বহন করেছিলেন তাঁর যৌবন কালে, সে সকল ভুল ধারণা, বিশ্বাস থেকে তিনি এখন বেরিয়ে আসতে চান। এবং আশা প্রকাশ করছেন – একদিন তিনি তাঁর নিজের রচিত – গড়ে তোলা চিন্তার মাঝে বসবাস করবেন। দেকারতের মন্তব্যটিতে কোনও সুনির্দিষ্ট বিশ্বাসের কথা বলা নেই, এটা কি ধর্ম বিশ্বাস নাকি অন্য কোনও প্রসঙ্গে? তাতে আসলে কিছু যায় আসেনা, যদি আমরা তাঁর “বোধ” টিকে বোঝার চেষ্টা করি।
এটা দর্শনের একটি প্রধান ধাপ – বর্তমান – অস্তিত্তমান বিষয়ের প্রসঙ্গে প্রশ্ন তোলা, পুরনো চিন্তার মাঝ থেকে বেরিয়ে এসে নিজের চিন্তা গড়ে তোলা, অন্তত গড়ে তোলার চেষ্টা করা।
প্রশ্ন হচ্ছে – মানুষ কিভাবে পুরনো চিন্তা থেকে বেরিয়ে এসে নিজের মতো করে নতুন চিন্তা গড়ে তোলে বা তোলার চেষ্টা করতে পারে? এর কোনও সোজা সাপটা উত্তর নেই। অথবা এর হয়তো অসংখ্য উত্তর আছে। তবে সবচাইতে সহজ উত্তর টা হচ্ছে – “জিজ্ঞাসা” ! মানুষ জিজ্ঞাসার মাধ্যমেই তাঁর নিজের পুরনো জ্ঞান – জানাশোনা – বোধ কে চ্যালেঞ্জ করে এবং নতুন জ্ঞান – জানাশোনা – বোধ তৈরী করার চেষ্টা করে। এই পথপরিক্রমায় হয়তো নানান পদ্ধতিগত ধাপ আছে – নানান টুল আছে ব্যবহারের। পদ্ধতিগত বিষয়ে নানান তফাত থাকলেও – মৌলিক বিষয়টি হচ্ছে – “জিজ্ঞাসা” বা প্রশ্ন তোলা। এই জিজ্ঞাসা কখনও নিজের সম্পর্কে কখনও বা বহিরঙ্গন সম্পর্কে, কখনও সৃষ্টি বা স্রষ্টা সম্পর্কে কিম্বা প্রকৃতি সম্পর্কে।
৬।
সাম্প্রতিক সময়ের এক দর্শনের অধ্যাপক বিষয়টিকে এভাবে লিখেছেন – “ফিলসফি বা দর্শনের শুরুটা প্রায়ই হয় কিছু ঘ্যান ঘ্যান করা ব্যক্তিগত প্রশ্ন দিয়ে। প্রায়শই আমাদের দার্শনিক চিন্তার শুরু হয় কোনও বিশাল হতাশা বা বিষাদের মধ্যে দিয়ে। কখনও কখনও বড় সড় ট্র্যাজেডি থেকেই আমাদের দার্শনিক চিন্তার উদ্ভব ঘটে। আমাদের দার্শনিক চিন্তার শুরু হয় যখন সত্যিই আমরা অনেক কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে অতিবাহিত করি, যখন আমারা সত্যিই অনেক কঠিন প্রশ্নের মুখোমুখি হই ও সেসবের সমাধানের চেষ্টা করি। সোজা করে বললে দর্শন হচ্ছে জীবনের সেই বড় প্রশ্ন গুলো উত্থাপন করা। দর্শন হচ্ছে জীবনের প্রাথমিক প্রশ্নগুলো তোলা, আমাদের চিন্তা ও জ্ঞানের জগতের খুব ছোট কিম্বা বড় কিম্বা প্রাথমিক প্রশ্নগুলো তোলা, সেইসকল প্রশ্ন যা প্রায়শই আমরা ধরাধার্য বলে মেনে নেই, প্রশ্ন করিনা। ধরা যাক আমরা জানি মানুষ হত্যা খুব মন্দ একটি কাজ। এটা আমরা বিশ্বাস করি এবং ধরেই নেই সঠিক বলে কিন্তু কেউ যদি প্রশ্ন তোলে কেনও মানুষ হত্যা ভালো কাজ নয়? কখন মানুষ হত্যা ভালো কাজ নয়? এই নৈতিক অবস্থানটি কি সকল সময়েই সঠিক? এই প্রশ্নগুলো বিব্রতকর, কঠিন প্রশ্ন এবং আমরা সকলেই হয়তো এই ধরনের বিব্রতকর-কঠিন প্রশ্নগুলো করিনা, অথচ এসকল প্রশ্ন জীবনেরই অংশ। সাধারণ মানুষের প্রাত্যহিক মধ্যবিত্ত যাপিত জীবনে এই প্রশ্নগুলো করা হয়ে ওঠেনা, তাঁরা এই সকল প্রশ্নের একধরনের উত্তর বা নৈতিক অবস্থান কে ধরাধার্য হিসাবে মেনে নেন। কিন্তু কেউ কেউ এধরনের বিব্রতকর প্রশ্নগুলো তোলেন, সেসবের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেন, এই সকল প্রশ্নের প্রেক্ষিতে নিজের চিন্তাগুলোকে আরটিকুলেইট বা সংঘবদ্ধ করেন বা গুছিয়ে তোলেন, সেই সকল গোছানো চিন্তার পেছনে যুক্তি দাঁড়া করেন এবং সব শেষে… সেই সকল চিন্তার প্রকাশ, অন্যদের কে জানানো – কখনও লিখে,কখনও বা বলে। হয়তোবা এই নতুন চিন্তার সাথে বেশীরভাগ মানুষ একমত হবেন না, কিম্বা মানুষ হয়তো প্রতিক্রিয়ায় আক্রান্ত হবেন এই নতুন চিন্তায়, কিন্তু এইই হচ্ছে দর্শনের পদ্ধতি। বলা যেতে পারে, প্রায়শই দর্শনের শুরুই হয় দ্বিমত দিয়ে, ভিন্নমত পোষণের মধ্যে দিয়ে।” (The Big Question – Robert C Solomon, Kathleen Higgins)
