‘পাপ’ শব্দটি মানুষের একটি কন্সেপ্ট মাত্র। তবে অভিধানে এ ‘পাপ’ শব্দের
অর্থান্তর দেখলে রীতিমতো অবাক হতে হয়। কতরকম নামকরণ! অন্যায়, অধর্ম,
অপুণ্য, দুষ্কৃতি, পাতক, অঘ, অংহ, শাবর, কল্মাষ, কিল্বিষ, কলুষ, কর্বুর,
কিন্ব, কল্ব, প্রত্যবায়, দুরিত, অপরাধ, গুনাহ, গুনাহখাতা, বদি, ময়লা
ইত্যাদি কত নামে ডাকা হয় পাপকে। অথচ এর বিপরীত শব্দ ‘পুণ্য’-এর ক্ষেত্রে
অর্থান্তর অর্ধেকও নেই। হিন্দুশাস্ত্রে এ পাপকে ভাগ করা হয়েছে আবার তিন
ভাগে। এগুলোকে একত্রে বলে ত্রিপাপ : ১. অনুপাতক; ২. উপপাতক; ৩. মহাপাতক বা
মহাপাপ বা ঘোরপাপ। আলোচনা করা যাক এ তিন পাপ নিয়ে। ‘অনুপাতক’ শব্দটি
বিশ্লেষণ করলে পাওয়া যায় অনু (সাদৃশ্য)+পাতক (পাপ) অর্থাৎ সাদৃশ্য পাপ। কথা
হচ্ছে সাদৃশ্যটি কার সঙ্গে? মহাপাতকের সাদৃশ পাপই বিবেচিত হয় অনুপাপ
হিসেবে। এ পাপের মধ্যে পড়ে : মিথ্যা কথা, মিথ্যা সাক্ষ্য, প্রতারণা, গচ্ছিত
দ্রব্য দখল, ভূমি দখল, পরের স্ত্রী সঙ্গে সহবাস, বেদ ভুলে যাওয়া, বন্ধুর
সাথে বিশ্বাসঘাতকতা, মদপান ইত্যাদি। এমনই পঁয়ত্রিশ প্রকার অনুপাপ রয়েছে।
অন্যদিকে ব্রাহ্মণ হত্যা, ব্রাহ্মণের স্বর্ণচুরি, মদপান, গুরুপতœীহরণ
ইত্যাদি মহাপাতকের পর্যায়ে পড়ে। আর আছে ঊনষাটটি উপপাতক, অর্থাৎ অপেক্ষাকৃত
লঘু পাপ। এর মধ্যে অন্যতম হলো : পরস্ত্রীগমন, নিজেকে বিক্রি, স্ত্রীকে
বিক্রি, সন্তান বিক্রি, মাতৃত্যাগ, পিতৃত্যাগ, পুত্রসন্তানকে ত্যাগ,
আত্মীয়-স্বজন বা বন্ধুত্যাগ, কন্যাদূষণ, অনিষ্ট করার ইচ্ছায় মন্ত্রতন্ত্র
পাঠ ও নানা ক্রিয়া, ঋণ পরিশোধ না-করা, নাস্তিকতা, গোহত্যা ইত্যাদি। এ থেকে
দেখা যাচ্ছে নাস্তিকতা একটি পাপকর্ম। আর এমনই পাপ যে, তা
মা-বাবা-সন্তানত্যাগের মতো অনৈতিক এবং পরের স্ত্রীর সাথে সহবাস বা নিজের
স্ত্রীকে অন্যের কাছে বিক্রি করার মতো সমাজগর্হিত কাজের সঙ্গে তুলনীয়।
শাস্ত্র নাস্তিকদের এভাবেই বিচার-বিশ্লেষণ করেছে।
অপরদিকে ইসলাম ধর্মে কবিরা গুনাহ অর্থাৎ মহাপাপ হলো ৫০টি। গভীরভাবে না ভাবলেও চলবে, একটু খোলা চোখে দেখলেও এই ৫০টি পাপকর্ম একই তালিকাভুক্ত হওয়াকে অনেকক্ষেত্রে রীতিমতো হাস্যকার ব্যাপার মনে হবে। যেমন : দাড়ি কামানো আর নিরপরাধ ব্যক্তিকে হত্যা করা কীভাবে একই অপরাধে দুষ্ট হতে পারে তা আমার জানা নেই। একপলক না হয় দেখে নেওয়া যাক গুনাহের তালিকাটি : ১. তাচ্ছিল্যের সাথে কারও প্রতি বিদ্রুপ করে হাসা; ২. কাউকে খোটা দেওয়া; ৩. কাউকে মন্দ আখ্যা দিয়ে ডাকা; ৪. কুধারণা করা; ৫. কারও দোষ খোঁজ করা; ৬. কারও কুৎসা রটানো; ৭. অকারণে কাউকে দোষারোপ করা; ৮. আড়ালে কারও নিন্দা করা; ৯. অপবাদ দেওয়া; ১০. প্রতারণা করা; ১১. কাউকে তার পূর্বের গুনাহর জন্য লজ্জা দেওয়া; ১২. কারও ক্ষতিতে খুশি হওয়া; ১৩. অহংকার করা; ১৪. গৌরবান্বিত হওয়া; ১৫. সামর্থ থাকা সত্ত্বেও অসহায় লোকদের সাহায্য না করা; ১৬. কারও সম্পদের ক্ষতি করা; ১৮. কারও চরিত্রে আঘাত করা; ১৯. ছোটদের ¯েœহ না করা; ২০. অনাহারী ও বস্ত্রহীনদের উপযুক্ত সাহায্য না করা; ২১. পার্থিব মনোমালিন্যের কারণে পরস্পর তিন দিনের বেশি কথা বন্ধ রাখা; ২২. কোনো প্রাণীর ছবি তোলা; ২৩. অন্যের জমির ওপর মালিকানা দাবি করা; ২৪. সুস্থ-সবল শরীরে ভিক্ষা করা; ২৫. দাঁড়ি কামানো বা এক মুঠোর কম ছেটে ফেলা; ২৬. কাফের ও ফাসেকদের পোশাক ও ভেশভূষা পরিধান করা; ২৭. পুরুষেরা মহিলাদের পোশাক ও ভেশভূষা পরিধান করা; ২৮. মহিলারা পুরুষদের পোশাক ও ভেশভূষা পরিধান করা; ২৯. অপকর্ম করা; ৩০. চুরি করা; ৩১. ডাকাতি করা; ৩২. মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া; ৩৩. এতিমদের জিনিস আত্মসাৎ করা; ৩৪. মা-বাবার কথা অমান্য করা ও তাদের কষ্ট দেওয়া; ৩৫. নিরপরাধ লোককে হত্যা করা; ৩৬. মিথ্যা প্রতিজ্ঞা করা; ৩৭. ঘুষ গ্রহণ করা; ৩৮. ঘুষ দেওয়া; ৩৯. ঘুষ লেনদেনে সহায়তা করা; ৪০. মদপান করা; ৪১. জুয়া খেলা; ৪২. জুলুম করা; ৪৩. কারও কোনো জিনিস বিনা অনুমতিতে নিয়ে যাওয়া; ৪৪. সুদ গ্রহণ করা; ৪৫. সুদ দেওয়া; ৪৬. সুদের চুক্তিপত্র লেখা; ৪৭. সুদের সাক্ষী হওয়া; ৪৮. মিথ্যা কথা বলা; ৪৯. গচ্ছিত দ্রব্য আত্মসাৎ করা এবং ৫০. প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করা । সূত্র : মাজালিসে আবরার (২ খ-, পৃষ্ঠা : ১৭)। সচেতন পাঠকের কাছে নিশ্চয়ই এর পর আর বিস্তৃত আলোচনা দাবি করে না। তাদের কাছে এ তালিকা উপস্থাপনই যথেষ্ট। ‘কীসের সঙ্গে কী পান্তা ভাতে ঘি’ প্রবাদটি মনে হয় এ ক্ষেত্রে যথাযথ হবে।
পাপ ও নাস্তিকতা নিয়ে যেহেতু এ লেখা সেহেতু এবার আসা যাক আস্তিক ও নাস্তিক প্রসঙ্গে। আস্তিক বা নাস্তিক শব্দের সাধারণ যে অর্থ সকলের কাছে পরিচিত তা দিয়ে আলোচনা শুরু করছি। লেখাটি শেষ হবে এর বুৎপত্তিগত অর্থ দিয়ে। প্রথমে করা যাক ‘নাস্তিক’ শব্দটির বিশ্লেষণ। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর বঙ্গীয় শব্দকোষ-এ ‘নাস্তিক’ শব্দটি পাণিনির ব্যাকরণ অনুসারে বিশ্লেষণ করেছে এভাবেÑ নাস্তিক [নাস্তি+ইক (ঠক্্)]। সংস্কৃত ‘নাস্তি’ শব্দটি ব্যাখ্যা করে পাওয়া যায় ন (না)+অস্তি=নাস্তি। অব্যয়বাচক এ শব্দটির অর্থ ক্রিয়ারূপে দেখানো হয়েছেÑ ‘না আছে’, ‘নাই’, ‘নহে’ এবং অব্যয়রূপেÑ ‘অবিদ্যমান’, ‘সত্তাহীন’ ইত্যাদি। হরিচরণ ‘নাস্তিক’ শব্দের যে অর্থ করেছেন তা হলো : ‘পরলোক নাই’Ñ ইহা যাহার মতি; পরলোক অবিশ্বাসী; পরলোকাভাববুদ্ধিশালী; নাস্তি পরলোক, পরলোকসাধনাদৃষ্টাভাববাদী, বেদনিন্দুক ইত্যাদি। মনুসংহিতার অর্থানুসারে করা হয়েছে ‘নাস্তিক’ শব্দের এ সকল অর্থ। এ ছাড়াও নাস্তিকের আরও অর্থ বিদ্যমান আছে : যাহাতে তর্ক বলীয়ান, সর্ব বস্তু স্বভাবসিদ্ধ, ঈশ্বর কারও কর্তা নয়, বেদ অকিঞ্চিৎকর, তাদৃশ শাস্ত্র। এমনকি মাধ্যমিক, যোগাচার, সৌত্রাস্তিক, বৈভাষিক, চার্বাক, দিগম্বরÑ এই ছয় ভাগে ভাগ করা হয়েছে নাস্তিকদের। নাস্তিক বা নাস্তিকতা নিয়ে শাস্ত্রাবেত্তাদের ভাবনার অন্ত ছিল না দেখা যাচ্ছে। কত নামকরণ, কত ভাগে বিচারকরণÑ অবাক হতে হয়।
সাধারণ অর্থে একজন মানুষ আস্তিক হয় জন্মের পর থেকে নানা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে, আর নাস্তিক হয় নানা আত্মগত প্রতিকূল প্রচেষ্টার আলোকে। আস্তিক হতে কোনো জ্ঞান লাগে না। জন্মের পর থেকে যা শেখানো হয়, সেই শিক্ষা নিয়েই জীবন পার করে দিতে পারে একজন তথাকথিত আস্তিক মানুষ। তাতে করে সেই ব্যক্তির কোনোরকম কষ্ট তো হয়ই না, বরং এর ব্যত্যয় ঘটলেই যত সমস্যা দেখা দেয়। আস্তিকরা তাদের সকল কষ্টকেই ভাগ্য নামক অস্পৃশ্য বস্তুটির ওপর ছেড়ে দিয়ে অকারণ সান্ত¦না খোঁজে যায়; চুনকে দুধ ভাবতে বড় আনন্দ পায়। মজার বিষয় হলো, ওটা যে চুন, দুধ নয়Ñ তা তাদের বিশ্বাস করানোও বড় অসম্ভব ব্যাপার। তার ওপর তাদের বিশ্বাসের দুধকে চুন বলতে তো কথাই নেই, তেড়ে আসবে মারতে। এর জন্য কিন্তু সেই কূপম-ূক ব্যক্তিটি সম্পূর্ণ দায়ী নয়। দায়ী আছে তার সঙ্গে আরও অনেক কিছুই। একটি শিশু যে পরিবেশে বেড়ে ওঠে সেই পরিবেশের পারিপার্শ্বিক নানা উপাদান সে গ্রহণ করে চেতন ও অবচেতন মনে। তা ছাড়া প্রতিটি শিশুর অভিভাবক কোমলমতি শিশুটির মনে সচেতনভাবে তাদের নিজস্ব চিন্তা-চেতনা, বিশ্বাস-অবিশ্বাস, সংস্কার-কুসংস্কার প্রবেশ করে যায়। এক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মে বিশ্বাসী হওয়াকে পূণ্যজ্ঞান মনে করেই অধিকাংশ পিতামাতা তার শিশু সন্তানকে নিজের ধর্মে-বিশ্বাসী করে তোলে। এ ব্যাপারে তাদের কোনোরকম সংশয় নেই। সংশয় থাকা মানেই পাপ। তাই জন্মের পর থেকে একটি শিশু যেমন তার পরিবার ও আশপাশ থেকে ভাষা রপ্ত করে, তেমনই আত্মস্থ করে ধর্ম নামক আমৃত্যু