৭।
আমি জানি, কুট তার্কিক বন্ধুরা বলবেন, প্রশ্ন তোলাই যদি দর্শন হয়, তাহলে পৃথিবীর সকল মানুষই দার্শনিক, তাহলে তো পৃথিবীতে কোটি কোটি দার্শনিক ! প্রশ্ন তোলাই যদি দার্শনিক হওয়ার প্রাথমিক শর্ত হয়, তাহলে তো শিশুরা সবচেয়ে বড় দার্শনিক ! আপাত যুক্তিতে হয়তো তাইই। অর্থাৎ যেকোনো মানুষই দার্শনিক হতে পারেন। শিশুরাও দর্শনের প্রশ্ন তুলতে পারে। কিন্তু বিষয় হিসাবে দর্শন তা বলেনা। সকল প্রশ্নই দার্শনিক প্রশ্ন নয়। কেনো নয়, সে বিষয়ে দ্বিমত – ভিন্নমত – বহুমত থাকতে পারে, কিন্তু সকল প্রশ্নই দার্শনিক প্রশ্ন হিসাবে উত্তীর্ণ হয়না। এই বিষয়ে বহু লেখালেখি আছে। দর্শনের একাডেমিক পুস্তকগুলোতে তাই ইদানিং সুনির্দিষ্ট অধ্যায়ই থাকে – দার্শনিক প্রশ্ন কি সে বিষয়ে আলোচনা নিয়ে। হাতের কাছে একটা বহুল পঠিত ও স্বীকৃত দর্শনের প্রবন্ধ আছে – দার্শনিক প্রশ্ন কি এ বিষয়ের উপরে, প্রখ্যাত দার্শনিক ও দর্শনের অধ্যাপক Nermi Uygur ১৯৬৪ সালে, দার্শনিক প্রশ্ন কি? এ বিষয়ে একটি দারুন প্রবন্ধ লেখেন। প্রবন্ধটিতে তিনি বিষয়টির তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা দেন, কেনও আমাদের দৈনন্দিন প্রশ্নগুলো দার্শনিক প্রশ্ন নাও হতে পারে। দুটি খুব সহজ উদাহরন ব্যবহার করেছেন তিনি – আমি শুধু প্রেক্ষিত বদল করে তাঁর ব্যাখ্যাটি তুলে ধরছি। ধরুন, ঢাকা শহরে এখন এপার্টমেন্ট ব্যবসায়ের রমরমা অবস্থা (না হলেও ধরে নিন)। আপনি একটি এপার্টমেন্ট কিনবেন, তাই আপনি প্রশ্ন করছেন – “এখানকার এপার্টমেন্ট গুলোতে কয়টা করে বেডরুম আছে?” – এই প্রশ্নটি কি একটি দার্শনিক প্রশ্ন? কিম্বা হতে পারে? এই প্রশ্নটি একটি দার্শনিক প্রশ্ন হয়ে ওঠার সম্ভাবনা প্রায় শুন্যের কাছাকাছি। কেননা, কেবলমাত্র একটি সংখ্যা প্রশ্নকারীর সকল উত্তর দিতে পারে, কেবলমাত্র একটি সংখ্যার উল্লেখ এই বিষয়ের সকল জানার আগ্রহকে নিবৃত্ত করতে পারে। ধরুন উত্তরটি হচ্ছে – “চারটি বেডরুম আছে”। মাত্র একটি শব্দ – “চারটি”, উল্লেখিত প্রশ্নটি সম্পর্কে সকলের আগ্রহের অবসান ঘটায় এখানে। ধরুন, আপনি সেই ফ্ল্যাটটি কিনেছেন এবং একদিন আপনার সন্তান কে জিজ্ঞাসা করছেন – “রান্নাঘরের দরোজাটি কি বন্ধ নাকি খোলা?” এই প্রশ্নটি কি দার্শনিক প্রশ্ন হতে পারে? এটাও দার্শনিক প্রশ্ন হয়ে ওঠার সম্ভাবনা প্রায় শুন্যের কাছাকাছি। কেনন – মাত্র দুটি অপশনের যেকোনো একটি দিয়ে এই প্রশ্নটি সম্পর্কে সকল মিমাংসা করে দেয়া সম্ভব। “খোলা” অথবা “বন্ধ” এই দুটি শব্দের যেকোনো একটি হচ্ছে পার্থিব উত্তর। কিম্বা প্রশ্নটি শুধুমাত্র একটি অপশন দিয়েও করা যেতে পারে – “রান্না ঘরের দরোজাটি কি খোলা”? এই প্রশ্নেরও পরিনতি একই। কিন্তু ধরুন তো – “জীবনের মানে কি?” এই প্রশ্নটির কতগুলো উত্তর হতে পারে? একটি? দুইটি কিম্বা চৌদ্দটি? কিম্বা দুই হাজার? কিম্বা দুই লক্ষ উত্তর? এমন কি দুই লক্ষ উত্তর হলেও – দু’লক্ষতম উত্তরটিও হয়তো এই প্রশ্নটিতে পৃথিবীর সকলের আগ্রহ নিবৃত্ত করতে পারবেনা, অর্থাৎ কোনও উত্তরই শ্রোতার পরবর্তী প্রশ্ন করাকে বন্ধ করতে পারেনা। এটাই হচ্ছে প্রাত্যহিক প্রশ্ন ও দার্শনিক প্রশ্নের মাঝে একটা উল্লেখযোগ্য পার্থক্য। প্রাত্যহিক প্রশ্নের ঠিক কিম্বা বেঠিক উত্তর তৈরী থাকে, দর্শনের প্রশ্নের কোনও ঠিক বেঠিক উত্তর নেই, শুধু উত্তর খোঁজার প্রয়াস আছে।
৮।
আরজ আলী মাতুব্বর এর লেখালেখিগুলোকে তিনখন্ডে প্রকাশ করেছে ঢাকার একটি প্রকাশনা (অন্তত আমার কাছে এগুলোই আছে)। প্রথম খন্ডের প্রথম অংশের নাম “সত্যর সন্ধান” … এই পুস্তকে তিনি শুরু করেছিলেন মানুষের জিজ্ঞাসা দিয়ে… এবং কয়েকটি অধ্যায়ে তিনি বিন্যস্ত করেছেন তাঁর প্রশ্ন গুলো এবং তাঁর পেছনে দাড়া করিয়েছেন তাঁর যুক্তির দেয়াল। যারা আরজ আলী মাতুব্বর এর লেখা সত্যিই পড়েছেন – তাঁরা জানেন, আরজ আলী মাতুব্বর এর তোলা প্রশ্ন গুলো কি প্রাত্যহিক জীবনের প্রশ্ন নাকি সেই প্রশ্নগুলো মাতুব্বর সাহেবের নিজের পুরনো বিশ্বাস থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা। মাতুব্বর শুধু নিজেই তাঁর পুরনো বিশ্বাস কে প্রশ্নবিদ্ধ করেন নি, তিনি তাঁর সাথের ও তাঁর পরবর্তী মানুষদেরও সেই সকল প্রশ্নের সহযাত্রী করেছেন। মাতুব্বর সাহেব লিখেছেনঃ
প্রথম অধ্যায়ের শেষে তিনি প্রশ্ন রেখেছেন –
পাঠকের কাছে প্রশ্ন – বলুন তো এই প্রশ্নগুলো কি প্রাত্যহিক প্রশ্ন? নাকি দার্শনিক প্রশ্ন? প্রশ্নগুলো কি কোনও বিশেষ ধর্মের সমালোচনা? নাকি জীবন অনুসন্ধিৎসা? এই প্রশ্নগুলো থেকে আরজ মাতুব্বর সাহেব চেষ্টা করেছেন নিজের মতো করে অনুসন্ধান করতে, নিজের যুক্তি গুলোকে সাজাতে এবং নিজের চিন্তা – উপসংহার গুলোকে লিখে প্রকাশ করতে – একজন দার্শনিক এভাবেই তাঁর চিন্তাকে গড়ে তোলেন। তাঁর প্রকাশের ধরন হয়তো আমাদের আধুনিক নাগরিক মস্তিস্ক কে খুব স্বস্তি দেয়না, আমরা হয়তো ঠিক এভাবে বিষয়গুলিকে দেখিনা, দেখতে চাইনা, হয়তো আরজ মাতুব্বর সাহেবের লেখায় শহুরে মেকী “ক্ল্যাসিক” ভাবটি নেই, কিন্তু প্রশ্নগুলো দার্শনিক প্রশ্ন নাকি প্রাত্যহিক প্রশ্ন এ বিষয়ে কি ভেবে দেখবেন? আরজ মাতুব্বর এর পুস্তকগুলো অনলাইনে খুবই সহজলভ্য – পড়ে দেখুন, প্রেজুডিস বা সংস্কার মুক্ত থেকে পড়ে দেখুন, তারপর নিজেকে প্রশ্ন করুন – আরজ মাতুব্বর যে সকল প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন, সেগুলো কি দার্শনিক প্রশ্ন?
৯।
আরজ আলী মাতুব্বর রচনাসমগ্র ডাউনলোড করতে পারেন এখান থেকে আরজ আলী মাতুব্বর রচনাসমগ্র
আমি বলছিনা যে আরজ আলী মাতুব্বর সাহেবকে আপনার দার্শনিক হিসাবে স্বীকার করতেই হবে। এই স্বীকার করা না করা দিয়ে মাতুব্বর সাব তো বটেই তাঁর পাঠকদেরও কিছু যায় আসেনা। আমি চেষ্টা করলাম, দর্শনের চর্চা কিভাবে কিভাবে শুরু হয়, দার্শনিক প্রশ্ন কি? তাঁর একটা সহজ প্রাথমিক ধারণা দেবার, বলাই বাহুল্য দর্শনের একাডেমিক পুস্তক/প্রবন্ধ থেকেই আলোচনাটি করার চেষ্টা করেছি। যারা আরজ আলী মাতুব্বর এর লেখার নিবিড় পাঠক, তাঁরা সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন, আশা করি।
আগামী পর্বে দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে আলোচনা করবো।
(চলবে)
লেখক: , লেখক ও প্রাবন্ধিক
রেফারেন্সঃ
Nermi Uygur (1964) What is a Philosophical Question? Mind, New Series, Vol. 73, No. 289 (Jan., 1964), pp. 64-83
Robert C Solomon, Kathleen Higgins, (2010), The big questions: A short introduction to philosophy, 8th ed. 2010, 2006 Wadsworth, Cengage Learning –
আরজ আলী মাতুব্বর কিম্বা সরদার ফজলুল করিম কে “অ-দার্শনিক” প্রমান করবার জঙ্গে যারা হাজির তাদের যুক্তি গুলো কি? দেখুন তাদের যুক্তিগুলো কিরকমের “অকাট্য” !