পালনীয় আচার। ফলে অন্যান্য গুণাগুণের মতো সে সাধারণ অর্থে আস্তিক হয়েই বেড়ে ওঠে। এক্ষেত্রে শিশুটির পিতামাতা ধর্মে বা ঈশ্বরে অবিশ্বাসী হলে ভিন্ন বিষয়। ধরা যাক, হিন্দু ঘরে জন্ম নেওয়া কোনো একটি বাঙালি শিশুকে ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর আফ্রিকান কোনো আদিবাসীদের কাছে তুলে দেওয়া হলো। শিশুটি বড় হয়ে কোন সংস্কৃতি গ্রহণ করবে? হিন্দু ঘরে জন্ম নিয়েছে বলেই কি সে হিন্দু দেবদেবীকে পূজা করবে? না, তা সে করবে না। সে তার বেড়ে ওঠা ঐ জাতিগোষ্ঠীর নিজস্ব সংস্কৃতিই আপন জ্ঞান করবে। সেটাই সবার দেখাদেখি পালন করবে, পূজা করবে তাদের নিজস্ব দেবদেবী বা অশুভ আত্মাকে। এখানে বাঙালি রক্ত বা জিন কোনো কাজে আসবে না। বাঙালিদের ঈশ্বরকে সে পূজা দেবে না। বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধা সে পোষণ করবে না দুর্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতী নামক কোনো দেবদেবীর প্রতি। তাকে শত চেষ্টা করেও পালন করানো যাবে না বাঙালির সংস্কৃতি। যদি বাঙালির কোনো সংস্কৃতির অংশ সে পালন করেই-বা তা এক হয় সে ভালোবাসার তাগিদে করবে, নয়ত তাকে বাধ্য হয়ে করানো হবে। এ দুটি রাস্তাই তার সামনে খোলা থাকে। আমরা কোনো শিশুকেই বেড়ে ওঠার সময় কেউ জিজ্ঞাসা করে না, সে ধর্মপালন করবে কি করবে না। এমন প্রশ্ন মাথায়ই আসে না পিতামাতার কাছে। ধর্মপালন করবে এমন ভাবনাই যেন স্বাভাবিক। এর অন্যথা যেন হতে নেই; হলেই সর্বনাশ। তা ছাড়া মানুষমাত্রই ‘ভয়’ ও ‘লোভ’ নামের দুটি রিপুর দ্বারা কোনো না কোনোভাবে কমবেশি আক্রান্ত। প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম এ দুই শক্তিশালী রিপুকে মানুষের মনের ভেতর উশকে দেয়। ধর্মপ্রবর্তকেরা এ দুটি রিপুকে চমৎকারভাবে প্রবেশ করিয়েছে তাদের নিজ নিজ ধর্মগ্রন্থগুলোতে। ধর্মের আজ্ঞা পালন করলে এই পাবে, সেই পাবে, আর না পালন করলে এই শাস্তি, সেই শাস্তি অমুক তমুক কত কী! মনের মাধুরী মিশিয়ে কল্পনা করে সৃষ্টি করা হয় স্বর্গ ও নরক নামের দুটি আলাদা স্থানও। ধর্মগ্রন্থগুলোতে শাস্তির যে বিধান দেওয়া আছে তা রীতিমতো রোমহর্ষক। নরকে বিচিত্র সব শাস্তির বর্ণনা শুনলে পরে ঈশ্বর যে দয়ালু, ক্ষমাশীল ইত্যাদি গুণবাচক শব্দগুলো ভুলে যেতে হয়। আর স্বর্গে তো ভোগের শেষ নেই। ওখানে ভোগের যে ব্যবস্থা আছে তা দেখে মনে হয় ঈশ্বর কতটা ভোগবাদে বিশ্বাসী। যেন ভোগেই প্রকৃত সুখ। যে ঈশ্বরের কাছে সকল কিছুর নিয়ন্ত্রণ থাকে, কেন তাকে মানুষকে লোভ বা ভয় দেখিয়ে কাজ করাতে হবে তা-ই মাথায় আসে না। যার নির্দেশ ছাড়া যেখানে গাছের একটা পাতাও নড়ে না, সেখানে পৃথিবীব্যাপী এই যে বোমাবাজি চলছে তাতে করে কাকে দোষ দিতে হয়, ঈশ্বরকে নাকি মানুষকে? যে ঈশ্বর পৃথিবীর ¯্রষ্টা, যিনি সর্বত্র বিরাজমান বলে খ্যাত আছেন, আমার কথা হলো দক্ষিণ আমেরিকার অ্যামাজন জঙ্গলে বসবাসকারী উলঙ্গ নারী-পুরুষেরা কেন তাঁকে বা তাঁর প্রেরিত ধর্মগ্রন্থের নাম পর্যন্ত শোনেনি? তাহলে কি ঐ মানুষগুলো তার সৃষ্ট নয়? যাই হোক, আমার মনে হয়, আজ যারা নাস্তিক হয়েছেন তারা সবাই নিজের চেষ্টায় হয়েছেন। নাস্তিক হতে হলে কেবল তথ্য বা তত্ত্বগত জ্ঞানই থাকলেই হয় না, সেইসাথে প্রয়োজন হয় আধুনিক বিজ্ঞানচেতনা, যুক্তিবাদিতা, সততা, আদর্শগত মূল্যবোধ, আত্মবিশ্বাস, নির্ভীকতার মতো নানা গুণ। কেননা তাদেরকে আশেপাশের মানুষের নানা অকারণ প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়, শুনতে হয় নানা ভর্ৎসনা। আস্তিকদের এ ব্যাপারে দারুণ সুবিধা। তাদের এমন কোনো বিব্রত অবস্থার সম্মুখীন হতে হয় না। বিশ্বাস করলে যেন সব ঝামেলা মুক্ত। ব্রিটিশ প্রাবন্ধিক, অভিধান রচয়িতা স্যামুয়েল জনসন (১৮ সেপ্টেম্বর ১৭০৯ – ১৩ ডিসেম্বর ১৭৮৪)-এর একটি কথা মনে পড়ছে, “প্রতিটি যুগেই নতুন নতুন ভুল দেখা যায়, আর দেখা যায় নতুন নতুন সংস্কার।” আর আমরা তো সবাই জানি, ধর্ম ও সংস্কার একে অপরের সাথে আষ্টেপৃষ্টে বাস করে। ফলে উল্লিখিত উদ্ধৃতিটির আলোকে বলা যায়, ধর্ম হচ্ছে এক প্রকা- ভুল, আর সেই ভুলের অগণিত সন্তান হচ্ছে তথাকথিত সংস্কার। আইরিশ নাট্যকার ও কবি অস্কার ওয়াইল্ড (১৬ অক্টোবর ১৮৫৪ – ৩০ নভেম্বর ১৯০০) অলৌকিকতা সম্পর্কে একবার বলেছিলেনÑ “জগতের অলৌকিকতা হলো যা দৃশ্যমান তার মধ্যে, কোনো অদৃশ্যের মাঝে নয়।” কথাটির একটু গভীরে প্রবেশ করলে পাওয়া যায় অমোঘ সত্য। অর্থাৎ যা কিছু দৃশ্যমান, তাই সত্য। অদৃশ্যের মধ্যে মিথ্যা বলা অনেক সহজ ব্যাপার। ঈশ্বর অদৃশ্য। তাই মিথ্যা ঈশ্বর মিথ্যার জন্ম দিয়ে যাচ্ছে ক্রমাগত। একবিংশ শতাব্দীতে এসে এখন যেহেতু নতুন কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের অবতরণা সম্ভব নয়, নতুনভাবে স্বর্গপ্রেরিত দূত নেমেও আসবে, আসলেও তাকে থাকতে হবে পাগলাগারদে সেহেতু ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ক্রমবর্ধমান মিথ্যার হাত থেকে বেঁচে গেল। যেসকল মিথ্যা এখনও বেঁচেবর্ত্তে আছে তা যুগের সাথে সাথে বিলীন হতে বাধ্য। একটি মিথ্যাকে দশবার সত্যের মতো করে বললে সত্যের মতো শোনায় সত্যি, কিন্তু মিথ্যা তো সত্য হয়ে যায় না। মিথ্যা মিথ্যাই থাকে। কেবল সাময়িক দেখতে অন্যরকম লাগে।
রচনার বিষয়টি যেহেতু নাস্তিকতা, তাই ফিরে আসি আবার নাস্তিক ও আস্তিক প্রসঙ্গে। কলিম খান ও রবি চক্রবর্তী রচিত ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক শব্দার্থের অভিধান বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ (প্রথম খ-) আস্তিক ও নাস্তিক ভুক্তিটিতে বলা হয়েছে : “‘আছে’ এই বিশ্বাস যার, তাঁকে আস্তিক বলা হয়ে থাকে। কী ‘আছে’? এর উত্তর হলো ‘কোনো একটা কিছু আছে’। তথাকথিক ধর্মনিষ্ঠ ধর্মভীরু মানুষেরা বলতে পারেন, ‘ঈশ্বর’। যুক্তিবাদীরা এসব কথাকে বাজে কথা বলে মনে করেন। কিন্তু আমরা দেখেছি ‘আছে’ এই ‘বিশ্বাস’ না থাকলে মানুষ তো বটেই, কোনো জীবই বেঁচে থাকতে পারে কি না সন্দেহ। গাছের তলা দিয়ে যাওয়ার সময় গাছটি ঘাড়ের ওপর ভেঙে পড়বে না কিংবা রাস্তাটি যে হঠাৎ দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে আমাকে গিলে ফেলবে না, আগন্তুক গাড়িটি যে হঠাৎ ফুটপাথে উঠে আমাকে চিঁড়ে চ্যাপটা করে দেবে না, পাশের গুমটিতে বসে থাকা ছোকরাগুলো যে হঠাৎ দৌড়ে এসে আমার জামাকাপড় কেড়ে নিয়ে আমাকে রাস্তায় ফেলে দিয়ে চলে যাবে নাÑ যথাক্রমে এই প্রাকৃতিক, যান্ত্রিক, সামাজিক নিয়ম আমাদের ঘিরে বলবৎ ‘আছে’। এই ‘আছে’তে ‘বিশ্বাস’ না থাকলে আমরা কি একদিনও বাঁচতাম! তাই ভেবে দেখলে জীবমাত্রেই আস্তিক। এমন একটি মানুষও নেই যে আস্তিক নয়। ধারণা করা হয় খুব সম্ভব গ্রিক ধরংঃযবঃরশড়ং (যার থেকে ইংরেজি ধবংঃযবঃরপ শব্দটি তৈরি হয়েছে) শব্দটি ‘আস্তিক’-এরই জ্ঞাতিভাই। অন্যদিকে ‘নাই’তে বিশ্বাস করে যে, সে হলো নাস্তিক। এখন প্রশ্ন হলো, কার থাকা বা না-থাকার কথা হচ্ছে? শেষ বিচারে তিনি হলেন জগৎ¯্রষ্টা জগন্নাথ বা জগৎকারণ। আস্তিক শব্দের আলোচনায় আমরা দেখেছি যে, প্রকৃতপক্ষে নাস্তিক হওয়া অবাস্তব, অসম্ভব। অন্ততপক্ষে ‘সর্ব্ব বস্তু স্বভাবসিদ্ধ’Ñ এই জগৎকারণে বিশ্বাস না থাকলে কোনো জীবই বেঁচে থাকতে পারে না, নাস্তিকেরাও পারেনি।” বুৎপত্তিগত অর্থ বিচারে আস্তিক ও নাস্তিক শব্দের অর্থই গেল বদলে। অর্থাৎ ‘আছে’ তে বিশ্বাস করতে হবে। ধর্মগুরুরা এই ‘আছে’র সঙ্গে ঈশ্বরের অস্তিত্বকে জড়িয়েছে। নিরীহ শব্দের সঙ্গে অযথা ধর্মের গন্ধ মেশানো আর কি! সবশেষে একটি নিরীহ প্রশ্ন রেখে লেখাটি শেষ করতে চাইÑ “স্বয়ং বুদ্ধ যেখানে বলে গেলেনÑঈশ্বর বলে কিছু নেই; সেই তাঁকেই কেন ঈশ্বর বানিয়ে পূজা করা হচ্ছে আজ?”