- আরজ আলী মাতুব্বর সাহেব কেবল ইসলাম ধর্মের সমালোচনা করেছেন, তিনি কোনও মৌলিক প্রশ্ন তোলেন নি।
- আর সরদার ফজলুল করিম দর্শন পড়েছেন বটে, দর্শন পড়িয়েছেন বটে এমন কি কিছু দর্শনের বই অনুবাদও করেছেন, কিন্তু তিনি দর্শন চর্চা করেন নি।
২।
যে সকল অনলাইন পুরোহিত আরজ আলী মাতুব্বর সাহেবের কাজ কে গৌন প্রমানের জঙ্গে লিপ্ত তাদের মতামত কে আমি গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। আমি মনে করি, পৃথিবীর যেকোনো মানুষ মনে করতেই পারেন – অমুক গৌন লেখক, তমুক গৌন শিল্পী কিম্বা অমুক তো দার্শনিক নন, তমুক তো কবি নন ইত্যাদি। কিন্তু যে সকল অনলাইন পুরোহিতেরা আরজ আলী বা সরদার ফজলুল করিমের পেছনে লেগে আছেন কয়েক বছর ধরে, আমরা তাদের এজেন্ডার কথা জানি। এবং আমি মনে করি আমাদের তরুন পাঠকদের এই সকল অনলাইন পুরোহিতদের এজেন্ডাগুলোর কথা জানানোটা জরুরী।
৩।
বাংলাদেশ যেভাবে রকেটের গতিতে ইসলামী মোল্লাতন্ত্রের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, তাতে – সেকুলার, ধর্ম-নিরপেক্ষ, প্রগতিবাদী চিন্তকদের উপরে ব্যক্তি আক্রমন, তাঁদের কাজ কে গৌন বলে প্রচার করা, তাঁদের ভুমিকা, তাঁদের প্রতিষ্ঠান, তাঁদের অর্জন সকল কিছুকে গৌন বলে প্রচার করাটা খুব স্বাভাবিক একটি কাজ, খুবই প্রত্যাশিত প্রবনতা। এই ধরনের প্রচারনার পেছনে রাজনীতিটা আসলে মোল্লাতন্ত্রের রাজনীতি। ঐতিহাসিক ভাবেই মোল্লাতন্ত্র এই সকল কাজ করে এসেছে, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে। একাজ করার জন্যে “মালপানি”র সরবরাহও কম নয়। সেকুলার প্রগতিশীল চিন্তার সাথে মোল্লাতন্ত্রের এই বৈরীতা ঐতিহাসিক। তা সে কখনও ইউরোপে খ্রিস্টিয় মোল্লাতন্ত্রের রুপ ধরে এসেছে আবার কখনও বা এশিয়ার দেশ গুলোতে ইসলামী মোল্লাতন্ত্র কিম্বা ভারতে হিন্দু মোল্লাতন্ত্রের স্বরূপে এসেছে। তাই ভারতে যেমন প্রগতিশীল চিন্তক ইরফান হবিব কে হিন্দু বিদ্বেষী হিসাবে চিহ্নিত করা হয় ঠিক একই কায়দায় ইতিহাসের অধ্যাপক ও গবেষক রোমিলা থাপারকেও হিন্দু বিদ্বেষী বলা হয়। অরুন্ধতী রায় কে বলা হচ্ছে পশ্চিমের দালাল – ভারতের শত্রু। এদের সবারই “দোষ” হচ্ছে এরা নিরন্তর ভাবে ভারতের ভয়াবহ মোল্লাতন্ত্র – হিন্দুত্তবাদের বিরুদ্ধে তাঁদের সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন। ভারতের কর্পোরেট পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে নিরন্তর সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন। মোল্লাতন্ত্র আর কর্পোরেট পুঁজির ঐক্য তো ঐতিহাসিক। পৃথিবীর ইতিহাস আমাদের বলে দেয়, পুঁজি কখনই মোল্লাতন্ত্র কে উৎখাত করতে চায়নি, বরং পুঁজি – পুজিবাদ সবসময়েই মোল্লাতন্ত্রের সাথে হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করেছে। যেখানে যেখানে দরকার সেখানে সেখানে পুঁজির সবচাইতে কাছের বন্ধু হচ্ছে – ধর্ম বা মোল্লাতন্ত্র। ভারতে যারা ইরফান হবিব – রোমিলা থাপার বা অরুন্ধতী রায়ের গুষ্ঠি উদ্ধার করছেন দিন রাত, তাঁদের ঠিকুজি নিয়ে দেখুন … পেয়ে যাবেন হিন্দুত্ববাদের এলিট প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিগুলোকে। একই ভাবে, বাংলাদেশে যারা আরজ আলী মাতুব্বর, আহমদ শরীফ, সরদার ফজলুল করিম, হুমায়ুন আজাদ বা সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী সহ আরো অনেকের পেছনে লেগে আছেন দলবল নিয়ে, তাঁদের ঠিকানা – সাকিন – পরিচয় নিয়ে দেখুন, দেখবেন, গোড়াটা একই যায়গায় বাঁধা – ওপারে হিন্দুত্ববাদ আর এপারে ইসলাম আর দুপারেই রয়েছে মোল্লাতন্ত্র আর ব্যবসায়ী – বেনিয়াদের জোট । ইরফান হবিব-রোমিলা থাপার – অরুন্ধতী রায় – আরজ আলো মাতুব্বর – সরদার ফজলুল করিম – আহমদ শরীফ – হুমায়ুন আজাদ – সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী এদের সকলকে গৌন প্রতিপন্ন করাটা মোল্লাতন্ত্রের বড় এজেন্ডার অংশ। শুধু প্রেক্ষিত ভেদে তা কখনও হিন্দু মোল্লাতন্ত্র কিম্বা ইসলামী মোল্লাতন্ত্রের অংশ মাত্র। আসুন এবার, বাংলাদেশের মোল্লাতন্ত্রের প্রতিনিধিদের “কে দার্শনিক” বিষয়ক প্রশ্নটি নিয়ে আলোচনা করি।