লেখক: অঞ্জন আচার্য
(প্রথম প্রকাশ মুক্তমনা, ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১২)
অপরদিকে ইসলাম ধর্মে কবিরা গুনাহ অর্থাৎ মহাপাপ হলো ৫০টি। গভীরভাবে না ভাবলেও চলবে, একটু খোলা চোখে দেখলেও এই ৫০টি পাপকর্ম একই তালিকাভুক্ত হওয়াকে অনেকক্ষেত্রে রীতিমতো হাস্যকার ব্যাপার মনে হবে। যেমন : দাড়ি কামানো আর নিরপরাধ ব্যক্তিকে হত্যা করা কীভাবে একই অপরাধে দুষ্ট হতে পারে তা আমার জানা নেই। একপলক না হয় দেখে নেওয়া যাক গুনাহের তালিকাটি : ১. তাচ্ছিল্যের সাথে কারও প্রতি বিদ্রুপ করে হাসা; ২. কাউকে খোটা দেওয়া; ৩. কাউকে মন্দ আখ্যা দিয়ে ডাকা; ৪. কুধারণা করা; ৫. কারও দোষ খোঁজ করা; ৬. কারও কুৎসা রটানো; ৭. অকারণে কাউকে দোষারোপ করা; ৮. আড়ালে কারও নিন্দা করা; ৯. অপবাদ দেওয়া; ১০. প্রতারণা করা; ১১. কাউকে তার পূর্বের গুনাহর জন্য লজ্জা দেওয়া; ১২. কারও ক্ষতিতে খুশি হওয়া; ১৩. অহংকার করা; ১৪. গৌরবান্বিত হওয়া; ১৫. সামর্থ থাকা সত্ত্বেও অসহায় লোকদের সাহায্য না করা; ১৬. কারও সম্পদের ক্ষতি করা; ১৮. কারও চরিত্রে আঘাত করা; ১৯. ছোটদের ¯েœহ না করা; ২০. অনাহারী ও বস্ত্রহীনদের উপযুক্ত সাহায্য না করা; ২১. পার্থিব মনোমালিন্যের কারণে পরস্পর তিন দিনের বেশি কথা বন্ধ রাখা; ২২. কোনো প্রাণীর ছবি তোলা; ২৩. অন্যের জমির ওপর মালিকানা দাবি করা; ২৪. সুস্থ-সবল শরীরে ভিক্ষা করা; ২৫. দাঁড়ি কামানো বা এক মুঠোর কম ছেটে ফেলা; ২৬. কাফের ও ফাসেকদের পোশাক ও ভেশভূষা পরিধান করা; ২৭. পুরুষেরা মহিলাদের পোশাক ও ভেশভূষা পরিধান করা; ২৮. মহিলারা পুরুষদের পোশাক ও ভেশভূষা পরিধান করা; ২৯. অপকর্ম করা; ৩০. চুরি করা; ৩১. ডাকাতি করা; ৩২. মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া; ৩৩. এতিমদের জিনিস আত্মসাৎ করা; ৩৪. মা-বাবার কথা অমান্য করা ও তাদের কষ্ট দেওয়া; ৩৫. নিরপরাধ লোককে হত্যা করা; ৩৬. মিথ্যা প্রতিজ্ঞা করা; ৩৭. ঘুষ গ্রহণ করা; ৩৮. ঘুষ দেওয়া; ৩৯. ঘুষ লেনদেনে সহায়তা করা; ৪০. মদপান করা; ৪১. জুয়া খেলা; ৪২. জুলুম করা; ৪৩. কারও কোনো জিনিস বিনা অনুমতিতে নিয়ে যাওয়া; ৪৪. সুদ গ্রহণ করা; ৪৫. সুদ দেওয়া; ৪৬. সুদের চুক্তিপত্র লেখা; ৪৭. সুদের সাক্ষী হওয়া; ৪৮. মিথ্যা কথা বলা; ৪৯. গচ্ছিত দ্রব্য আত্মসাৎ করা এবং ৫০. প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করা । সূত্র : মাজালিসে আবরার (২ খ-, পৃষ্ঠা : ১৭)। সচেতন পাঠকের কাছে নিশ্চয়ই এর পর আর বিস্তৃত আলোচনা দাবি করে না। তাদের কাছে এ তালিকা উপস্থাপনই যথেষ্ট। ‘কীসের সঙ্গে কী পান্তা ভাতে ঘি’ প্রবাদটি মনে হয় এ ক্ষেত্রে যথাযথ হবে।
পাপ ও নাস্তিকতা নিয়ে যেহেতু এ লেখা সেহেতু এবার আসা যাক আস্তিক ও নাস্তিক প্রসঙ্গে। আস্তিক বা নাস্তিক শব্দের সাধারণ যে অর্থ সকলের কাছে পরিচিত তা দিয়ে আলোচনা শুরু করছি। লেখাটি শেষ হবে এর বুৎপত্তিগত অর্থ দিয়ে। প্রথমে করা যাক ‘নাস্তিক’ শব্দটির বিশ্লেষণ। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর বঙ্গীয় শব্দকোষ-এ ‘নাস্তিক’ শব্দটি পাণিনির ব্যাকরণ অনুসারে বিশ্লেষণ করেছে এভাবেÑ নাস্তিক [নাস্তি+ইক (ঠক্্)]। সংস্কৃত ‘নাস্তি’ শব্দটি ব্যাখ্যা করে পাওয়া যায় ন (না)+অস্তি=নাস্তি। অব্যয়বাচক এ শব্দটির অর্থ ক্রিয়ারূপে দেখানো হয়েছেÑ ‘না আছে’, ‘নাই’, ‘নহে’ এবং অব্যয়রূপেÑ ‘অবিদ্যমান’, ‘সত্তাহীন’ ইত্যাদি। হরিচরণ ‘নাস্তিক’ শব্দের যে অর্থ করেছেন তা হলো : ‘পরলোক নাই’Ñ ইহা যাহার মতি; পরলোক অবিশ্বাসী; পরলোকাভাববুদ্ধিশালী; নাস্তি পরলোক, পরলোকসাধনাদৃষ্টাভাববাদী, বেদনিন্দুক ইত্যাদি। মনুসংহিতার অর্থানুসারে করা হয়েছে ‘নাস্তিক’ শব্দের এ সকল অর্থ। এ ছাড়াও নাস্তিকের আরও অর্থ বিদ্যমান আছে : যাহাতে তর্ক বলীয়ান, সর্ব বস্তু স্বভাবসিদ্ধ, ঈশ্বর কারও কর্তা নয়, বেদ অকিঞ্চিৎকর, তাদৃশ শাস্ত্র। এমনকি মাধ্যমিক, যোগাচার, সৌত্রাস্তিক, বৈভাষিক, চার্বাক, দিগম্বরÑ এই ছয় ভাগে ভাগ করা হয়েছে নাস্তিকদের। নাস্তিক বা নাস্তিকতা নিয়ে শাস্ত্রাবেত্তাদের ভাবনার অন্ত ছিল না দেখা যাচ্ছে। কত নামকরণ, কত ভাগে বিচারকরণÑ অবাক হতে হয়।
সাধারণ অর্থে একজন মানুষ আস্তিক হয় জন্মের পর থেকে নানা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে, আর নাস্তিক হয় নানা আত্মগত প্রতিকূল প্রচেষ্টার আলোকে। আস্তিক হতে কোনো জ্ঞান লাগে না। জন্মের পর থেকে যা শেখানো হয়, সেই শিক্ষা নিয়েই জীবন পার করে দিতে পারে একজন তথাকথিত আস্তিক মানুষ। তাতে করে সেই ব্যক্তির কোনোরকম কষ্ট তো হয়ই না, বরং এর ব্যত্যয় ঘটলেই যত সমস্যা দেখা দেয়। আস্তিকরা তাদের সকল কষ্টকেই ভাগ্য নামক অস্পৃশ্য বস্তুটির ওপর ছেড়ে দিয়ে অকারণ সান্ত¦না খোঁজে যায়; চুনকে দুধ ভাবতে বড় আনন্দ পায়। মজার বিষয় হলো, ওটা যে চুন, দুধ নয়Ñ তা তাদের বিশ্বাস করানোও বড় অসম্ভব ব্যাপার। তার ওপর তাদের বিশ্বাসের দুধকে চুন বলতে তো কথাই নেই, তেড়ে আসবে মারতে। এর জন্য কিন্তু সেই কূপম-ূক ব্যক্তিটি সম্পূর্ণ দায়ী নয়। দায়ী আছে তার সঙ্গে আরও অনেক কিছুই। একটি শিশু যে পরিবেশে বেড়ে ওঠে সেই পরিবেশের পারিপার্শ্বিক নানা উপাদান সে গ্রহণ করে চেতন ও অবচেতন মনে। তা ছাড়া প্রতিটি শিশুর অভিভাবক কোমলমতি শিশুটির মনে সচেতনভাবে তাদের নিজস্ব চিন্তা-চেতনা, বিশ্বাস-অবিশ্বাস, সংস্কার-কুসংস্কার প্রবেশ করে যায়। এক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মে বিশ্বাসী হওয়াকে পূণ্যজ্ঞান মনে করেই অধিকাংশ পিতামাতা তার শিশু সন্তানকে নিজের ধর্মে-বিশ্বাসী করে তোলে। এ ব্যাপারে তাদের কোনোরকম সংশয় নেই। সংশয় থাকা মানেই পাপ। তাই জন্মের পর থেকে একটি শিশু যেমন তার পরিবার ও আশপাশ থেকে ভাষা রপ্ত করে, তেমনই আত্মস্থ করে ধর্ম নামক আমৃত্যু পালনীয় আচার। ফলে অন্যান্য গুণাগুণের মতো সে সাধারণ অর্থে আস্তিক হয়েই বেড়ে ওঠে। এক্ষেত্রে শিশুটির পিতামাতা ধর্মে বা ঈশ্বরে অবিশ্বাসী হলে ভিন্ন বিষয়। ধরা যাক, হিন্দু ঘরে জন্ম নেওয়া কোনো একটি বাঙালি শিশুকে ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর আফ্রিকান কোনো আদিবাসীদের কাছে তুলে দেওয়া হলো। শিশুটি বড় হয়ে কোন সংস্কৃতি গ্রহণ করবে? হিন্দু ঘরে জন্ম নিয়েছে বলেই কি সে হিন্দু দেবদেবীকে পূজা করবে? না, তা সে করবে না। সে তার বেড়ে ওঠা ঐ জাতিগোষ্ঠীর নিজস্ব সংস্কৃতিই আপন জ্ঞান করবে। সেটাই সবার দেখাদেখি পালন করবে, পূজা করবে তাদের নিজস্ব দেবদেবী বা অশুভ আত্মাকে। এখানে বাঙালি রক্ত বা জিন কোনো কাজে আসবে না। বাঙালিদের ঈশ্বরকে সে পূজা দেবে না। বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধা সে পোষণ করবে না দুর্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতী নামক