৪।
কে দার্শনিক আর কে নয়? প্রশ্নটা প্রায় একই রকমের যখন আমরা জিজ্ঞাসা করি কে কবি আর কে নয়। অর্থাৎ কোনটা কবিতা তা যত সহজে বোঝা যায় কবিকে ততটা সহজে বোঝা যায়না। তাই – আধুনিক কালে দর্শন কি, দর্শনের আওতা কতদূর, দর্শনের আলোচনার প্রধান প্রশ্ন গুলো কি কি, আর দর্শনের পদ্ধতিই বা কি রকমের? এই সকল প্রশ্ন নিয়ে হাজার হাজার লেখা পাওয়া যাবে। দর্শনের একাডেমিক বই গুলোতে এই শিরোনামের অধ্যায় গুলো পাওয়া যাবে। কিন্তু কে দার্শনিক আর কে নয়, এ বিষয়ে আলোচনার – লেখালেখির নজির খুব বেশী নয়। এমন কি কে দার্শনিক নন, এটা পেশাদার দার্শনিকদের আলোচনার বিষয়ের মধ্যে পড়েই না। বরং দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি কি, একজন মানুষ কখন দার্শনিক হয়ে ওঠেন সেই সকল বিষয়ে কিছু আলোচনা আছে।
৫।
প্রথম পর্বে উল্লেখ করেছি, আরজ আলী মাতুব্বর আর সরদার ফজলুল করিমের বিরুদ্ধে এই জঙ্গের নেতৃত্ব দিচ্ছেন যে অনলাইন পুরোহিত, তিনি অনুবাদ করেছিলেন (অথবা করিয়ে নিয়েছিলো)ফরাসী দার্শনিক রেনে দেকারতের পুস্তক, সেই অতি নীচু মানের অনুবাদের ভুমিকা লিখে দিতে রাজী হননি অধ্যাপক সরদার ফজলুল করিম। সেই থেকেই সরদার ফজলুল করিমের নাম দার্শনিকের খাতা থেকে কাটা যায়। আমার বিশ্বাস, অধ্যাপক সরদার বা মাতুব্বর সাবের কেউই খুন মাইন্ড করবেন না – যদি বাংলাদেশের মোল্লাতন্ত্র তাঁদেরকে দার্শনিকের খাতা থেকে বাদ দিয়ে দেন। বরং আসুন মূল আলোচনাটা শুরু করি – কে দার্শনিক, কখন ও কিভাবে দার্শনিক?
রেনে দেকারতেরই একটা বিখ্যাত কথা দিয়ে শুরু করি। পড়ে দেখুন –
“It is now some years since I detected how many were the false beliefs that I had believed to be true since my earliest youth. And since that time, I have been convinced that I must once and for all seriously try to rid myself of all the opinions which I had formerly accepted, and begin to build a new, if I wanted to establish any firm and permanent structure for my beliefs.”
— René Descartes, Meditations
“অনেক বছর হলো, আমি এখন বুঝতে পারি, আমার যৌবন থেকে এখন পর্যন্ত কতগুলো ভুল ও মিথ্যা বিশ্বাস আমি সত্যি বলে জেনেছিলাম। যেদিন থেকে বুঝেছি, সেদিন থেকেই মনে করেছি, আমি অন্তত একবার, সকল শক্তি দিয়ে চেষ্টা করবো আমার বয়ে বেড়ানো সেই সকল মিথ্যা বিশ্বাস – সংস্কার থেকে বেরিয়ে এসে আমার নিজের চিন্তা গড়ে তুলতে, যা হবে দীর্ঘস্থায়ী এবং আমার নিজস্ব চিন্তা”।(অনুবাদ আমার নিজের, ভুল হলে দেখিয়ে দিন, শুধরে নেবো)
— মেডিটেশন, রেনে দেকারতে
রেনে দেকারতে হচ্ছেন আধুনিক দর্শনের জনক। ফরাসী এই নাক উচু ভদ্রলোক দর্শনে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্যে স্মরনীয়। তাঁর কথা বলার আগে, খেয়াল করে দেখুন, তিনি কি বলছেন – জীবনের একটা পর্যায়ে এখন তিনি বুঝতে পারেন, কত ভুল ধারণা বিশ্বাস তিনি পুষে রেখেছিলেন, বহন করেছিলেন তাঁর যৌবন কালে, সে সকল ভুল ধারণা, বিশ্বাস থেকে তিনি এখন বেরিয়ে আসতে চান। এবং আশা প্রকাশ করছেন – একদিন তিনি তাঁর নিজের রচিত – গড়ে তোলা চিন্তার মাঝে বসবাস করবেন। দেকারতের মন্তব্যটিতে কোনও সুনির্দিষ্ট বিশ্বাসের কথা বলা নেই, এটা কি ধর্ম বিশ্বাস নাকি অন্য কোনও প্রসঙ্গে? তাতে আসলে কিছু যায় আসেনা, যদি আমরা তাঁর “বোধ” টিকে বোঝার চেষ্টা করি।