কোনো দেবদেবীর প্রতি। তাকে শত চেষ্টা করেও পালন করানো যাবে না বাঙালির সংস্কৃতি। যদি বাঙালির কোনো সংস্কৃতির অংশ সে পালন করেই-বা তা এক হয় সে ভালোবাসার তাগিদে করবে, নয়ত তাকে বাধ্য হয়ে করানো হবে। এ দুটি রাস্তাই তার সামনে খোলা থাকে। আমরা কোনো শিশুকেই বেড়ে ওঠার সময় কেউ জিজ্ঞাসা করে না, সে ধর্মপালন করবে কি করবে না। এমন প্রশ্ন মাথায়ই আসে না পিতামাতার কাছে। ধর্মপালন করবে এমন ভাবনাই যেন স্বাভাবিক। এর অন্যথা যেন হতে নেই; হলেই সর্বনাশ। তা ছাড়া মানুষমাত্রই ‘ভয়’ ও ‘লোভ’ নামের দুটি রিপুর দ্বারা কোনো না কোনোভাবে কমবেশি আক্রান্ত। প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম এ দুই শক্তিশালী রিপুকে মানুষের মনের ভেতর উশকে দেয়। ধর্মপ্রবর্তকেরা এ দুটি রিপুকে চমৎকারভাবে প্রবেশ করিয়েছে তাদের নিজ নিজ ধর্মগ্রন্থগুলোতে। ধর্মের আজ্ঞা পালন করলে এই পাবে, সেই পাবে, আর না পালন করলে এই শাস্তি, সেই শাস্তি অমুক তমুক কত কী! মনের মাধুরী মিশিয়ে কল্পনা করে সৃষ্টি করা হয় স্বর্গ ও নরক নামের দুটি আলাদা স্থানও। ধর্মগ্রন্থগুলোতে শাস্তির যে বিধান দেওয়া আছে তা রীতিমতো রোমহর্ষক। নরকে বিচিত্র সব শাস্তির বর্ণনা শুনলে পরে ঈশ্বর যে দয়ালু, ক্ষমাশীল ইত্যাদি গুণবাচক শব্দগুলো ভুলে যেতে হয়। আর স্বর্গে তো ভোগের শেষ নেই। ওখানে ভোগের যে ব্যবস্থা আছে তা দেখে মনে হয় ঈশ্বর কতটা ভোগবাদে বিশ্বাসী। যেন ভোগেই প্রকৃত সুখ। যে ঈশ্বরের কাছে সকল কিছুর নিয়ন্ত্রণ থাকে, কেন তাকে মানুষকে লোভ বা ভয় দেখিয়ে কাজ করাতে হবে তা-ই মাথায় আসে না। যার নির্দেশ ছাড়া যেখানে গাছের একটা পাতাও নড়ে না, সেখানে পৃথিবীব্যাপী এই যে বোমাবাজি চলছে তাতে করে কাকে দোষ দিতে হয়, ঈশ্বরকে নাকি মানুষকে? যে ঈশ্বর পৃথিবীর ¯্রষ্টা, যিনি সর্বত্র বিরাজমান বলে খ্যাত আছেন, আমার কথা হলো দক্ষিণ আমেরিকার অ্যামাজন জঙ্গলে বসবাসকারী উলঙ্গ নারী-পুরুষেরা কেন তাঁকে বা তাঁর প্রেরিত ধর্মগ্রন্থের নাম পর্যন্ত শোনেনি? তাহলে কি ঐ মানুষগুলো তার সৃষ্ট নয়? যাই হোক, আমার মনে হয়, আজ যারা নাস্তিক হয়েছেন তারা সবাই নিজের চেষ্টায় হয়েছেন। নাস্তিক হতে হলে কেবল তথ্য বা তত্ত্বগত জ্ঞানই থাকলেই হয় না, সেইসাথে প্রয়োজন হয় আধুনিক বিজ্ঞানচেতনা, যুক্তিবাদিতা, সততা, আদর্শগত মূল্যবোধ, আত্মবিশ্বাস, নির্ভীকতার মতো নানা গুণ। কেননা তাদেরকে আশেপাশের মানুষের নানা অকারণ প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়, শুনতে হয় নানা ভর্ৎসনা। আস্তিকদের এ ব্যাপারে দারুণ সুবিধা। তাদের এমন কোনো বিব্রত অবস্থার সম্মুখীন হতে হয় না। বিশ্বাস করলে যেন সব ঝামেলা মুক্ত। ব্রিটিশ প্রাবন্ধিক, অভিধান রচয়িতা স্যামুয়েল জনসন (১৮ সেপ্টেম্বর ১৭০৯ – ১৩ ডিসেম্বর ১৭৮৪)-এর একটি কথা মনে পড়ছে, “প্রতিটি যুগেই নতুন নতুন ভুল দেখা যায়, আর দেখা যায় নতুন নতুন সংস্কার।” আর আমরা তো সবাই জানি, ধর্ম ও সংস্কার একে অপরের সাথে আষ্টেপৃষ্টে বাস করে। ফলে উল্লিখিত উদ্ধৃতিটির আলোকে বলা যায়, ধর্ম হচ্ছে এক প্রকা- ভুল, আর সেই ভুলের অগণিত সন্তান হচ্ছে তথাকথিত সংস্কার। আইরিশ নাট্যকার ও কবি অস্কার ওয়াইল্ড (১৬ অক্টোবর ১৮৫৪ – ৩০ নভেম্বর ১৯০০) অলৌকিকতা সম্পর্কে একবার বলেছিলেনÑ “জগতের অলৌকিকতা হলো যা দৃশ্যমান তার মধ্যে, কোনো অদৃশ্যের মাঝে নয়।” কথাটির একটু