(রেনে দেকারতে, আধুনিক দর্শনের অন্যতম ব্যক্তি, পুরনো বিশ্বাসকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে গড়ে তুলেছিলেন, নিজের চিন্তা – বিশ্বাস।)
সকল মানুষের এই বোধদয় হয়না। বরং বাস্তব জীবন থেকে বললে – বলা যাবে,
পৃথিবীর বেশীর ভাগ মানুষেরই তাঁর জীবদ্দশায় এই বোধদয় হয়না। খুব কম মানুষই
ভেবে উঠতে পারেন … যে সে তাঁর সমগ্র শৈশব – কৈশোর – যৌবন ধরে অসংখ্য
ভ্রান্তির মাঝে অতিবাহিত করেছে, এখন সময়, সেই সকল ভ্রান্তি কে দূর করার,
নতুন চিন্তা গড়ে তোলার। রেনে দেকারতের এই বোধদয় ছিলো এবং তিনি তা দূর করার
চেষ্টা করেছেন তাঁর নিজের চিন্তা গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে।এটা দর্শনের একটি প্রধান ধাপ – বর্তমান – অস্তিত্তমান বিষয়ের প্রসঙ্গে প্রশ্ন তোলা, পুরনো চিন্তার মাঝ থেকে বেরিয়ে এসে নিজের চিন্তা গড়ে তোলা, অন্তত গড়ে তোলার চেষ্টা করা।
প্রশ্ন হচ্ছে – মানুষ কিভাবে পুরনো চিন্তা থেকে বেরিয়ে এসে নিজের মতো করে নতুন চিন্তা গড়ে তোলে বা তোলার চেষ্টা করতে পারে? এর কোনও সোজা সাপটা উত্তর নেই। অথবা এর হয়তো অসংখ্য উত্তর আছে। তবে সবচাইতে সহজ উত্তর টা হচ্ছে – “জিজ্ঞাসা” ! মানুষ জিজ্ঞাসার মাধ্যমেই তাঁর নিজের পুরনো জ্ঞান – জানাশোনা – বোধ কে চ্যালেঞ্জ করে এবং নতুন জ্ঞান – জানাশোনা – বোধ তৈরী করার চেষ্টা করে। এই পথপরিক্রমায় হয়তো নানান পদ্ধতিগত ধাপ আছে – নানান টুল আছে ব্যবহারের। পদ্ধতিগত বিষয়ে নানান তফাত থাকলেও – মৌলিক বিষয়টি হচ্ছে – “জিজ্ঞাসা” বা প্রশ্ন তোলা। এই জিজ্ঞাসা কখনও নিজের সম্পর্কে কখনও বা বহিরঙ্গন সম্পর্কে, কখনও সৃষ্টি বা স্রষ্টা সম্পর্কে কিম্বা প্রকৃতি সম্পর্কে।
৬।
সাম্প্রতিক সময়ের এক দর্শনের অধ্যাপক বিষয়টিকে এভাবে লিখেছেন – “ফিলসফি বা দর্শনের শুরুটা প্রায়ই হয় কিছু ঘ্যান ঘ্যান করা ব্যক্তিগত প্রশ্ন দিয়ে। প্রায়শই আমাদের দার্শনিক চিন্তার শুরু হয় কোনও বিশাল হতাশা বা বিষাদের মধ্যে দিয়ে। কখনও কখনও বড় সড় ট্র্যাজেডি থেকেই আমাদের দার্শনিক চিন্তার উদ্ভব ঘটে। আমাদের দার্শনিক চিন্তার শুরু হয় যখন সত্যিই আমরা অনেক কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে অতিবাহিত করি, যখন আমারা সত্যিই অনেক কঠিন প্রশ্নের মুখোমুখি হই ও সেসবের সমাধানের চেষ্টা করি। সোজা করে বললে দর্শন হচ্ছে জীবনের সেই বড় প্রশ্ন গুলো উত্থাপন করা। দর্শন হচ্ছে জীবনের প্রাথমিক প্রশ্নগুলো তোলা, আমাদের চিন্তা ও জ্ঞানের জগতের খুব ছোট কিম্বা বড় কিম্বা প্রাথমিক প্রশ্নগুলো তোলা, সেইসকল প্রশ্ন যা প্রায়শই আমরা ধরাধার্য বলে মেনে নেই, প্রশ্ন করিনা। ধরা যাক আমরা জানি মানুষ হত্যা খুব মন্দ একটি কাজ। এটা আমরা বিশ্বাস করি এবং ধরেই নেই সঠিক বলে কিন্তু কেউ যদি প্রশ্ন তোলে কেনও মানুষ হত্যা ভালো কাজ নয়? কখন মানুষ হত্যা ভালো কাজ নয়? এই নৈতিক অবস্থানটি কি সকল সময়েই সঠিক? এই প্রশ্নগুলো বিব্রতকর, কঠিন প্রশ্ন এবং আমরা সকলেই হয়তো এই ধরনের বিব্রতকর-কঠিন প্রশ্নগুলো করিনা, অথচ এসকল প্রশ্ন জীবনেরই অংশ। সাধারণ মানুষের প্রাত্যহিক মধ্যবিত্ত যাপিত জীবনে এই প্রশ্নগুলো করা হয়ে ওঠেনা, তাঁরা এই সকল প্রশ্নের একধরনের উত্তর বা নৈতিক অবস্থান কে ধরাধার্য হিসাবে মেনে নেন। কিন্তু কেউ কেউ এধরনের বিব্রতকর প্রশ্নগুলো তোলেন, সেসবের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেন, এই সকল প্রশ্নের প্রেক্ষিতে নিজের চিন্তাগুলোকে আরটিকুলেইট বা সংঘবদ্ধ করেন বা গুছিয়ে তোলেন, সেই সকল গোছানো চিন্তার পেছনে যুক্তি দাঁড়া করেন এবং সব শেষে… সেই সকল চিন্তার প্রকাশ, অন্যদের কে জানানো – কখনও লিখে,কখনও বা বলে। হয়তোবা এই নতুন চিন্তার সাথে বেশীরভাগ মানুষ একমত হবেন না, কিম্বা মানুষ হয়তো প্রতিক্রিয়ায় আক্রান্ত হবেন এই নতুন চিন্তায়, কিন্তু এইই হচ্ছে দর্শনের পদ্ধতি। বলা যেতে পারে, প্রায়শই দর্শনের শুরুই হয় দ্বিমত দিয়ে, ভিন্নমত পোষণের মধ্যে দিয়ে।” (The Big Question – Robert C Solomon, Kathleen Higgins)
৭।
আমি জানি, কুট তার্কিক বন্ধুরা বলবেন, প্রশ্ন তোলাই যদি দর্শন হয়, তাহলে পৃথিবীর সকল মানুষই দার্শনিক, তাহলে তো পৃথিবীতে কোটি কোটি দার্শনিক ! প্রশ্ন তোলাই যদি দার্শনিক হওয়ার প্রাথমিক শর্ত হয়, তাহলে তো শিশুরা সবচেয়ে বড় দার্শনিক ! আপাত যুক্তিতে হয়তো তাইই। অর্থাৎ যেকোনো মানুষই দার্শনিক হতে পারেন। শিশুরাও দর্শনের প্রশ্ন তুলতে পারে। কিন্তু বিষয় হিসাবে দর্শন তা বলেনা। সকল প্রশ্নই দার্শনিক প্রশ্ন নয়। কেনো নয়, সে বিষয়ে দ্বিমত – ভিন্নমত – বহুমত থাকতে পারে, কিন্তু সকল প্রশ্নই দার্শনিক প্রশ্ন হিসাবে উত্তীর্ণ হয়না। এই বিষয়ে বহু লেখালেখি আছে। দর্শনের একাডেমিক পুস্তকগুলোতে তাই ইদানিং সুনির্দিষ্ট অধ্যায়ই থাকে – দার্শনিক প্রশ্ন কি সে বিষয়ে আলোচনা নিয়ে। হাতের কাছে একটা বহুল পঠিত ও স্বীকৃত দর্শনের প্রবন্ধ আছে – দার্শনিক প্রশ্ন কি এ বিষয়ের উপরে, প্রখ্যাত দার্শনিক ও দর্শনের অধ্যাপক Nermi Uygur ১৯৬৪ সালে, দার্শনিক প্রশ্ন কি? এ বিষয়ে একটি দারুন প্রবন্ধ লেখেন। প্রবন্ধটিতে তিনি বিষয়টির তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা দেন, কেনও আমাদের দৈনন্দিন প্রশ্নগুলো দার্শনিক প্রশ্ন নাও হতে পারে। দুটি খুব সহজ উদাহরন ব্যবহার করেছেন তিনি – আমি শুধু প্রেক্ষিত বদল করে তাঁর ব্যাখ্যাটি তুলে ধরছি। ধরুন, ঢাকা শহরে এখন এপার্টমেন্ট ব্যবসায়ের রমরমা অবস্থা (না হলেও ধরে নিন)। আপনি একটি এপার্টমেন্ট কিনবেন, তাই আপনি প্রশ্ন করছেন – “এখানকার এপার্টমেন্ট গুলোতে কয়টা করে বেডরুম আছে?” – এই প্রশ্নটি কি একটি দার্শনিক প্রশ্ন? কিম্বা হতে পারে? এই প্রশ্নটি একটি দার্শনিক প্রশ্ন হয়ে ওঠার সম্ভাবনা প্রায় শুন্যের কাছাকাছি। কেননা, কেবলমাত্র একটি সংখ্যা প্রশ্নকারীর সকল উত্তর দিতে পারে, কেবলমাত্র একটি সংখ্যার উল্লেখ এই বিষয়ের সকল জানার আগ্রহকে নিবৃত্ত করতে পারে। ধরুন উত্তরটি হচ্ছে – “চারটি বেডরুম আছে”। মাত্র একটি শব্দ – “চারটি”, উল্লেখিত প্রশ্নটি সম্পর্কে সকলের আগ্রহের অবসান ঘটায় এখানে। ধরুন, আপনি সেই ফ্ল্যাটটি কিনেছেন এবং একদিন আপনার সন্তান কে জিজ্ঞাসা করছেন – “রান্নাঘরের দরোজাটি কি বন্ধ নাকি খোলা?” এই প্রশ্নটি কি দার্শনিক প্রশ্ন হতে পারে? এটাও দার্শনিক প্রশ্ন হয়ে ওঠার সম্ভাবনা প্রায় শুন্যের কাছাকাছি। কেনন – মাত্র দুটি অপশনের যেকোনো একটি দিয়ে এই প্রশ্নটি সম্পর্কে সকল মিমাংসা করে দেয়া সম্ভব। “খোলা” অথবা “বন্ধ” এই দুটি শব্দের যেকোনো একটি হচ্ছে পার্থিব উত্তর। কিম্বা প্রশ্নটি শুধুমাত্র একটি অপশন দিয়েও করা যেতে পারে – “রান্না ঘরের দরোজাটি কি খোলা”? এই প্রশ্নেরও পরিনতি একই। কিন্তু ধরুন তো – “জীবনের মানে কি?” এই প্রশ্নটির কতগুলো উত্তর হতে পারে? একটি? দুইটি কিম্বা চৌদ্দটি? কিম্বা দুই হাজার? কিম্বা দুই লক্ষ উত্তর? এমন কি দুই লক্ষ উত্তর হলেও – দু’লক্ষতম উত্তরটিও হয়তো এই প্রশ্নটিতে পৃথিবীর সকলের আগ্রহ নিবৃত্ত করতে পারবেনা, অর্থাৎ কোনও উত্তরই শ্রোতার পরবর্তী প্রশ্ন করাকে বন্ধ করতে পারেনা। এটাই হচ্ছে প্রাত্যহিক প্রশ্ন ও দার্শনিক প্রশ্নের মাঝে একটা উল্লেখযোগ্য পার্থক্য। প্রাত্যহিক প্রশ্নের ঠিক কিম্বা বেঠিক উত্তর তৈরী থাকে, দর্শনের প্রশ্নের কোনও ঠিক বেঠিক উত্তর নেই, শুধু উত্তর খোঁজার প্রয়াস আছে।
৮।