গভীরে প্রবেশ করলে পাওয়া যায় অমোঘ সত্য। অর্থাৎ যা কিছু দৃশ্যমান, তাই সত্য। অদৃশ্যের মধ্যে মিথ্যা বলা অনেক সহজ ব্যাপার। ঈশ্বর অদৃশ্য। তাই মিথ্যা ঈশ্বর মিথ্যার জন্ম দিয়ে যাচ্ছে ক্রমাগত। একবিংশ শতাব্দীতে এসে এখন যেহেতু নতুন কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের অবতরণা সম্ভব নয়, নতুনভাবে স্বর্গপ্রেরিত দূত নেমেও আসবে, আসলেও তাকে থাকতে হবে পাগলাগারদে সেহেতু ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ক্রমবর্ধমান মিথ্যার হাত থেকে বেঁচে গেল। যেসকল মিথ্যা এখনও বেঁচেবর্ত্তে আছে তা যুগের সাথে সাথে বিলীন হতে বাধ্য। একটি মিথ্যাকে দশবার সত্যের মতো করে বললে সত্যের মতো শোনায় সত্যি, কিন্তু মিথ্যা তো সত্য হয়ে যায় না। মিথ্যা মিথ্যাই থাকে। কেবল সাময়িক দেখতে অন্যরকম লাগে।
রচনার বিষয়টি যেহেতু নাস্তিকতা, তাই ফিরে আসি আবার নাস্তিক ও আস্তিক প্রসঙ্গে। কলিম খান ও রবি চক্রবর্তী রচিত ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক শব্দার্থের অভিধান বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ (প্রথম খ-) আস্তিক ও নাস্তিক ভুক্তিটিতে বলা হয়েছে : “‘আছে’ এই বিশ্বাস যার, তাঁকে আস্তিক বলা হয়ে থাকে। কী ‘আছে’? এর উত্তর হলো ‘কোনো একটা কিছু আছে’। তথাকথিক ধর্মনিষ্ঠ ধর্মভীরু মানুষেরা বলতে পারেন, ‘ঈশ্বর’। যুক্তিবাদীরা এসব কথাকে বাজে কথা বলে মনে করেন। কিন্তু আমরা দেখেছি ‘আছে’ এই ‘বিশ্বাস’ না থাকলে মানুষ তো বটেই, কোনো জীবই বেঁচে থাকতে পারে কি না সন্দেহ। গাছের তলা দিয়ে যাওয়ার সময় গাছটি ঘাড়ের ওপর ভেঙে পড়বে না কিংবা রাস্তাটি যে হঠাৎ দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে আমাকে গিলে ফেলবে না, আগন্তুক গাড়িটি যে হঠাৎ ফুটপাথে উঠে আমাকে চিঁড়ে চ্যাপটা করে দেবে না, পাশের গুমটিতে বসে থাকা ছোকরাগুলো যে হঠাৎ দৌড়ে এসে আমার জামাকাপড় কেড়ে নিয়ে আমাকে রাস্তায় ফেলে দিয়ে চলে যাবে নাÑ যথাক্রমে এই প্রাকৃতিক, যান্ত্রিক, সামাজিক নিয়ম আমাদের ঘিরে বলবৎ ‘আছে’। এই ‘আছে’তে ‘বিশ্বাস’ না থাকলে আমরা কি একদিনও বাঁচতাম! তাই ভেবে দেখলে জীবমাত্রেই আস্তিক। এমন একটি মানুষও নেই যে আস্তিক নয়। ধারণা করা হয় খুব সম্ভব গ্রিক ধরংঃযবঃরশড়ং (যার থেকে ইংরেজি ধবংঃযবঃরপ শব্দটি তৈরি হয়েছে) শব্দটি ‘আস্তিক’-এরই জ্ঞাতিভাই। অন্যদিকে ‘নাই’তে বিশ্বাস করে যে, সে হলো নাস্তিক। এখন প্রশ্ন হলো, কার থাকা বা না-থাকার কথা হচ্ছে? শেষ বিচারে তিনি হলেন জগৎ¯্রষ্টা জগন্নাথ বা জগৎকারণ। আস্তিক শব্দের আলোচনায় আমরা দেখেছি যে, প্রকৃতপক্ষে নাস্তিক হওয়া অবাস্তব, অসম্ভব। অন্ততপক্ষে ‘সর্ব্ব বস্তু স্বভাবসিদ্ধ’Ñ এই জগৎকারণে বিশ্বাস না থাকলে কোনো জীবই বেঁচে থাকতে পারে না, নাস্তিকেরাও পারেনি।” বুৎপত্তিগত অর্থ বিচারে আস্তিক ও নাস্তিক শব্দের অর্থই গেল বদলে। অর্থাৎ ‘আছে’ তে বিশ্বাস করতে হবে। ধর্মগুরুরা এই ‘আছে’র সঙ্গে ঈশ্বরের অস্তিত্বকে জড়িয়েছে। নিরীহ শব্দের সঙ্গে অযথা ধর্মের গন্ধ মেশানো আর কি! সবশেষে একটি নিরীহ প্রশ্ন রেখে লেখাটি শেষ করতে চাইÑ “স্বয়ং বুদ্ধ যেখানে বলে গেলেনÑঈশ্বর বলে কিছু নেই; সেই তাঁকেই কেন ঈশ্বর বানিয়ে পূজা করা হচ্ছে আজ?”
লেখক: অঞ্জন আচার্য
(প্রথম প্রকাশ মুক্তমনা, ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১২)