আরজ আলী মাতুব্বর এর লেখালেখিগুলোকে তিনখন্ডে প্রকাশ করেছে ঢাকার একটি প্রকাশনা (অন্তত আমার কাছে এগুলোই আছে)। প্রথম খন্ডের প্রথম অংশের নাম “সত্যর সন্ধান” … এই পুস্তকে তিনি শুরু করেছিলেন মানুষের জিজ্ঞাসা দিয়ে… এবং কয়েকটি অধ্যায়ে তিনি বিন্যস্ত করেছেন তাঁর প্রশ্ন গুলো এবং তাঁর পেছনে দাড়া করিয়েছেন তাঁর যুক্তির দেয়াল। যারা আরজ আলী মাতুব্বর এর লেখা সত্যিই পড়েছেন – তাঁরা জানেন, আরজ আলী মাতুব্বর এর তোলা প্রশ্ন গুলো কি প্রাত্যহিক জীবনের প্রশ্ন নাকি সেই প্রশ্নগুলো মাতুব্বর সাহেবের নিজের পুরনো বিশ্বাস থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা। মাতুব্বর শুধু নিজেই তাঁর পুরনো বিশ্বাস কে প্রশ্নবিদ্ধ করেন নি, তিনি তাঁর সাথের ও তাঁর পরবর্তী মানুষদেরও সেই সকল প্রশ্নের সহযাত্রী করেছেন। মাতুব্বর সাহেব লিখেছেনঃ
“জগতে এমন অনেক বিষয় আছে, সেসব বিষয়ে দর্শন, বিজ্ঞান ও ধর্ম এক কথা বলেনা। আবার ধর্ম জগতেও মতানৈক্যর অন্ত নেই। যেখানে একই কালে দুইটি মত সত্য হইতে পারেনা সেখানে শতাধিক ধর্মে প্রচলিত শতাধিক মত সত্য হইবে কিরুপে? যদি বলা হয় সত্য হইবে একটি তখন প্রশ্ন হইবে কোনটি এবং কেনো? অর্থাৎ সত্য বিচারের মাপকাঠি কি? সত্যতা প্রমানের উপায় কি এবং সত্যর রুপ কি?”— আরজ আলী মাতুব্বর রচনা সমগ্র, খন্ড – ১, পৃষ্ঠাঃ ৫০ / ৫১
প্রথম অধ্যায়ের শেষে তিনি প্রশ্ন রেখেছেন –
- আমি কে?
- প্রান কি অরুপ না স্বরূপ?
- মন ও প্রান কি এক?
- প্রানের সহিত দেহ ও মনের সম্পর্ক কি?
- প্রান চেনা যায় কি?
- আমি কি স্বাধীন?
- অশরীরী আত্মার কি জ্ঞান থাকিবে?
পাঠকের কাছে প্রশ্ন – বলুন তো এই প্রশ্নগুলো কি প্রাত্যহিক প্রশ্ন? নাকি দার্শনিক প্রশ্ন? প্রশ্নগুলো কি কোনও বিশেষ ধর্মের সমালোচনা? নাকি জীবন অনুসন্ধিৎসা? এই প্রশ্নগুলো থেকে আরজ মাতুব্বর সাহেব চেষ্টা করেছেন নিজের মতো করে অনুসন্ধান করতে, নিজের যুক্তি গুলোকে সাজাতে এবং নিজের চিন্তা – উপসংহার গুলোকে লিখে প্রকাশ করতে – একজন দার্শনিক এভাবেই তাঁর চিন্তাকে গড়ে তোলেন। তাঁর প্রকাশের ধরন হয়তো আমাদের আধুনিক নাগরিক মস্তিস্ক কে খুব স্বস্তি দেয়না, আমরা হয়তো ঠিক এভাবে বিষয়গুলিকে দেখিনা, দেখতে চাইনা, হয়তো আরজ মাতুব্বর সাহেবের লেখায় শহুরে মেকী “ক্ল্যাসিক” ভাবটি নেই, কিন্তু প্রশ্নগুলো দার্শনিক প্রশ্ন নাকি প্রাত্যহিক প্রশ্ন এ বিষয়ে কি ভেবে দেখবেন? আরজ মাতুব্বর এর পুস্তকগুলো অনলাইনে খুবই সহজলভ্য – পড়ে দেখুন, প্রেজুডিস বা সংস্কার মুক্ত থেকে পড়ে দেখুন, তারপর নিজেকে প্রশ্ন করুন – আরজ মাতুব্বর যে সকল প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন, সেগুলো কি দার্শনিক প্রশ্ন?
৯।
আরজ আলী মাতুব্বর রচনাসমগ্র ডাউনলোড করতে পারেন এখান থেকে আরজ আলী মাতুব্বর রচনাসমগ্র
আমি বলছিনা যে আরজ আলী মাতুব্বর সাহেবকে আপনার দার্শনিক হিসাবে স্বীকার করতেই হবে। এই স্বীকার করা না করা দিয়ে মাতুব্বর সাব তো বটেই তাঁর পাঠকদেরও কিছু যায় আসেনা। আমি চেষ্টা করলাম, দর্শনের চর্চা কিভাবে কিভাবে শুরু হয়, দার্শনিক প্রশ্ন কি? তাঁর একটা সহজ প্রাথমিক ধারণা দেবার, বলাই বাহুল্য দর্শনের একাডেমিক পুস্তক/প্রবন্ধ থেকেই আলোচনাটি করার চেষ্টা করেছি। যারা আরজ আলী মাতুব্বর এর লেখার নিবিড় পাঠক, তাঁরা সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন, আশা করি।
আগামী পর্বে দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে আলোচনা করবো।
(চলবে)
লেখক: , লেখক ও প্রাবন্ধিক
রেফারেন্সঃ
Nermi Uygur (1964) What is a Philosophical Question? Mind, New Series, Vol. 73, No. 289 (Jan., 1964), pp. 64-83
Robert C Solomon, Kathleen Higgins, (2010), The big questions: A short introduction to philosophy, 8th ed. 2010, 2006 Wadsworth, Cengage Learning –